দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা অমিত শাহ এই মাসের ৫ ও ৬ তারিখের পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে ভোটযুদ্ধের দামামা সজোরে বাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। যার আঁচ গিয়ে সরাসরি পড়েছে কালীঘাটে। বস্তুত গত এক দশকের মধ্যে ভারতীয় জনতা পার্টি যেভাবে সারা দেশে বিস্তার লাভ করেছে তা বহু বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কাছের এক গবেষণার বিষয়। প্রশাসনিক সংস্কার ও সুশাসনের মাধ্যমে সমস্ত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বিজেপি তার বিজয়রথ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তবে এর মধ্যেও বিজেপির অভ্যন্তরে কান পাতলেই শোনা যায় বাংলা নিয়ে তাঁদের বিশেষ আবেগের কথা। বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর রাজ্যেই বরাবর প্রান্তিক শক্তি হয়েই থেকে গিয়েছিলো দল। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের মধ্যেই রকেট গতিতে উত্থানের মাধ্যমে আজ তারা রাজ্যে ক্ষমতা দখলের দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত। আর কয়েকমাসের মধ্যে বিজেপি সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হবে রাজ্যের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। তার আগে সংগঠন ঢেলে সাজানোয় মনোনিবেশ করেছেন বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। এইজন্য রাজ্যকে ৫টি সাংগঠনিক জেলায় ভাগ করে ৫ জন বিশিষ্ট সংগঠক যথা সুনীল দেওধর, দুষ্মন্ত গৌতম, বিনোদ তাওড়ে , হরিশ দ্বিবেদী ও বিনোদ সোনকরকে এই রাজ্যে বিজেপির সংগঠনকে শক্তিশালী করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে দুদিক থেকে বিজেপির লাভ হবে। বুথ লেভেলের বর্তমান সংগঠন গুলো চাঙ্গা হয়ে উঠবে এবং রাজ্যের প্রায় ৭৮ হাজার বুথের মধ্যে যে ২০ হাজার বুথে এখনও সংগঠন গুছিয়ে উঠতে পারেনি সেগুলোকেও গড়ে নেওয়া যাবে। পাশাপাশি রাজ্য নেতৃত্বও সংগঠনের চিন্তা ছেড়ে বর্তমান রাজ্য সরকারের অপশাসনের দিকগুলো সঠিকভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারবেন। উল্লিখিত পাঁচজনের সাংগঠনিক দক্ষতা এ বিষয়ে প্রশ্নাতীত। এতেই অশনিসংকেত দেখছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি যতোটাই তাদের সবকিছু গুছিয়ে তুলছে, মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের করুণ দশা ততটাই প্রকট হয়ে উঠছে। উত্তরে মিহির গোস্বামী থেকে শুরু করে দক্ষিনে শীলভদ্র দত্ত , পূর্বে এনায়েত শেখ তো পশ্চিমে শুভেন্দু অধিকারী , বিভিন্ন ওজনদার দলীয় বিধায়কেরা আজ বেসুরো গাইছেন এবং প্রকাশ্যে দলনেত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করছেন। এমনকি বাম সরকারের পালা বদল আন্দোলের আঁতুরঘর নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরও আজ বিমুখ। কখনো বেচারাম পদত্যাগ করেছেন তো পরক্ষনেই রবীন্দ্রনাথ বাবু দলত্যাগের হুমকি দিচ্ছেন। দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী শোভন মুকুল আজ পদ্মাসনে। ছেড়ে গিয়েছেন আরো অনেকেই । পা বাড়িয়ে রয়েছেন ততোধিক। এই অবস্থায় দলনেত্রী মরিয়া হয়ে তাঁর কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক তোষণের মতোই নির্লজ্জ ভাবে প্রাদেশিকতার অস্ত্রে শান দেওয়া আরম্ভ করেছেন। অথচ অবৈধ বাংলাদেশী বা রোহিঙ্গ্যাদের ব্যাপারে তাঁর দরদ উথলে পরে, যেহেতু তারা দলীয় ভোটার!”যে গরু দুধ (পড়ুন ভোট) দেয় তাঁর লাথি (পড়ুন দাঙ্গা হাঙ্গামা, অসামাজিক কার্যকলাপ) তো তিনি খাবেনই। একদিকে বাঙালির ভাবাবেগকে সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন এবং আরেকদিকে তিনি ইচ্ছে করেই চেপে যাচ্ছেন যে এই খাস কলকাতাতেই তাঁরই শাসন কালে মৌলালি, রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস ও আরো অনেক জায়গায় বহু সরকারি সাইনবোর্ডে কেবল উর্দু ভাষা জ্বলজ্বল করছে, বাংলা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।এই মাননীয়াই লোকসভা ভোটে বিজেপির সাফল্যে ক্রোধান্বিত হয়ে যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় এদেশে বাস করে আসা হিন্দিভাষীদের ব্যারাকপুর যাবার পথে অপমান করে বলেছিলেন যে এখানে তিনি তাদের থাকতে দিচ্ছেন ও খেতে-পড়তে দিচ্ছেন। অথচ উর্দুভাষীদের বেলায় তাঁর নির্লজ্জ তোষণ চোখে পড়ার মতন। আজ আর তৃণমূলের বেসুরো গাওয়া নেতারা একবাক্যে দায়ী করছেন কয়েকশো কোটি টাকা নিয়ে ভাড়া করে নিয়ে আসা ভোট ম্যানাজার প্রশান্ত কিশোর ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বজনপোষণ ধন্য “ভাইপো” কে।
মাননীয়াকে খুব প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে যে প্রশান্ত কিশোর কোন বাঙালি রত্নগর্ভার সন্তান ? বিগত কয়েক বছরে তথাকথিত “সর্বভারতীয়” তৃণমূল কংগ্রেস যখন উত্তেজনার বশে অন্য কয়েকটি রাজ্যে প্রার্থী দিয়েছিলো তখন তাঁর লোকজন কিভাবে বহিরাগত হয়ে সেই রাজ্যে গিয়েছিলেন ? জোর করে উর্দু শিক্ষক নিয়োগ করার বিরুদ্ধে ইসলামপুরের দড়ভিট স্কুলের প্রতিবাদী স্কুল ছাত্রদের ওপরে গুলি চালিয়ে হত্যা করার সময় মাননীয়ার মনে জাগেনি বাঙালীর আবেগ ? যা কিছু বলা করা সবই কেবল ক্ষমতায় থাকার জন্যই ? এতই তাঁর ক্ষমতা লিপ্সা!!!! এদিকে তাঁর এই নোংরা খেলাকে কটাক্ষ করে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শ্রী দিলীপ ঘোষ বলেছেন যে ” পশ্চিমবঙ্গে দেশের ‘প্রধানমন্ত্রী বহিরাগত’ আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা বাঙালী!” তিনি আরো প্রশ্ন তুলেছেন গত দুবছর ধরে জেড প্লাস নিরাপত্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তৃণমূলের ভোট ম্যানেজার বহিরাগত প্রশান্ত কিশোর সম্পর্কে তৃণমূলের নীরবতা নিয়ে । যদিও তৃণমূল দলের আজ দুর্দশার জন্য ভাড়া করা বহিরাগত পিকের ভূমিকা যে অনস্বীকার্য তা বিভিন্ন বিদ্রোহী নেতাদের বক্তব্যে সাফ জানান দিচ্ছে । ঠিক যেমন ভাবে সংখ্যালঘু তোষণের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রতিবাদ প্রদর্শিত হয়েছিল ২০১৯ এ লোকসভার ভোটে ঠিক তেমন ভাবেই এটাও পরিষ্কার যে বাঙালিরা আর সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা ফাঁদে পা দিতে রাজি নন। এটা মাননীয়াও খুব ভালো করে বুঝতে পারছেন। কিন্তু ডুবন্ত ব্যক্তি যেমন খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় তেমনই মাননীয়াও রাজনীতির স্বার্থে যে কোনো নীতি বিসর্জন দিতে পারেন তা সর্বজনবিদিত। এতে আশ্চর্যান্বিত হবারও কিছু নেই। কেবল প্রার্থনাই করা যেতে পারে তাঁর শুভবুদ্ধির উদয়ের জন্য। ভোট যত এগিয়ে আসবে ততই সংকীর্ণ রুচির ক্রমপ্রকাশ ঘটবে। তবে তাঁর মনে রাখা দরকার যে সিঁড়ি বেয়ে তিনি ক্ষমতার চূড়োয় উঠেছিলেন, ক্ষমতা চ্যুত হবার পরে তাঁকে সেই সিঁড়ি দিয়েই নামতে হবে। এই সমস্ত সংকীর্ণ রাজনীতির মূল্যও তাঁকে চোকাতেই হবে। ইতিহাস বড়োই নিষ্ঠূর। কাউকে তা ক্ষমা করেনা।