সাংবাদিক দীপ হালদার মৌখিক স্মৃতি রোমন্থনের ভিত্তিতে মরিচঝাঁপি গণহত্যার বাস্তব ইতিহাস রচনা করেছেন। এই লেখাটিতে উঠে এসেছে ওই এলাকায় আশ্রয় নেওয়া অন্যতম উদ্বাস্তু সন্তোষ সরকারের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন।
কোনো ঘোষণা ছাড়াই মরিচঝাঁপিতে আর্থিক অবরোধ চাপিয়ে দেয় রাজ্য সরকার। ২৬ জানুয়ারি প্রায় তিরিশটি পুলিশ লঞ্চ এবং দুটি বিএসএফ স্টিমার মরিচঝাঁপির চারপাশে চক্কর কাটছিল, যাতে কোনো বাসিন্দা পাশের কোনো দ্বীপ থেকে নৌকা করে খাবার, জল সহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী না আনতে পারেন। যাঁরা তেমনটা চেষ্টা করেছিলেন, পুলিশের লঞ্চ সাত তাড়াতাড়ি হামলা করে তাঁদের নৌকা ডুবিয়ে দেয়। অগত্যা, তাঁরা সাঁতরে দ্বীপে ফিরতে বাধ্য হন। কয়েকজনকে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
‘৩১ জানুয়ারি আমরা নতুন একটা পরিকল্পনা নিলাম। আমাদের নেতা সতীশ মন্ডল আর রঙ্গলাল গোলদার বললেন যে গ্রামের মেয়ে-বৌ রা-ই এবার থেকে দানাপানি আর ওষুধপত্র আনতে নৌকা বেয়ে পাশের দ্বীপে যাবেন। আমরা ভেবেছিলাম, নৌকায় মহিলা দেখলে পুলিশ কখনোই ধাক্কা মারবে না।
‘দেখা গেল, ভাবনাটা পুরোপুরি ভুল ছিল। বেজন্মা পুলিশগুলো মেয়েদেরকেও ছাড়ল না। ছোটোখাটো নৌকাগুলোর ভিতরে লঞ্চ ঢুকিয়ে দিল, সেগুলো গেল ডুবে।’
সন্তোষবাবু তখন সবে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন। খাবার বলতে সামান্য খুদসেদ্ধ আর কী। এমন সময় চিৎকার শুনে মায়ের কথা অগ্রাহ্য করেই খাবার ফেলে দৌড়ে গেলেন।
প্রথম কাজ মেয়েদের উদ্ধার করা। কাঁদানে গ্যাসের শেল বর্ষণ সহ্য করেই পুরুষেরা নৌকা বের করলেন। কয়েক জন মহিলাকে তাঁরা বাঁচাতে পারলেও অনেকেই সেদিন হারিয়ে গেলেন। পরে জানা গেছিল, পুলিশেরা কিছু মহিলাকে লঞ্চে তুলেছিল। নিকটবর্তী থানায় নিয়ে গিয়ে কয়েকদিন ধরে তাঁদের ক্রমাগত গণধর্ষণ করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
‘আমাদের ধৈর্যের বাঁধ গেল ভেঙে। পুলিশগুলো লঞ্চে, সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্রও আছে। এদিকে আমরা পাড়ে। গরান গাছের মোটা ডালগুলোকে ছুলে বর্শার মতো বানিয়েছিলাম আমরা। ইতরগুলোর দিকে সেগুলোই একটানা ছুঁড়তে লাগলাম সবাই, বেজন্মাগুলো আমাদের মেয়ে-বৌ দের ডুবিয়ে মারতে চাইছে! এই হঠাৎ পাল্টা মারে ওরা একটু হতচকিত হতেই আমরা নৌকা নিয়ে নদীতে নামার সুযোগ পেয়ে গেলাম।’
সংখ্যায় ওঁরা ছিলেন ৪০০ জন, ৪০০ জন নানা বয়সের পুরুষ মানুষ। সরকারবাবুও সেই দলের সাথেই নৌকা নিয়ে নদীতে নামলেন ডুবন্ত মহিলাদের বাঁচাতে। আর তখনই পুলিশেরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে আরম্ভ করল। ‘নৌকায় উঠতে পারার আগেই রবিন জোয়ারদার গুলি খেলেন, তবু আমরা থামি নি’, স্মরণ করেন সন্তোষবাবু।
‘আমাদের মধ্যে কয়েকজন কিছু মহিলাকে জল থেকে তুলে নৌকা ঘুরিয়ে মরিচঝাঁপি ফিরে গেল। বাকিদের সাথে আমিও প্রয়োজনের তাগিদেই এগিয়ে চললাম কুমিরমারির দিকে। পৌঁছে দেখি বেশিরভাগ গ্রামবাসী ভয়ে দোর দিয়েছে, ভাবছে তারা জ্যোতি বসুর পুলিশের সাথ দিয়েছে বলে আমরা তাদের মারব। ভাবছে যে আমরা হয়তো তাদেরকে পুলিশের খোচর মনে করি। দরজা খুলতে চাইছিল না ওরা।’
কিন্তু যাঁরা বুলেটকে ডরান নি, তাঁরা কি বন্ধ দরজা দেখেই ফিরে যাবেন? ‘অনেক করে বোঝালাম যে ওদের কোনো ক্ষতি করতে আসি নি। কেবল দরকার মতো খাদ্যশস্য, পানীয় জল আর ওষুধ নিতেই ওদের গ্রামে এসেছি। শেষমেশ চাল, ডাল আর কয়েক কলসী পানীয় জল পাওয়া গেল। এবার সমস্যা হল, মরিচঝাঁপি ফিরব কী করে?’
উদ্বাস্তুরা একটা উপায় বের করলেন। চাল-ডাল আর ওষুধপত্র সমেত একটা নৌকায় থাকবে মাঝি সহ পাঁচজন। তাতে করে জলদি এগনো সম্ভব হবে। বাকি নৌকাগুলো দুপাশ থেকে এই নৌকাটাকে আড়াল করবে পুলিশের নজর থেকে। সন্তোষবাবু রইলেন এরকমই একটা নৌকায়।
‘আমাদের কাছে গরানকাঠের বর্শাগুলো ছিল, আমরা বলতাম চেঙা। পুলিশ আমাদের দিকে বুলেট বা কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুঁড়লে, আমরাও তখন ওই বর্শাগুলো ছুঁড়তাম। আমাদের কয়েকজন সাথে করে ছোটো ছোটো কুঠারও নিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ গুলি চালালে আমাদের বাঁচার কোনোই আশা ছিল না। তবে মরিচঝাঁপিতে আমাদের ভাই-বন্ধু দের জন্য সেদিন আমরা মরতেও তৈরি ছিলাম।’
বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত ওই ৪০০ জন সফলভাবে এই দুঃসাহসিক কাণ্ড চালিয়ে গেলেন। এইভাবেই তাঁরা বেশ কয়েকবার কুমিরমারি থেকে মরিচঝাঁপি পর্যন্ত দরকারি জিনিসপত্র বয়ে ফেললেন। পুলিশের লঞ্চগুলো কাছে এলেই তাঁরা বর্শা, কুঠার এইসব ছুঁড়ছিলেন। লঞ্চগুলো তাঁদের নৌকা ধাক্কা মেরে ডুবিয়ে দিলেও আসল নৌকাটির পাত্তা পাচ্ছিল না। পরিকল্পনা কাজে আসছিল।
চারটে নাগাদ তাঁরা সামান্য মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি নিলেন। কিন্তু খবর এল যে তাঁদের রুখতে আরও পুলিশ এসে পড়েছে। ‘সামান্য চিঁড়ে-গুড়ও শেষ করার ফুরসৎ পেলাম না।’
অতিরিক্ত পুলিশ সত্যিই এসৈ থাকলে তাঁদের আর কোনো আশাই ছিল না। এমনিতেও সকলে একসাথে ছিলেন না। একদল নদীতে তখনো মাল বইছেন, অন্যদল খাবার নিয়ে বসেছেন।
তাঁরা দেখলেন লঞ্চে করে রাইফেল নিয়ে প্রায় ৫০০ পুলিশ তাঁদের দিকেই এগিয়ে আসছে।
উনচল্লিশ বছর আগের ঘটনা, তবু সন্তোষবাবুর মনে তার স্মৃতি আজও দগদগে, যেন এই সেদিনকার ব্যাপার। ‘কী করে ভুলতে পারি? আমার ডান পা টা ওরা নষ্ট করে দিয়েছিল যে!’
উনি বরাবরই স্বামীজির ভক্ত। সেদিন যখন সঙ্গীসাথীদের লড়াইয়ের ডাক দিলেন, স্বামীজি স্বয়ং যেন তাঁর জিভে ভর করেছিলেন। ‘ভাইসব, এখন লুকনোর বা পালানোর সময় নয়। পালাতে গেলেও পুলিশের গুলি খাবে। ওরা আমাদের, উদ্বাস্তুদের মানুষ বলে মনেই করে না। মনে করলে আমাদের মেয়েদের ওইভাবে ডুবিয়ে দিত না। অমরা হিন্দু শরণার্থীরা যবে থেকে এ দেশে এসেছি, ওরা আমাদের সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার করেছে। ক্যাম্পে কিংবা বাইরে, কোনোদিন কোনো সম্মান আমরা পাই নি। আজ হিসাব মেটানোর দিন। মরলে মাথা উঁচু করেই মরব।’
এই আহ্বানে এক লহমায় সকলে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে রুখে দাঁড়ালেন।
কুমিরমারিতে হাতের কাছে যা পাওয়া গেল – তীর-ধনুক, লাঠি, ইঁট-পাথর – তাই নিয়েই সবাই পাড়ে এসে দাঁড়ালেন। নৌকা এবং পাড়ের দিকে তাক করে গর্জে উঠল পুলিশের রাইফেল।
নৌকা থেকে ঝুপঝাপ লাশ পড়ছিল নদীতে। আহতের আর্তনাদে বাতাস ভারাক্রান্ত। কুমিরমারির এক মহিলা সন্তানকে স্তন্যদানের সময় কী ঘটছে দেখতে ঘরের বাইরে এসেছিলেন। সরকারবাবু দেখলেন, গুলি খেয়ে তাঁর প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। শিশুটি কাঁদতে লাগল।
সরকারবাবু ধনুক তুললেন। তিরন্দাজ হিসাবে খানিকটা নামডাক তাঁর ছিল। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ার মধ্যেই একটু উঁচুতে থাকা একটা খেজুর গাছের পিছনে আশ্রয় নিয়ে ডেকের পুলিশদের দিকে নিশানা সাধলেন। তাঁর সাথীরা তখন আগুয়ান লঞ্চগুলোর দিকে ইঁট ছুঁড়ছেন, বর্শা ছুঁড়ছেন। পুলিশরা তাঁদের ভয় দেখাতে আরও বেশি করে কাঁদানে গ্যাসের শেল আর গুলি ছুঁড়তে লাগল।
কিন্তু পিছিয়ে না এসে সেদিন উদ্বাস্তুরা অপ্রতিম সাহসের পরিচয় দিলেন। এবার তাঁদের দিকে সরাসরি তাক করেই বুলেট ছোঁড়া হচ্ছিল। সরকারবাবু দেখতে পেলেন না কখন একটা লঞ্চ পাড়ে ভিড়ল আর কখন তাঁর পিছনে চুপিচুপি চলে এল পুলিশ।
‘মাত্র বিশ-তিরিশ ফুট দূর থেকেই গুলি চালিয়ে দিল একজন। গুলিটা লাগল পায়ে। কিছুই বুঝি নি, কেবল মনে হল যেন একটা হাড় গুঁড়ো হয়ে গেল। মাটিতে পড়ে গেলাম।’
অবশ্য কাঁদানে গ্যাসের চোটে তাঁর চোখের যন্ত্রণা পায়ের থেকে বেশি তখন। তাতেও কোনো মতে একটা ঘেরা জায়গা অব্দি গিয়ে শুয়ে পড়লেন। শত্রু তাঁকে ঘিরে নিল।
চারপাশে উদ্যত বেয়নেট দেখে সরকারবাবু চোখ বুজলেন, মৃত্যুর জন্য তখন এক দুঃসহ অপেক্ষা। হঠাৎ কোথা থেকে একজন পুলিশ ছুটে এল, ‘খবরদার একে মারবে না। এ আহত, একে ছোঁবে না।’
ব্যস, এত দূরই মনে রাখতে পেরেছেন সন্তোষবাবু।
পা খানি একেবারে বাদ যাওয়ার পরেই তাঁর জ্ঞান ফিরেছিল। বেদনায়, বিষাদে, মন কেমন আর নিদ্রায় কেটে গেছিল আরও তেরোটা দিন। পরে জানতে পেরেছিলেন, সেদিন সিপিএম ক্যাডাররা মরিচঝাঁপিতে ঢুকে খুন, ধর্ষণ, লুঠতরাজের মেহফিল বসিয়ে দেয়। অরাজকতা চলেছিল সারাদিন।
সন্তোষবাবু শুনেছিলেন, পুলিশ বাচ্চাদেরও ছাড়ে নি। পাঁচ থেকে বারো বছরের পনেরোটা বাচ্চা লুকিয়েছিল তাদের স্কুলের কুঁড়েঘরে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয় তাদের, থেঁতলে দেওয়া হয় খুলি। বাচ্চাগুলো সেখানে গিয়েছিল পরের দিনের সরস্বতী পূজার তোড়জোড় করতে, যাওয়ার আগে পুলিশ ভেঙে দিয়ে যায় মা সরস্বতীর মূর্তিটা।
প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কিন্তু ৩১ জানুয়ারি ১৯৭৯,যেদিন সন্তোষ সরকার হারিয়েছিলেন তাঁর পা, সেদিন প্রাণ হারান অন্তত ১৭০০ মানুষ।
লেখকের অনুমতিক্রমে সাংবাদিক দীপ হালদারের লেখা Blood Island: An Oral History of the Marichjhapi Massacre ‘রক্ত দ্বীপ : মরিচঝাঁপি গণহত্যার মৌখিক ইতিহাস‘ বইটি থেকে লেখাটি নেওয়া হয়েছে। অনুবাদক সূর্যদেব।