।।১।।
পাল ও সেন বংশের পর বাংলার বুকে গড়ে ওঠা এই বিশাল ইতিহাসকে কেন গুরুত্ব দেওয়া হয় না জানি না… কিন্তু এর গুরুত্ব পাল ও সেন বংশের থেকে কিছু অংশে কম নয়।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির কাছে রানী ভবশঙ্করী নামটা ততটা পরিচিত নয়। কিন্তু রানী ভবশঙ্করী অবিভক্ত বাংলার মুসলমান শাসকদের কাছে একটা আতঙ্ক ছিল, যাকে বাংলার সুলতানি শাসক, পাঠান শাসকরা কোনোদিন পরাজিত করতে পারেনি। এমনকি রানী ভবশঙ্করীর শাসনকালে মুঘল শাসক আকবর ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব মেনে নেন। আসুন তাঁর বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
রানী ভবশঙ্করীর জন্মসূত্রে নাম ছিল ভবশঙ্করী চৌধুরী। তাঁর জন্ম হয়েছিল ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যে( ইংরেজি Bhurshut kingdom), সেই সময় ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য বর্তমান হাওড়া ও হুগলি জেলা জুড়ে ছিল। তাঁর পিতার নাম দীননাথ চৌধুরী। তিনি রাজা রুদ্রনারায়ণের সাম্রাজ্যে একজন দুর্গরক্ষক ছিলেন। তাঁর পিতা দীনানাথ চৌধুরী দুর্গের রক্ষক ছিলেন, সেইসঙ্গে সেনাদের যুদ্ধ বিদ্যার প্রশিক্ষণ দিতেন। আর তাই ছোটবেলা থেকেই ভবশঙ্করী পিতার কাছে অস্ত্র শিক্ষা পান। তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করা, তরোয়াল যুদ্ধ, তীর ছোঁড়া ইত্যাদির প্রশিক্ষণ নেন। সেইসঙ্গে তিনি মাঝে মাঝে পিতার সঙ্গে যুদ্ধ অভিযান এবং শিকার অভিযানে যেতেন।
ভবশঙ্করী ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পন্ডিতদের কাছ থেকে সমাজশাস্ত্র, রাজনীতি, দর্শন, কূটনীতি এবং ধর্মশাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এইভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু এর কিছু সময় পরেই ভবশঙ্করীর মায়ের মৃত্যু হয়। তারপরেই দীনানাথ তাঁর কন্যার বিবাহ দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করতে থাকেন। কিন্তু স্বাধীনচেতা, যোদ্ধা ভবশঙ্করী এক অদ্ভুত শর্ত দেন যে যে পুরুষ তাকে তরোয়াল যুদ্ধে হারাতে পারবেন তিনি তাকেই বিয়ে করবেন।কিন্তু শেষপর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। কারণ সময়ের ফেরে ভবশঙ্করীর সঙ্গে রাজা রুদ্রনারায়ণ-এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। এ নিয়ে আজও হাওড়া এবং হুগলী জেলার গ্রামে-গ্রামে লোকমুখে কাহিনী প্রচলিত আছে। একবার ভবশঙ্করী শিকার অভিযানে গিয়েছিলেন। সেখানে একদল বুনো মহিষ ভবশঙ্করীকে আক্রমণ করে। কিন্তু ভবশঙ্করীর তরোয়াল চালানোয় অসাধারণ দক্ষতা ছিল। সেই দক্ষতায় সবকটি বুনো মহিষকে তিনি হত্যা করেন এবং শিকার অভিযানে থাকা বাকিদের রক্ষা করেন। এই দৃশ্য রাজা রুদ্রনারায়ন দূর থেকে লক্ষ্য করেন এবং যুদ্ধ দক্ষতায় মুগ্ধ হন। তিনিই ভবশঙ্করীর পিতাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন এবং খুব শীঘ্রই তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয় গড় ভবানীপুর দুর্গের কাছে দামোদর
রাজপ্রাসাদে। এরপরেই ব্রাম্ভন কন্যা ভবশঙ্করী চৌধুরী পরিচিত হন রানী ভবশঙ্করী নামে। বিবাহের পরেই রানী ভবশঙ্করী রাজ্য শাসন বিষয়ে রাজা রুদ্রনারায়নকে সাহায্য করতেন। একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো রানী ভবশঙ্করী দেবী চন্ডীর ভক্ত ছিলেন। সেই কারণে বিবাহের পরেই রাজপ্রাসাদের পাশেই দেবী চন্ডীর মন্দির নির্মাণ করান। তিনি রোজ নিষ্ঠাভরে মা চন্ডীর পূজা করতেন। আজও হাওড়া ও হুগলী জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যে বেতাই চন্ডী এবং মেলাই চন্ডীর পূজা হয়ে থাকে, তা ভবশঙ্করীর শাসনকালেই হিন্দুদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দেবী চন্ডীর অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করেন।
এছাড়াও রানী ভবশঙ্করী সাম্রাজ্যের সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে বিশেষ নজর দেন। রানী ভবশঙ্করী ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অনেকগুলো সামরিক দুর্গের নির্মাণ করেন। তিনি খানাকুল, ছাউনপুর, তমলুক, আমতা , উলুবেড়িয়া, নস্করডাঙ্গায় দুর্গ নির্মাণ করেন। সেই সঙ্গে রাজ্যের সামরিক প্রশিক্ষণের বিষয়টিও দেখভাল করতেন। তাঁর নজরদারির মধ্যেই অনেকগুলি সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হতো। তিনিই প্রথম ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে মহিলাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন।সেই সঙ্গে তিনি নিয়ম করেন যে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের একজনকে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিতে হবে, যাতে আপদকালীন পরিস্থিতিতে সেনার দরকার পড়লে যুদ্ধ যোগ দিতে পারে। রানী ভবশঙ্করীর প্রশাসনিক দক্ষতায় ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য হাওড়া ও হুগলী ছাড়িয়ে পূর্ব বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিন মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অংশে বিস্তার লাভ করে।সেই সঙ্গে তিনি নৌবাহিনীর দিকেও নজর দেন।
রানী ভবসশঙ্করীর তত্বাবধানে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের নিজস্ব নৌবাহিনী গঠন করেন, যা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সেইসময় গৌড়ের শাসক ছিলেন পাঠান বংশীয় সুলেমান কারী। মুসলিম শাসকদের লুটেরা বাহিনী ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অতর্কিত হামলা করার লুঠ-পাট চালাতো। তাই এদের শায়েস্তা করতে রানী ভবশঙ্করীর পরামর্শে উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেবের সঙ্গে জোট করেন রাজা রুদ্রনারায়ন । ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেনির যুদ্ধে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য এবং মুকুন্দদেবের মিলিত সেনাবাহিনী গৌড়ের সুলতান সুলেমান কারীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুকুন্দদেবের সেনাপতি রাজীবলোচন রায়, যিনি কালাপাহাড় নামে বিখ্যাত। সুলেমানের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র দাউদ খান গৌড়ের শাসক হন। তিনি মুঘলদের পরাজিত করার জন্যে রাজা রুদ্রনারায়নের সাহায্য চান। রুদ্রনারায়ন রাজি না হলে দাউদ খান তাঁর সেনাপতি কলটু খানকে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য আক্রমণের নির্দেশ দেন । রুদ্রনারায়নের সেনাবাহিনী কলটু খানের সেনাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে এবং হত্যা করেন। এইযুদ্ধে বিশাল সংখক পাঠান সেনার মৃত্যু হয়। এরফলে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুসলিম শাসনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।এর পরেই রানী ভবশঙ্করী এক পুত্র সন্তান প্রতাপনারায়নের জন্ম দেন।প্রতাপনারায়নের বয়স যখন ৫ বছর, তখন রাজা রুদ্রনারায়নের মৃত্যু হয়।
(ক্রমশ)