।।২।।
রাজা রুদ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর রানী ভবশঙ্করী মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। তিনি মানসিক দিক থেকে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে তিনি রাজা রুদ্রনারায়ণের চিতায় নিজেকে আহুতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্ বংশের কুল পুরোহিত রানী ভবশঙ্করীকে বাধা দেন। রাজ পুরোহিত রানী ভবশঙ্করীকে রাজ্যের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান, যতদিন না পর্যন্ত রাজকুমার প্রতাপনারায়ণ প্রাপ্তবয়স্ক না হয়ে ওঠেন। তার পরেই রানী ভবশঙ্করী রাজ্যের শাসনভার সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শাসনভার গ্রহণ করার পূর্বে রাজ্যের সভাসদদের কাছে তিন মাস সময় চেয়ে নেন নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্যে। এরপরে তিনি তাঁর রাজ্যের দায়িত্বভার সেনাপতি চতুর্ভুজ চক্রবর্তী এবং রাজস্ব মন্ত্রী দুর্লভ দত্তের ওপর ছেড়ে দিয়ে কাস্তাসনগড়-এর মহাদেব মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তিনি পাঠান আক্রমণের সম্ভাবনা মাথায় রেখে তাঁর সঙ্গে খুবই বিশ্বস্ত এবং শক্তিশালী মহিলাদের একটি সেনাদলকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মহাদেব মন্দিরে তিনি রোজ নিষ্ঠাভরে পূজা করতেন এবং সেইসঙ্গে গরিব-দুঃখী, ভিখারিদের অর্থ, অন্ন-বস্ত্র দান করতেন। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে সেনাপতি চতুর্ভুজ চক্রবর্তী রাজ্যের ক্ষমতা দখলের জন্যে সচেষ্ট হলেন। সেনাপতি চতুর্ভুজ সুলতান ওসমান খানের সঙ্গে চক্রান্ত করেন রানী ভবশঙ্করী এবং তাঁর নাবালক পুত্র প্রতাপনারায়ণকে হত্যা করার। সেইমতো চতুর্ভুজ সমস্ত তথ্য ওসমান খানের কাছে পৌঁছে দেন। ওসমান খান তাঁর সেনাবাহিনীর বাছাইকরা শক্তিশালী সেনা নিয়ে রানী ভবশঙ্করীকে হত্যার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী ওসমান খানের সেনারা হিন্দু সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যে প্রবেশ করেন। এছাড়াও বহু পাঠান সৈন্য ব্যবসায়ী, পর্যটক, ফকির ইত্যাদি ছদ্মবেশে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যে প্রবেশ করেন। কিন্তু বর্তমান হাওড়া জেলার আমতার দুর্গে থাকা সেনা ইউনিটের গোয়েন্দারা পাঠান সেনাদের চিনতে পারেন। তারাই রানী ভবশঙ্করীকে পাঠান সেনার আগমনের খবর পৌঁছে দেন।
রানী ভবশঙ্করী এই সংবাদ পাওয়া মাত্রই পাঠান সেনাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। সেই মতো তিনি আশেপাশের দুর্গগুলি থেকে দক্ষ সেনাদের ডেকে নেন এবং তাদেরকে আশেপাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে বলেন। তিনি নিজের সঙ্গে বিস্বস্ত নারী সেনাদের রাখেন। রাতে রানী ভবশঙ্করী যুদ্ধের পোশাক পরে, অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পূজায় বসেন। পূজায় বসার সময় তিনি নিজের শরীরে একটি সাদা কাপড় জড়িয়ে নেন। গভীর রাতে ওসমান খানের সেনাবাহিনী রানী ভবশঙ্করীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মন্দিরে আক্রমণ করেন। কিন্তু সেনারা প্রস্তুত থাকায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। রানী ভবশঙ্করীর নেতৃত্বে থাকা সেনারা পাঠান সেনাদের কচুকাটা করেন। পিছনে থাকা পাঠান সেনাদের একটি দল এই খবর পাওয়ার পর ভোরের সময়ে কিছু দূরের গ্রামে থাকা একটি শৈব সাধুদের আখড়ায় আক্রমণ করেন। কিন্তু শৈব সাধুরা পাঠানদের তরোয়ালের জবাব তরোয়ালের দ্বারাই দেন। সেখানে শৈব সন্ন্যাসীরা বহু পাঠান সৈন্যকে হত্যা করেন। ওসমান খান রাতের অন্ধকারে পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচান।
পরেরদিনই রানী ভবশঙ্করী নিজের রাজধানী গড় ভবানীপুরে ফিরে আসেন। তিনি গোয়েন্দা মারফত খবর পেয়েছিলেন চতুর্ভুজ চক্রবর্তীর চক্রান্তের কথা। কিন্তু প্রমানের অভাবে তাকে কোনো শাস্তি দিতে পারেননি। কিন্তু এরপরেই রাজ্যের শাসনভার সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন রানী ভবশঙ্করী। দায়িত্ব নিয়েই তিনি চতুর্ভুজ চক্রবর্তীকে সেনাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেন এবং ভূপতি কৃষ্ণ রায়কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সেনা প্রশিক্ষণের শিবির স্থাপন করেন, যেগুলি রানী ভবশঙ্করী নিজে তদারকি করতেন। এরপরেই পাঠান সেনাদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা, বাঘের মতো ক্ষিপ্রতায় তাঁর যুদ্ধ করার কাহিনী ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যের লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। যদি রানী ভবশঙ্করী বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ না করে ওসমান খানকে পরাজিত করতেন, তাহলে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্য ইসলামের শাসন শুরু হতো এবং হিন্দুর মঠ-মন্দির, হিন্দুর সংস্কৃতি, সুখ-শান্তি সব ধ্বংস হয়ে যেত।
এর কিছুদিন পরেই রানী ভবশঙ্করীর রাজ্যাভিষেকের দিনক্ষণ স্থির হয়। ঠিক হয় যে এক বিশেষ দিনে তান্ত্রিক মতে ছাউনাপুরের অন্তর্গত বাঁশুরি গ্রামের ভবানী মন্দিরে রানী ভবশঙ্করীর রাজ্যাভিষেক হবে। স্থির হয় যে গোলক চট্টোপাধ্যায় নামক একজন তান্ত্রিক রাজ্যাভিষেকের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন। কিন্তু পদচ্যুত সেনাপতি চতুর্ভজ চক্রবর্তী চক্রান্ত করতে থাকেন রানী ভবশঙ্করীকে হত্যা করে ভূরিশ্রষ্ঠ রাজ্যের ক্ষমতা দখলের। এবারেও তিনি পাঠান সেনাপতি ওসমান খানের সঙ্গে হাত মেলান। এবারে চতুর্ভুজ চক্রবর্তী, ওসমান খানকে প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর অনুগত সেনাদের নিয়ে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যে আক্রমণ করবেন। পরিকল্পনা মতো ওসমান খান কয়েকশো সেনা নিয়ে রাতের অন্ধকারে খানাকুলে এসে পৌঁছান। খানাকুলে এসে জঙ্গলে ঘাঁটি গাড়েন। কিন্তু জঙ্গলে শিকার করতে যাওয়া এক শিকারী এদের দেখতে পেয়ে খানাকুলের দুর্গে খবর দেন। সেই খবর যখন চতুর্ভুজ চক্রবর্তীর কাছে পৌঁছায়, তিনি তা গুজব বলে উড়িয়ে দেন( ওই সময় সেনাপতি ভূপতি কৃষ্ণ রায় বিশেষ কাজে দূরে থাকায় চতুর্ভুজ চক্রবর্তী খানাকুল দুর্গের দায়িত্বে ছিলেন)।
কিন্তু রানী ভবশঙ্করীর গুপ্তচর ব্যবস্থা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, এই খবর তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। খবর পাওয়ার সঙ্গেই তিনি ব্যবস্থা নেন। তিনি দূতের মাধ্যমে ভূপতি কৃষ্ণ রায়কে ফিরে আসতে বলেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন দুর্গে থাকা সেনাদেরকে ডেকে নেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রানী ভবশঙ্করী নিজের রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে সেনাবাহিনীকে রাজ্যের সীমান্ত বরাবর সেনাকে ছড়িয়ে রাখতেন। সেই জন্যে রাজধানীতে কখনো বেশি সংখক সেনা থাকতো না। তিনি রাজ্যের সীমানা বরাবর নির্দিষ্ট দূরত্বে বহু দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রতিটি দুর্গে একটি করে সেনা ইউনিট থাকতো। এছাড়াও প্রতিটি দুর্গে অশ্বারোহী সৈন্য, হস্তী বাহিনী এবং পদাতিক সৈন্য থাকতো। সেই কারণে রানী ভবশঙ্করী ছাউনাপুর, বাঁশডিঙ্গাগড় এবং লস্করডাঙ্গা দুর্গের সেনা ইউনিটগুলোকে নিজের কাছে ডেকে নেন এবং তাদেরকে আশেপাশের এলাকায় মোতায়েন করেন। সেই সঙ্গে রানী ভবশঙ্করী তাঁর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হরিদেব ভট্টাচার্যের পরামর্শে আশেপাশের বাগদি(বর্গ ক্ষত্রিয়) এবং নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের বাছাই করা যোদ্ধাদের সামিল করেন, যারা তীর ছোঁড়া এবং তরোয়াল চালানোয় বিশেষ দক্ষ ছিলেন। তাছাড়া, তাদের পূর্বেই যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল, যেহেতু রানী ভবশঙ্করী রাজ্যের প্রত্যেক পরিবারের একজনের সেনা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছিলেন।
সমাপ্ত