দীপাবলীর পরে কোর কমিটির বৈঠকে দিদি পইপই করে বুঝিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “এমনটা কেউ ভাববেন না যে, আমি তো পঞ্চায়েতে, আমি তো বিধানসভায়, আমারটা হয়ে গিয়েছে, তাই এমপি ভোটে কাজ করব না!” কিন্তু দিদির বলাই সার হল। বিধায়ক তো বটেই, লোকসভা ভোটে বিধানসভাওয়াড়ি ফলাফল হিসেব করতে গিয়ে দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার ১৫ জন সদস্য নিজেদের বিধানসভায় হেরেছেন। কেউ কেউ আবার গো হারা।

উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ সর্বত্র নিজের কেন্দ্রে হেরেছেন তাবড় মন্ত্রীরা। বাদ যায়নি কলকাতা শহরও।

কোন কোন জেলায় কোন কোন মন্ত্রীরা হারলেন নিজেদের বিধানসভায়?

উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলা। গত কয়েক বছর ধরেই এই জেলা তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দলের কারণে শিরোনামে। গত পঞ্চায়েত ভোটে মাদার বনাম যুবর লড়াইয়ে ঢুকে পড়েছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রও। এ বার সেই কোচবিহার জিতে নিয়েছে বিজেপি। একদা জেলা তৃণমূল যুব নেতা নিশীথ প্রামাণিককে প্রার্থী করেছিল গেরুয়া শিবির। ওই জেলার তৃণমূল জেলা সভাপতি তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের নিজের নাটাবাড়ি বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী হেরেছেন প্রায় ১৮ হাজার ভোটে। ওই জেলারই এর এক মন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন তাঁর নিজের বিধানসভা মাথাভাঙায় হেরেছেন প্রায় ২০ হাজার ভোটে।

মন্ত্রী গৌতম দেব তাঁর নিজের বিধানসভা ডাবগ্রাম ফুলবাড়িতে হেরেছেন প্রায় ৯০ হাজার ভোটে। দার্জিলিং কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে এই বিধানসভা। ওই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্ত জিতেছেন তিন লাখের বেশি ভোটে। সাত বিধানসভার মধ্যে ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতেই সবচেয়ে বেশি ভোটে পিছিয়ে তৃণমূল।

উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার দুই মন্ত্রী গোলাম রব্বানি এবং বাচ্চু হাঁসদা হেরেছেন নিজেদের বিধানসভায়। গোলামের বিধানসভা গোয়ালপোখরে তৃণমূল ৩২ হাজার ভোটে এবং দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে মন্ত্রী বাচ্চু হাঁসদার তপন কেন্দ্রে তৃণমূল পিছিয়ে গেছে প্রায় ২৩ হাজার ভোটে।

বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী করেছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামল সাঁতরাকে। তিনি তো হেরেইছেন, লিড নিতে পারেননি নিজের বিধানসভা কোতলপুর থেকেও। কোতলপুরে তৃণমূল হেরেছে প্রায় ৯ হাজার ভোটে। রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের আসানসোল উত্তর বিধানসভাও মুনমুন সেনের থেকে মুখ ফিরিয়েছে। সেখানেও লিড পেয়েছেন বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়।

কয়েক মাস আগে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্ত্রিসভার রদবদল করলেন, সেই সময় যাঁদের ক্যাবিনেটে নিয়েছিলেন দিদি, তাঁদের মধ্যেও দু’জন হেরেছেন নিজেদের বিধানসভায়। বারাসত কেন্দ্র তৃণমূল জিতলেও, কাকলি ঘোষ দস্তিদারকে নিজের বিধানসভা থেকে লিড দিতে পারেননি দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু।  বিধাননগরে তৃণমূল পিছিয়ে রয়েছে ১৮ হাজার ৫৭৫ ভোটে। সেই সময় ক্যাবিনেটে জায়গা পাওয়া নদিয়ার দাপুটে নেত্রী তথা চাকদহের বিধায়ক রত্না ঘোষ কর  তাঁর বিধানসভায় হেরেছেন ২৯ হাজারের বেশি ভোটে।

হুগলি কেন্দ্র জিতেছে বিজেপি। ওই কেন্দ্রের মধ্যেই রয়েছে তিন মন্ত্রীর বিধানসভা। কিন্তু চন্দননগরে ইন্দ্রনীল সেন এবং ধনেখালিতে অসীমা পাত্র নিজেদের বিধানসভায় জিতলেও সপ্তগ্রাম বিধানসভায় হেরেছেন জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী তপন দাশগুপ্ত। প্রায় ২১ হাজার ভোটে।

হুগলির মতো গঙ্গার উল্টো পারেও এক ছবি। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী তথা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালু তাঁর হাবরা বিধানসভা থেকে পিছিয়ে পড়েছেন প্রায় ১৮ হাজার ভোটে। মন্ত্রী না হলেও জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতি তথা বিধানসভার তৃণমূল পরিষদীয় দলের সচিব পার্থ ভৌমিক তাঁর নৈহাটি বিধানসভা থেকে তৃণমূল প্রার্থী দীনেশ ত্রিবেদীকে লিড দিতে পারেননি। অর্জুন সিং সেখান থেকে লিড পেয়েছেন প্রায় দু’হাজার ভোটের।

হাওড়া জেলার তিন মন্ত্রীর মধ্যে অরূপ রায় এবং রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেদের বিধানসভায় দলের মান রাখলেও, উত্তর হাওড়া বিধানসভায় তৃণমূল পিছিয়ে পড়েছে প্রায় তিন হাজার ভোটে। এখানকার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী তথা প্রাক্তন ক্রিকেটার লক্ষ্মীরতন শুক্ল।

বাদ যায়নি শহর কলকাতাও। কলকাতার দুই কেন্দ্রে জোড়া ফুল ফুটলেও, উত্তর এবং দক্ষিণের দুটি বিধানসভায় হারতে হয়েছে শাসক দলকে। রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজার শ্যামপুকুর এবং বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের বিধানসভা রাসবিহারীতে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে।

চোদ্দর ভোটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা ভবানীপুরেও পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। কিন্তু এ বার তা হয়নি। মন্ত্রীদের মধ্যে বিধানসভাওয়াড়ি ফলাফলে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা মান বাঁচিয়েছে তৃণমূলের। সেখানকার দুই মন্ত্রী মন্টুরাম পাকিরা এবং গিয়াসুদ্দিন মোল্লা ব্যাপক ভোটে তৃণমূল প্রার্থীকে লিড দিয়েছেন নিজেদের বিধানসভা থেকে। তবে সেরার সেরা রাজ্যের পরিবহণ ও পরিবেশমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের দুই জনপদের মধ্যে একটি সিঙ্গুর এবং অন্যটি নন্দীগ্রাম। সিঙ্গুর এ বার দিদির থেকে মুখ ফেরালেও, নন্দীগ্রাম অর্থাৎ শুভেন্দুর নিজের বিধানসভা থেকে তৃণমূল প্রার্থী লিদ পেয়েছেন প্রায় ৭০ হাজার ভোটের।

এমনিতেই লোকসভার নিরিখে বিধানসভা অনুযায়ী যা হিসেব তাতে ১২৯টি বিধানসভায় এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। গোদের উপর বিষ ফোড়া আবার ১৫ মন্ত্রীর ডাহা ফেল করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.