নতুন কৃষি আইনের বিরোধিতা নিয়ে দেশের রাজনীতি গরম করে তোলার প্রয়াস ও প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু দেশের জনগণ আরও বেশি তেতে আছে বলিউড-সংক্রান্ত তদন্ত নিয়ে। অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের রহস্যময় মৃত্যুর তদন্ত করতে গিয়ে ড্রাগ-আসক্তির বিষয়টি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে আসায় নারকোটিকস্ কন্ট্রোল ব্যুরো এখন একের পর এক জেরা করছে বলিউডের স্টারদের। জেরায় ডাক পড়েছে অন্যতম এ-লিস্টার অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোনেরও। আগামীকাল অর্থাৎ ২৫শে সেপ্টেম্বর জেরা করা হবে তাঁকে। ভারতবাসীর নজর রয়েছে সে দিকেও।
রাজ্যসভায় কৃষিবিল যেদিন পাশ হল, কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা প্রেস কনফারেন্সে সেইদিনই বলেন যে নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের মত বিদ্রোহ করবেন তাঁরা। অর্থাৎ বর্তমান ভারতবর্ষের সঙ্গে তুলনা করা হল কংগ্রেস-পূর্ব বৃটিশ ভারতের। ১৮৫৭ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয় নি। সুরজেওয়ালার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেন যে নতুন কৃষি আইন দেশে দুর্ভিক্ষ ডেকে আনবে। “করোনা”র সঙ্গে মিলিয়ে এই আইনগুলির নাম তিনি দেন “মরোনা”। বলা হয়, এই বিলের বিরোধিতায় রাস্তায় নামবে তৃণমূল। মমতা বলেন সমস্ত বিরোধী দলকে একযোগে দাঁত, নখ বের করতে হবে নতুন কৃষি আইনগুলির বিরুদ্ধে। তার ঠিক পরেই ২৫শে সেপ্টেম্বর প্ল্যান করা হল সর্বভারতীয় কৃষক প্রতিবাদ সমাবেশ। তখন দেখা গেল, ঐ দিনেই জেরা করার জন্য দীপিকা পাড়ুকোনকে ডেকে পাঠিয়েছে নারকোটিকস্ কন্ট্রোল ব্যুরো। তাতে নেটিজেনদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন ইকোসিস্টেমের অন্যতম মুখ রাজদীপ সারদেশাই। “সমঝে কুছ”? রামচন্দ্র গুহ টুইট করলেন—১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের নীতিসমূহের বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে সমস্ত বিরোধীরা যেদিন এক জনসভায় একত্রিত হয়েছিলেন, সেই দিন বিরোধী-মিটিং এর সময়ে, কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন দূরদর্শনে দেখানো হয়েছিল তৎকালীন সুপারহিট সেনসেশনাল ফিল্ম ‘ববি’ ।
শুধু রাজদীপ সারদেশাই বা রামচন্দ্র গুহ নন, অনেক সাংবাদিকই ইঙ্গিত করেছেন যে কৃষক প্রতিবাদের মঞ্চকে প্রাপ্য মিডিয়া কভারেজ থেকে বঞ্চিত করার জন্যই দীপিকাকে জেরার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ঐ দিনটিকে। যাতে মিডিয়া ও মানুষ দীপিকাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং কৃষক প্রতিবাদের মত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয় জনগণের মনোযোগ টানতে ব্যর্থ হয়। ভারতীয় মিডিয়ার একাংশ ক্ষুব্ধ যে ভারতীয় জনগণকে বলিউড-কেচ্ছা নিয়ে এমন বুঁদ করে রাখা হয়েছে যে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, কৃষিনীতির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে মানুষ যথাবিধি মনোযোগ দিচ্ছেন না। মিডিয়ার একাংশের এ অভিযোগ যদি সত্যিও হয়, তাহলেও আদত বিষয়টি হল, মিডিয়ার যে অংশ একথা বলছে, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নেহাৎ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। গত সাত দশক যাবৎ মিডিয়ার এই অংশ যেভাবে একটি পরিবারের সেবা করে এসেছে ও আজও করে যাচ্ছে, তাতে আজ তারা যা-ই বলুন, তাতে যদি সারবত্তাও থাকে, তাহলেও দেশের মানুষ তাতে যথোচিত গুরুত্ব দিতে পারছেন না। এ জন্য মানুষকে দোষারোপ করা যায় না। রাখালের গরুর পালে বাঘ পড়ার গল্প হয়ত আমরা সকলেই জানি। দেশের জনগণ যে তাঁদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে পারছেন না তার দায়ও “ইকোসিস্টেম মিডিয়া”কে নিতে হবে।
তবে আর একটি সন্দেহও মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। সর্বভারতীয় কৃষক প্রতিবাদ সভার দিনে দীপিকা পাড়ুকোনকে জেরার জন্য ডাকার বিরুদ্ধে কংগ্রেসী ইকোসিস্টেমের প্রায় সকলেই তির্যক মন্তব্য করছেন। তাঁদের লিখিত আর্টিকলগুলিতে ক্ষোভ স্পষ্ট। তাঁদের অভিযোগ—নিছক হেনস্থা করার জন্যই ডাকা হচ্ছে দীপিকা পাড়ুকোনকে। কোনো কিছু বাজেয়াপ্ত করা হয় নি, কাউকে গ্রেফতার করা হয় নি, কেবলই রাজনৈতিক হাওয়া গরম রাখার জন্য এবং জনগণকে উত্তেজনা সরবরাহ করার জন্য ডাকা হয়েছে বলিউডের এ-লিস্টার এই অভিনেত্রীকে। ইকোসিস্টেমের এমত ক্ষোভ দেখে সন্দেহ হচ্ছে, তবে কি কৃষক প্রতিবাদের নাম করে বিধ্বংসী কোনো নতুন গেমপ্ল্যান তৈরি হচ্ছে যা দীপিকা পাড়ুকোনকে জেরার জন্য ডাকার ফলে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে? #BlackLivesMatter এর আদলে #FarmerLivesMatter বা অনুরূপ কোনো বিধ্বংসী গণতন্ত্র-বিরোধী আন্দোলনের সলতে পাকানো কি চলছে? সর্বভারতীয় কৃষক প্রতিবাদ সভা কি তার উদ্বোধন-মঞ্চ হিসেবে পরিকল্পিত হয়েছে? এ প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত হবে, ভারতবর্ষে সিএএ-বিরোধী বিধ্বংসী প্রতিবাদ প্রথম শুরু হয়েছিল ২০১৯ এর ১৩ই ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গায়। সেটি ছিল উদ্বোধন। তার ঠিক পরদিনই দিল্লির জনসভা থেকে “ইসপার ইয়া উসপার কি লড়াই” এর ডাক দিয়ে শাহীনবাগ প্রতিবাদ মঞ্চের উদ্বোধন করে দিয়েছিলেন সনিয়া গান্ধী। এবারও ১৮৫৭’র বিদ্রোহের কথা বলে রেখেছেন কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালা, সংসদে গান্ধীমূর্তির সামনে রাতভর ধর্ণায় বসেছেন রাজ্যসভার সাসপেণ্ডেড সাংসদরা এবং একটি সর্বভারতীয় কৃষক প্রতিবাদ সমাবেশের পরিকল্পনাও করা হয়ে গিয়েছে। ছকটি পরিচিত ঠেকছে কি?
এরকম কোনো ছক যদি করা হয়ে থাকে, তবে তার সর্বাঙ্গীন সফল রূপায়ণের পথে নারকোটিকস্ কন্ট্রোল ব্যুরোর তদন্ত কি বাদ সাধছে? সেই জন্যই কি ইকোসিস্টেম এ তদন্তের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ? এটি ওপেন সিক্রেট যে ড্রাগের কালো ব্যবসা ভারতের অর্থনীতি থেকে পাম্প আউট করে এক বিশাল পরিমাণ অর্থরাশি এবং তা সমৃদ্ধ করে রাডিকাল ইসলামিক দুনিয়াকে। এ ব্যবসার অন্যতম কর্ণধার দাউদ ইব্রাহিম এবং এই টাকা ব্যবহৃত হয় মূলতঃ সন্ত্রাসবাদের প্রসারে ও ‘গাজওয়া-এ-হিন্দ’ এর পরিকল্পনার রূপায়ণে। অন্যদিকে, সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধীর সহানুভূতি ও সহমর্মিতা বহুজনবিদিত। নিন্দুকে বলে, অধুনা পাকিস্তান-নিবাসী ড্রাগব্যবসায়ী ডনের মাথার ওপর তাঁর হাত না থাকলে অনেকদিন আগেই ডনকে নিকেশ করে দিত ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী। এ হেন ড্রাগ সংক্রান্ত কেসে দীপিকাকে জেরা করে কি কি তথ্য বের করবে এনসিবি, তা নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন থাকা ইকোসিস্টেমের পক্ষে স্বাভাবিক, বিশেষতঃ দীপিকা পাড়ুকোন যেখানে রাহুল গান্ধীর রাজনীতির প্রতি তাঁর ভরসার কথা প্রকাশ করেছেন গণমাধ্যমে। সেই উদ্বেগ থেকেই হয়ত তাঁরা আর্টিকল লিখছেন যে কোনো প্রমাণ, অনুসন্ধান, বাজেয়াপ্তকরণ বা গ্রেফতার না করে শুধু শুধু ডাকা হচ্ছে দীপিকা পাড়ুকোনকে।
অন্য লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হল, দীপিকা পাড়ুকোনকে জেরা করা হবে সর্বভারতীয় কৃষক প্রতিবাদ সমাবেশের দিনে। অর্থাৎ দীপিকা যতক্ষণ NCB’র আওতায় থাকছেন, কৃষক প্রতিবাদের নামে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের মত আর একটি অগণতান্ত্রিক বিধ্বংসী আন্দোলনে ইন্ধন জোগানোর ক্ষেত্রে ইকোসিস্টেমের পায়ে থাকবে বেড়ি। আন্দোলনের নামে তেমন দুঃসাহসিক কিছু করার উদ্যোগ নিলে দীপিকার মাধ্যমে ইকোসিস্টেমের একদম মাথার নামও কি ড্রাগ-ইস্যুতে সর্বসমক্ষে চলে আসতে পারে না? ইকোসিস্টেমের ক্ষোভের আদত কারণ কি সেটি?
ভারতের রাজনীতি সব মিলিয়ে সরগরম। যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তা বোধ করি হিমশৈলের চূড়া মাত্র।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য
Debjani Bhattacharyya