বেশ কয়েক বছর থেকে যে শব্দবন্ধটি সংবাদমাধ্যমে সব থেকে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হলো হিন্দুত্ব। দেশের যে কোনো প্রান্তের কোনো ঘটনাকে হিন্দুত্বের আতসকাচে ফেলে তার বিশ্লেষণ শুরু হয়। এদেশের সংবাদমাধ্যমের কাছেও নিশ্চয় কোনো পদ্ধতি অথবা মাপকাঠি আছে যেখানে হিন্দুত্বের পরিমাপ করা যায়। কিছু মুখরোচক শব্দ সৃষ্টি করে হিন্দুদের চেতনাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা বহুকাল ধরে হয়ে এসেছে। তাই কেউ পৈতেধারী ব্রাহ্মণ সেজে মন্দিরে গেলে কিংবা হিজাব ছেড়ে করজোড়ে প্রার্থনা করলেই তার থেকে বিশুদ্ধ হিন্দুত্বের সুগন্ধ বেরোয়। এযাবৎ অবচেতন থাকা তাদের হিন্দু মনন হঠাৎ প্রবল আধ্যাত্মিকতার চৈতন্যে উদ্বেলিত হয়। হিন্দুত্বের এমন কদর্য সহজলভ্য অভিনয় এর আগে এদেশে দেখা গিয়েছে কিনা জানা নাই। স্বাধীনতার পর থেকেই হিন্দুত্বকে নিছক একটি উপাচারে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলেছে যেখানে সামান্য কিছু কসরত করলেই বিশুদ্ধ হিন্দু হয়ে উঠে হিন্দুদের ভোট চাওয়া যায়। সভ্যতা থেকে জাতি আর জাতি থেকে রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় হিন্দু শব্দটির ব্যাপ্তি ক্রমাগত ক্ষয় হতে হতে এখন নিছক বাহ্যিক উপাচারে এসে পরিণত হয়েছে। হিন্দুত্বের পরিভাষা নিয়ে নানা মতবাদ রয়েছে। আমাদের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাবো হিন্দু শব্দটি প্রথমে ভৌগোলিক অর্থে, পরে জাতি অর্থে এবং শেষে এটি ধর্মীয় রূপ পেয়েছে।
মিশর বা ব্যাবিলনের সভ্যতা যখন পৃথিবীর আলো দেখেনি তখন সিন্ধু নদীর অববাহিকার বাতাসে যজ্ঞের অগ্নিকুণ্ডের ধোঁয়া মিশেছে, বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে চারিদিক মুখরিত হয়েছে। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার সময়েও যে মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল তার প্রমাণ একাধিক জায়গায় পাওয়া গিয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার পর থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বহু বৈদেশিক জাতি যারা সিন্ধু নদী অতিক্রম করে এই পুণ্যভূমিতে অনুপ্রবেশ করেছে তারা কেউ না এক শতক ভূমি দখল করতে পেরেছে না তাদের পৃথক জাতিসত্তা এই ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। দেশীয় রাজন্যবর্গ নিজেদের মধ্যে প্রবল কোন্দলে লিপ্ত থাকলেও, নিজেদের সংস্কৃতিরক্ষার প্রশ্নে আপোশহীন সংগ্রাম করে গিয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দ থেকে ইউরোপীয় শাসকের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত এই সংগ্রাম নিরন্তর চলেছে। তারপর ইংরেজ শাসকেরা একটু একটু করে ইতিহাসকে বিকৃত করে হাজার হাজার বছর ধরে সযত্নে লালিত এই সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু ইংরেজ শাসকেরাও যা করে উঠতে পারেনি, কংগ্রেস তা করে দেখিয়েছে। এই বিরাট বিস্তৃত সভ্যতাকে দ্বিজাতি তত্ত্বের কুঠারাঘাত করে সিন্ধু নদীর অববাহিকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে বৈদেশিক শত্রুর হাতে দান করা হয়েছে। তাতেই ক্ষান্ত হয়নি, খণ্ডিত ভূভাগ নিয়ে যে জাতিসত্তা বেঁচে রইল তাকে ক্রমাগত তথাকথিত সেকুলারিজমের জগদ্দল পাথরে চাপা দিয়ে সমাধিস্থ করার নানা রকম বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আজ নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারের ছত্রছায়ায় যখন সেই সভ্যতার গরিমা পুনস্থাপিত হওয়ার পথে এগোচ্ছে, তখন কংগ্রেস ও কংগ্রেসের উপজাত দলগুলি প্রমাদ গুনতে শুরু করেছে। হিন্দু যখন বহু জাতি ও উপজাতিতে বিভক্ত একটি ধর্মীয় পরিভাষার সংকীর্ণতা সরিয়ে তার পৃথিবীর প্রাচীনতম গৌরবময় জাতিসত্তার কৌলিন্য ফিরে পেতে শুরু করেছে, তখন কংগ্রেস সভাপতি তথা তার সহযোগী আঞ্চলিক নেতারা মন্দিরে মন্দিরে পরিব্রাজন করে নিজেদের হিন্দুত্বের অভিনয়ে মত্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যমণি মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীরামের মন্দির নির্মাণে তাদের আপত্তি আছে, হিন্দু সংস্কৃতির বুনিয়াদ যে নারীর মর্যাদা, সেই নারীদের তিন তালাকের মতো ঘৃণ্য প্রথা থেকে মুক্তি দেওয়ার তারা বিরোধিতা করে, নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচার আকুতি নিয়ে যে লক্ষ লক্ষ হিন্দু প্রতিবেশী দেশে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের পাওয়া যাবে না। তারা কিন্তু হিন্দুত্বের অভিনয় করবেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা তাদের অভিনয় হলেও মন্দিরমুখী করতে পেরেছে, তাদের বিলুপ্ত হিন্দুত্ব দীর্ঘ শীতঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভেঙে সোজা রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে, এর জন্য নরেন্দ্র মোদীর নিশ্চয় তাদের কাছ থেকে একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।
সোমনাথ গোস্বামী
2019-05-10