ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি তুলে ভারতকে খণ্ডিত করে পাকিস্তান আদায় করে নিয়েছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ এবং তার মুসলিম লিগ। একথা কেউ স্বীকার করুন বা না করুন, মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসাবে যেদিন পাকিস্তান। আদায় করে নিয়ে গিয়েছিলেন জিন্নাহ, কার্যত সেদিনই স্বীকৃত হয়ে গিয়েছিল হিন্দুদের আবাসভূমি এই ভারতবর্ষই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার প্রাক্লগ্নে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তদানীন্তন পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুরা যখন মুসলিম লিগের ভয়াবহ অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে ভারতে আশ্রয়ের খোঁজ করছিলেন, তখন কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল অতীব নিন্দনীয়। অসহায় সেই মানুষগুলির আর্তিতে সাড়া তো দেয়ইনি কংগ্রেস, বরং কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের আচরণই বলে দেবে তাদের নির্লিপ্ততা এবং ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হওয়া পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের জন্য কী বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। ১৯৪৬ সালে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস এবং নোয়াখালিতে গণহত্যায় মুসলিম লিগের বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করার পর সকলেই বুঝে গিয়েছিলেন দেশভাগটা এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। জিন্নাহর দাবি অনুযায়ী পাকিস্তান না দিলে ভারতকে আরও রক্তক্ষয়ী গণহাতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এমনকী তৎকালীন বড়োলাট মাউন্টব্যাটেন পর্যন্ত গান্ধীকে বলেছিলেন—১৬ আগস্ট (১৯৪৬) মহড়া হিসাবে জিন্নাহ কলকাতায় ৫ হাজার লোককে হত্যা করেছে। কাজেই জিন্নাহকে এখন থামাতে না পারলে ভারতে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে।’ [Mountbatten and the Partition of India Vol. 1-Collins & Lapiere] অবস্থাটি যখন এই, তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং বাবাসাহেব আম্বেদকরের মতো কেউ কেউ বুঝেছিলেন, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ যদি অনিবার্যই হয়, তাহলে ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু জন বিনিময় জরুরি। তানা করে যদি দেশভাগ। করা হয়, তাহলে পাকিস্তানে হিন্দুরা বিপন্ন হয়ে পড়বে। এবং আরও একবার রক্তক্ষয়ী গণহত্যার সাক্ষী হয়ে থাকবে এই উপমহাদেশ। ১৯৪৬-এর আগস্টে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস এবং ওই বছরেরই অক্টোবরে নোয়াখালিতে হিন্দু নিধন আম্বেদকর এবং শ্যামাপ্রসাদদের সংখ্যালঘু বিনিময়ের কথাটি ভাবতে শিখিয়েছিল। আম্বেদকর এবং শ্যামাপ্রসাদ জন বিনিময়ের কথা বলার আগেই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বা ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাক দিয়ে জিন্নাহ বলেছিলেন—‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন আমি নীতিশাস্ত্র আলোচনা করতে যাচ্ছিনা… আমার হাতে একটি রিভলবার আছে আমি জানি সেটা কীভাবে ব্যবহার করতে হবে। জিন্নাহর অনুগামী মুসলিম লিগ নেতা লিয়াকত আলি খান বলেছিলেন, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বলতে বোঝায় আইন ভেঙে যে কোনো রকম কাজ করা।আর মুসলিম লিগ জিন্নাহর ছবি দেওয়া একটি প্রচার পত্রে লিখল— ‘আমরা মুসলমানরা রাজমুকুট পরে দেশ শাসন করেছি। উৎসাহ হারিও না। প্রস্তুত হও এবং হাতে অস্ত্র তুলে নাও। হে মুসলমানগণ একবার ভেবে দেখ আজ আমরা কাফেরদের অধীন। কাফেরদের ভালোবাসার পরিণাম ভালো নয়। হে কাফেরগণ, সুখ বা গর্ব অনুভব কোরো না। তোমাদের শেষ বিচার বেশি দূরে নয়। সার্বিক ধ্বংস ঘনিয়ে আসছে। আমাদের হাতের তরবারির দ্বারা বিজয়ীর বিশেষ শিরোপা অর্জন করব। এর পরের ঘটনা ইতিহাস। জিন্নাহর প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ফলশ্রুতি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস এবং নোয়াখালির হিন্দু নিধনের বর্বরতা সমগ্র বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছিল। এই দুটি ঘটনার ভিতরই অশনি সংকেত খুঁজে পেয়েছিলেন আম্বেদকর এবং শ্যামাপ্রসাদরা। আম্বেদকর বলেছিলেন, ‘একথা সন্দেহাতীত যে, সংখ্যালঘু বিনিময়ই হচ্ছে শান্তি স্থাপনের স্থায়ী প্রতিকার। সেই সঙ্গে আম্বেদকরের এই দাবিও ছিল পঞ্জাব এবং বাঙ্গলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে (দ্রষ্টব্য : পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক— অমলেন্দু দে)।
আম্বেদকর মনে করতেন, হিন্দুমুসলমানের একটি জাতি হিসেবে বেড়ে ওঠার আশা দুরাশা মাত্র। আম্বেদকরের মতে, বিগত কয়েকশো বছরেও ভারতবাসী একটি জাতি হিসেবে গড়ে ওঠেনি। সুদূর ভবিষ্যতেও ভারতে হিন্দু-মুসলমান মিলে একটি জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে— সে আশা করা বৃথা। (দ্রষ্টব্য : পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক অমলেন্দু দে)।‘পাকিস্তান অর দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে আম্বেদকর মুসলমান ধর্মীয় বিধান এবং অনুশাসন, ভারতে মুসলমান আক্রমণকারীদের নৃশংস অত্যাচার এবং মুসলিম লিগের জন্ম থেকে শুরু করে চল্লিশের দশক পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে বোঝাতে চেয়েছিলেন, কেন মুসলমান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মূল ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে চান না।
গান্ধী, নেহরু এবং কংগ্রেসের অবশ্য বাস্তব পরিস্থিতিটি বিচার করে দেখার কোনো সদিচ্ছাই ছিল না। খিলাফত আন্দোলনকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে তুলে ধরে গান্ধী অবশ্য এর অনেক আগেই একটি মারাত্মক ভুল করে ফেলেছিলেন। মুসলমান মন জয় করতে গিয়ে কার্যত মুসলমান মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে বসেছিলেন গান্ধী। গান্ধীর সেই সময়ের এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ। বলতে গেলে এই খিলাফত আন্দোলনই কিন্তু মুসলিম লিগের স্বতন্ত্র পাকিস্তানের দাবিকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছিল। গান্ধী এবং কংগ্রেস তাদের এই অত্যধিক তোষণ নীতির কারণেও স্বাধীনতার প্রাক্লগ্নে সংখ্যালঘু বিনিময়ের আবশ্যিকতা। বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, বা বলা ভালো বুঝতে চাননি। আম্বেদকর এবং শ্যামাপ্রসাদরা যখন সংখ্যালঘু বিনিময়ের প্রস্তাব দিলেন, তখন গান্ধী বলেছিলেন, ‘লোক বিনিময়ের কথা আমি ভাবতেই পারছি না। আমি মনে করি ওটা সম্পূর্ণ অসম্ভব প্রস্তাব। জওহরলাল নেহরও আম্বেদকরের এই প্রস্তাবকে বিরক্তিভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এমনকী বাস্তব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে গিয়ে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসের পর গান্ধী বলেছিলেন— ‘এখন আমার নীরব থাকাই বাঞ্ছনীয়।… আমরা ভয়ে ভীত হয়ে পালিয়ে । যাই। এটা উচিত নয়। যারা পালিয়ে যায়। ঈশ্বরের উপর তাদের বিশ্বাস নেই। ঈশ্বর যখন অন্তরে আছেন, তখন পালিয়ে যাবার প্রয়োজন কোথায়? মানুষ যখন মারা যায়, তখন বুঝতে হবে ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই এটা ঘটে। আমাদের যদি কেউ পেটায় তখন বুঝতে হবে ঈশ্বরই এটা ঘটান’ (দ্রষ্টব্য : মহাত্মা গান্ধী নির্বাচিত রচনা)। নোয়াখালির গণহত্যার পরও নোয়াখালি পরিদর্শনে গিয়ে গান্ধী বললেন— ‘পাকিস্তান হওয়া না হওয়া নিয়ে ঝগড়া করতে আমি এখানে আসিনি। জনগণ চাইলে পাকিস্তান হবে, না হলে হবে না।’ ১৯৪৬ সালের ১২ নভেম্বর স্টেটসম্যান কাগজে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানতে পারা যায়, নোয়াখালিতে মুসলমানরা গান্ধীকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ওই একরোখা মনোভাব দেখেও গান্ধী বুঝতে চেষ্টা করেননি হিন্দুদের কপালে কী দুর্দশা লেখা আছে। বরং কিছু আজগুবি কথা তিনি বললেন– পূর্ববঙ্গে বসবাসরত হিন্দুদের উদ্দেশে। গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব নির্মল কুমার বসুর বক্তব্য থেকে জানা যায়, গান্ধী পূর্ববঙ্গের অত্যাচারিত হিন্দুদের উদ্দেশে বলেছিলেন, …অহিংস ধর্ম অনুসারে তারা আক্রান্ত হয়েও আক্রমণকারীকে আঘাত করবে না’ (দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশের ইতিহাস— রমেশচন্দ্র মজুমদার)। আসলে গান্ধীর ধারণা ছিল তিনি একাই ভারত ভাগ আটকে দিতে পারবেন। তাই বলেছিলেন—“আমি যতদিন বেঁচে আছি। ভারতভাগে সম্মতি দেব না। কিন্তু নেহরু-আজাদ-প্যাটেলদের চাপে ভারত ভাগ যখন আটকাতে পারলেন না, তখনও গান্ধী একবারও বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভাবলেন না পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুদের কী অবস্থা হবে। বরং, স্বাধীনতার পর পাকিস্তানকে ৫০ কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য অনশনে বসার মনস্থ করলেন।
কংগ্রেসের এই নীতিটিকেই আম্বেদকরের মনে হয়েছিল মুসলমান তোষণ। আম্বেদকর লিখেছিলেন— কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী হিন্দুদের নীতি হলো সহনশীলতা এবং রাজনৈতিক ও অন্য সুবিধাদান দ্বারা মুসলমান তোষণ। …আমার মনে হয় কংগ্রেস দুটো জিনিস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত, তোষণ ও নিষ্পত্তির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের ব্যর্থতা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তোষণের অর্থ হলো, যেসব আক্রমণকারী নির্দোষ ও নিরীহ মানুষের উপর খুন, ধর্ষণ, লুঠ এবং অগ্নিসংযোগের মতো কার্যকলাপে অভ্যস্ত তাদের দোষ উপেক্ষা করে তাদের উৎকোচ দিয়ে বশে রাখা। অপর পক্ষে নিষ্পত্তির অর্থ হলো একটি সীমারেখা টেনে দেওয়া যা কোনো পক্ষই অতিক্রম করতে পারবে না। তোষণ আক্রমণকারীর দাবি ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি কোনো সীমারেখা স্থাপন করে না। নিষ্পত্তি তা করে। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস এই কথাটি বুঝতে ব্যর্থ যে, সুবিধাদানের নীতি মুসলমানদের আক্রমণাত্মক মনোভাব বাড়িয়ে দিয়েছে এবং যা সবচেয়ে খারাপ তা হলো মুসলমানরা এই সব সুবিধাদানকে হিন্দুদের পরাজয় বরণের মানসিকতা এবং বাধা দেওয়ার শক্তির অভাব বলে বর্ণনা করে। এই তোষণ নীতি হিন্দুদের একই ভয়াবহ অবস্থায় ফেলবে যা হিটলারের প্রতি তোষণের নীতির পরিমাণ হিসাবে মিত্রশক্তিকে ভোগ করতে হয়েছিল’ (দ্রষ্টব্য : Dr. Babasaheb Ambedkar Writing & Speeches, Vol. 1)।
কংগ্রেসের এই আচরণকে নিন্দা করেছেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও। তিনি লিখছেন, যখন স্বাধীনতার পর পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ হিন্দু নরনারী লাঞ্ছিত, উৎপীড়িত ও সর্বস্বান্ত এবং চরম দুর্দশাগ্রস্ত হইয়া পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিল তখন পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন আরম্ভ হইল যে, যত সংখ্যক হিন্দু বিতাড়িত হইয়া পূর্ববঙ্গ হইতে পশ্চিমবঙ্গে আসিয়াছে, সেই সংখ্যক মুসলমানকে পূর্ববঙ্গে পাঠাইয়া পূর্ববঙ্গ হইতে বিতাড়িত নবাগত হিন্দুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হউক। ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল গান্ধীজীর কথার প্রতিধ্বনি করিয়া বলিলেন যে, ইহা ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাজ্যে অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে নির্দেশ দিলেন, পূর্ববঙ্গ হইতে উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় লওয়া বন্ধ করিতে হইবে। যে দুখানি চিঠিতে নেহরু এই অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন তাহা চিরকাল মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলালের দুরপনেয় কলঙ্ক ও নিষ্ঠুরতার চরম নিদর্শন বলিয়া গণ্য হইবে’ (দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশের ইতিহাস রমেশচন্দ্র মজুমদার)।
১৯৪৭-এ দেশভাগের ভিতর দিয়েই পাকিস্তানে হিন্দু নিধন শেষ হয়ে যায়নি। দেশভাগের অব্যবহতি পরেই ১৯৪৯ সালের আগস্ট থেকে ১৯৫০ সালের মার্চ অবধি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চলল। লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালি হিন্দু শরণার্থী এসে আশ্রয় নিলেন পশ্চিমবঙ্গে। পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের বিষয়টি যখন ব্যাপক আকার নিল তখন প্রধানমন্ত্রী নেহরু পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানকে দিল্লিতে আহ্বান জানালেন। লিয়াকত দিল্লিতে এলেন এবং সাতদিন দিল্লিতে অবস্থান করলেন। অবশেষে কার্যত নেহরুকে বোকা বানিয়েই একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে দেশে ফিরে গেলেন। এই চুক্তিটিই হলো ঐতিহাসিক নেহরু-লিয়াকত চুক্তি। এই চুক্তিতে বলা হলো— (১) উভয় সরকার নিজ নিজ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যাবতীয় নিরাপত্তার বিধান করবে। যাতে উভয় দেশের সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য না হন।
(২) ইতিমধ্যে যারা দেশত্যাগ করেছেন তারা নিজ নিজ দেশে যাতে ফিরে যান তার জন্য তাদের বোঝাতে হবে এবং উৎসাহিত করতে হবে। নেহর সানন্দে এমন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বসলেন কিন্তু বুঝলেন না, অত্যাচারিত হয়ে এদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া হিন্দুরা ফের পাকিস্তানে ফিরে গেলে আবার একইরকম অত্যাচারের সম্মুখীন হবেন। নেহরু এও বুঝলেন না, লিয়াকত তাঁকে দিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে গিয়ে প্রকৃত অর্থে পাকিস্তানের কুকীর্তি ঢাকা দিতে চাইছেন। তবে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, বি আর আম্বেদকর, শ্যামাপ্রসাদ এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। চুক্তির বিরোধিতা করে শ্যামাপ্রসাদ এবং ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ অভিযোগ করেছিলেন, নেহরু পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বাঙ্গালিশরণার্থীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। সংসদে শ্যামাপ্রসাদ এও বলেছিলেন, এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হবে সংখ্যালঘু বিনিময়ে এবং ভারত – পাকিস্তানের সীমানা পুনঃনির্ধারণ। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের এই প্রস্তাব মানেননি নেহরু। নেহরু বলেছিলেন—সংখ্যালঘু বিনিময় সম্ভব। নয়। আর সীমানা পুনর্নির্ধারণের অর্থ যুদ্ধ করা।
শ্যামাপ্রসাদের আশঙ্কা যে অমূলক ছিল — তা প্রমাণ হয় কয়েকবছরের ভিতরই। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসেন। তার আগেই পূর্বপাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে গিয়ে ভয় দেখাতে থাকে সেনাবাহিনী। হিন্দুদের ওপর নতুন করে শুরু হয় অত্যাচার। নেহরু-লিয়াকত চুক্তিকে পাকিস্তান কার্যতনিক্ষেপ করে বাজে কাগজের ঝুড়িতে। পূর্ব পাকিস্তানে আইন পরিষদের সভায় এর প্রতিবাদ করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সুতার। কিন্তু তাকে কট্টর ইসলামপন্থীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়। প্রমাণ হয়ে যায়, নেহরু পাক নেতাদের চিনতেই পারেননি।
গঙ্গা দিয়ে জল অনেক গড়িয়েছে। ১৯৬৪, ১৯৭০, ১৯৯২ অনেকবারই অত্যাচারিত হিন্দুরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ থেকে বারেবারেই প্রাণ হাতে করে এদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বাধীনতার প্রাক্লগ্নে যে বিশ্বাসঘাতকতা তাদের সঙ্গে কংগ্রেস নেতৃত্ব করেছিলেন, সেই ক্ষত সহ্য করেই বারে বারে তারা সীমানা পেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতের রাজপথে। অতীতের সেই দুরপনেয় কলঙ্ক মোছাবার একটি সুযোগ বোধহয় এসেছে আবার ভারতের সামনে। সুযোগ এসেছে এই হতভাগ্য হিন্দুশরণার্থীদের বুকে টেনে নেবার, তাদের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেবার, মর্যাদা দেবার।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.