লোমশ বলেন ডাকি ধৰ্ম্মের নন্দনে ।
শ্যেন-কপোতের কথা করহ শ্রেবণে ॥
এই বিতস্তা নদী শিবিরাজ্য দেশে ।
সারস সারসী ক্রীড়া করিছে উল্লাসে ॥
উশনীর নামে নৃপ আছিল তথায় ।
ৰঞ্জ অনুষ্ঠানে ইন্দ্র পরাভব পায় ॥
অগ্নি সনে যুক্তি করি অতি সঙ্গোপনে ।
শ্যেল ও কপোত রূপে ছলিতে রাজনে ॥
ধরিল কপোতরূপ দেব হুভাশন ।
দেবরাজ শ্যেন রূপ করিল ধারণ ॥
সভাতলে যজ্ঞে ব্র ঠী আছিল রাজন ।
শ্যেন ভয়ে কপোতক লইল শরণ ॥
ছদ্মবেশী কপোতক কহিল রাজায় ।
লইনু শরণ প্রভু রাথ ঘোর দায় ॥
সে অনেক কাল আগের কথা। কত কাল আগে? সেই যখন পৃথিবীর বুকে থেকে বৃহৎ বৃহৎ প্রাণী কুলের শেষ হয়েছে। মানুষ রাজা, গোষ্ঠী , কৌম গঠন করতে শিখেছে। প্রকৃতির উপাসনা করতে শিখেছে সেই সময়ের কথা।তখন লড়াই ছিল। কিন্তু মানুষ ছিল সরল। সরলতা তাদের শিশুর মত পবিত্র ও ধার্মিক করে রাখত।
উশীনর নামে এক প্রাচীন জাতি ছিল। যারা মধ্য পাঞ্জাব, গান্ধার এলাকায় বাস করতেন। তারা প্রায়ই মাদ্রাজ, কেকায়স, সিবিস ইত্যাদির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং তাদের এলাকাটির উল্লেখ পাননির গ্রন্থে পাওয়া যায়। প্রমাণ অনুসারে Vahikacountry এর অংশ ছিল।
সেই সময় নানা দেবতা, উজ্জ্বল নক্ষত্র, উপগ্রহের নামে বংশ বা গোষ্ঠী পরিচিত হত।সেরম ই এক বংশ ছিল চন্দ্র বংশ।খুব খ্যাতিমান বংশ। গোষ্ঠী, কৌম, এলাকা জয় করে সে সসাগরা পৃথিবীর রাজবংশ।সেই বংশের এক রাজা ছিলেন উশীনর । তিনি সেই সময় গান্ধারের রাজা ছিলেন।
তিনি ছিলেন ধার্মিক ব্যক্তি। ধর্ম পালনের জন্য তিনি জীবন দিতে পারতেন । তার সততা ও ধর্মের তেজের জন্য তিনি স্বর্গ ও পাতাল , দেব ও রাক্ষস সর্বত্র প্রশংসিত ছিলেন।
একদা দেবলোকে তাঁর ধর্মবল নিয়ে আলোচনা হল। দেবগন ঠিক করলেন যে রাজা উশনীরের ধর্মবলের পরীক্ষা নেবেন। তাহলেই প্রমাণিত হবে যা রটে তাই ঘটে নাকি পুরোটাই অতিরঞ্জিত।
দেবরাজ ইন্দ্র বললেন ” বেশ তবে তাই হোক। আমি নেব সেই ধার্মিকের পরীক্ষা। আপনারা কে আমাকে সাহায্য করবেন?”
দেবগন অগ্নি দেব কে নির্বাচন করলেন।” অগ্নি দেব আপনি জ্বালাময় কিন্তু পবিত্র। আপনি ঠিক ভুল নির্বাচনের যোগ্য। আপনিও আসুন।”
অগ্নি বললেন,” বেশ তাই হোক।”
“খাদ্য ও খাদকের বাস্তুতন্ত্রই শেষ কথা । বাঁচার জন্য উভয়ই লড়ে। উভয়ের লড়াই ধর্ম মতে সঠিক। বাঁচার অধিকার সবার আছে। আমি ইন্দ্র সেই খাদক হব। তুমি অগ্নি খাদ্য হবে। আমি হব শেন্য তুমি হবে কপোত। দেখি তিনি কেমন ধর্মবল প্রাপ্ত।”
দেবরাজ ইন্দ্র ও অগ্নিদেব তাঁর ধর্মনিষ্ঠার পরীক্ষা নেবার জন্য শ্যেন পক্ষী আর কপোতের রূপ ধরে তাঁর যজ্ঞস্থানে উপস্থিত হন।
জলা ও উপজলা নামের দুই নদীর( যমুনা ও বিতস্তা) তীরে এক যজ্ঞ শুরু করেন মহারাজ
উশীনর । তিনি তখন ব্যস্ত। এমত সময় তিনি দেখেন শ্যেন কপোতকে তাড়া করে আসছে যজ্ঞ স্থলের দিকে। ধরলে কপোত খাদ্য হয়ে যাবে।
শেন্য শিকারের জন্য আর কপোত প্রাণভয়ে সম্রাট উশীনরের উরুদেশে আশ্রয় নিল।
কপোত বলে উঠল ” হে মহারাজ আমি প্রাণ ভয় ভীত। এই শেন্য আমাকে হত্যা করবে। আপনি প্রবল ধার্মিক। আমাকে রক্ষা করুন। আপনি মহা, দানী, আর্তের সহায়, আমি আপনার শরণাগত । আমাকে সাহায্য করুন মহারাজ।”
শেন্য ছটফট করে উঠল। বলল “মহারাজ, ওর একার কথা শুনলেই হবে না।আমার কথাও শুনুন। আমি খুব ক্ষুদার্ত। ওই কপত আমার খাদ্য। আমাকে খাদ্য গ্রহণ করতে দিন।”
রাজা বললেন, ” শোন হে শেন্য, এই কপোত আমার শরণাগত। একে রক্ষাই আমার পরম ধর্ম।তোমার হাতে দিয়ে আমি পাপের ভাগিদার হতে পারব না। “
শেন্য বলল ” সে কথা ঠিক বটে। কিন্তু আমি ক্ষুদার্ত। আপনার ধর্মবলে এ বেঁচে যাবে। আমি খুদায় মারা পড়ব। কারণ আমার আর চলত শক্তি নেই। আমি আমার স্ত্রী সন্তানকে প্রতি পালন করি। আমি মারা গেলে তারাও অনাথ হবে ও মৃত্যু মুখে পতিত হবে। মাত্র এক কপোতের জন্য আপনি এটি গুলো প্রাণ নিতে পারবেন? আপনি তো নরক ভোগী হবেন….”
বাঁধা দিয়ে রাজা উশীনর বলে উঠলেন ” হে শেন্য , এর পরিবর্তে তুমি যা চাইবে আমি দেব।আমার সব নাও। কিন্তু এই নিরীহ কপোত কে প্রার্থনা করো না। এ আমার শরণাগত। বল কি চাও?”
শেন্য বলল, ” মহারাজ আমি খুব ক্ষুদার্ত। আমার মাংস চাই। ধনসম্পদ দিয়ে কি করব?”
রাজা বললেন, ” বেশ আমি তোমাকে মেষ, অশ্ব বা ছাগ উৎসর্গ করছি। তুমি খুদা মেটাও। “
শেন্য বললে,” আমি সামান্য পক্ষী। ওতো বড় জীবিত পশু হত্যা করব কি করে? আপনি ধরুন হত্যা করে দিলেন।এত মাংস খাব বা বহন করব কি করে? আমি ওই কপোত টিকে চাই বা ধরুন ওই কপোত সমান মাংস চাই। আপনি কি পারবেন যে উরুর মধ্যে লুকিয়ে আছে সেখান থেকে আপনি কি কপোত এর ওজন সমান মাংস আমাকে দিতে পারবেন?”
উশীনর সানন্দে রাজি হলেন প্রস্তাবে।
উশীনর তূলাদণ্ডের একদিকে কপোত রূপী অগ্নিকে রেখে আর এক দিকে নিজ হাতে নিজের মাংস কেটে ওজন করতে থাকেন। কিন্তু একি? এই টুকু ছোট কপোত, তার কতই বা ওজন হবে? এত ভারী? অগ্নির মায়ায় যতই মাংস দেন তবুও কপোতের ওজনের সমান হয় না । উরুদেশ থেকে হাড় বেরিয়ে আসে। তবুও কপোতের ওজনের সমান হয় না ।
তখন সম্রাট নিজেই তূলাদণ্ডে উঠে বসেন।
তার এই ত্যাগ দেখে ইন্দ্র ও অগ্নি আশ্চর্য হয়ে যান । এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে শেন্য রূপী ইন্দ্র চলে গেলেন।অগ্নি নিজ রূপ ধারণ করে বললেন,” আমার তোমার ধর্মবল দেখে হতবাক। তুমি কেবল একটি শরণাগত কে রক্ষার জন্য নিজেকে দিয়ে দিচ্ছিলে? আমরা সন্তুষ্টই নয়। বরং হতবাক। একাজ মানব দেহ ধারণ করে আমরাও করতে পারব না।”
ব্যথায় যন্ত্রনায় কাতর উশীনর অবাক হয়ে অগ্নির কথা শুনলেন। অগ্নি বললেন ,”মহারাজ তোমার এই ত্যাগ এর মহিমা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।তুমি হবে দৃষ্টান্ত। তুমি পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাও রাজা।”
উশীনর সুস্থ হয়ে উঠলেন। চারিদিকে তার এই ত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়ল। সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগল।নিজের থেকে প্রিয় মানুষের আর কিছু তেমন নয়, যে পরের জন্য নিজের প্রাণ ও দিতে পারে সেই ঈশ্বরকৃপা লাভ করে আর তাই পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ত্যাগ।
উশীনরের এই ত্যাগের কাহিনী রয়েছে বৌদ্ধ জাতক কাহিনীতেও।
ধনবল, অর্থ বল, জন বল এসবের থেকে শ্রেষ্ঠ হল ধর্ম বল।এই ধর্ম রক্ষার্থে যদি জীবন পন হয় তাও ত্যাগ করে তাকে রক্ষা করতে হয়। এই জীর্ন হিন্দু জাতি তা কবে আর উপলব্ধি করবে?
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃমহাভারত: বনপর্ব- পাণ্ডবাগ্রজ যুধিষ্ঠির এই উপাখ্যান লোমশ ঋষির কাছে শ্রবণ করেন