বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পূজনীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রী মোহন রাও ভাগবতের নাগরিক সম্ভাষণ

আজ এক বিশেষ পরিস্থিতিতে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই পর্দায় আপনাদের সাথে দেখা হচ্ছে। আজ করোনা মহামারী সমস্ত পৃথিবীকে আক্রান্ত করেছে। এই বিশেষ পরিস্থিতি প্রতিরোধের একমাত্র উপায় ঘরে বসে থাকা। আজকে সবাই আমরা কাজকর্ম ছেড়ে ঘরে বসে আছি। শাখা বন্ধ, শিক্ষা বর্গ বন্ধ, আমাদের সঙ্ঘের কাজও বন্ধ। কিন্তু যেরকম বাড়িতে বন্দি থেকেও জীবন চলছে, একই ভাবে সঙ্ঘের কাজও চলছে। সঙ্ঘের কাজ দেশ ও সমাজ এবং সমাজের ,মানুষমাত্রের ভালো করা। আমাদের কাজ হলে সেবার কাজ সেটা অব্যাহত। স্বয়ংসেবকরা বাড়িতে সময় মত প্রার্থনা করছে। এই পরিস্থিতিতে সঙ্ঘের কাজ প্রচন্ড ভাবে এগিয়ে চলেছে। আমাদের নিত্য কাজকর্ম এখন সেবার স্বরুপ নিয়েছে। আমরা বলেই থাকি, “একান্তে আত্মসাধনা, লোকান্তে সমাজ সেবা“, এই মূলমন্ত্র নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সমাজে অনেক ভালো মানুষ থাকে যারা সমাজের জন্য কিছু করে না। এটা যেরকম ব্যর্থ, সেরকমই সমাজে খারাপ লোক থাকে তারা কখনো কখনো হঠাৎ করে কিছু ভালো কাজ করে তবে সেটাও একইভাবে ব্যর্থ। আজকের এই পরিস্থিতিতে আমাদের পুরনো শিক্ষা আবার কার্যকরী হয়েছে যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজে ভালো হতে হবে, সমাজকেও ভালো করতে হবে

এই প্রসঙ্গে গল্প বলি, চীনের এক পরিব্রাজক ভারত থেকে তথাগতর শিক্ষা, নিজের দেশে নিয়ে যান। মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেটাকে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন, কিন্তু ছাপানোর আগেই ভূমিকম্পে ওখানে ক্ষয়ক্ষতি হয়। বই ছাপানোর টাকা ত্রাণের কাজে খরচ হয় । দ্বিতীয়বার আবার বই ছাপানোর আগে বিশাল বন্যা হয়। সংগ্রহীত টাকা বন্যাত্রাণে খরচ হয়ে যায়তৃতীয়বার টাকা সংগ্রহ করে বই ছাপানো হয়। তথাগতর বই পেয়ে প্রত্যেক মানুষ খুব খুশী এবং সেই বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা “এই বইটি তথাগতর শিক্ষার তৃতীয় সংস্করণ” অর্থাৎ প্রথম দুবার তথাগতর বাণীর বই ছাপা না হলেও ওনার শিক্ষা অনুসারেই কাজ হয়েছিল। তাই এই বই ওনার শিক্ষার তৃতীয় সংস্করণ। মানে প্রথম দুবার বই না ছাপিয়েও বইয়ের কাজই করা হয়েছে।

এই সময় আমাদের সেবার কাজ নিজের প্রতিপত্তি বা নিজের নাম বাড়ানোর জন্যে করাটা একদম অনুচিত। আমরা কোন কাজ নিজের খ্যাতির জন্যে করি না। প্রয়োজন হলে, নিরবে থেকে কাজের শ্রেয় অন্যকে দেওয়াই ভালো। এই কাজ আমাদের দেশের ও সমাজের, এখানে ব্যক্তিগত খ্যাতির কোন জায়গা নেই।

এখন নিরাশ হলে চলবে না। কখন লক ডাউন শেষ হবে, কখন আবার স্বাভাবিক হবে, এই সব ভেবে হতাশ, দুঃখিত বা কুন্ঠিত হওয়ার কারণ নেই। যতই বিষম পরিস্থিতি হোক তার মধ্যেই জীবনের সূত্র ও সন্দেশ লুকোনো থাকে। এই প্রসঙ্গে আপনাদের বলি, একজন ব্যক্তি হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। আত্মহত্যা করার সময় তার কাছে যথেষ্ট টাকা পয়সা ছিলো, যেহেতু সে মরতে চলেছে তাই সে সেটা খরচ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে পাশের গ্রামে জুয়া খেলে টাকা খরচ করার উদ্দেশ্যে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে ম্যাঙ্গানিজ খনি খোদাই এর কাজ চলছে। সে লক্ষ্য করে অনেকটা খোদাই হওয়ার পরেও ম্যাঙ্গানিজ না পাওয়াতে ব্যবসায়ীরা সকলে ওখান থেকে চলে যায়। সেই জমি কেউ কিনতে চায়না গর্ত হওয়ার কারণে, তখন সেই লোকটা ভাবে আমি তো টাকা ডোবাতেই এসেছি, তাহলে এই পরিত্যক্ত খাদানটাই কিনে ফেলি। খাদান কেনার পরে দেখলো যে ওখানের শ্রমিকদের সারা দিনের পারিশ্রমিক দেওয়া ছিলো। তাই শ্রমিকেরা জিজ্ঞেস করলো যে আমরা কি খোদাই চালু রাখবো না চলে যাব। সেই ব্যক্তি ভাবল যে টাকা যখন ডুবেই গেছে আর ওরা বাকি কাজটুকু করতে চাইছে যখন করেই ফিরুক। শ্রমিকেরা আরো তিন ফুট খোদাই করলো আর তারপরই ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া গেল। সেই ব্যক্তি এক নিমেষে হতাশা থেকে চরম আনন্দে পৌঁছে গেল। অর্থাৎ যেখানে সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলো সেই ব্যক্তি ওখান থেকেই কাজ শুরু করে মাত্র তিন ফিটের মধ্যেই সফলতা পেলো। এই গল্পটা রিডার্স ডাইজেস্টে বেরিয়েছিলো এবং শীর্ষক ছিলো “The difference between success & failure is just 3 feet
হতাশ হয়ে চেষ্টা বন্ধ করলে হবে না। ক্লান্তিতে পরিশ্রান্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিলে চলবে না।অবিরাম কাজ করে যেতে হবে। থামলে চলবে না। করে যেতে হবে এবং সবার জন্য করতে হবে।যারা পীড়িত প্রত্যেকে তারা আমাদের পরিজন। এক সময় যে ওষুধের রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল আজ ভারত তা অন্যান্য দেশকে দিচ্ছে। আমরা সবাইকে দেব। যারা চাইবে, তাদের সবাইকে দেব।কারণ এটা আমাদের স্বভাব।আমরা মানুষে মানুষে কখনো ভেদ করিনা।সকলে আপনজন।যে যে পীড়িত তাদের সর্বশক্তি দিয়ে সেবা করব।সেবা করার সময় কোনও অহঙ্কার বোধ আসবে না।কারণ সঙ্ঘ কখনো নিজেদের কীর্তির গুনগান করে না।কাউকে হারনোর জন্য আমরা কাজ করছিনা। বিশ্বে যারা কাজ করছেন, তাদের সকলকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করাই আমাদের শিক্ষা।সামগ্রিকভাবে সেবা কাজ করতে হবে। আপনজনের মত প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে কাজ করব। আমাদের ব্যবহারে এই স্বভাব যেন প্রকাশ পায়।সেবার কাজ যেন উৎকৃষ্ট হয়। আমরা কোনও উপকার করছিনা। আমরা আপনজনদের কাজ করছি। তাই সকল কাজ উত্তম হতে হবে। প্রেমময় হতে হবে।হনুমানের কাজ সম্পর্কে দেবতারা চারটি গুনের স্তুতি করেছেন। কাজ করার সময় দূতি, দৃষ্টি, মতি, দক্ষ অর্থাৎ দক্ষতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। জীবন গড়ে তোলার আশ্বাস দেওয়া। অনেক দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ সামান্য পরিস্থিতিতে কোন নিয়ম অনুশাসন মানতে চায় না। তাদের এখন বেশী করে মনে হতে পারে যে তাদের সাথে অন্যায় হচ্ছে। যেখানে অনুশাসন পালন হচ্ছে সেখানে করোনার প্রভাবকে আটকানো যাচ্ছে ও যেখানে অনুশাসন পালন হচ্ছে না সেখানে আটকানো যাচ্ছে না। এরকম অসামাজিক তত্ত্বগুলোকে প্ররোচনা আর উস্কানি দেওয়ার মত অশুভ শক্তিরা অনেক বেশী সক্রিয়। এরকম অশুভ শক্তির থেকে আমাদের সজাগ ও সাবধান থাকতে হবে

   এই প্রসঙ্গে বলি বিদুরের নীতি আমাদের মনে রাখতে হবে। বিদুর ছটি দোষ উল্লেখ করেছেন যা সাফল্যের পথে বাধা। যথা, নিদ্রা, তন্দ্রা, ভয়, ক্রোধ, আলস্য এবং দীর্ঘসূত্রিতা। এটা নিশ্চয় নিদ্রার সময় নয়। আর তন্দ্রা মানে নিজের কোনো কাজে এমনভাবে লীন হয়ে যাওয়া নয় যে বুদ্ধি, বিবেক শিথিল হয়ে যায়। সেটাও এখন করা যাবে না। আর আলস্য, দীর্ঘসূত্র দেখানো যাবে না। কেন না লক ডাউন সময় মত হয়েছে। সরকার নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। ভয় আর ক্রোধ করলে বিপত্তির শক্তি বাড়ে। সেই ক্ষতি থেকে আমাদের নিজেদের বাঁচাতে হবে।কিছু মানুষ এই কোয়ারেন্টাইনকে তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। কিছু  দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ আছে, তারা এদের উস্কাচ্ছে।কিন্তু আমাদের ভয় ও রাগ করলে চলবে না। কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোকের জন্য সমস্ত সম্প্রদায়কে দোষী করা ঠিক হবে না।এই পরিস্থিতিতে ভারত তেরে টুকড়ে হোঙ্গে, এরা সম্মিলিতভাবে প্রয়াস করে চলেছে।আমাদের কারও জন্য মনে দ্বেষ ও প্রতিক্রিয়া রাখা চলবে না ।সব সমাজে দুর্বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ আছে। তারা যাতে  আমাদের ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য সচেতন থাকার সঙ্গে সঙ্গে সেই সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সেই সমাজের অনুশাষিত এবং ভাল মানুষদের সহযোগিতা করতে হবে। কেন না তারাও ভারত মাতার সন্তান এবং আমাদের ভাই। আর ওরাও এই বিপত্তিতে দেশ সমাজের ভালটাই চাইছে।এই প্রসঙ্গে আমরা সাধুদের নির্মম হত্যা দেখেছি। এই দুঃখকষ্ট আমাদের মনের মধ্যে থাকবে।এ একটি বিরাট চক্রান্ত। যার জন্য বিশ্বহিন্দু পরিষদ এবং সন্ত সমাজ আগমী ২৮এপ্রিল একটি প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে। তাদের সাধুবাদ জানাই। এই দুর্গম পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে আর অফুরন্ত ধৈর্য্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমি নিহত সাধুদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী ব্যক্ত করে আমার বক্তব্যে পরবর্তী অংশে যাচ্ছি।

আজকের এই ব্যতিব্যস্ত সময়কে বাধা হিসেবে না দেখে নতুন সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। যেরকম, এক সময় স্কুল আবার খুলবে। তখন আমাদের এই পরিস্থিতিতে শেখা জিনিসগুলো অব্যাহত রাক্ষতে হবে। যেমন সোশ্যাল ডিস্টানসিং, ছোট ছোট ক্লাস করে দূরে দূরে বসিয়ে পড়ান যায় কিনা। কল কারখানা বাজার আবার খুলবে। তখন আমরা দেখবো নতুন করে অর্থ ব্যবস্থা আমরা কি করে শুরু করতে পারি।  আমাদের নিজেদের উদাহরণ দিয়ে মানুষের নতুন জীবন গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করতে হবে।এই পরিস্থিতিতে আমরা যা অনুভব করেছি, যেমন নিজের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, যোগ, প্রাণায়াম, আয়ুর্বেদ,নিজেদের পারিবারিক মূল্যবোধ ইত্যাদি তা দিয়ে আমাদের এই রাষ্ট্র পুনর্নির্মানে সহযোগিতা করতে হবে।ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আজকের মূল মন্ত্র হচ্ছে স্বাবলম্বন। স্বাবলম্বনকে নিয়েই আমাদের এখন কাজ করতে হবে।যে কলকারখানা থেকে শ্রমিক বাদ হয়েছে, তারা কি সেই কাজগুলো আর ফিরে পাবে?  তাহলে এই মানুষজনকে জীবন জিবিকার কি উপায় হবে?সেজন্যই আমাদের নতুন করে স্বদেশির ভাবনা চিন্তা নিয়ে এগুতে হবে। যেগুলি একদম প্রয়োজনীয় সেখান থেকে শুরু করতে হবে। নিজের দেশের তৈরি করা জিনিস,  যুগ সম্মত উচ্চমানের পদ্ধতির ভিত্তিতে নতুন অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নিজের সামর্থ নিজেকেই গড়তে হবে। এই সংকটের সময়ে দেখছি জলবায়ু পরিবেশ কিভাবে দূষণ মুক্ত হয়েছে। নতুনভাবে শুরু করার সময় পরিবেশকে পুনরায় দূষিত করা চলবে না। জৈবিক ও গোসম্পদ ভিত্তিক কৃষি, গ্রামভিত্তিক উৎপাদন, পরিমিত ভোগ যা আমাদের শাশ্বত ধ্যান ধারণা সেটা দিয়ে পুনরায় সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ শুরু করতে হবে। পরিবেশ রক্ষা আর গ্রাম উন্নয়ন একই সিকির এপিঠ আর ওপিঠ।এই মূল্যবোধ আমাদের উঠে দাঁড়াবার শক্তি যোগাবে।পারিবারিক জীবনও অনেক ভাল হয়েছে। নাগরিক অনুশাসনের মাত্রা অনেক বেড়েছে। ভগিনী নিবেদিতা বলেছিলেন স্বাধীনতার অর্থ সমাজ দেশ নিজেই অনুশাসিতভাবে চলবে। ডঃ আম্বেডকারও সংবিধাণ সভায় নিজের ভাষণে মানুষের নিয়ম ও আইন মেনে চলার উপযোগিতা উল্লেখ করেছেন।

  এমতাবস্থায় আমাদের কাজ দেশ, সমাজকে এই নতুন স্বচ্ছতা, অনুশাসন বজায় রাখা আর  জীবনযাপনের মানকে উন্নত করা।আমাদের আত্মবিশাসই আমাদের জগতগুরু হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে।আজকের এই সংকট’কে  আমাদের সুযোগ হিসেবে গ্রহন করতে হবে।এই সুযোগ আমাদের এক নতুন দিন ও ব্যবস্থা গড়ার সন্ধিক্ষন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন ভারত গড়ার এটা আমাদের স্বপ্ন। সেটা পূরণ করার এটাই শুভ লগ্ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.