বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাইসিনা উঠোনে শপথ বাক্য পাঠ করছেন প্রাক্তন বিদেশ সচিব তথা কেরিয়ার ডিপ্লোম্যাট জয়শঙ্কর সুব্রহ্মণ্যম। আর অদৃশ্য ব্যাকড্রপে তখন যেন ভেসে উঠছে অন্য একটি মুখ। যে মুখ বলে দিতে চাইছে, আরে! এ তো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। আঠাশ বছর পর ফের এমন হল।

অদৃশ্য পর্দায় যে মুখ ভেসে উঠছিল, তিনি কিন্তু বাস্তবেও রাইসিনার উঠোনে কাল ছিলেন। দর্শাকসনের প্রথম সারিতে সনিয়া গান্ধীর পাশে বসেছিলেন তিনি,- মনমোহন সিংহ।

রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে কেন্দ্রে সংখ্যালঘু কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরসিংহ রাও। সমসাময়িক কংগ্রেসি নেতারা বলেন, রাওয়ের মন্ত্রিসভার নাকি মুখ বেছেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তবে রাও নিজে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর অর্থমন্ত্রীকে। দেশ যখন চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলছে, নরসিংহ রাও তখন তুলে এনেছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর মনমোহন সিংহকে। আর্থিক উদারীকরণের পথে মনমোহনই নিয়ে গিয়েছিলেন দেশকে। রাজনৈতিক বাধা অতিক্রম করে, মুক্ত অর্থনীতির উপর ভর দিয়ে, বৃদ্ধির পথে ফিরে সেই আসা কিংবদন্তীর মতোই। এখন, এতদিন পরেও সেই সাফল্য-গাঁথা অমলিন। নরসিংহ রাওকেও তারিফ করে অনেকে এখনও বলেন, জহুরির চোখ ছিল ওঁর।

মোদীর চোখও তেমনই কিনা সময় বলবে। কিন্তু তিনি মন্ত্রিসভায় নিয়ে এলেন এমন এক কূটনীতিককে যিনি আবার সাফল্যের ছাপ রেখেছিলেন বিদেশ মন্ত্রকে। সে দিনের মনমোহনের তুলনায় আজ জয়শঙ্করের গুরুত্বও কম নয়,- বিদেশমন্ত্রী। মন্ত্রিসভায় বিগ ফোরের সদস্য।

জয়শঙ্করের সঙ্গে মোদীর সখ্য প্রায় এক দশকের। ২০১১ সাল। তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। জয়শঙ্কর সে সময়ে ছিলেন চিনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। কূটনৈতিক দৌত্যে বেজিংয়ের প্রশাসন ও চিনা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ সারির নেতাদের সঙ্গে মোদীর বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। চিনের বেশ কিছু শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের ব্যবস্থাও করেছিলেন জয়শঙ্কর। তার ফলে গুজরাতে চিনা বিনিয়োগেও জোয়ার এসেছিল।

২০১১ সালে মোদীর চিন সফরের সময়

এ হেন জয়শঙ্কর কূটনীতিতে বরাবর চৌখস। নিজে দক্ষিণ ভারতীয় হলেও দিল্লিতে পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠার জন্য ঠেঁট হিন্দিতে কথা বলতে পারেন। প্রথমে এয়ারফোর্স স্কুলে পড়েছেন। পরে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে। বেজিংয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসাবে দীর্ঘতম সময় ছিলেন তিনি। প্রায় সাড়ে চার বছর। তাই চিনা ভাষায় চোস্ত কথা বলতে পারেন। একই ভাবে রাশিয়ানও বলতে পারেন গড়গড় করে।

২০১৩ সালে মনমোহনও চেয়েছিলেন তাঁকে বিদেশ সচিব করে তুলে আনতে। কেন না ভারত মার্কিন পরমাণু চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করতে আমেরিকায় তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রণেন সেনকে খুবই সাহায্য করেছিলেন জয়শঙ্কর। কিন্তু কংগ্রেসের ক্ষমতার অলিন্দে তখন পাল্লা ভারী ছিল সুজাতা সিংহের। শেষমেশ জয়শঙ্করকে আমেরিকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছিলেন মনমোহন।

ওদিকে ব্যক্তিগত স্তরে মোদীর সঙ্গে জয়শঙ্করের সম্পর্কে ততদিনে আরও গাঢ় হয়েছে। তা স্পষ্ট বোঝা গেল চোদ্দর নির্বাচনের পর। কেন্দ্রে সরকার গড়েই আগে সুজাতা সিংহকে মেয়াদ শেষের আগেই বিদেশ সচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেন মোদী। পরিবর্তে জয়শঙ্করকে বিদেশ সচিব করেন তিনি।

নয়াদিল্লির কূটনীতিকদের কথায়, তার পর থেকে ভারতের বিদেশনীতির পথ প্রদর্শক এখন দু’জন। এক জন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। যিনি অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। দ্বিতীয় জন জয়শঙ্কর,-যিনি ভারসাম্যের কূটনীতির পক্ষে এবং দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কে যিনি বারবার বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বাণিজ্যের সম্প্রসারণে।

বিদেশ সচিব পদে দেড় বছর আগে মেয়াদ শেষ হয়ে যায় জয়শঙ্করের। কিন্তু নয়াদিল্লির কূটনীতিকদের মতে তার পরেও সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের কথায়, মোদীর প্রথম পাঁচ বছরের মেয়াদে জয়শঙ্করের সাফল্য কম নয়। প্রথমত, কূটনৈতিক ভাবে নয়াদিল্লির কাছে যে দেশগুলির গুরুত্ব কমে গেছিল, তাদের সঙ্গে বন্ধু সম্পর্ক বাড়ানো। রাষ্ট্রপুঞ্জে নয়াদিল্লির অবস্থানকে মজবুত করা। সন্ত্রাস দমনের প্রশ্নে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলিকে কূটনৈতিক ভাবে নয়াদিল্লির পাশে আনা। বিশেষ করে সৌদি আরবের মতো রাষ্ট্রকেও। তা ছাড়া ডোকালাম জটিলতার সময় যখন অজিত ডোভাল বেজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের উত্তাপ বাড়িয়ে ফেলেছিলেন, তখন তা প্রশমিত করে আনার নেপথ্যেই ছিলেন জয়শঙ্কর।

বিজেপি-র অনেক নেতার মতে, পুলওয়ামা পরবর্তী সময়ে ঘোষিত ভাবে জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। জয়শঙ্করের কূটনীতিতেও তা প্রাধান্য পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্য পদ অর্জনই হবে মুখ্য লক্ষ্য। তা ছাড়া কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয় দুটি এবার আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

শঙ্খদীপ দাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.