কাশ্মীরে স্বাভাবিক অবস্থার প্রত্যাবর্তন জরুরি

কাশ্মীরে দীর্ঘ বিতর্কিত ৩৭০ ধারা বিলোপের খবরে সারা ভারত খুশি হয়েছে, সবরকম ভাবে এই ঘটনাকে সাদরে মেনে নিয়েছে। কাশ্মীর কিন্তু এখনও নানাবিধ বাধা নিষেধের মধ্যে নাগরিক জীবনযাপন করছে। সেখানে কারফিউ অনেক জায়গায় বলবৎ রয়েছে। আমি যখন বড়ো হয়ে উঠছিলাম তখন এখনকার প্রযুক্তি চালু ছিল না। কিন্তু আজ আমি এগুলি ছাড়া বেঁচে থাকার কথা ভাবতে ঘৃণা বোধ করি। ইন্টারনেটে টিকিট কাটতে পারব না, প্রয়োজনে e-mail করা যাবে না তা সে বন্ধু হোক বা আত্মীয় বা কোনো জরুরি কাজ কোনোটাই নয়। ব্যবসা থাকলে গ্রাহক বা অন্যান্য সহযোগীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকা তো আজকের দিনে জীবন বিপর্যস্ত করে তুলবে। জীবন যাপনের গুণগত মানও নেমে যাবে।
যদিও এটা ঠিক অতীতে কাশ্মীরে প্রায়শই ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। পাতিদার আন্দোলনের সময়, গুজরাটে গুজ্জর বিক্ষোভের সময় রাজস্থানে উত্তেজনা বাড়তে না দেওয়ার কারণে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এগুলি সবই ছিল অত্যন্ত সাময়িক, মাত্র কয়েকদিনের জন্য। কাশ্মীরে কিন্তু তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত আন্তর্জালহীন। এই অবস্থা নিশ্চয়ই বেদনাদায়ক। যদিও এই অবস্থা কবে স্বাভাবিক করা হবে তা নির্ভর করবে স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর মতামতের ওপর, তবু আমরা চাইব অতি দ্রুত নিষেধাজ্ঞাগুলি উঠে যাক।
এত কথা বলার পর কিন্তু এটাও বলা দরকার কিছু ভারত-বিরোধী পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ইংরেজি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরাও গোটা পরিস্থিতির গতি প্রকৃতি না বুঝে কাশ্মীরে সরকার পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে বলে রব তুলে দিতে চাইছেন। ভারত সরকারের হাতে এছাড়া কি অন্য কোনো বিকল্প খোলা ছিল ? হ্যা এ বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা ও সাম্প্রতিক অতীত ঘটনাবলীর দিকে নজর ফোরানো উচিত।
উপত্যকার একজন সন্ত্রাসবাদী বুরহান ওয়ানি ২০১৬ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়। বুরহান বয়সে তরুণ, সুদর্শন,বলিয়ে কইয়ে, সংবাদমাধ্যমে সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ব ছিল। ওয়ানি প্রায়শই তার অন্য সন্ত্রাসবাদী বন্ধুদের হাতে অত্যাধুনিক রাইফেল শোভিত হয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ছবি পাঠাতো। বন্ধুরাও সকলেই মেশিনগান নিয়েই ছবি আদান প্রদান করত। এর ফলে তার কিছু অনুরাগীও জুটেছিল। কিন্তু তার ফলে একটা জিনিস তো কোনোভাবেই বদলায়নি যে সে একজন সন্ত্রাসবাদী ছিল। তার হিংসার পথ নেওয়ার কোনো নিজস্ব যুক্তি নিশ্চয় থাকতে পারে কিন্তু তার সমর্থনে সে হিংসার পথ ধরেছিল। এই কারণেই মুখোমুখি সংঘর্ষে সে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। যা বিশ্বের যে কোনো দেশের সন্ত্রাসবাদীরই অন্তিম পরিণতি। কিন্তু জনপ্রিয়তার টানে কাশ্মীর উপত্যকায় তার শোকমিছিলে দু’লক্ষ লোক জড়ো হয়েছিল। গোটা অঞ্চল জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিরাপত্তারক্ষীদের সংঘর্ষে নামতে হয়। শতাধিক লোক মারা যায় ও ১৫ হাজার মানুষ আহত হয়। কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি না থাকায় শয়ে শয়ে বুরহান সমর্থক একজোট হতে থাকে। তারা ভারত-বিরোধী স্লোগানের সঙ্গে অত্যন্ত আপত্তিকর, উত্তেজক মন্তব্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাজারে ছড়িয়ে দেয়। সেসব দেখেশুনে বুরহান সমর্থকদের একটা অংশ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। পাথরের আঘাতে বাহিনীর বহু জওয়ান মারাত্মক আহত হয়। পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
পরিণতিতে অবস্থা আয়ত্তে আনতে কারফিউ জারি করা হয়। কাশ্মীরে ইন্টারনেট পরিষেবা ৫০ দিনের জন্য বন্ধ থাকে (হা, ঠিক এখনকারই মতো আপৎকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল)। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কয়েক মাস লেগেছিল। এই ঘটনা নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর টনক নড়িয়ে দেয়। যদি বিশেষ কোনো ঘটনার কারণে হিংসা শুরু হয় সেক্ষেত্রে তার মোকাবিলা করতে পর্যাপ্ত পূর্বপ্রস্তুতি রাখতেই হবে। ৩৭০ ধারা নাকচ হওয়ার পর বাহিনী ঠিক সেটাই করেছে। যার ফলে বুরহানের মৃত্যুর পর যে পর্যায়ে হিংসা ছড়িয়েছিল, প্রাণহানি হয়েছিল, এবারে তার কিছুই ঘটেনি।
তাহলে, যদি ধরা যায় যে নির্দিষ্ট ওই এলাকাটির দেখভাল বা হেফাজত আপনার দায়িত্বে রয়েছে সেক্ষেত্রে আপনি কী করা ঠিক মনে করবেন? ইন্টারনেট কানেকশান খুলে দেওয়া নাকি আপনার চারপাশে নির্বিচারে মানুষ খুন হতে দেওয়া? নিশ্চয় এমন পরিস্থিতির কোনোটাই আপনি চাইবেন না। আমরাও আশা করব অনতিবিলম্বে ইন্টারনেট চালু হয়ে যাক। কিন্তু ইন্টারনেটের প্রত্যাবর্তনের থেকেও কাশ্মীরে স্বাভাবিকতা ফেরানো ভীষণ জরুরি। বাস্তবিক এ এক অদ্ভূত পরিস্থিতি। যদি কোনো সন্ত্রাসবাদীর অন্তিমযাত্রায় দু’ লক্ষ লোক সহযাত্রী হয়। তাদের সকলকেই নিশ্চয় সন্ত্রাসবাদী বলা যাবে না। তাহলে এখানে কী করা উচিত? খুব কঠিন সিদ্ধান্ত। বেশি সংখ্যায় জড়ো হয়েছে বলেই তাদের সেন্টিমেন্ট অনুযায়ী হিংসাত্মক কাজকর্ম দেখে হাত গুটিয়ে রাখবেন, না প্রশ্রয় দেবেন? আগামী কয়েক বছর ধরে ভারত সরকারকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বাড়তি পরিশ্রম করতে হবে। একদিকে নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর সক্রিয় হওয়ার লক্ষণরেখা তৈরি করা ও কাশ্মীরিদের মনে রক্ষীবাহিনীর ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তোলা। অন্যদিকে তরুণদের জন্য আকর্ষণীয় প্রকল্প চালু করে তাদের মূল স্রোতের শরিক করা। কিন্তু কাশ্মীরিদের বিশ্বাস অর্জন করতে গিয়ে কোনোভাবেই চিরকালীন কোনো তোষণবাদী নীতি গ্রহণ করার রাজনীতি চলবে না। বলা ভালো গোটা কাশ্মীরের জনসংখ্যা মোট ১ কোটি ২০ লক্ষ। এর মধ্যে কাশ্মীর উপত্যকাবাসীর সংখ্যা ৭০ লক্ষ। ১৩০ কোটি লোকসংখ্যার দেশের পটভূমিতে এই সংখ্যাটি নিতান্তই নগণ্য। তাই যদি আমরা দেশের সম্পদের কিছুটা বাড়তি হলেও এই সমস্যার হাল করতে খরচ করি মনে হয় তা বিফলে যাবে না। আমার প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার ৫টা বিষয়ে চেষ্টা করতে পারে।
(১) যে সমস্ত কাশ্মীরি তরুণ চাকরি করতে ইচ্ছুক তাদের চাকরির বন্দোবস্ত করা। সরকারের কলসেন্টারগুলিকে ওখানে। স্থানান্তরিত করা যেতে পারে। নতুন পরিকাঠামো নির্মাণ ও পর্যটকদের জন্য skiresort তৈরি করা। মনরেগায় যে ধরনের কাজ দেওয়া হয় তাকে বিভিন্ন ভাবে ভাগ করে লোক নিযুক্ত করা।
(২) সমস্ত সন্ত্রাসবাদী ও তাদের সমব্যথীদের এ যাবৎ করা যাবতীয় অপরাধমূলক কাজ মাফ করে দিয়ে একেবারে আনকোরা অবস্থা থেকে শুরু করা। এই সূত্রে একটি নতুন তারিখ ঠিক করে তারপর থেকে পাথরবাজি, সন্ত্রাসবাদী লিফলেট ছড়ানো, অস্ত্র তুলে নেওয়া, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে নাম লেখানোর মতো কাজ বেআইনি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ তোমার অতীত ক্রিয়া-কলাপের জন্য তোমাকে দাগি করে দেওয়া হবে না কিন্তু তোমাকেও ভবিষ্যতে সঠিক পথে চলতে হবে।
(৩) আগামী কয়েক বছর ধরে যতদিন তারা চাকরি পাচ্ছে তাদের মাঝে মাঝে একটি নির্দিষ্ট ভাতা দেওয়া। পকেটে টাকা থাকলে লোকে কম রাগবে। কিছুটা নিরাপত্তা (অর্থনৈতিক) বোধ করবে। তারা ভবিষ্যৎ জীবনটাকে সুন্দর করে তুলতে সচেষ্টহবে। এর ফলে তাদের সন্ত্রাসবাদীদের পথ বেছে নিতে দ্বিধা আসবে।
(৪) সীমিত সময়ের জন্য কাশ্মীরিদের জন্য বহু ক্ষেত্রে কিছুটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। আমি কখনই জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ প্রথায় বিশ্বাসী নয়। কিন্তু এর ফলে যদি তাদের মনে আশার সঞ্চার হয় যে ভারত তাদের কাছে টেনে নিতে উদগ্রীব সেক্ষেত্রে এই ব্যবস্থায় কাজ হতে পারে। তাদের মোট সংখ্যা যেহেতু কম এর ফলে সামগ্রিক ভারতের ওপর তেমন চাপ পড়বে না।
শেষ দুটো প্রস্তাব শুনলে তোষণের রাজনীতি মনে হতে পারে। কিন্তু জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক সময় মানুষকে প্র্যাকটিকাল হতেই হয়। কাশ্মীরিরা ও একই সঙ্গে সরকার এতে উপকৃত হবে। কাশ্মীরে যদি শান্তি ফিরে আসে তাহলে প্রতিরক্ষা খাতে যে খরচ বাঁচবে তার তুলনায় এই খরচ তো কিছুই নয়। তাই যথার্থই এটি টান-টান পরিস্থিতি।
যারা যতই না না বলে চিৎকার করুক কেন কাশ্মীর ভারতের সঙ্গেই সম্পূর্ণ অঙ্গাঙ্গি হয়ে যাবে। কাশ্মীরি ও বাকি ভারতীয়দের মধ্যে বহুবিধ সাংস্কৃতিক বন্ধন রয়েছে। বহু দশক ধরেই ভারতীয় পর্যটকের প্রিয় ভ্রমণকেন্দ্র কাশ্মীর। ভারত বরাবরই একটি বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মিলনভূমি কাশ্মীরিরাও অচিরেই তার সঙ্গে যোগ দিয়ে মূলস্রোতে মিশে যাবে। ভারতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হিসেবে হবে তার অবস্থান। বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য বা পর্যটন প্রতিটি ক্ষেত্র থেকেই ওখানকার অর্থনীতি উন্নত হয়ে উঠবে।ইন্টারনেট খুলে দেওয়া তাই যেমন জরুরি, তেমনই কখনোও যেন আর ভবিষ্যতে বন্ধ করতে না হয়। সেটাও দেখা জরুরি।
চেতন ভগত
(বিশিষ্ট স্তম্ভলেখক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.