অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রাসঙ্গিকতা ও বর্তমান অবস্থা

আমাদের দেশে নাগরিকদের জন্য ব্যক্তিগত আইনে—বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ ও দত্তকগ্রহণ ইত্যাদি চলে বড় বড় ধর্মীয় গোষ্ঠীর নিজস্ব শাস্ত্র ও প্রথানুসারে। কিন্তু তার পরিবর্তে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ব্যক্তিগত ব্যাপারে অভিন্ন আইন বা বিধি চালু করার কথা সংবিধানের নির্দেশিকা নীতির ৪৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে—সংক্ষেপে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। বলতে তাই বোঝায়। আবার অনুচ্ছেদ ২৫-এ ভারতবর্ষে নিজস্ব ধর্মপালনের মৌলিক অধিকার আছে। এই দুটো একে অপরের বিরুদ্ধে যাবে না।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিতর্ক ঔপনিবেশিক ভারতেই শুরু হয়েছিল। তার আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথার সংস্কার সাধন করতে শুরু করেছিল। ১৮২৯ সালে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতের গভর্নর জেনারেল থাকার সময়ে সতীদাহ প্রথা রদ করার আইন ঘোষণা করেন। কিন্তু তারা ধর্মীয় ব্যাপারে বেশিদূর হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। বিশেষত ১৮৫৭-র মহা বিদ্রোহের পরে ১৮৫৯ রানির সনদে ধর্মীয় বিষয়ে একেবারে হস্তক্ষেপ না করার। কথা ঘোষণা করা হয়। কেবল অপরাধ, ভূসম্পত্তি, চুক্তি আইন ও সাক্ষ্যপ্রমাণ এইগুলো সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য ছিল।
শরিয়ত-নির্ভর মুসলিম পার্সোনাল ল’ মুসলমান মহিলাদের বিপক্ষে ছিল বিশেষত বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তির অধিকার ও পণনির্ণয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে। মুসলমান এলিট সমাজের চাপে ১৯৩৭-এর শরিয়ত আইন পাশ হয় যাতে বলা হয়েছিল বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, খোরপোষ, দত্তকগ্রহণ, উত্তরাধিকার এসব ব্যাপারে ভারতীয় মুসলমানরা শরিয়তি আইন মেনে চলবে।
নারীর স্বাধীনতা, সম্পত্তি, বিধবা অবস্থায় বিবাহ করা ইত্যাদি বিষয়ে হিন্দু ধর্মে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ছিল। বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রয়াসে ব্রিটিশ শাসক বিধবাবিবাহ আইন পাশ করে ১৮৫৬ সালে। ভারতীয় উত্তরাধিকার আইন ১৮৬৫-তে পাশ হয়েছিল, তা মহিলাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা বিধানের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে গণ্য হয়। সবই হিন্দুদের জন্য। ইন্ডিয়ান ম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৮৬৪ খ্রিস্টান মহিলাদের বিবাহ বিষয়ে পদ্ধতি ও সংস্কার সুনিশ্চিত করেছিল। বিবাহিত মহিলাদের সম্পত্তি আইন, ১৯২৩ ও হিন্দু ইনহারিট্যান্স (রিমুভাল অব ডিসএবিলিটিজ) অ্যাক্ট, ১৯২৮ হিন্দু মহিলাদের সম্পত্তির উপর অধিকার কায়েম করেছিলো। ১৯৩৩ সালে নারী সংগঠনগুলো তৎকালীন ব্যক্তিগত আইন বদলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার দাবি জানায়। হিন্দু মহিলাদের সম্পত্তি অধিকার আইন, ১৯৩৭ পাশ হয় তার থেকে বি এন রাউ কমিটি গঠন হয়; ওই কমিটি সিদ্ধান্তে আসে যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার সময় এসে গেছে। এই বিধি সমাজের আধুনিক প্রবণতা অনুসারে মহিলাদের সমানাধিকার দেবে তবে তার জোর ছিল শাস্ত্রানুসারে হিন্দু মহিলাদের অধিকার সুরক্ষার উপরে। রাউ কমিটি কয়েকবার তার রিপোর্ট দাখিল করে, শেষবার ১৯৪৭ সালে ভারতীয় সংসদে।
স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮-১৯৫১ ও ১৯৫১-১৯৫৪ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তার সমর্থক ও মহিলা সদস্যদের নিয়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চেয়েছিলেন। আইনমন্ত্রী আম্বেদকর এইরাউ কমিটির বিল পেশ করার দায়িত্বে ছিলেন। দেখা গেল যে গোঁড়া হিন্দু আইনগুলো একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ একবিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ও বিধবাদের। সম্পত্তির উপর অধিকার হিন্দু শাস্ত্রে আছে। আম্বেদকর অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার দাবি জানিয়েছিলেন। সর্দার প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ এই হিন্দু বিলের আপত্তি করেছিলেন। কারণ তারা দেখেছিলেন যে এই বিল ভীষণভাবে হিন্দু-বিরোধী ও ভারত-বিরোধী। তারা বলেছিলেন যে সব ধর্মের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চাই। তাই এই বিল কাটছাঁট করে ১৯৫৬ সালে চারটে আইন জারি হয়, হিন্দু বিবাহ আইন, উত্তরাধিকার আইন, নাবালক ও অভিভাবকত্ব আইন এবং দত্তক ও খোরপোষ। আইন। তখন ৪৪ অনুচ্ছেদ ঢোকানো হয় যাতে ভবিষ্যতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা যায়।
সাম্প্রতিক অবস্থা—ইন্দোরের এক মুসলমান মহিলা শাহ বানোর স্বামী মহম্মদ আহমে খান তাকে তিন তালাক দিয়ে। বিবাহবিচ্ছেদ ঘটায়। ১৯৮৫ সালে শাহ বানো ফৌজদারি বিধির ১২৫ ধারায় ইন্দোরের নিম্ন আদালতে খোরপোষের জন্য মামলা দায়ের করেন। তার স্বামী খান বলেন। শাহ বানো আর তার স্ত্রী নয় তাই সেইসলামি মতে যেটুকু পাওনা হয় তার অতিরিক্ত কোনো খোরপোষ দেবেন না আর সেসবের পরিমাণ হলো ৫৪০০ টাকা। শেষ পর্যন্ত মামলা শীর্ষ আদালত গ্রহণ করে। শীর্ষ আদালত কোনো ধর্মীয় নিয়মের উপর নির্ভর না করে কেবল ধর্মনিরপেক্ষ ফৌজদারি বিধির উপর ভিত্তি করে শাহবানের পক্ষে রায় দেয়।
এই মামলা কয়েকটি বিষয় সামনে আনে
মুসলমান মহিলাদের ও মুসলমান সমাজের অন্যান্য অংশের আকাঙ্ক্ষা ও প্রগতিশীল চরিত্র এতে বোঝা যায়।
মুসলমান মহিলাদের দুরবস্থা ও বিবাহের ব্যাপারে তাদের উপর যে পক্ষপাতদুষ্টতা কাজ করছে তা সকলের নজরে আনে।
সামাজিক ন্যায়নীতির জয় ঘোষিত হয়।
এটা ছিল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রচলনের দিকে একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটা নারীর অধিকার ও সমতার পক্ষে বিতর্ক তুলে দেয়। এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সুশীল সমাজ, ধর্মীয় গোষ্ঠী, আইনসভাসমূহ ও সাধারণ মানুষ। আর একটা গণতন্ত্রের পক্ষে বিতর্কের চেয়ে ভাল কিছু হয় না।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজ শোরগোল তোলে এবং তার জেরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নতিস্বীকার করে ১৯৮৬ সালে সংসেদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই রায় নাকচ করে বিল পাশ করান। যে তিন তালাকের বিরুদ্ধে এই খোরপোষ মামলা পরবর্তীকালে দেখা গেছে তা কোরাণ অনুসারী নয় অথচ তখন। এইরকম দাবি করা হয়েছিল বৃহত্তর মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে। আর অনুচ্ছেদ ৪৪-এর অন্তর্নিহিত ধারণা হলো কোনো সভ্য সমাজে ধর্ম আর ব্যক্তিগত আইনের মধ্যে কোনো বাধ্যতামূলক সম্পর্ক নেই। বিবাহ, উত্তরাধিকার ও অনুরূপ বিষয়গুলো ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতির আর আইন দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এবিষয়ে। বিচারপতি আর এম সহায়ের মন্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন—“আমাদের দেশ একটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র। সামান্যতম বিচ্যুতি এর সমাজবন্ধন শিথিল করতে পারে। কিন্তু যে ধর্মীয় অনুশীলন মানুষের অধিকার ও মর্যাদা লঙ্ঘন করে এবং ধর্মীয় নেতারা নাগরিক ও বৈষয়িক স্বাধীনতার শ্বাসরোধ করে সেটা কোনো। স্বাধিকার নয়, সেটা নিপীড়ন। সুতরাং নিপীড়িতদের সুরক্ষা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি উভয় কারণে একটা অভিন্ন বিধি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে।”
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি শেষ পর্যন্ত সাম্য আনবে। এটা লিঙ্গ সাম্য আনতে সাহায্য করবে, জাতীয় সংহতি আনবে ও সংখ্যালঘুদের মূলস্রোতে নিয়ে আসবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে প্রোৎসাহন জোগাবে। এই বিধির অন্তর্নিহিত প্রেরণা বুঝতে মানুষের মধ্যে একটা প্রগতিবাদী, প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। এর জন্য চাই শিক্ষা, সচেতনতা ও উদ্বুদ্ধকরণ। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি যেন সব ধর্মের কল্যাণসাধন করে।
মুসলিম পার্সোনাল ল’তে একতরফা বিবাহবিচ্ছেদ (সম্প্রতি এটা রদ করে বিল পাশ হয়েছে) ও বহুবিবাহের অনুমতি আছে। সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয় কোনো প্রগতিপন্থীর পক্ষে। গোয়ায় কিন্তু অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু আছে। ২০১৫ সালে ভারতের শীর্ষ আদালত অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে। ভারতীয় ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবি তুফাইল আহমেদ ২০১৬ সালে ৩০শে নভেম্বর এর ১২ দফা খসড়া পেশ করে বলেছেন ১৯৫০ সাল থেকে সরকার কোনো চেষ্টা করেনি। ২০১৮-র ৩১শে আগস্ট আইন কমিশন ১৮৫ পাতার পত্রে মত দিয়েছে যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এই পর্বে প্রয়োজনও নয় কাঙ্খিতও নয়, দেশের বহুস্বরকে অমান্য করা যায় না।
সম্প্রতি আরিফ মহম্মদ খান বলেছেন, “অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ৪৪ নং অনুচ্ছেদের দ্বারা বাধ্যতামূলক করা আছে। যেহেতু এটা সুবিচারসম্মত ও নির্দেশিকা নীতির অংশ সেহেতু রাষ্ট্রের পক্ষে এটা করা অবশ্য বাধ্যতামূলক। এজন্য যথাশীঘ্র মুসলমান নাগরিকরা কেন এগিয়ে আসবেন না তাদের ভুলগুলো শুধরে এক প্রগতিশীল উদার। মানবিক সমাজ গড়তে?
সুদীপ নারায়ণ ঘোষ

Uniform Civil Code in easy words by Anamika Tiwari Ji in Politically Perfect with Mini Krishna Ji. The Uniform Civil Code is a proposal in India to formulate and implement personal laws of citizens which apply to all citizens equally regardless of their religion, gender, and sexual orientation. Currently, the personal laws of various communities are governed by their religious scriptures.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.