।।চতুর্থ অংশ।।
গোধূলির আবিরে রাঙা অস্তায়মান লাল সূর্য। দিনের শেষে থেমে আসে চারপাশের কোলাহল। প্রকৃতিতে নেমে আসে অন্যরকম এক নিস্তব্ধতা। পশু-পাখি নীড়ে ফিরে যেতে থাকে। চরাচরে সর্বএই বিরাজ করছে এক অনৈসর্গিক নীরবতা। সূর্যের রক্তিম আলোর ছটায় প্রকৃতি যেন অনরকম রঙে নিজেকে সাজায়। কিন্তু আজকের সূর্য , আজকের বিকাল কেমন বিষন্ন। বিস্তৃত নদীতীর, সামনে কল্লোলিত নদী, আজ রক্তের আভায় রাঙ্গনো আকাশ—
সূর্যাস্তের সময় নির্জন নদীতীরে দাঁড়ালে এমন অধ্যাত্ন-ভাবনা ভেসে আসে মনে। দিবসের অবসান আর রাএির আগমনের এই পৃথিবী যেন মিলন-বিরহের খেলায় মেতে ওঠে। আকাশ আর মাটি যেন মুখোমুখি মৌনমুখর। ছায়াঢাকা অরন্য নিবিড় প্রেক্ষাপটে সূর্যাস্তের দৃশ্য ঘোমটা-টানা লাজুক বধূর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সামনে বিশাল জলরাশি,ওপরে রক্তিম উদার আকাশ,গোধূলি লগ্নে উন্মুক্ত নদীতীরে দাঁড়ালে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
নদী আর আকাশ যেন মিশে গেছে দিগন্তরেখায়। আজ সূর্য যেন কান পেতে শুনছে পৃথিবীর গোপন বিষাদের সুর। তারপর সেই অগ্নিগোলক যেন নদীর বুকে টুপ করে ডুবে গেল। আঁধারে কালো চাদর আচ্ছন্ন করল চারদিক। চরাচরে ঝিঁঝির শব্দ,জোনাকির টিপটিপ আলো,ঝিরিঝিরি বাতাসে সৃষ্টি হয় অদ্ভুত এক আবেশ।
সূর্য অস্ত গেল। শুক্রাশ্রমের গরুগুলি পর্যাপ্ত তৃন ভক্ষণ করে করে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকলে। জাবর কাটলো ।ইতিউতি চাইলো। আমাকে তারা দেখতে পেল না। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই পুরাতন অভ্যাস এর গরু গুলি আশ্রমে ফিরে এলো। অনেকক্ষণ পর এই ফেরার পথেই আমার প্রাণ সখী ঋষি কন্যার সঙ্গে আমার দেখা হয় । সেদিনও তিনি অধীর আগ্রহে বসে ছিলেন । তাঁর হৃদয়ে সহে না সে যাতনা। সারা বেলা, সারা দিবস, বিরলে একলা প্রহর গুনে গুনে বসে রইলেন শুধু পথপানে চেয়ে–. “সখা হে, এলে না। ” আমি ফিরলাম না।
রাখাল বালক কে কোথায় ফেলে গরু গুলি ফিরে এল? না না এ কিসের ইঙ্গিত? প্রমাদ গুনলেন ঋষি কন্যা। এমন তো হবার কথা নয় । চকিতে কন্যা শুক্রাচার্যের কাছে গেলেন, ” পিতা….পিতা … তোমার সায়ন্তন হোম তো শেষ হয়ে গেল ।সূর্য পাটে বসলেন। কতক্ষণহল আশ্রমে গরু গুলো ফিরে এল… কিন্তু পিতা কচকে তো দেখতে পাচ্ছি না ? – কচস্তত ন দৃশ্যতে।
আজন্ম শুক্রকন্যা অসুর সমাজের কাছাকাছি থেকে বড় হয়েছেন। তিনি যে দানবদের স্বভাব আঁচ করতে পারেন না , তা মোটেই নয়। ব্যাকুল হয়ে কেঁদে ফেলেলন কন্যা, ” নিশ্চয়ই কেউ তাকে মেরে ফেলেছে পিতা । কারণ সে দেবপুত্র ।অথবা এমন কোন কারণ ঘটেছে যাতে সে নিজেই মারা পড়েছে । “
কন্যা পায়ে পড়লেন পিতা শুক্রাচার্য এর , ” পিতা । যা কিছুই হোক । কচের এমন কিছু হয়ে গেলে , তাহলে সত্যি বলছি পিতা আমি কিন্তু বাঁচবো না….”
শুক্রাচার্য বিচলিত হলেন না। কারন তিনি সঞ্জীবনীবিদ্যা জানেন। তার কেবল কষ্ট হল তাঁ কন্যার জন্য । জন্মলগ্ন থেকে মেয়েটিকে তিনি একটুও কষ্ট দিতে পারেন না । মেয়েটির একটু কষ্ট সহ্য করতে পারেন না । দেবযানী তাঁর নিকট যেন সেই ছোট্ট আদরের কন্যা ।তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত করে শুক্রাচার্য বললেন,
” মাগো , শান্ত হও। যদি কোন ভাবে কচ মারা গিয়ে থাকে, তাতে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন ? আমি মহকাল মহাদেবের বর প্রাপ্ত। তিনি আমায় মৃতসঞ্জীবনী দান করেছেন ।তুমি চিন্তা করো না আমি সে মন্ত্র পড়ে জল ছিটিয়ে দেব। কচ বেঁচে উঠবে।”
অবাক হয়ে গেলেন দেবযানী। বললেন, ” পিতা আপনি তো সে মন্ত্র পড়ে কেবল অসুর কুলকে বাঁচাতে পারেন । দেবকুলকে কেমন করে বাঁচাবেন?”
শুক্রাচার্য বললেন, ” মহাদেব যে সঞ্জীবনী মন্ত্র দান করেছেন ,তা কেবল অসুর সমাজের উপকারের জন্য নয়। সেই মন্ত্র দিয়ে আমি দেব দৈত্য দানব প্রত্যেককেই বাঁচাতে পারি।”
কন্যার করুন অবস্থা দেখে শুক্রাচার্য আর দেরি করলেন না । শিবের পূজা স্থলে যজ্ঞ কুন্ড প্রজ্জ্বলন করলেন। হাতে কমুন্ডল হতে জল নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র পড়লেন। ডাক দিলেন ,” কচ ….হে দেবগুরু পুত্র কচ , হে আমার প্রিয় কচ তুমি দেবলোক বা যমলোক অথবা মৃত্যুলোক যেখানেই থাক আমার সম্মুখে জীবিত ও সুস্থ, নীরোগ শরীরের উপস্থিত হও।” শুক্রাচার্য এর কন্ঠ জলমন্দ্র মেঘের ন্যায় গুম গুম শব্দে সন্ধ্যা আঁধারের আরণ্যক নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে , ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলল। এরূপ তিন বার তিনি জল ছিটিয়ে ডাক দিলেন….
অমনি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এক হয়ে সম্পূর্ণরূপে আমি উপস্থিত হলাম সেই যজ্ঞ স্থলে। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে আমি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়নি। কি হয়েছিল আমার সম্পূর্ণ মনে ছিল। শুক্রাচার্য তাঁর আদরিনী কন্যার দিকে প্রশ্রয় চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন । আর গুরুতনয়া এই মুহূর্তে অন্যদিকে আমার মুখপানে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। যেন কত কত কাল পড়ে দোঁহের দেখা।
“তখন কাঁদি চোখের জলে
দুটি নয়ন ভরে–
তোমায় কেন দিই নি আমার
সকল শূন্য করে।”
অনেকখন কন্যা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন , “তুমি এত দেরী করলে কেন ?তুমি জানো আমি কত ভাবছিলাম তোমার জন্য ? কি হয়েছিল তোমার কচ? বল এক বার, কোথায় হারিয়ে ছিলে তুমি সখা?”
আমি বললাম, ” সখী আমার। গুরুদেবের নিমিত্ত সমধি কাষ্ঠ , ফুল চয়ন করে একটি বটের ছায়ায় বসে ছিলাম। বড় ক্লান্ত লাগছিল। দক্ষিণা বাতাস দিচ্ছিল শীতল মধুর। তোমার কথা মনে পড়ছিল। আমাকে বসতে দেখে আশ্রমে গরু গুলি আমার পাশে এসে বসল ।এমন সময় কিছু অসুরেরা এসে আমাকে প্রশ্ন করল- তুমি কে ? তোমার নাম কি? আমি বললাম – আমি বৃহস্পতি পুত্র ।লোকে আমাকে কচ বলে ডাকে। তারপর বললো আমার সঙ্গে তাদের কিছু কথা আছে। এরপর আমরা আমাকে তারা বনের গভীরে একান্তে নিয়ে গেল। তারপর কোথা হতে থেকে অনেক অস্ত্র আঘাত নেবে এল আমার শরীরের উপর ।আমাকে টুকরো টুকরো মেরে ফেললো। তারপর তোমার অনুরোধ, গুরুদেব আমাকে সঞ্জীবনী মন্ত্র পড়ে ডাকলেন ।আর আমি কোনমতে বেঁচে তোমাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পেরেছি- ত্বৎসমীপমিহায়াত কথনচিৎ প্রাপ্তজীবিত।”
সুন্দরী কেঁদে পড়লেন। ” কচ ক্ষমা কর। আমি সেই অসুর কুল কন্যা।”
“ছিঃ কন্যা কর কি? তোমার পিতা বেদঞ্জ ঋষি। তুমি এমন বল না। দেখ আমি তোমার জন্য কেমন সুগন্ধি পুষ্প এনেছি।।এস তোমার শৃঙ্গার করে দি…”
কন্যা সন্ধ্যার আঁধারে ম্লান জোৎস্নালোকে আমার বুকে মুখ লোকাল।
আমার চোখের চেয়ে দেখা, আমার কানের শোনা,
আমার হাতের নিপুণ সেবা, আমার আনাগোনা–
সব দিতে হবে ॥
হেথায় যে অসম্পূর্ণ ,
সহস্র আঘাতে চূর্ণ
বিদীর্ণ বিকৃত ,
কোথাও কি একবার
সম্পূর্ণতা আছে তার
জীবিত কি মৃত ,
জীবনে যা প্রতিদিন
ছিল মিথ্যা অর্থহীন
ছিন্ন ছড়াছড়ি
মৃত্যু কি ভরিয়া সাজি
তারে গাঁথিয়াছে আজি
অর্থপূর্ণ করি —
মৃত্যু । গভীর , নীল , শান্ত , শীতল মৃত্যু। সে আমার পিছু ত্যাগ করে নাই। নানা অসুর শিষ্য , বৃষপর্বার পরিচারক রূপে আমার সঙ্গে নিস্তব্ধ , লঘু পদে ভ্রাম্যমাণ ছিল। মরনের অনেক ফাঁড়া ছিল আমার। ঋষি কন্যাকে আমি তখন প্রাণাধিক প্রিয় করেছি। প্রত্যহ আমি তাঁর নিমিত্ত অরন্যের মধ্যে হতে কিছু না কিছু নিয়ে আসি।
সে যখন রাখাল বালক হয়ে ধেনু চরাতে যাচ্ছি , কোথা হতে ঋষি কন্যা ছুটে এল আমার কাছে…” কোথায় যাও দেব কুমার?”
” ধেনু চরাতে কন্যা…আদেশ কর কি বা আনি তব লাগি?”
” এখন তো ফাগ চলে গেছে। এখন বনের গভীরে কাঞ্চন ফুল ফোটে। আমরা ওকে পারিজাত কাঞ্চন বলি। এনে দেবে কুমার? “
” দেব। ফেরার পথে এনে দেব। তারপর সন্ধ্যায় তোমাকে সাজাবো।”
ঋষি কন্যা লজ্জায় ছুটে চলে গেলেন। আগে যখন শৃঙ্গার করে দিতাম কন্যার। তখন তিনি এত লজ্জা পেতেন না। কিন্তু এখন লজ্জায় রাঙা হয়ে যান। ভারী ভালোলাগে আমার। আমি ধেনু নিয়ে কন্যার কথা ভাবতে ভাবতে বনের পথে চললাম।
রুক্ষ দিন , বসন্ত যায় যায়, খর রৌদ্র , ধুলির ঝড় যেন এখনই মহাকালের পথে নিয়ে চলে যেন। সেইতো সেদিন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিতে এসেছিল শীত । আর আজ ঘরে বাইরে কোথাও শান্তি নেই। গাছে গাছে কত ফুল ফুটেছে তবু, আহা এই বসন্তে , এখন বসন্ত চলছে। আমি আজ ক্লান্ত হয়ে বসলাম একটি অশথ বৃক্ষের নীচে। দেবযানীর কথা ভেবে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম ….
সারাবেলা আকাশজোড়া খর দাবদাহ যেন সবকিছু পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিতে চায়। দিন পার করে আসে বিকেল তাপ কমতে থাকে কিন্তু এ যেন নিঃশেষ হওয়ার নয়। এ যেন চিরকালের এক মহা পরিতাপ মহা এক জ্বলজ্বলে অগ্নিকুণ্ড । বেলা ডোবার পরও বেশ খানিকক্ষণ তাপ বিকিরিত হতে থাকে মাটি থেকে, আর আশেপাশের প্রকৃতি থেকে। চকিতে আমার ঘুম ভাঙল। বেলাশেষে এবার আঁধার ঘনাবে। কন্যা আমাকে পারিজাত কাঞ্চন তুলতে বলেছিলেন।
এই প্রকৃতিতে হাটলে মনে হয় হেটে চলেছি কোন এক উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ডে। গাছপালা ক্রান্তিকালের স্বাক্ষী হয়ে থাকে। গাছ আমার নাগালের মধ্যেই । আমি ফুল তুলব বলে হাত দিয়েছি, কথা হতে অস্ত্র এসে আমার হাত কেটে ফেলল, তারপর আমার সারা দেহ টুকরো হল, শুকনো পাতা, সবুজ তৃন, আর বুনো ফুল আমার রক্তে রাঙা হল। অসুররা আমার দেহ পুঁটুলি করে নিয়ে জলে বিসর্জন দিলেন।
আমার প্রথমবার মৃত্যুর পর ,শুক্রাচার্য দানবদের কিছু বলেননি। তিনি যেহেতু মৃত সঞ্জীবনীর অধিকারী ,অতএব তিনি দানবদের আমার প্রতি এ ধরনের ব্যবহার কি মোটেই চিন্তিত ছিলেন না। তিনি এও জানতেন যে বৃহস্পতি পুত্রকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে দানবদের সঙ্গে তার কোন প্রকার কথা আপস-মীমাংসা হোক তা তিনি চান না। তিনি একজন বেদঞ্জ ব্রাহ্মণ। যাকে মন চাইবে শিক্ষা দেবেন। তিনি যেমন ছিলেন তেমনই আছেন ।
সন্ধ্যা নামল। ঝড় উঠল। বসন্তের শেষে এমন ঝড় ওঠে। দেবযানী দুয়ারে প্রদীপ জ্বালিয়ে আঁচল ঘিরে দাঁড়ালেন।
গোধূলিতে নামল আঁধার,
ফুরিয়ে গেল বেলা,
ঘরের মাঝে সাঙ্গ হল
চেনা মুখের মেলা।
দূরে তাকায় লক্ষ্যহারা
নয়ন ছলোছলো,
এবার তবে ঘরের প্রদীপ
বাইরে নিয়ে চলো।
আমি ফিরলাম না। আজ গুরু যজ্ঞ করে উঠেছেন। কন্যার চক্ষু ছল ছল। “কি হয়েছে মা গো? ”
“পিতা , তিনি যে ফেরেন নি। সেই যে ধেনু চড়াতে গেলেন। অভুক্ত ছিলেন। পিতা…”
পিতার বুকে কান্নায় ভেঙে পড়লেন দেবযানী। গুরুদেব জানতেন কি করতে হবে….যজ্ঞভূমিতে তিনি জল হাতে ডাক দিলেন আমায়…আমি ভূমিতে প্রনত হলাম গুরুর সুমুখে।
গুরু সব শুনে দানবদের উপর বড়ই অসন্তুষ্ট হলেন…
আমার মন মানে না– দিনরজনী।
আমি কী কথা স্মরিয়া এ তনু ভরিয়া পুলক রাখিতে নারি।
ওগো, কী ভাবিয়া মনে এ দুটি নয়নে উথলে নয়নবারি–
ওগো সজনি॥
দিন যায় রাত যায়। দেবযানী এখন ভয়ে আমাকে আর চক্ষের আড়াল করেন না। তবু গুরু গৃহের কর্ম আমাকে সম্পাদন করতেই হয়। আশ্রমে এটাই নিয়ম।এখন দেবযানীও আমার সঙ্গে পূজার কাজ করে, গান করে, আমাকে রুদ্র বীণা শেখায়।আমরা নৃত্য করি
“তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ–
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥
এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না। কিন্তু তৃতীয়বার যখন মৃত্যু হল তখন আমার জীবিত হওয়া ছিল অসম্ভব ।
সোমরস। সোমরসে আমার দেহ মিশ্রিত হয়েছিল। গুরু আমাকে গ্রাস করেছিলেন! যে গুরু পুত্র তুল্য করে শিষ্যকে ভালোবাসতেন সেই গুরু কেমন করে গ্রাস করেন ? যজ্ঞে সোমরস আহুতি দেওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য প্রচলিত ছিল। শুক্রাচার্যের ব্যাপার ছিল অন্য । তাঁর যেমন ছিল তেজ ,তেমন ছিল রাজকীয় সম্মান। বিশেষত তিনি অসুরদের উপাধ্যায়, আচার্য । অসুর কুলে থেকে তিনি সোমরস ও সুরাপানে উভয় পানে অভ্যাস করেছিলেন।
সেদিন বড় উত্তাপ ছিল প্রকৃতি জুড়ে। এখন আর বসন্তের নাহি আর। গ্রীষ্মের দাবদাহে অরন্য , জীবকুল ত্রাহি ত্রাহি রব করছে। দিন কেটে সন্ধ্যা হলে ঝড় আসে। প্রকৃতি শান্ত হয়। আমি ধেনু চড়িয়ে , ফুল কুড়িয়ে আশ্রম অভিমুখে মুখে চলেছি বনের পথে। ঝড় উঠেছে। অকস্মাৎ পিছন থেকে আমার মুখ কেউ চেপে ধরল। আমি নিজের আত্মরক্ষার জন্য নিরস্ত্র অবস্থায় বহুক্ষণ লড়লাম। কিন্তু পুনরায় অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হলাম। পথের মাঝেই আমার দেহকে অগ্নি দান করল। আমার দেহের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। ঝড়ের বাতাসে সে শিখা আরো আরো আরো ভয়ঙ্কর হল….আমি দগদ্ধ হয়ে ছাই হয়ে গেলাম।
আমাকে পুড়িয়েও শান্তি হল না অসুরদের। তাঁরা আমার ছাইভস্ম সোমরসে মেশাল।
গুরুদেব তখন হোম শেষ করেছেন। এমন সময় বৃষপর্বার পরিচারক হাতে পাত্র নিয়ে উপস্থিত হলেন গুরুর সম্মুখে। ” গুরু শুক্রাচার্য মহারাজ এই উত্তম মানের সোমরস আপনার নিমিত্ত প্রেরন করেছেন।আপনি গ্রহণ ও পান করুন।”
গুরু আমার ছাইভস্ম মেশানো সোমরস আকন্ঠ পান করলেন। কিন্তু তাঁর মন প্রফুল্লিত হবার পরিবর্তে কেমন বিষণ্নতায় ভরে উঠল….আমি তৃতীয়বার মারা গেলাম।
গুরুর কেবল মনে হল খুব প্রিয়জন যেন তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে অনেক দূরে। অনেক অনেক অনেক….গুরু পাত্র খানি রাজভৃত্যের হাতে দিয়ে কুটিরে প্রবেশ করলেন। প্রদীপ জ্বাললেন না।
সকল বেলা কাটিয়া গেল
বিকাল নাহি যায়।
দিনের শেষে শ্রান্তছবি
কিছুতে যেতে চায় না রবি,
চাহিয়া থাকে ধরণী-পানে,
বিদায় নাহি চায়।
সেদিনও সন্ধ্যা হল। এক বিষন্ন সন্ধ্যা। ঝড় উঠল। যেন কালের ঝড়। দেবযানীর তুলসিতলার প্রদীপ নিভে গেল। এক চিত্র। ব্রাহ্মণ রাখাল বাড়ি ফিরল না। অরক্ষিত গরুর দল নিজের পথ চিনে বাড়ি ফিরে এলো। গরুগুলো সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়। আজ যেন তারা খুব ভীত। গুরুকন্যার মন প্রমাদ গুনল…
গুরু কন্যা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পিতার কাছে ছুটে গেলেন। দেখলেন পিতার কুটির অন্ধকার… গুরুকন্যা কম্পিত কন্ঠে ডাকলেন , ” পিতা…পিতা…আপনি কোথায়? আপনার অধ্যয়ন কুটির এত অন্ধকার কেন ? “
অন্ধকার হতে শুক্রের কন্ঠ ভেসে এল , ” বল মা, কি বলবে? “
“আপনি অন্ধকারে….!পিতা? আপনি বলেছেন, গৃহ অন্ধকার থাকলে সন্ধ্যায় শ্রী ও মহাবিদ্যা দুজনেই চঞ্চল হন।”
“আজ আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত কন্যা। আলোর কোলাহল ভালো লাগছে না। তুমি কিছু বলবে ? “
অশ্রুসিক্ত ঋষি কন্যা বললেন , ” পিতা ,কচ আজ পুনরায় ফিরে আসেনি। সে গোচারণে গেলে আমি তাকে বুনো ফুল নিয়ে আসতে বলেছিলেম। কিন্তু ফুল নিয়ে সে ফেরেনি। পিতা নিশ্চয়ই তাকে কেউ পুনশ্চ মেরে ফেলেছে। তাকে ছাড়া আমি কেমন করে বাঁচবো ?”
“কচ ফেরেনি ? “
“না পিতা। “
প্রচন্ড ঝড়ের দাপট আর বজ্রপাতের শব্দে অরন্যভূমি কেঁপে উঠল। কন্যা দৌড়ে বাইরে গেলেন।
দুয়ারগুলি সব ভাঙল ঝড়ে, সব যে হয়ে গেল কালো, নিবে গেল দীপের আলো, আকাশ-পানে কন্যা হাত বাড়ালে কার তরে? কি অজানা অশনি সঙ্কেত দিল গুরু গৃহে ….
মনের কথা রেখেছি মনে
যতনে,
ফিরিছ মিছে মাগিয়া সেই
রতনে।
তুচ্ছ অতি, কিছু সে নয়,
দু চারি ফোঁটা অশ্রু ময়
একটি শুধু শোণিত-রাঙা
বেদনা।
দেবযানী সেই আঁধার রাতে , ঝড়ের বেলায়, আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টির মধ্যে আকুল হয়ে কেঁদে বসে পড়লেন। কন্যার মনের অবস্থা বুঝে শুক্রাচার্য পুনরায় মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র পড়লেন নিজের যজ্ঞ ভূমে বসে। বৃষ্টির তোড়ে যজ্ঞে র আগুন জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়। গুরু নিজের আত্মার সমস্ত শক্তি উজাড় করে আহ্বান জানালেন আমাকে।
আমি তখন কোথায় ? শুক্রাচার্য এটা উপলব্ধি করলেন না আমি বাইরে কোথাও নেই । সোমরস মিশ্রিত আমার দেহাবশেষ গুরুর নিজের উদরে অবস্থান করছে। সে ধারনাও করতে পারলেন না। গুরুদেব সঞ্জিবনী মন্ত্রের উচ্চারণ সত্বেও যখন আমি ফিরলেম না…. তখন শুক্রাচার্যের ধারণা হলো আমি মারা গেছি। মহাকাল হয়ত আমার সময় ওই অবধি নির্ণয় করেছিলেন। তিনি কাদা পাঁকে পড়ে পড়ে যেখানে কন্যা কাঁদছিলেন সেখানে গেলেন । পথের কাদা হতে কন্যাকে সস্নেহে তুলে বললেন – ” মাগো ,কচ সত্যিই মারা গেছে মা ….কি বা করি বল ? মহাকাল হয়ত তাঁর সময় ওই অবধি নির্ণয় করেছিলেন।আমার বিদ্যায় বারবার তাকে আমি বাঁচিয়ে তুলেছি। কিন্তু অসুর তাকে পুনরায় হত্যা করেছে । এ অবস্থায় আমি আর কি করতে পারি ? -কচঃ প্রেতগতিং গতঃ। বিদ্যয়া জীবিত’প্যেবং হন্যতে করবাম কিম?”
শুক্রাচার্য কন্যাকে সান্তনা দিয়ে বললেন ” তুমি আর কেঁদো না ….জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে? কেউ অমর হয় না। অমর হয় আত্মা। তাছাড়া অসুর দানবেরা যেভাবে দেবকুমারের প্রাণনাশের প্রচেষ্টা করছে, তাতে সত্যিই সেই ব্রাম্ভন যুবককে বেশিদিন জীবিত বোধহয় সম্ভব নয় ।”
গুরুকন্যা আর্তনাদ করে বললেন , ” আপনি কি বলছেন পিতা ? আপনি সেই ব্যক্তি যিনি স্বয়ং মহাদেবের হতে বিদ্যা প্রাপ্ত করেছেন। আপনি ভৃগু পুত্র। এমন কথা কেমন করে বলেন আপনি?”
নিশ্চুপ হয়ে রুদ্রাক্ষ হস্তে শুক্র গোপনে চোখের জল মুছলেন। কি উত্তর দেবেন তিনি বৃহস্পতিকে?
রাত্রি তখন দ্বিপ্রহর । কন্যা সেই মালতি লতার কুঞ্জে গিয়ে বসলেন। বার বার তাঁর হৃদয় কচের সঙ্গে কাটানো প্রতি মুহূর্ত আঘাত হেনে যায়। ঝড় থেমে গেছে বৃষ্টি হয়ে চলেছে অবিরল। গুরু তাঁর আত্মজার মাথায় হাত রাখলেন। দেবযানী অশ্রু কম্পিত কন্ঠে বললেন , ” যাঁর পিতামহ অঙ্গীরা , বৃহস্পতি যাঁর পিতা, যিনি দেবপুত্র, যিনি বিদ্বান , শুক্র যাঁর গুরু ,সেই কচ কে আমি কেমন করে ভুলব? তাঁর জন্য আমি না কেঁদে কেমন করে থাকবো ? – কথং ন শোচেয়ম অহং ন রুদ্যাম।”
দেবযানী স্মৃতিতে কচে র জন্য পূর্ব সম্বন্ধ ঘটনাগুলি বার বার স্মরণে আসতে লাগলো । দেবযানীকে বললেন , ” পিতা কচ আমাদের জন্য কি না করেছে? বলুন ? একজন আশ্রমবাসী হিসাবে গুরকুলের সব নিয়ম পালন করেছে। তপস্যার ক্লান্তি তো আছেই । এর মধ্যে তাঁকে যখন যা বলেছি তা কত দক্ষতার সঙ্গেই না করেছে। মনে রাখুন পিতা – কচ যে পথে গেছেন , আমার ও সে পথ । আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে চাই না। সে সে বিদ্বান সুপুরুষ এবং দেবপুত্র । তাঁকে আমি ভালোবাসি । – প্রিয়হি মে তাত কচো’ভিরূপঃ। “
কন্যার কষ্ট কান্না দেখে শুক্রাচার্য অসুর কুলের ওপর প্রচন্ড রেগে উঠলেন ।বললেন, “অসুররা নিশ্চয়ই আমার উপর বিদ্বেষ পোষণ করে। নইলে বারবার কেন আমার নির্দোষ শিষ্যটিকে মেরে ফেলবে? তারা এই ভাবে আমার সঙ্গে প্রতিকূল ব্যবহার করছে…. তার ফল তারা নিশ্চয়ই পাবে।”
শুক্রাচার্য এখন আমার জীবনের ব্যাপারে আশা ছেড়ে দিয়েছেন । বরং , যাঁরা আমাকে মেরেছে তাদের শাস্তি দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি নিজ আত্মজাকে কিছু শান্তি দিতে চান। অন্যদিকে অসুরকুলের ক্ষতি বৃদ্ধি নিয়ে দেবযানীর কোন চিন্তা নেই। তিনি নিজে বাঁচার জন্য আমার জীবন ভিক্ষা চান।
তখন বৃষ্টি থেমে মেঘ কেটেছে। পূর্ব দিগনতে রক্তিম আভা লেগেছে ।
দেবযানী কোন কথাই শুনছেন না। তখন গুরু প্রাতঃ স্নান , আহ্নিক করে এসে পুনশ্চঃ যজ্ঞভুমিতে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করলেন। গুরু তনয়াও স্নান সেরে শুদ্ধ হয়ে মহাকালের সম্মুখে বসলেন। শুক্রাচার্য আবার মন্ত্র পড়ে আমাকেকে আহবান করলেন। এবার মৃত সঞ্জীবনীর প্রভাবে শুক্রাচার্যের উদরের মধ্যেই আমি জীবিত হয়ে উঠলাম । চৈতন্য লাভ করে আমি গুরুর কথা শুনতে পেলাম বটে …কিন্তু গুরুর ক্ষতি হবে এই ভেবে আমি উদরের মধ্য থেকেই ধীরে ধীরে গুরুর উদ্দেশ্যে বললাম , ” গুরুদেব প্রণাম। আমি কচ ।আপনার উদরের মধ্যে থেকে কথা বলছি । লোকে নিজের পুত্রকে যেমন ভালোবাসে আপনি তেমন করেই আমাকে ভালোবেসে ক্ষমা করুন ।”
শুক্রাচার্য প্রমাদ গুনলেন। এ নিশ্চয় তাঁর দানব শিষ্যদের চক্রান্ত , এই আশঙ্কা করে কুক্ষিগত আমাকে বললেন, ” তুমি বলো সব। এই অসুরদের মেরে আমি আজ দেব পক্ষে যুক্ত হব।- গচ্ছামি দেবান অহমদ্য বিপ্র।”
আমি বললাম , ” প্রভু আপনার কৃপায় আমার স্মৃতিশক্তি এতোটুকু নষ্ট হয়নি ।সকল কথা বলছি। আমি তখন আমূলান্ত সব বললাম। কিভাবে দানবরা আমাকে মেরে পুড়িয়ে চূর্ণ করে সোমরসের সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রাচার্য্যকে পান করিয়েছেন।”
আমার কথা শুনে শুক্রাচার্য শিউরে উঠলেন। তারপর দেবযানীকে বললেন “কিভাবে তোমার প্রিয় সাধন করবো জানিনা মা ….আমি যদি মরে যায় তবেই কচ জীবিত হয়ে উঠতে পারে।কচকে যদি জীবিত করতে হয় তাহলে আমার পেট চিরে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে।”
দেবযানী পিতার কথায় ডুকরে কেঁদে উঠলেন, বললেন, ” যদি কচ মারা যায় তবে জীবনে আমার সুখ বলতে কিছু থাকবে না আর আপনি মারা গেলে আমি বেঁচে থাকতে পারবো না । একদিকে ভালোবাসার মৃত্যু অন্যদিকে পিতার মৃত্যু। এক চরম পরীক্ষা। যৌবনের সন্ধিক্ষণে কন্যা যাঁকে ভালোবাসেন তিনি যদি মারা যান তবে মানসিকভাবে সুখ পাবেন না। আর জন্মদাতা পিতা যদি কন্যার যৌবন সুখের জন্য প্রাণ ত্যাগ করেন তবে দেবযানী নিজের বেঁচে থাকাটা সমর্থন করবেন কিভাবে ?
মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে, জীবন হতেছে শেষ।
শিথিল কপোল, মলিন নয়ন, তুষারধবল কেশ।
পাশেতে আমার নীরবে পড়িয়া অযতনে বীণাখানি—
বাজাবার বল নাহিক এ হাতে, জড়িমাজড়িত বাণী।
গীতিময়ী মোর সহচরী বীণা, হইল বিদায় নিতে।
আর কি পারিবি ঢালিবারে তুই অমৃত আমার চিতে।
তবু একবার, আর-একবার, ত্যজিবার আগে প্রাণ
মরিতে মরিতে গাইয়া লইব সাধের সে-সব গান।
দুলিবে আমার সমাধি-উপরে তরুগণ শাখা তুলি—
বনদেবতারা গাহিবে তখন মরণের গানগুলি॥
দিনে দিনে সুখগান থেমে গেল এ হৃদয়ে,
নিশীথশ্মশানসম আছিল নীরব হয়ে—
সহসা উঠেছে বাজি তব করপরশনে,
পুরানো সকল ভাব জাগিয়া উঠেছে মনে,
বিরাজিছে এ হৃদয়ে যেন নব-ঊষাকাল,
শূন্য হৃদয়ের যত ঘুচেছে আঁধারজাল।
কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ।
এ দয়া তোমার, মনে রবে চিরদিন॥
“তবোপঘাতে জিবীতুং নাসমি শক্তা”
দেবযানী জানেন তাঁর পিতার অসীম ক্ষমতা। তাঁর পিতা সবপারেন। পিতার তপস্যা শক্তি আছে। গুরুকন্যা জানেন যে তাঁর কন্যার ক্রন্দনে বিগলিত হয়ে তাঁর পিতা কোনো কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন যাতে তাঁদের সকলের মঙ্গল হবে ।
শুক্রাচার্য কন্যার মনের অবস্থা সহজেই উপলব্ধি করেছেন। উপলব্ধি করেছেন – এক তরুণীর হৃদয় বাঁধা পড়েছে ভালবাসার বাঁধনে। ঠিক যেমন অনেক অনেক দিন পূর্বে জয়ন্তী ও তিনি বাঁধা পড়েছিলেন। গুরু সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে বাঁচাবেন অভিনব এক উপায় ।আমি গুরু শুক্রাচার্য এর শত্রু শিবিরের অন্যতম হলেও আমি আমার কঠিন তপস্যায় , আমার কাজে, আমার সেবায় শুক্রাচার্য কে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি । যে কারনে শুক্রাচার্য আমাকে আর অবহেলা করতে পারেন না । বিশেষত আমি এখন তাঁর উদরস্থ হয়েছি ।গুরুর ক্ষতি হবে এই উপলব্ধি করে আমি নিজেকে বাঁচার ইচ্ছা একবারও প্রকাশ করি নি। অতএব এই তো সময়…..
শুক্রাচার্য বললেন ,” হে তাপস, হে দেবগুরু পুত্র তোমার তপস্যায় আজ তুমি সিদ্ধিলাভ করেছ। ইহা ব্যতীত আমার একমাত্র আদরের কন্যা তোমাকে ভালোবেসেছে। অতএব এই উপযুক্ত সময় তুমি যখন সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করবে । – বিদ্যামিমাং প্রাপ্নুহি জীবনিং ত্বম।”
বস্তুত শুক্রাচার্য জীবন এখন আমার হাতে। মন্ত্র উচ্চারণের পূর্বে শুক্রাচার্য বললেন – ” তুমি নিজেকে আমার পুত্র বলে মন্যতা দিয়েছ। অতএব আমার দেহ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসার পর তুমি আমার প্রদত্ত সঞ্জীবনী মন্ত্র দিয়ে আমাকেই আবার জীবিত করে তুলবে । – পুত্র ভূত্বা ভাবয়ে ভাবিত মাম / অস্মদ্দেহাদুপনিস্ক্রম্য তাত। আমার প্রদত্ত মন্ত্র শিখে তুমি বিদ্বান হবে বটে। কিন্তু তাই বলে শিষ্যের ধর্ম থেকে বিস্তৃত হয় না ।আসলে একটাই মাত্র সম্ভাবনা আছে আমি শুক্রাচার্যের কুক্ষিভেদ করে বেরিয়ে এসে শুক্রাচার্য্কে জীবন দান নাই করতে পারি। তাতে দেবকুলের লাভ হবে। সঞ্জীবনীবিদ্যা কেবল তখন আমার মাধ্যমে দেবপক্ষেই থাকবে।
কিন্তু গুরু হিসাবে শুক্রাচার্য যে রূপ অন্য ধাতুতে তৈরি ছিলেন, তেমনি শিষ্য হিসেবে আমিও অন্য ধাতুতে গড়া । শুক্রাচার্য তাঁর চরম শত্রুপুত্রকে বরণ শিষ্য রূপে বরণ করেছিলেন। যে উদারতা তিনি দেখিয়েছিলেন , আজ সেই উদারতা ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। শুক্রাচার্য মন্ত্র উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে, আমি তাঁর কুক্ষিভেদ করে বেরিয়ে এলাম।
আমি দেখলাম ,আমার গুরু শুক্রাচার্য মাটিতে ছিন্নভিন্ন মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন আধ্যাত্ম জ্ঞানের এক প্রতিমূর্তি ভূমিলগ্ন হয়ে রয়েছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গেই মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্রপূত জল দিয়ে গুরুকে দ্রুত প্রাণ দান করলাম। নবলব্ধ সঞ্জীবনী মন্ত্র।
কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ।
এ দয়া তোমার, মনে রবে চিরদিন।
যবে এ হৃদয়মাঝে ছিল না জীবন,
মনে হ’ত ধরা যেন মরুর মতন,
সে হৃদে ঢালিয়ে তব প্রেমবারিধার
নূতন জীবন যেন করিলে সঞ্চার।
একদিন এ হৃদয়ে বাজিত প্রেমের গান,
কবিতায় কবিতায় পূর্ণ যেন ছিল প্রাণ—
তিনি জীবিত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুক্রাচার্য্যকে আমি বললাম – ” আপনার মত ব্যক্তি, যিনি আমার মত বিদ্যাহীন ব্যক্তির কর্ণে বিদ্যার অমৃত মন্ত্র জপ করেছেন তাঁকে আমি আমার পিতা মাতা দুই মনে করে থাকি। – ত্বয়ং মন্যেহং পিতরং মাতরঞ্চ… আপনার সঙ্গে কোনভাবেই আমি প্রতিকূল আচরণ করব না ।কারণ আমি জানি ,আপনি আমার কত উপকার করেছেন। – তস্মই ন দ্রুহ্যে কৃতমস্য জানন। “
শুক্রাচার্যের প্রতিভাশালী শিষ্য আমি জীবন ফিরে পেলাম। শুক্রাচার্য যৎপরোনাস্তি খুশি হলেন। মনে মনে নিজের ওপর হয়তো একটু ক্রুদ্ধ হলেন বটে। দানবদের তিনি যতই কটু কথা বলুন তাঁর সোমরস পানের অভ্যাস এর সুযোগ নিয়ে যে এই বিপত্তি ঘটেছে তাছাড়া আমি তাঁর প্রিয় শিষ্য উদরস্ত অবস্থাতেও তাঁকে বলেছিলাম – ” অসুরেরা আমাকে মেরে ফেলে পুড়িয়ে আপনার পানের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। আমি কি করে সেই আসুরি মায়া অতিক্রম করি? ” কথাটা শুনে শুক্রাচার্যের মনে লেগেছিল।
শুক্রাচার্য তার দানব শিষ্যদের ওপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। বারংবার আমার ওপর আক্রমণ হতে দেখে ক্রোধে তিনি দানবদের বলেছিলেন যে তিনি দেব পক্ষে যোগ দেবেন । কিন্তু আমার সম্পূর্ণ জীবিত হয়ে ওঠার পর অসুরকুলের ওপর তা গুরুর আর তেমন ক্রোধ রইল না। শুধু একবার তাদের ডেকে বললেন – “বাছারা ।তোমরা বড় মূর্খ ।তোমাদের বোকামিতে বিপক্ষের এই লাভ হলো । কচ সঞ্জীবনীবিদ্যা লাভ করেছেন। এখন তাঁর ক্ষমতা আমার সমান । তাছাড়া এখন কচ আমার নিকট বহুদিন থাকবেন । গুরুর কথা শুনে দানবরা হতচকিত হয়ে ফিরে গেলেন । গুরুদেব হয়তো তার কন্যার মুখের দিকে চেয়ে নিজে ভবনে আমার দীর্ঘতর আবাস কল্পনা করেছিলেন। হয়তো বা সঞ্জিবনী মন্ত্রের প্রয়োগ ও কৌশল আয়ত্ত করার জন্য আমিও বহুদিন আরো গুরুগৃহে রয়ে গেলাম…..হয়ত বা দেবযানীর সেই নির্মল পবিত্র প্রেম আমাকে সেই দানব সমাজে আটকে রাখল আরো বহুকাল।
তারপর সময় এলো ফিরে যাবার। আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। আমি গুরু শুক্রাচার্যের নিকট স্বর্গে ফিরে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম । আমার ব্যবহার, গুরু শুশ্রূষা তথা মন্ত্র গ্রহণের নিপুণতায় পরম সন্তুষ্ট গুরুদেব আমাকে স্বর্গে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার তো আমাকে সবচেয়ে কঠিন কাজটি সারতে হবে ।আমাকে যে একজন বিশেষজনের নিকট বিদায় নিতে হবে….কি করে করব সেই কাজ? এমন কঠিন হৃদয় তো আমার নয়….কি হবে উপায়?
ক্রমশঃ
দুর্গেশনন্দিনী