।। দ্বিতীয় অংশ।।
তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
আর সেই জয়ন্তীর কি হল?
এক লক্ষ্যে স্থির শুক্রাচার্য ধুম তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে যেদিন সঞ্জীবনী মন্ত্র পেলেন মহাদেবের কাছ থেকে সেদিন তার দৃষ্টি পরল জয়ন্তীর উপর …..কতকাল ধরে এই রমণী একাকী তাঁর ভোজন- শয়ন- জপ- তপস্যার ওপর নির্বাক দৃষ্টি রেখেছে । একদিনের তরে সে বলেনি আমি দেবকন্যা , আমি এই চাই আপনার প্রসন্নতার পরিবর্তে। শুধু প্রসন্নতাই যে তাঁর দিকে আজ ঘুরে দাঁড়ালেন শুক্রাচার্য ।
“কে তুমি ? তুমি কি কারো পত্নী ? কেনই বা তুমি আমার কষ্ট দেখে কষ্ট পাও? – কস্য ত্বয়ং সুভগে কা বা দুঃখিতে ময়ি দুঃখিতা? আমি কঠোর তপস্যায় মগ্ন, আর তুমি সব সময় আমাকে রক্ষা করে চলেছ। আমার প্রতি মমতায় আমাকে তুমি শুধু প্রশ্রয় দিয়েছো। আর তোমার দিক থেকে ছিল শুধু আত্মদমন, নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করা। আমি বড় খুশি হয়েছি। বল তুমি কি চাও? তোমার সমস্ত প্রার্থনা আমি পূরণ করব ?
প্রথমে নিজের পরিচয় দিলেন না জয়ন্তী । সলজ্জিত হয়ে বললেন, ” আমি কি চাই জানিনা ! আপনি আমার মনের কথা আপনার তপস্যায় জেনে নিন। আমি কি চাই ? “
শুক্রাচার্য তপস্যায় বসলেন, – স্মরণ করলেন প্রথম সেইদিন, যেদিন মধ্যাহ্নের সূর্যদগধ তাঁর মাথার ওপরে আঁচল বিস্তার করে দাঁড়িয়ে ছিলেন এই একাকী রমণী। একে একে ভেসে আসে জয়ন্তীর নানা চিত্রপট- শয়নে , বসনে অশনে আসনে, তাঁর উৎকত তপশচরণে তপস্বীনি এক রমণীর সদাজাগ্রত সুরক্ষার ছবি । কিন্তু কেন? কেন এই শুষ্ক রুক্ষ মুনির জন্য রমনীর এই রমণীয় মমতা?
শুক্রাচার্য উপলব্ধি করলেন। তবুও অভিনবা সুন্দরীর মুখে শুনতে ইচ্ছে হয়। সেই কথা যা বারবার উচ্চারণে লঘবতা প্রাপ্ত হলেও চিরতরে নূতন। শুক্রাচার্য বললেন , “আমি আমার মনশ্চঃখুতে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি তোমার মনের কি অভিলাষ…. তবু তুমি একবার স্পষ্ট করে বলো সে কথা। আমি শুনতে চাই ।তুমি যা বলবে আমি শুনবো। আমি করব।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী,
প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে,
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।
জয়ন্তী এবার বললেন নিজের পরিচয়, “আমি ইন্দ্রের কন্যা জয়ন্তী। জয়ন্তের কনিষ্ঠা ভগিনী ।আমি আপনাকে ভালোবাসি আচার্য ।আমি আপনার সঙ্গে সহধর্মিনী হতে চাই। আপনার সঙ্গে ধর্মের নিয়ম বিধি অনুসারে মেনে সংসারে মিলিত হতে চাই।”
রংস্যে ত্বয়া মহাভাগ ধর্মত প্রীতিপূর্বকম।
শুক্রাচার্য সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, ” বেশ তুমি আমার সঙ্গে সহধর্মিনী হয়ে কালাতিপাত করবে সবার অগোচরে। শুক্রাচার্য সম্মতা জয়ন্তীকে সসম্মানে গৃহে নিয়ে গেলেন। বিধিসম্মতভাবে পানি গ্রহণ করলেন।….
এবমুক্তা গহং গত্বা জয়ন্ত্যা পানিমুদবহন।
এদিকে দৈত্য দানবের মধ্যে হৈ হৈ পড়ে গেল । তাঁরা শুনেছেন, তাদের গুরু তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে ফিরে এসেছেন। মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা এখন শুক্রাচার্যের করায়ত্ত। তাঁরা সকলে ছুটে এলেন গুরুর বাড়িতে। কিন্তু কোথায় কি ?কোথায় গুরু? কোথায় বা সেই সঞ্জীবনী ? শুক্রাচার্য তখন মায়াবৃত্তে। অতএব শুক্রাচার্য্যকে অসুরেরা দেখতে পেলেন না। যেমন তাঁরা এ কথা শুনেছিলেন যে শুক্রাচার্য সিদ্ধিলাভ করে ফিরে এসেছেন, তেমনি একথাও শুনেছিলেন যে শুক্রাচার্য কাউকে ভালোবেসে বিবাহ করেছেন। তাই শুক্রাচার্যের সংসারে তাঁকে বিরক্ত করার সাহস পাননি । তাঁরা পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যখন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে চাইছেন । তাঁকে তখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
এরপর তাঁরা গুরুর গৃহের কাছাকাছিও আসেননি তাঁরা ভেবেছিলেন যে নিজের ইচ্ছায় তাদের কাছে আসবেন , সেদিন গুরু সঙ্গে তাঁদের দেখা হবে । অতএব তারা গুরুর অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ রইলেন।
দীর্ঘকাল তপস্যা করার পর শুক্রাচার্যের এই মুক্তি কামনা কোন অস্বাভাবিক কান্ড ছিল না। উপরন্তু জয়ন্তী কোনো জাল বিস্তার করেন নি। তিনি শুক্রাচার্যের ছন্দ চারিনি হয়ে ছিলেন।
দিন অতিক্রান্ত হতে লাগল। একদিকে দেবতাদের অপেক্ষা , একদিকে দানবদের। তাতে কি? এদিকে শুক্রাচার্য ও জয়ন্তীর একটি অসাধারণ সুন্দরী কন্যা জন্ম হল । কন্যার নাম হল দেবযানী। দেবকন্যার যোনী থেকে জন্ম, তাই নাম হয়েছিল দেবযানী – সময়ান্তে দেবযানী সদ্যোজাতা সুতা তদা।
কন্যার জন্ম হওয়ার পর, শুক্রাচার্য অসুরদের কথা স্মরণ করলেন। তিনি জানেন কি অসীম ধৈর্য নিয়ে দৈত্য ও দানব কুল তাঁর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন । তিনি জয়ন্তী কে ডেকে বললেন, “একবার শিষ্যদের দেখে আসি । তারা আমার ভক্ত।” শুক্রাচার্যের কথায় সম্মতি দিয়ে জয়ন্তী বললেন , ” আপনি যজমানদের দেখতে যাবেন । অসুরগুরু হিসাবে সেটাই আপনার ধর্ম ।আমি কখনো আপনার ধর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবো না । আপনি সচ্ছন্দে যান।
শুক্রাচার্য এদিকে অসুরদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন অসুররা সংযম পালন করেন নি । উপরন্তু তাঁরা এমন অনেক কাজ করেছেন সেগুলো হয়তো শুক্রাচার্যের অপছন্দের । বড় ক্রুদ্ধ হলেন গুরু। তাদের পরিত্যাগ করে চলে যেতে চাইলেন, সঙ্গে অভিশাপ দিলেন , “তোমরা যখন আমার কথা শুনলে না ।তখন তোমরা অবশ্যই হেরে যাবে ।আমাকে অবজ্ঞা করার ফল তখন বুঝতে পারবে।”
শুক্রাচার্য অভিশাপ দিয়ে চলে যেতেই দৈত্যরা তাঁদের ভুল বুঝতে পারলেন ।লজ্জায় অধোবদন জড়িয়ে ধরলেন শুক্রাচার্যের পদযুগল। গুরুর মায়া হল। কিন্তু তিনি অভিশাপ প্রত্যাহার করেননি। তবে ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ।
আর দেবযানীর কি হল?
বনকন্যার অঙ্গজুড়ে চিরল বিরল পাতা,
পুষ্প তাহার গোলাপি আভায় আদৃতা,
মুগ্ধ আমি যেই না ছুঁয়ে দিলেম তারে,
দেখলেম সে যেন লজ্জায় মরে মরে।
তাহার লজ্জা দেখিয়া নাম দিয়েছিলেম ত্রপিতা,
যদিও সকলেই জানে নাম তার লজ্জাবতী লতা॥
বনকন্যা দেবযানী। বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে তাঁর যদিও লজ্জা , সংযম ইত্যাদি লুপ্ত থেকে বিলুপ্ত হয়ে স্বভাব পাহাড়ি ঝর্ণার মত উচ্ছল, চঞ্চল, প্রজাপতির মত রঙিন , বিহঙ্গের মত মুক্ত হয়ে উঠেছিল। তপ্ত তাম্রবর্ণা অথবা রক্ত পদ্ম রঙ, দীর্ঘ আঁখি যুগল, দেবীর ন্যায় মুখমন্ডলী প্রাপ্ত, দেব মাতা অসুর পিতার কন্যা দেবযানীর হাঁসি পাখীর কলতানের ন্যায় অরন্যকে মুখরিত করে তুলত। তাঁর কলকল কথার শব্দ হাজার পাখির গুঞ্জনের মত মধুর অথচ আনন্দ পূর্ন ছিল। তাঁর আনন্দে বন ও আশ্রম যেমন উজ্জ্বল থাকত, তাঁর দুঃখে অভিমানে সকলে মুর্ছিয়ে যেত। বনবালা হয়ে অজানা ফুল সংগ্রহ করে সাজা তাঁর বড় প্রিয় কাজ ছিল। আর ছিল একটি প্রিয় কাজ, রুদ্র বীনা বাজানো। বীনার ঝংকারে কোন্ সুরে বেজে উঠে, কোন্ নব চঞ্চল ছন্দে… সেই ছন্দে অন্তর কম্পিত হত নিখিলের হৃদয়স্পন্দে ॥ আসে কোন্ তরুণ অশান্ত, উড়ে বসনাঞ্চলপ্রান্ত।.
পিতার বড় আদরের , বড় স্নেহের ছিল এই কন্যাটি। শুক্র পিতার সমস্ত আদর ও মমতা লাভ করে বড় হচ্ছিলেন কন্যাটি। সে স্নেহ এতই মাত্রা ছাড়া রকমের ছিল যে শুক্রাচার্য কন্যার সামান্য আল্লাদের জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন।
প্রসঙ্গত এ কথা বলে রাখি , শুক্রাচার্য যখন অসুরদের অভিশাপ দিয়েছিলেন তখন অসুরদের মুখপাত্র ছিলেন বৃদ্ধ প্রহ্লাদ। প্রহ্লাদের বহু অনুনয়তেও গুরু বলেছিলেন, ” আমার কথা মিথ্যা হবার নয় ” তবে অসুরদের গুরু উপকারে থেকে বিরত হন নি। দৈত্য দানব কুলের কারুর মৃত্যু হলেই সঞ্জিবনী মন্ত্রে বাঁচিয়ে তোলার কাজটি তিনি করে যেতেন সমানতালে।
প্রহ্লাদ ছিলেন পরম ও বিখ্যাত বিষ্ণু ভক্ত। তাঁর ভক্তির সাথে কেবল ধ্রুবর ভক্তির তুলনা চলে। প্রহ্লাদ ছিলেন দিতি কুল, যে কুল থেকে দৈত্যদের জন্ম।প্রহ্লাদ যখন দেখলেন তার বংশের স্বর্গ গৌরব আসতে দেরি আছে তখন তিনি থমকে গেলেন। এই সুযোগে দনুর ছেলে দানব কুলের প্রধান পুরুষ বৃষপরবা দানবদের নেতৃত্ব দিয়ে সুরঅসুরের সংঘর্ষ করেছিলেন।
বিষয় একটাই – তিন ভুবনের অধিকার। এদিকে বৃহস্পতি মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র জানতেন না। এর অধিকার ছিল একমাত্র দেবাদিদেবের। তিনি সেটুকু দিয়েছিলেন শুক্রাচার্যকে । যুদ্ধে মৃত অসুরদের বার বার গুরু শুক্র মন্ত্র পড়ে জীবিত করে তুলছিলেন। অসুরকুল ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল। শুক্রাচার্য নিকট হতে সেই সঞ্জীবনী মন্ত্র আহরণ করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ।
দেবগুরু বৃহস্পতির নিকট সুর কুল উপস্থিত হলেন। কি হবে উপায়? আমি বৃহস্পতির জ্যেষ্ঠ পুত্র কচ তখন নবীন। আমি তখন উদ্যমী। আমি তখন পিতার নিকট শাস্ত্র ও শস্ত্র চর্চার নবীন শিক্ষানবিশ। কিন্তু যুদ্ধের নিমিত্ত পিতার আমার গুরু হবার সময় নাই। সুরকুলপতি ইন্দ্র এলেন আমার নিকট। দেবতারা আমার কাছে এসে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। পিতা আদেশ দিয়েছিলেন যে ওই মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে আসতে হবে। যা জানেন ভগবান মহাদেব এবং শুক্রাচার্য । শুক্র ছিলেন অসুররাজ বৃষপ্বরবার এক মাত্র বুদ্ধি দাতা ।
একমাত্র আমিই সেখানে যেতে পারি। আমি তরুণ শুক্রাচার্য এর নিকট শিক্ষানবিশ হতে গেলে কেউ আমায় সন্দেহ করবেন না ।
তবে শুনেছি শুক্রাচার্য এর একটি পরমা সুন্দরী কন্যা আছে। তাঁর রূপ গুণের কথা ত্রিভুবন আমোদ করে। সেই কন্যা হতে আমাকে সাবধানে থাকতে হবে। সে বড় চঞ্চল উচ্ছল । সে কারুর বাঁধা মানে না। তাঁর পিতাকে বিমোহিত করতে গিয়ে নিজে বিমোহিত হলে বিপদ হবে। তাই সুরলোকবাসী বার বার আমাকে বলেছেন – ইন্দ্রিয়সংযম- আচরেন দমেন চ।নচেৎ সঞ্জীবনী বিদ্যা কোনো দিন আহরণ করা যাবে না।
তারপর….বন পেরিয়ে আমি পর্বতের যে পাহাড়ের চূড়ায় শুক্রাচার্য আশ্রম তথায় উপস্থিত হলাম। সেই আশ্রম দানব বৃষপর্বার রাজ্যের অধীন। আশ্রম বড় সুন্দর। ভারী অচেনা ফুলের সুবাস। পাখির শব্দ। কাছেই একটা খর স্রোতে ঝর্ণার শব্দ কানে আসছে। আর আসছে মহাশিব মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ….কেমন যেন আমি না জানি দেশের অজানা বনে এসে পড়েছি। কেমন যেন সেইমন্ত্র আমরা হৃদয় মন্দিরের মর্মর পবিত্র ধ্বনির ন্যায় গঞ্জরিত হতে লাগল….ওই তো শুক্রাচার্য। শিব লিঙ্গের সামনে পূজায় বসেছেন…
আছছা উনি কি আমার গুরু হবেন ? করবেন তাঁর শত্রু পুত্রকে শিক্ষানবিশ। নাকি অসুর কুলের মধ্যে ফেলে দেবেন? কি হবে?
ক্রমশঃ
দুর্গেশনন্দিনী