দিবানিশি ,প্রহর …. প্রতি মুহূর্তে মা ব্রহ্মময়ীর ধ্যানে বিভোর। প্রতি অমা নিশায় সেই প্রাতের আদিষ্ট মাতৃমূর্তির বিগ্রহ স্বহস্তে নির্মাণ করেন। রাতভোরে সেই বিগ্রহ পূজা, মাতৃধ্যানে বিভোর। মায়ের পূজা সাঙ্গ হলে গঙ্গাজলে পুনরায় মূর্তিকে বিসর্জন দেন। এই নিভৃত পূজা অনুষ্ঠিত হয় পরম শ্রদ্ধা ও শুদ্ধাচারের মধ্য দিয়ে। দেবীর পূজার উপচার ও উপকরণ সংগ্রহে ভক্তের কোনো উৎসাহের অভাব নেই।

পিতা মহেশ্বর ভট্টাচার্যের ধারাটি নিজ জীবনে অক্ষুণ্ন রেখে চলেছেন তিনি। নিজে আগম শাস্ত্রে সুপন্ডিত।

 পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ অঙ্ক…. নবদ্বীপ পন্ডিত সমাজে সাধক মহেশ্বর ভট্টাচার্যের তখন প্রবল প্রতিষ্ঠা। ধর্মনিষ্ঠ আচার্য ও তন্ত্রবিদরূপে তিনি সে অঞ্চলের সর্বত্র পরিচিত। মহেশ্বর ভট্টাচার্যের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল উত্তরবঙ্গ। মঙ্গলজানি মৈত্র হিসাবে এক সময় তাঁদের খ্যাতি প্রতিপত্তি কম ছিল না। নবদ্বীপে বাস করার পর, তন্ত্রশাস্ত্রে সুপন্ডিত বলে এই বংশের প্রসিদ্ধি বৃদ্ধি পায়। মহেশ্বর পন্ডিত আপন সুপান্ডিত্যের নিমিত্ত উপাধি পান গৌড়াচার্য। এহেন বিখ্যাত পন্ডিতের জ্যেষ্ঠ সুপুত্র হলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। 

কিন্তু তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সহস্রাক্ষ পরম বৈষ্ণব। পিতা বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মার্গের থেকে একেবারেই তিনি ব্যতিক্রম। আপন গৃহের একপাশে নিজস্ব এক ক্ষুদ্র কুটিরে নাড়ুগোপাল বিগ্রহ স্থাপন করে , তাঁর উপাসনায় দিবারাত্রি অতিক্রম করেন। 

শীতের অমানিশা তিথি , গভীর রাত্রে কৃষ্ণানন্দ শ্যামাপূজা করবেন। তাই সেই পুব কোণে যখনই একটু আলোক রেখা লেগেছে , তিনি গ্রাত্রোত্থান করে শুদ্ধ হয়ে পূজার উপাচার সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর হৃদয় বিগত রাত্রি থেকেই উৎসাহ উদ্দীপনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। পূজার উপকরণ সংগ্রহের নিমিত্ত আপন গৃহ সংলগ্ন উদ্যানের এদিক ওদিক ভ্রমণ করছিলেন। সহসা, লক্ষ্য করলেন নিকটেই পুরুষ্ট এক কাঁদি কলা বেশ পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। কলাগাছের পাতার আড়ালে আছে বলে প্রথমে চোখে পড়ে নি। এমন সময় এমন ভালো কলা সহসা পাওয়া যায় না।  কৃষ্ণানন্দের হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠল। মনে মনে ভাবলেন , ” অদ্য রাত্রে এই পাকা কলাগুলি আদ্যাশক্তির পূজা ও ভোগে উৎসর্গ করব। বিকাল নাগাদ কাঁদিটি কেটে নিয়ে যাব।”

শীতের বেলা দ্রুত হয়। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে দেখে কৃষ্ণানন্দ বাগানে এলেন, কলার কাঁদি পাড়তে হবে। কিন্তু একি অতো বড় একমানুষ সমান লম্বা কলার কাঁদি গেল কৈ? কে কেটে নিলে ? মনে বড় দুঃখ ও অনুতাপ নিয়ে হল তাঁর। মায়ের নামে প্রভাতে সংকল্প করা বস্তুটি আর মায়ের ভোগে দান করা গেল না।

ঘরে গিয়ে খোঁজ করতে জানতে পারলেন , ভ্রাতা সহস্রাক্ষ কদলীখানি তাঁর ইষ্ট বিগ্রহের ভোগে সবেমাত্র উৎসর্গ করেছেন। কৃষ্ণানন্দ অসন্তুষ্ট হলেন। তাঁর হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। কিন্তু ভ্রাতাকে কিছু না বলে ক্ষোভ মনে চেপে রেখে আপন গৃহের দ্বার দিলেন। 

অমাবস্যা তিথিতে মধ্যরাত্রে পূজাদি সমাপ্ত হল। কৃষ্ণানন্দ ধ্যানে বসলেন। কিন্তু ধ্যানে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। কেবল তাঁর মনে পড়ছে প্রভাতে দেখা আপনার উদ্যানের সুপক্ক কদলী কথা।  আপন গৃহের বস্তু মহামায়াকে উৎসর্গ করবেন বলে সংকল্প করলেন, কিন্তু তা দিতে পারলেন কৈ? জগন্মাতার ভোগে না লেগে তা লাগল তাঁর ভ্রাতার ইষ্ট গোপালঠাকুরের ভোগে ? 

ছোট্ট বাল গোপাল , তাঁকে এত আমল দেবারই বা কি আছে ? আপন ইষ্টদেবী ব্রহ্মময়ী শ্যামামায়ের নিকট এ যেন এক সদ্যোজাত শিশু। শক্তির সাধনাই তো প্রকৃত সাধনা , ভক্তিমার্গে সাধনা তাঁর নিকট চিরদিনই তুচ্ছ মনে হয়েছে। 

কৃষ্ণানন্দের হৃদয়ের ক্ষোভ , খেদ এখনো যায় নি। ধ্যানেও মন নেই। পূজাগৃহের কর্ম সম্পন্ন করে দুয়ার বন্ধ করে অঙ্গনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু একি? গোপালের কুটিরের প্রদীপ যেন সবেমাত্র প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। তার দীপশিখায় কুটির ও কুটিরের বাহির অঙ্গন আলোয় আলোয় আলোকিত। গভীর রাত…ভ্রাতা সহস্রাক্ষ তো রাত্রি হবার পূর্বেই গোপালের ভোগাদি দান করে শয়ন দিয়ে দেন। তবে কি আজ ভ্রাতা ধ্যানজপ অধিকমাত্রায় করছেন?

ভীষণ অনুসিৎসু হয়ে গোপালের পূজাকক্ষে প্রবেশ করলেন। একি ? কি দৃশ্য দেখলেন তিনি ?  বিস্ময়ে তাঁর বাক্ রহিত হয়ে গেল – তাঁর ইষ্টদেবী জগন্মাতা ছোট্ট গোপালকে কোলে তুলে সেই সকালের সুপক্ক কদলী নৈবিদ্যের থালা থেকে একটি একটি করে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন ! এ দৃশ্য যেমন অলৌকিক ,তেমনি মর্মস্পর্শী। 

যা কালী সৈব কৃষ্ণঃসাৎ , যঃ কৃষ্ণ স শিবঃ স্মৃতঃ।

এষং ভেদো না কর্তব্যো যদীচ্ছেদাত্মনো হিতং।।

এ যে চরম সত্য… আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের সম্মুখে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। আপনার হৃদয়, মস্তিস্ক , চিন্তাভাবনায় যতেক কালিমা ছিল সকল ঘুচে সত্য আলোকে উদ্ভাসিত হল। জগৎ সংসারে শ্যামা ও শ্যামে পার্থক্য কোথায় ? যে শ্যাম সেই তো শ্যামা , যে মহাকাল সেই তো মহাকালী , যিনি ব্রহ্ম তিনিই ব্রহ্মময়ী।

দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া 

মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।

গায়ত্রী যা পুরা প্রোক্তা ব্রহ্মজ্ঞান স্বরূপিণী

শ্রীকৃষ্ণস্তু ঋষিস্তস্য গায়ত্রী ছন্দ এব ।।

শিবশক্তিস্বরূপা হি দেবতা পরিকীর্ত্তিতা

যিনি ব্রহ্ম, তিনি আদ্যাশক্তি। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন তাকে ব্রহ্ম বলি। পুরুষ বলি। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় এসব করেন তাকে শক্তি বলি। প্রকৃতি বলি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যিনি পুরুষ তিনি প্রকৃতি। আনন্দময় আর আনন্দময়ী।  পিতা আর জননী। যিনি জগৎরূপে আছেন- সর্বব্যাপী হয়ে তিনি মা। 

ত্যাজি নরশির মালা ,পর গলে বনমালা,

একবার কালী ছেড়ে হও মা কালা,

ওগো পাষাণের মেয়ে

হৃৎ কমলে কাল শশী , আমি দেখতে বড় ভালোবাসি

একবার ত্যাজে অসি ধর মা বাঁশী,

ভক্ত বাঞ্ছা পুরাইয়ে।।

বিষ্ণুরূপে শালগ্রাম শিলা, শিবরূপে লিঙ্গ , ধর্মরূপে কুর্ম , দেবী রূপে বিবিধ যন্ত্র এবং ঘট পবিত্র বস্তু  এগুলিই শূন্য শক্তি স্বরূপ তুলসী সহ দেবতার পূজা প্রকৃতি , শূন্য অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পূজার নামান্তর  সকল দেবদেবীর জর উপাসনা করা হয় তা সবই ব্রহ্মের উপাসনা বিষ্ণু , শিবদুর্গা , কালী, শ্ৰী, সরস্বতী প্রমুখেরা ব্রহ্ম স্বরূপ আমরা পরম ব্রহ্মকে যে ভাবে দেখি সেভাবেই তিনি দেখা দেন  অতএব বিষ্ণু, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সমস্ত দেবতাই তাঁদের উপাসকের  মধ্যেও উচ্চ নীচ নিরূপন হতে পারে না 

আমার মা যে গোপাল সুন্দরী

যেনো এক বৃন্তে কৃষ্ণ কলি অপরাজিতার মঞ্জরী।।

মা আধেক পুরুষ অর্ধ অঙ্গে নারী

আধেক কালি আধেক বংশীধারী

মার অর্ধ অঙ্গে পীতাম্বর আর অর্ধ অঙ্গে সে দিগম্বরী

আমার মা যে গোপাল সুন্দরী।।

মাতৃ আদেশে তন্ত্রসাধক ও আচার্যদের সুবিধার্থে আগমবাগীশ সেইসময় মন্ত্র ও কৌলিক আচার এবং ক্রিয়াদি পদ্ধতির এক গ্রন্থ সংকলন করছিলেন। ১৭০ টি গ্রন্থ থেকে নির্যাস গ্রহণ করে সেই গ্রন্থ রচিত হচ্ছিল। সেই অলৌকিক নিশীথ রাত্রেই ত্রস্তব্যস্ত হয়ে আপন পাঠগৃহে প্রবেশ করলেন। নব উপলব্ধ সত্যের স্বীকৃতি অবিলম্বে শাস্ত্র গ্রন্থে সন্নিবেশিত না করে মন তাঁর শান্ত হবে না। গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি টেনে নিয়ে আগমবাগীশ নতুন করে লিখলেন – 

নত্বা কৃষ্ণপদদ্বয়ং ব্রহ্মাদিসুর পূজিতম্

গুরুত্ব জ্ঞানদাতারং কৃষ্ণানন্দের ধীমতা!

 সৃষ্টি হল সুবিখ্যাত তন্ত্রসার গ্রন্থের। শৈব, গণপত্য, শাক্ত, বৈষ্ণব ও সৌর সম্প্রদায়ের তন্ত্রগ্রন্থগুলির সার গ্রহণ করে সন্নিবেশিত হল সেই গ্রন্থে। দিকে দিকে সমাদৃত হল সেই গ্রন্থ। তেমন মার্জিত তন্ত্র আজ অবধি কেহ বুঝি রচনা করতে পারেন নি। 

শ্রী চৈতন্যদেব ও কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ – বঙ্গের বুকে ভক্তি সাধনা এবং শক্তি সাধনার দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যার ঘটনাকাল ছিল একই সময়। তাঁরা নবদ্বীপে প্রায় একই সময় আবির্ভূত হন। বিদ্যাচর্চার একই ক্ষেত্রে ও সামাজিক পরিবেশে তাঁরা বর্ধিত হয়ে ওঠেন। পরবর্তী কালে সনাতনী দুই বিশিষ্ট ধারায় প্রবাহিত হয় দুই মহাজীবন। মধ্যযুগীয় গলিত চিন্তাযুক্ত সমাজে প্রদান করে নতুন আলো। উভয়ের মধ্যে এক দুরতিক্রম্য ব্যবধান রচিত হয়েও যেন উভয়েই একই পথের পথিক ছিলেন। 

মাতৃসাধক আগমবাগীশের আধ্যাত্ম অনুভূতি এক সুগভীর খাতে প্রবাহিত হয়েছিল। নবদ্বীপের এক প্রান্তে গঙ্গার তীরে নির্জন শ্মশান।  প্রতি অমানিশায় কৃষ্ণানন্দ এখানেই বসে নিরাকার রূপে মা ব্রহ্মময়ী শ্যামার পূজা সম্পন্ন করতেন। তারপর মায়ের নামে ধ্যানজপে প্রহরের পর প্রহর কেটে যেত। প্রাতঃকালে গঙ্গা স্নান সম্পন্ন করে ফিরে আসতেন। সেই সময় সাধের তন্ত্রসাধনার ব্যাপক অবনতি হয়েছে। নানা অদ্ভুত বহিরাগত ব্যভিচার ক্রিয়া  প্রবেশ করে তন্ত্রসাধনাকে দুর্গতির পথে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে। কদাচার ও দুর্নীতির প্রাবল্য চারিদিকে । শক্তিসাধনার মহান ক্ষেত্র ক্লেদাক্ত ও পঙ্কিল হয়ে উঠেছে। আগম বিশারদ , মাতৃসাধক কৃষ্ণানন্দের মনে বড় ক্ষোভ তা নিয়ে। সাধক প্রবর তাই জগদম্বার নিকট বার বার মিনতি জানান , তন্ত্র সাধনার ধারা পুনশ্চঃ যেন উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। 

আরো কিছু চেয়েছিলেন কৃষ্ণানন্দ মাতৃকার নিকট …কি চেয়েছিলেন ?  নিরাকার সেই পরম ব্রহ্মের উপাসনা দেহিদের পক্ষে অতি কষ্টকর । এইজন্যই নানা রূপে  তাঁহার উপাসনা ব্যবহার দেখা যায়। ঘট বা যন্ত্র প্রভৃতি প্রতীক পূজায় কি মন ভরে ? ব্রহ্মময়ী মহাকালী , তাঁর রূপময়ী বিগ্রহ তিনি অর্চনা করতে চান,  সেই চিন্ময়ী মৃন্ময়ী মূর্তি সারা বঙ্গের জনসমাজে এক মাতৃমূর্তি , এক আদর্শ বিগ্রহকে প্রচার করতে চান।  নচেৎ মনে শান্তি নেই। মায়ের মূর্তি রচনা প্রাচীন কাল হতেই হয়ে আসছে। কিন্তু তা রুদ্ররূপ। গৃহী , সাধারণ মানুষ তাঁদের পক্ষে সেই রূপ পূজা করা সম্ভব নয়। একটি সুশীতল মূর্তি চাই। আসলে, কৃষ্ণানন্দ শক্তি সাধনাকে মাতৃ ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে ভক্তিরসে রসায়িত করে তিনি তাকে স্বার্থকতর করে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।

সেই কর্ম সম্পাদনের প্রত্যাদেশ পান এক ঘোর অমাবস্যার রাত্রে। ইষ্টদেবীর চরণে অন্তরের সকল প্রার্থনা নিবেদন করে তিনি ধ্যানস্থ হলেন। বড় দুর্নিবার ছিল তাঁর এই প্রার্থনা। তিনি আদিষ্ট হলেন – মহানিশার অবসানে প্রাতঃমুহূর্তে কৃষ্ণানন্দ প্রথম যে নারীমূর্তি দর্শন করবেন, সেই মূর্তিই হবে ইচ্ছাময়ীর যথার্থ সাকার মূর্তি। 

পর প্রভাতে গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে কৃষ্ণানন্দ দেখলেন । কিয়দ্  অগ্রসর হয়ে অস্ফুট ঊষালোকে অবলোকন করলেন , এক  দরিদ্র গোপবালা অপরূপ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দক্ষিণ পদটি অনুচ্চ বারান্দার উপর স্থাপিত। আর বামপগুঁড়ির উপর নিবিষ্ট মনে ঘুঁটে দিচ্ছেন। দক্ষিণ করতলে গোবরের মস্ত তাল। এমন করে সে হাত তুলে দাঁড়িয়ে যেন , হাত তুলে বরাভয় প্রদান করছেন। বাম হস্ত কর্মচঞ্চল। বেড়ার গায়ে ঘুঁটে দিচ্ছে। গাত্রবর্ণ কালো, বসন আলুথালু, পিঠে আলুলায়িত কুন্তল। এ হেন অবস্থায় পরপুরুষ কৃষ্ণানন্দকে দেখে লজ্জায় জিভ কাটলেন সেই বধু।— এই ছবিটিই মানসপটে এঁকে গঙ্গামাটি নিয়ে মূর্তি গড়তে বসলেন কৃষ্ণানন্দ। 

করালবদনা ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম।

কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালা বিভূষীতাম।।

সদ্যশ্ছিন্নশিরঃ খড়গ বামাবোর্ধ করামবুজাম।

 অভয়ং বরদাঞ্চৈব দক্ষিণাদ্ধোর্ধ পানিকাম। ।

ঘট ও যন্ত্রের স্থলে শক্তিস্বরূপিনী মাতৃমূর্তি সাধকের ভাব কল্পনা ও পূজা ধ্যান বেঁধে উঠবে। এই মাতৃআরাধনা প্রচারিত হল দিকে দিকে। শক্তিসাধনার সঙ্গে ঘটল ভক্তি রসের সংমিশ্রণ। মা মা রবে দিক হতে দিগন্ত মুখরিত হল। পুনরুজ্জীবিত হল সুপ্রাচীন তন্ত্রসাধনা। জননী শ্মশানে আবির্ভূতা হয়ে তাঁকে বরদান করে গেলেন। 

সাধক কৃষ্ণানন্দের সংকল্প অচিরেই সিদ্ধ হল। তাঁর শ্যামপূজার পদ্ধতি ও রীতি সমগ্র বঙ্গ গ্রহণ করল । তন্ত্রসাধনার শুষ্ক খাতে প্রবাহিত হল মাতৃসাধনার উচ্ছল রসধারা। তন্ত্রশাস্ত্র সঙ্কলনা, তান্ত্রিক আচার আচরণের শুদ্ধতা সম্পাদনে কৃষ্ণানন্দ অপূর্ব সফলতা অর্জন করেন। কয়েক শত বৎসরের ব্যবধানেও এই সমগ্র সনাতনী বঙ্গ তথা ভারত তাঁর অবদানের কথা ভুলতে পারেন নি। 

আয় মা চঞ্চলা মুক্তকেশী শ্যামা কালী।

নেচে নেচে আয় বুকে দিয়ে তাথই তাথই করতালি॥

দশদিক আলো করে

ঝঞ্ঝার মঞ্জীর পরে

দুরন্ত রূপ ধরে

আয় মায়ার সংসারে আগুন জ্বালি॥

আপন ভ্রাতার ইষ্টদেবের গৃহে সেই রাত্রির অলৌকিক ঘটনার পরে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের আধ্যাত্মিক অনুভূতি আরো গভীর হতে গভীরতর হতে লাগল। একদিকে চলতে লাগল ব্রহ্মময়ীর স্মরণ , মনন ও অনুধ্যান। অপর দিকে অনুষ্ঠিত হয় দিব্যাচারী , নিষ্ঠাবান সাধকের তান্ত্রিক আরাধনা। এবার আর দিনক্ষণ তিথি নক্ষত্র দেখে নয় , প্রতি নিশীথে তিনি মায়ের পূজা অনুষ্ঠান করতে লাগলেন। উদ্যানের একপ্রান্তে তাঁর নিভৃত সাধনগৃহ। সেখানে পঞ্চমুন্ডির আসন , সেখানে ধ্যানকুটির …।  মা গঙ্গার মৃত্তিকা দিয়ে নিজেই রোজ সেই আদিষ্ট দেবীর মূর্তি গড়েন আগমসিদ্ধ কৃষ্ণানন্দ। প্রাণ দিয়ে সমাপন করেন অর্চনা।  শক্তিমান সাধকের ধ্যানজপে , আবাহনে মৃন্ময়ী মূর্তি হয়ে ওঠেন চিন্ময়ী। সেই জ্যোতির্ময়ী মূর্তির নিকট সাধকের কত আবদার, কত মান , কত অভিমান। মা সকল কিছু শ্রবণ করেন। রাত্রি শেষে আগমবাগীশ লোকচক্ষুর অগোচরে ইষ্টবিগ্রহ গঙ্গার জলে বিসর্জন দেন। তারপর আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।  পরবর্তীকালে কৃষ্ণানন্দের এই নিয়ম বা আচার #আগমবাগীশি_কান্ড শব্দটি একটি প্রবাদে পরিণত হয়  নবদ্বীপের #আগমেশ্বরীতলা আজও এই তন্ত্রসিদ্ধ সাধক ও বহুবিশ্রুত আচার্যের পবিত্র স্মৃতি বক্ষে ধারণ করে রয়েছে। আজও নবদ্বীপে কৃষ্ণানন্দের ভিটায়, তাঁর পঞ্চমুন্ডির আসনে তাঁর পূজিত শ্যামা মা আগমেশ্বরী নামে উপাসিতা হন। 

নবদ্বীপে আগমবাগীশের কালীপূজার যাবতীয় আয়োজন হয় তাঁর মতো করেই। আগমবাগীশ প্রবর্তিত কিছু বিশেষ রীতি এই পূজোকে অন্য সব কালী পুজো থেকে আলাদা করেছে। কার্তিকের কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমীতে খড়বাঁধা দিয়ে মূর্তি নির্মাণের সূচনা হয়। একাদশীতে পাঁচপোয়া খড়ের বিশেষ ধরনের অবয়ব বিরাটাকার প্রতিমার বুকে স্থাপন করা হয়। অমাবস্যা লাগলে চক্ষুদান। একটা সময়ে পুজো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিসর্জন হত। এখন দুপুরের মধ্যেই বিসর্জন শেষ হয়।


সে সময় শাক্ত এবং বৈষ্ণবের ঘোরতর বিরোধ ছিল। শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্যের উত্তরপুরুষ মথুরেশ গোস্বামী সেই বিরোধ মেটাতে কৃষ্ণানন্দের প্রপৌত্র সার্বভৌম আগমবাগীশের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। তবে বৈষ্ণব কন্যাকে বিয়ে করায় নবদ্বীপের তৎকালীন শাক্ত সমাজ সার্বভৌমকে একঘরে করেছিল। এমনই এক অবস্থায় মথুরেশ তাঁর মেয়ে-জামাইকে শান্তিপুরে নিয়ে আসেন। এর পর বড়গোস্বামীবাড়ির অদূরে পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে সার্বভৌম সেখানে কালীপুজোর প্রচলন করেন। শান্তিপুরের বড়গোস্বামীপাড়ায় পূজিত সেই কালীমূর্তির নামও আগমেশ্বরী। অতীতে এই পুজোয় কার্তিকী অমাবস্যায় এক দিনে মূর্তি গড়ে পুজোর রীতি ছিল। এখন আগে থেকে প্রতিমা তৈরি হলেও, দেবীর চক্ষুদান করা হয় পুরোহিত পুজোয় বসার আগে।

সর্বশক্তিময়ী নিত্যাং, ব্রহ্মময়ী পরাৎপরাং| 

জ্ঞানরূপাং মহাদেবীং, তারিনীং প্রণমাম্যহম্||

জগন্মাতার কৃপায় কৃষ্ণানন্দ আধ্যাত্ম জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উঠেছিল এক মহাকৌল সাধকের শক্তি ও প্রেরণা। জটাধারী পরমহংস তন্ত্রসাধকের সাহচর্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পরিপূর্ন।  জটাধারী পরমহংস ছিলেন সিদ্ধ মহাপুরুষ , অসামান্য যোগবিভূতির অধিকারী ছিলেন তিনি। লোকে তাঁকে জটিয়া জাদু বলতেন। কিছুকাল নবদ্বীপে অবস্থান কালে কৃষ্ণানন্দ তাঁর নিকট হতে নানা গূঢ় এবং দুরূহ তত্ত্ব শিক্ষা করেন। অচিরে তন্ত্রসিদ্ধির আলোকে তাঁর আধ্যাত্ম জীবন প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে। তন্ত্রসাধনা এবং তন্ত্রশাস্ত্রের অন্যতম দিকদর্শনরূপে তিনি চিহ্নিত হয়ে ওঠেন।

তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ তন্ত্রসার এবং শ্রী তত্ত্ববোধনী প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণানন্দ প্রসিদ্ধি অর্জন করেন।পন্ডিত এবং সাধক সমাজে তাঁর রচনা সমাদৃত হতে থাকে। তাঁর কৌল সাধনার দীক্ষা নিয়ে শত শত সাধক কৃতার্থ হন। 

তন্ত্রসাধনাকে জনপ্রিয় করে তুলতে তিনি সর্ব প্রথম তান্ত্রিক সাধকদের অনুষ্ঠেয় কর্মশুদ্ধির উপর জোর দিলেন। তাঁর শাস্ত্র ব্যাখ্যান , ব্যক্তিত্ব, সাধনার সাফল্য অল্পকাল মধ্যে জনজীবনে নবতম চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এ চেতনাকে তিনি উজ্জীবিত করলেন মাতৃসাধনার ভাবপ্রবাহে। এই প্রবাহের রসসিঞ্চনে পুষ্ট হয়ে ওঠে উত্তরকালের তন্ত্রপ্রভাবিত বাঙ্গালী সমাজের একটি বৃহৎ অংশ।

অদ্যাবব্ধি তাঁর প্রবর্তিত তন্ত্রসাধনার বেগ প্রশমিত হয় নি। তাঁর নির্দেশিত পদ্ধতিতে শ্যামাবিগ্রহের পূজা সম্পন্ন হয়ে থাকে বঙ্গ তথা ভারতের এক বৃহৎ অংশ জুড়ে। দেশের দিকে দিকে , শহরে , গ্রামে , বারোয়ারী তলায় এই মাতৃমূর্তির উপাসনা সাড়ম্বরে সূচিত হয় । শক্তিপীঠ বহুল বঙ্গের সর্বত্র ব্যাপ্তি হয় আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শক্তি সাধনার প্রভাব। মা ব্রহ্মময়ীর অনুধ্যান করে মানব সমাজ ধন্য হয়। আপন শক্তিবলে শক্তি সাধনার গূঢ় অন্তঃসঞ্চারী ধারাকে কৃষ্ণানন্দ এনে দেন আমাদের সকলের গৃহের মাঝে। 

নবদ্বীপে আগমেশ্বরী পাড়া। পোড়ামাতলা থেকে হাঁটা পথে মিনিট আটেক …বর্তমান মন্দিরটি আধুনিক। মাঝারি আকার । মাথায় ত্রিশূল। মন্দিরের মধ্যে কিন্তু কোনো বিগ্রহ নেই। বাঁধানো বেদী। পঞ্চমুন্ডির আসনে  ত্রিশূল আর খাঁড়া। প্রায় পাঁচশো বছর আগে কৃষ্ণানন্দ এখানে নিজহাতে স্থাপন করেন পঞ্চমুন্ডির আসন। মন্দিরের ডদেওয়ালে পাথরের ফলকে লেখা আছে “শ্রীশ্রীঁঁআগমেশ্বরীমাতার মন্দির।” মায়ের কৃপায় এই অতিমারী কাল শেষ একবার ঘুরে আসুন সেই মহাসিদ্ধ পুরুষের মায়ের মন্দির থেকে। 

আদ্যাশক্তি মহামায়া নিত্যা, নির্গুণা এবং নিরাকারা হলেও অশুভের দমনের জন্য  তাঁকে সগুণা সাকারা হয়ে জগতে আবির্ভূতা হতে হয়। দেবী ভাগবতে এর একটি সুন্দর উপমা আছে। সেখানে বলা হয়েছে—অভিনেতা একই ব্যক্তি হলেও লোকরঞ্জনের নিমিত্ত তাকে যেমন রঙ্গস্থলে নানা বেশে, নানা চরিত্রের অভিনয় করতে হয়, সেরূপ দেবী মহামায়া নির্গুণা নিরাকারা হলেও দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য স্বীয় লীলায় তাঁকে নানাবিধ রূপ ধারণ করতে হয়।

মোট তেরোটি অধ্যায়ে বিভক্ত চণ্ডীগ্রন্থের প্রধান বর্ণিত বিষয় দুটি: রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও দেবীস্তুতি। গ্রন্থের সিংহভাগ জুড়ে আছে দেবীর যুদ্ধলীলা। এই অংশে ফুটে উঠেছে তাঁর অসুরদলনী রূপ। পূর্ব-অধ্যায়ে অসুরবধপ্রসঙ্গে তাঁর যুদ্ধোন্মাদনার আভাস আমরা পেয়েছি। এবারে আমরা পরিচয় পাব স্তবের মাধ্যমে উদ্‌ঘা঩টিত মহামায়ার সামগ্রিক সত্তার। গ্রন্থের সূচনাপর্বেই আছে ব্রহ্মার স্তব। সেখানে মহামায়ার তামসী প্রকাশ; তিনি যোগনিদ্রাস্বরূপা মহাকালী। 

আচারে-অনুষ্ঠানে, আয়োজনে, অংশগ্রহণে, আকারে-আঙ্গিকে, আনন্দ-উৎসবে নানা রূপে শক্তি পূজা আজ ব্যক্তি ও পরিবারের সংকীর্ণ গন্ডী পেরিয়ে পেয়েছে সার্বজনীনরূপ। মায়ের আগমনী ছন্দে ছন্দায়িত হয় ভক্তজনের তনুমন। মঙ্গলালোকে উচ্ছ্বসিত, সমুদ্ভাসিত ও উদ্বেলিত হয় শরণাগতের অন্তরাকাশ। মায়ের পূজা মূলতঃ শক্তিপূজা। শুভশক্তি আবাহনার্থেই মায়ের পূজানুষ্ঠান। তাই বেদে বলা হয়েছে –

আরাত্রি পার্থিবং রজঃ পিতুরপ্রায়ি ধামভিঃ।

দিবঃ সদাংসি বৃহতী বিতিষ্ঠসে ত্বেষাং বর্ততে তমঃ ||  ||

যে তে রাত্রি নৃচাক্ষসো যুক্তাসো নবতির্নব।

অশীতিঃ সন্ত্বষ্টা উতো তে সপ্ত সপ্ততীঃ ||  ||

রাত্রিং প্রপদ্যে জননীং সর্বভূতনিবেশনীং।

ভদ্রাং ভগবতীং কৃষ্ণাং বিশ্বস্য জগতো নিশাং ||  ||

সম্বেশনীং সংযমনীং গ্রহনক্ষত্রমালিনীম্।

প্রপন্নোহং শিবাং রাত্রিং

ভদ্রে পারং অশীমহি ভদ্রে পারং অশীমহি ওঁ নমঃ || 

নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা আর শক্তি পূজার মধ্যে নেই কোন প্রভেদ। কারণ ‘এক ও অদ্বিতীয় নিরতিশয় চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্ম অনাদিসিদ্ধ মায়ার আবরণে ধর্ম ও ধর্মীরূপে প্রতিভাসিত হন।’

অগ্নি ও তার উত্তাপকে যেমন পৃথক করা যায় না, ধর্ম ও ধর্মীকে যেমন স্বতন্ত্র ভাবা যায় না, তেমনি ব্রহ্ম আর শক্তিও অভিন্ন।

দেবী ভগবতে আছে-

“সদৈকত্বং ন ভেদোহস্তি সর্বদৈব মমাস্য চ।

যোহসৌ সাহম্ অহং যাসৌ ভেদোহস্তি মতিবিভ্রমাৎ”

অর্থাৎ “আমি ও ব্রহ্ম এক। উভয়ের মধ্যে ভেদ নেই। যিনি ব্রহ্ম তিনিই আমি। আমি যাহা, তিনিও তাহাই। এই ভেদ ভ্রমকল্পিত, বাস্তব নহে।” ‘আমি’-ই শক্তি। সচ্চিদানন্দরূপিণী মহামায়া পরাশক্তি অরূপা হয়েও ভক্তপ্রাণের পরিত্রাণ রূপে ধরা দেন। যিনি সর্বশক্তিমান সব কিছুই তাঁর ইচ্ছাধীন, সব কিছুই তাঁর আয়ত্তাধীন। তাই তিনি নিরাকার পরব্রহ্ম হয়েও স্বেচ্ছায় সাকারে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন।  এই কথাই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ কত সহজ করে বলেছিলেন। দিয়েগিয়েছেন অমৃত ।  সেই মহাসাধকের চরণকমলে আমার এই লেখাটিকে উৎসর্গ করলাম।

“ভক্তি, আমার ধুপের মত,

ঊর্ধ্বে উঠে অবিরত।

শিবলোকের দেব দেউলে,

মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।”

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১. কালিকাপুরাণ

২. বেদ – রাত্রিসূক্ত

৩. কালীকথা

৪.ভারতের সাধক

৫.বৃহৎ তন্ত্রসারঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.