আজ থেকে দশ বছর আগের কথা। আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। ইন্ডিয়া টিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘আজ কি আদালত’-এর কাঠগড়ায় বসে সেদিন রজত শর্মার চাঁছাছোলা প্রশ্নের উত্তরে মোদী বলেছিলেন- মুম্বইয়ে পাক- সন্ত্রাসবাদী হামলার সময় যদি আপনি দায়িত্বে থাকতেন, আপনি কী করতে পারতেন? মোদীর সাফ উত্তর ছিল—“গুজরাটে যা করেছিলাম সেটাই করতাম। ব্যবস্থা নিতে আমার কোনো সময়ই লাগত না। আমি আজও বলছি, পাকিস্তানকে ওদের নিজেদের ভাষাতেই জবাব দিতে হবে। লাভ লেটার লেখা বন্ধ হওয়া দরকার! প্রণব মুখার্জি বার বার চিঠি দিচ্ছেন আর ওরা জবাব দিয়ে যাচ্ছে। অপরাধ ওরা করছে আর ভারত সরকার তার জবাব দিচ্ছে।” আন্তর্জাতিক চাপের প্রসঙ্গ উঠলে মোদীর জবাব ছিল— “আন্তর্জাতিক চাপ! ভারতবর্ষ ১০০ কোটি মানুষের দেশ। ইচ্ছে করলে আমরা গোটা পৃথিবীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি। আমাদের ওপর চাপ তৈরি করবে কে? এ তো দেখছি গঙ্গার স্রোত উল্টোদিকে বইছে। পাকিস্তান আমাদের ওপর হামলা করল। আমাদের মেরে চলে গেল। আর আমাদের মন্ত্রী কী করলেন? আমেরিকায় গিয়ে ‘ওবামা, ওবামা আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও’ করে কান্না জুড়ে বসলেন। এটা কোনো কথা হলো? প্রতিবেশী দেশ তোমায় মেরে গেল, আর তুমি চলে গেলে আমেরিকায়। আরে ভাই, পাকিস্তানে যাও না। সোজা কথা, পাকিস্তান যে ভাষা বোঝে, সেই ভাষা বুঝিয়ে দিতে হবে। রাস্তা একটাই।”
সাল ২০১৯। ১৪ ফেব্রুয়ারি, জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় পাক সন্ত্রাসবাদীরা কেড়ে নিল কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের ৪০ জন জওয়ানের দেশপ্রেমী জীবন। তাদের কোনও অপরাধ ছিল না।
দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী দশ বছর আগে যা বলেছিলেন, তাই করে দেখালেন। পাক হামলার পরদিনই ঘোষণা করে দিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবার জন্য দেশের সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হলো। তারা যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তাই নেবেন।
আর দশ দিনের মাথায় ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বারোটি বিমান পাকিস্তানের সীমারেখা ভেদ করে বোমাবর্ষণ করে গুঁড়িয়ে দিল বালাকোট, মুজফফরাবাদ ও চাকোটির সবচেয়ে বড়ো জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি। নিকেশ হলো পাক সন্ত্রাসবাদের নাটের গুরু মাসুদ আজাহারের শ্যালক ইউসুফ আজাহার ওরফে উস্তাদ ঘাউড়ি, মাসুদের তুতোভাই মওলানা তলহা সইফ, মওলানা আমের, মুফত আজাহার খান ওরফে খান কাশ্মীরি আর ইব্রাহিম আজাহারের মতো কুখ্যাত জঙ্গি নেতা ও প্রশিক্ষকরা। মাত্র ২১ মিনিটেই পাকিস্তানকে তাদের ভাষাতেই বুঝিয়ে দিলেন মোদীজী— হামলার জবাব হামলাতেই শেষ হবে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ভারত যুদ্ধের পথে এগোতেও দ্বিধা করবে না।
দশ বছর আগে বলেছিলেন—শ’ কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষ চাপ-সৃষ্টি করবে গোটা বিশ্বের ওপর। পুলওয়ামা ঘটনার মাত্র ৩/৪ দিনের মধ্যেই বিশ্বের প্রায় সমস্ত বৃহৎ শক্তি (একমাত্র চীন ছাড়া) ভারতবর্ষের পাশে এসে দাঁড়াল। একযোগে নিন্দাধ্বনি প্রয়োগ করল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের একমাত্র বন্ধু চীনও শেষ পর্যন্ত চীনের মাটিতে বসেই রাশিয়ার সঙ্গে গলা মিলিয়ে পাক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গোটা বিশ্বের সঙ্গে গলা মেলাতে বাধ্য হয়েছে। মোদীজী দশ বছর আগের দেওয়া কথা যে শুধুমাত্র ভাষণ ছিল না, তার প্রমাণ রেখেছেন। আগামীদিনেও যে তিনি প্রয়োজনে কঠোর হতে দ্বিধা করবেন না তাও বলেছেন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজস্থানের চুরুর জনসভায়। বলেছেন—
সৌগন্ধ মুঝে ইস মিট্টি কি
ম্যায় দেশ নহি মিটনে দুঙ্গা
ম্যায় দেশ নহি রুখনে দুঙ্গা
ম্যায় দেশ নহি ঝুঁকনে দুঙ্গা।
নিজের জোড় হাত জনগণের সামনে তুলে ধরে শপথ নিয়েছেন, মানুষের মনে বিশ্বাস জাগিয়েছেন— ‘দেশ ইস হাত মে সুরক্ষিত হ্যায়।না, মোদীজীকে আমেরিকায় গিয়ে চোখের জল ফেলতে হয়নি। দেশের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকেই পাঠিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানে। বুঝিয়ে দিয়েছেন, মোদীজী মোদীজীই। ভারতের ইতিহাসে এক অন্য ধাতুতে গড়া চরিত্র।
১৯৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধের পর পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে এত বড়ো পদক্ষেপ আর কেউ নেননি। যদিও গত ৪৭ বছরে পাকিস্তান ভয়াবহ রকমের সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়েছে একের পর এক। শয়ে শয়ে নিরীহ ভারতবাসীর প্রাণ গিয়েছে। বিনা অপরাধে। গোটা বিশ্ববাসীর সামনে ভারতবর্ষের আত্মরক্ষার সামর্থ্য কত দুর্বল, তা প্রমাণ করে দিয়েছে পাকিস্তান। অপমানে অপমানে ভারত জর্জরিত হয়েছে কিন্তু ঠিক এইভাবে, মোদীজী যেভাবে গোটা বিশ্বের ওপর চাপ তৈরি করে বিশ্বকে বলতে বাধ্য করেছেন যে, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের প্রশ্রয়দানকারী রাষ্ট্র, সন্ত্রাসবাদের মদত দানকারী রাষ্ট্র। তেমন কোনো নজির এর আগে কোনো সরকারই রাখতে পারেননি। একমাত্র আগের বিজেপি সরকার ছাড়া যার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী যিনি পোখরানে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ করে পাকিস্তানকে সমঝে দিয়েছিলেন—রক্তচক্ষু দেখিও না। প্রয়োজনে তোমার গোটা পাকিস্তানকে পুড়িয়ে ছাই করে দেব নিমেষে।
তবে দেশটার নাম তো ভারতবর্ষ। তার ও পর প্রধানমন্ত্রী পদে রয়েছেন এ তাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী ৫৬ ইঞ্চি ছাতির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। বিরোধীদের গায়ের জ্বালা তো ধরবেই। তাই বিরোধীরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছেন। হামলার পরদিন থেকেই– (১) বিজেপি ক্ষমতায় এলেই যুদ্ধ যুদ্ধ জিগির ওঠে কেন? (২) যুদ্ধ শুরু কি ভোটের তাগিদেই? (3) পুলওয়ামা হামলার পিছনে কি পাক সন্ত্রাসবাদীরাই, নাকি রক্ত ঝরানোর পিছনে ছিল সরকারি পরিকল্পনাও ? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদীজীর বড়ো বিরোধী তিনি শুধু সেনাবিদ্রোহে উস্কানি দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। প্রায় সরাসরি । পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুললেন, পাকিস্তান হামলা করেছে, তার প্রমাণ কী?
এক এক করে প্রশ্নগুলির জবাব দেওয়া যাক।
প্রথম প্রশ্ন, বিজেপি সরকারে বসলেই যুদ্ধ যুদ্ধ রব ওঠে। কেন? বিরোধীদের এই পর্যবেক্ষণ মিথ্যে নয়। ১৯৯৯ সালে বিজেপি সরকারের আমলেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কার্গিল যুদ্ধ হয়েছিল। ২০১৯-এও যুদ্ধ যুদ্ধ রব। আসলে এর কারণ যে বিরোধীরা নিজেরাই তা জেনেও তারা ভালোমানুষ সেজে থাকেন। বিরোধীরা ধর্মনিরপেক্ষতার বোরখা পরে পাকিস্তানের বন্ধু সেজে থাকেন। মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পরে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করেন মুসলমান ভোট আদায় করে। আর পাকিস্তানকে বার্তা পাঠাতে থাকেন— আমরা তোমার পাশে আছি। বেআইনি অনুপ্রবেশ চলুক। দেশের মধ্যে যত খুশি মাদ্রাসা, মসজিদ গড়ে তোলো। গড়ে তোলো সন্ত্রাসবাদ প্রশিক্ষণ শিবির। মানবতাবাদের চাদর জড়িয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার নামে এই বিরোধীরাই আমন্ত্রণ জানায় সন্ত্রাসবাদীদের। কারণ ভোট বড়ো বালাই। স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বেশি সময় দেশ শাসন করেছে যে সব বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দল, তারা শুধুমাত্র ভোটের স্বার্থে জাতীয়তাবোধ নামক আবেগটাকেই বেচে দিয়েছে পাক সরকার এবং পাক সরকারের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীদের কাছে। তাই তাদের শাসনকালে হামলা হয় কম। যুদ্ধ যুদ্ধ রব ওঠে কম।
কিন্তু বিজেপি যে প্রকৃত জাতীয়তাবাদী সংগঠন। তার ওপর প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী যিনি বিনা আমন্ত্রণেই পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের জন্মদিনে হাজির হয়ে যেতে পারেন দুঃসাহসে ভর করে। যিনি গোটা বিশ্ব চষে বেড়ান গোটা বিশ্বের সামনে ভারতবর্ষকে তুলে ধরতে। যিনি প্রয়োজনে গোটা বিশ্বের সমর্থন ও সম্মান আদায় করে নিতে পারেন। যিনি ভারতবর্ষকে উদ্বেলিত করেন জাতীয়তাবাদের আবেগে নতুন করে। যিনি নিজেকে হিন্দু বলতে ভয় পান না কিন্তু যিনি মুসলমান বিরোধী নন, যিনি পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। যাঁর কাছে রাষ্ট্রের চেয়ে বড়ো কিছু নয় বলেই উন্মুক্ত কণ্ঠে বলতে পারেন— “মেরা বচন হ্যায় ভারতমাকো/তেরা শির ঝুঁকনে নহি দুঙ্গা/হম ফিরসে দোহরানা চাহাতা হ্যায়/আউর খুদকো ইয়াদ দিলানা হ্যায়/না ঝুঁকেঙ্গে না হটেঙ্গে/কুছ ভি হো হম দেশ কো নহি মিটনে দেঙ্গে।” এরকম একটা মানুষকে পাকিস্তানই বা সহ্য করবে কেমন করে? বিরোধীরাই বা সইবে কীভাবে? অতএব পাক-হামলার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি অস্থির হয়। সরকার পাল্টা আঘাত হানে একথা প্রমাণ করতে ভারতবর্ষ দুর্বল নয়। ১৩০ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ। আত্মরক্ষার্থে পাল্টা হানা দেবেই। যুদ্ধ যুদ্ধ রব ওঠে। এতে অন্যায়ের কিছু নেই। বরং এ রব গর্বের। কারণ এর জন্য বিশ্বের দরবারে গিয়ে কান্নাকাটি করতে হচ্ছে না কাউকে।
যুদ্ধ শুরু কি আসন্ন ভোটের তাগিদেই?
বিরোধীরা সেটাই মনে করছেন। কারণ গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি সহ বেশ কয়েকটি লেজুড় দলবল জোটের নামে ঘোঁট পাকিয়ে আওয়াজ তুলেছে— ‘২০১৯, বিজেপি ফিনিশ!’ কারণ মোদীর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। কারণ মোদী দেশশাসনে ব্যর্থ। কারণ মোদীর আমলে সবচেয়ে বেশি চাষি আত্মহত্যা করেছেন। কারণ মোদীর আমলে নোটবন্দি হয়েছে। কারণ মোদীর আমলে জিএসটি চালু হয়েছে। কারণ রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি হেরেছে। বেশ ভালো কথা। তাদের যুক্তি, হারিয়ে ফেলা জনপ্রিয়তার পুনরুদ্ধারেই মোদীর এই যুদ্ধ প্রয়াস।
মাননীয় বিরোধীদের বলব— একটু পিছন ফিরে তাকান। ১৯৯৯ সাল। দেশে বিজেপি সরকার। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ভোটের তিনমাস আগে হয়েছিল কার্গিল যুদ্ধ। ভোটের পর বিজেপি পেল ১৮২টি আসন। ১৯৯৮-এর ভোটের চেয়ে একটা আসন বেশিও নয়, একটি আসন কমও নয়। বরং সব মিলিয়ে বিজেপির ভোট কমেছিল ২ শতাংশ। উত্তরপ্রদেশে নিজস্ব আসন ৫৭ থেকে কমে হয়েছিল ২৯। কর্ণাটকে কমেছিল ৬টি আসন। পঞ্জাবে নিজস্ব জয় ৩ থেকে কমে হয়েছিল ১। ভোট কমেছিল ২.৫ শতাংশ। এই ফলাফল কি প্রমাণ করে, যুদ্ধ বিজেপিকে বেশি ভোট, বেশি জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল?
আরও একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৯৬২ সাল। সংসদে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ছিল ৩৬১। ১৯৬৫ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ হলো। ভোট হলো ১৯৬৭-তে। কংগ্রেসের আসন সংখ্যা কমে হলো ২৮৩। ভোট কমল সব মিলিয়ে ৪ শতাংশেরও বেশি। যুদ্ধ যুদ্ধ রব যে ভোট বাড়ায় না, জনপ্রিয়তাও বাড়ায় না, এটা আরও একটা প্রমাণ। কারণ যুদ্ধে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে বেশি। দেশ আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়। অতএব যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ হারিয়ে বলছেন, সেনা জওয়ানদের রক্তের হোলি খেলে ভোট বৈতরণী পার হতে চাইছেন মোদীজী, যখন অন্যান্য বিরোধী দল পাকিস্তানকে নিন্দামন্দ করলেও, মোদীকেই দায়ী করেছেন এই অস্থির পরিস্থিতির জন্য, তখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে— আসলে তারা মোদীর জনপ্রিয়তাকে ভয় পাচ্ছেন। আসলে তারা বুঝতে পেরেছেন, একদিকে চাণক্য সুলভ রাজনীতি, অন্যদিকে জাতীয়তাবোধের অনুপ্রেরণার দীপ জ্বালিয়ে মোদীজী সব বিরোধী শক্তিকেই বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। শুধু সামান্য ভোটের ব্যবধানে বা আসনের ব্যবধানে রাজস্থানে, মধ্যপ্রদেশের বিজেপির পরাজয়কে আইকন হিসেবে খাড়া করে জিএসটি এবং নোটবন্দি নীতির রূপায়ণের সাফল্যকে ম্লান করা যাবে না। ধামাচাপা দেওয়া যাবে না গত পাঁচ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের জনমুখী প্রকল্পগুলির সাফল্যকে এবং তারা নিজেরাই যত বেশি করে সংখ্যালঘুদের দাবার চালে বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করবেন, সংখ্যাগুরু বোড়ের সংখ্যা রাজা মোদীকে ততবেশি করেই ফিরে থাকবে ভোটবাক্সে। কারণ মোদী আজ ভারতীয় তথা হিন্দু ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছেন।
তৃতীয় প্রশ্নটা তুলেছেন, এই মুহূর্তে যিনি দিল্লির মসনদ দখলের আশায় হাওয়াই চটি পরা পা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রশ্ন, পুলওয়ামা ঘটনার পিছনে পাকিস্তান দায়ী, তার প্রমাণ কোথায়? নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটির অজুহাত তুলে তিনি হামলার দায় মোদীর ঘাড়েই চাপাতে চাইছেন এবং পরিষ্কার বলছেন, মোদীজী সেনার রক্তে হোলি খেলে রাজনৈতিক বাজিমাত করতে চাইছেন। অতি বড়ো মুখও মানে, ভারত যখন হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করছে, তখন গোটা বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তানের দিকে। বিনা প্রমাণে ভারতবর্ষ যে একথা বলেনি সেটা একটা শিশুও বুঝবে। বুঝবেন না শুধু মমতাজী যিনি নিজেকে পরম মুসলমান হিতৌষী প্রমাণ করতে গিয়ে এতবেশি মুসলমান ম্যানিয়াক হয়ে উঠেন যে মুসলমানদের কাছেই তিনি হাস্যাস্পদ হয়ে ওঠেন। তিনি বোঝেন না, অতি চালাকের গলাতেই দড়ির বাঁধন পড়ে। মূর্খের গলায় নয়।
গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুক এবং টুইটারেও বেশ সরব ‘বন্ধুরা’। বেশিরভাগ সমর্থনটা যখন পাকিস্তানের জঙ্গি শিবির নিকেশ করার পক্ষে এবং দেশবাসীর সবচেয়ে বড়ো অংশটা যখন সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের সর্বতোভাবে মদত দিয়ে থাকেন, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন, তখন কিন্তু মমতাদির কণ্ঠ রুদ্ধ। সেনাবাহিনীর জওয়ানদের জন্য তিনি অনুপ্রেরণার বাক্স খুলতে রাজি নন। বরং তার চ্যালাচামুণ্ডারা যাঁদের মূখত মূর্খামির সমস্ত রেকর্ডকে ছাপিয়ে যায়, তারা প্রশ্ন তুলছেন- বালাকোট, মুজফফরাবাদ আর চাকোটিতে যে জঙ্গি শিবির ধ্বংস হয়েছে, তার প্রমাণ কী? কোনো ছবি বা ভিডিও তো পাইনি। বরং উল্টো তারা একটি ভিডিও প্রচার করছেন তাদের বক্তব্যের সমর্থনে যা পাকিস্তানে জঙ্গি শিবির ধ্বংসের আগের দিনে তোলা। অর্থাৎ সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার আগেই তার রূপবর্ণনা। এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে! তাঁরা এটাও বোঝেন না যে, এখন ভারত কেন, কোনো দেশই এরকম পরিস্থিতিতে মিথ্যা প্রচার চালাতে পারে না। কারণ উপগ্রহের দৌলতে গোটা বিশ্ব জানে, প্রয়োজনে আপনার আমার বেডরুমের ছবিও তারা দেখিয়ে দেবে। আর সেখানে নাকি মিথ্যা প্রচার করবে ভারতবর্ষ ! দিদির অনুগামীদের গুণের শেষ নেই!
যাক সে কথা। আসা যাক অন্য কথায়।
পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন প্রাক্তন পাক ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খান। সুদর্শন এবং সুবক্তা, পাকিস্তান তহরিক-ই-ইনসাফ দলের সর্বাধিনায়ক কী চাইছেন? তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতবর্ষের সঙ্গে পাঙ্গা লড়া মানে জীবনকে হাতের মুঠোয় রেখে বাজি লড়া। কারণ, লোকবল এবং সামরিক বল দুটোতেই ভারত অনেক এগিয়ে। তার ওপর আছে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রায় সমস্ত বড়ো দেশের সমর্থন যা মোদীজী গত পাঁচ বছর ধরে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন বিশ্ব পরিক্রমা করে। যা বিরোধী দলগুলি এমনকী পাকিস্তানও অনুমান করতে পারেনি। অতএব ইমরান বোঝেন, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়েই বাঁচতে হবে। একেবারে শুরু থেকেই নিতান্ত অশিক্ষায় পরিপূর্ণ জেদের বশে পাকিস্তান ভারতবর্ষকে প্রথম এবং একমাত্র শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে যে লড়াইটা লড়ে চলেছে তা যে দেশের মধ্যেই অজস্র ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের জন্ম দিয়েছে, তা অতীতের বেনজির ভুট্টো ছাড়া কোনো প্রধানমন্ত্রীই বোঝেননি। তার ফল হয়েছে একের পর এক প্রধানমন্ত্রীর হত্যা। তা নইলে স্বাধীনতার ৭২ বছরে ২২টা প্রধানমন্ত্রী হয় একটা দেশে! ইমরান খান বোঝেন, গোটা দেশটা চলে গেছে সন্ত্রাসবাদীদের দখলে। সন্ত্রাসবাদী মানে এক একটি সন্ত্রাসবাদী পরিবারের হাতে যারা সন্ত্রাসবাদী কোম্পানি খুলে বসে গোটা পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে এবং সরকারকে বাধ্য করে তাদের অঙ্গুলি হেলনে চলতে। চললে ভালো। নইলে ধড়, মুণ্ড আলাদা হতে দেরি হবেনা। মনে পড়ে প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী জিয়াউল হকের মৃত্যুর কথা। প্লেনসমেত তাকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এমনভাবে যে শেষ পর্যন্ত দাঁতের পাটি দেখে বোঝা গিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী খতম। ইমরান খানের রাজনীতিতে প্রবেশ এবং প্রধানমন্ত্রীর তখতে আসীন হওয়ার পিছনেও রয়েছে জনগণের ভোট নয়, সন্ত্রাসবাদীদের মদত। তিনি চুক্তিবদ্ধ সন্ত্রাসবাদীরাই দেশ শাসক। তিনি ড্রাইভার মাত্র।
ইমরান খান এখন এগোলেও বিপদ— কারণ ভারত যুদ্ধের জন্য তৈরি। পিছোলেও বিপদ— পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ আজাহার। তার ওপর আছে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সুস্থ প্রশাসনের দাবি। কারণ তারা সুখে শান্তিতে বাঁচতে চায়।। তারা চায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পের প্রগতি। শুধু ইসলামের নামে নাড়া দিয়ে যে জীবন এগোয় না, তারা তা বোঝেন। তারাও চাইছেন পাকিস্তান রাষ্ট্রপতি বদলাক।
ইতিমধ্যেই ইমরান খান দু দু-বার আলোচনার প্রস্তাব রেখেছেন। বোঝা যাচ্ছে, তিনি রফায় আসতে চাইছেন। কিন্তু একবারও বলছেন না, মাসুদ আজাহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করে তাকে ফাঁসি দেব। একবারও বলছেন না, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হতে চায় না। কারণ তার মাথায় কালাশনিকভ ছুঁইয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ আজাহার স্বয়ং। এমতাবস্থায় ইমরান খান কী করবেন?
তিনি যদি সত্যিই চান, পাকিস্তান পরিণত হোক একটি স্বাভাবিক রাষ্ট্রে, তাহলে তাঁকে আন্তর্জাতিক দেশগুলির মতামতে সায় দিতে হবে। অবশ্য ২/১টি দেশ ছাড়া যারা চায় পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র হিসেবে খাড়া করে রেখে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করতে। আর যদি তা না চান, তাহলে তাকে ভারতের সঙ্গে মোকাবিলায় নামতে হবে। হয় সরাসরি সামরিক ময়দানে, নয় কূটনৈতিক মোকাবিলায়। তার জন্য ভারত প্রস্তুত। প্রস্তুত মোদীজী। এখন প্রশ্ন হলো— ভারতবর্ষের বিরোধীদের অবস্থান কী হবে? তারা কি মোদীর সঙ্গে অযৌক্তিক বিরোধিতাতেই মেতে থাকবেন? নাকি আক্ষরিক অর্থে যৌক্তিক বিরোধিতার পথে এগোবেন ? এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিরোধীরা, বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিজেপির নেতৃত্বের স্তরে অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী, নীতীন গড়কড়ি বা অরুণ জেটলিদের মধ্যে যে বিভাজন সৃষ্টির রাজনীতি করছেন, তা যে আসলে মূর্খের মুখে চপেটাঘাত হবে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। জোটের নামে যে ঘোঁট তৈরির চেষ্টা চলছে, তাও যে ব্যর্থ হবে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। এমনতাবস্থায় বিরোধীদের একটা সুস্থ অবস্থান নেওয়াই মঙ্গলের। পাকিস্তানের সহমর্মী হয়ে ভারতীয়ত্ব প্রমাণ করতে গেলে ফলটা যে উলটপুরাণ হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু সব প্রশ্নের শেষেও মূল প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে চলতি পরিস্থিতি কি বিজেপিকে আরও অনুকূল পরিস্থিতি এনে দেবে?
এ প্রশ্নের উত্তর একটাই– কোনো প্রতিফলের আশায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেনি বিজেপি। পাক-হামলার পিছনে বিজেপির কোনো চক্রান্ত ছিল না। চক্রান্তটা ছিল পাকিস্তানের, পাক- সন্ত্রাসবাদীদের। সুতরাং বিজেপি কিংবা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী কোনো কিছুর আশা করে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেননি দেশকে। এমনকী, এমন আশাও করেননি যে, যুদ্ধ করে জাতীয়তাবোধের আবেগে ধোঁয়া দিয়ে উত্তপ্ত করে ভারতবাসীর হৃদয়সম্রাট হয়ে জিইয়ে রাখতে চান নিজেকে। ভোট নয়, মোদীজী চান—ভারতের জাতীয়তাবোধ, সাহস, শৌর্য, ঐতিহ্য আর পরম্পরাকে জাগরুক করতে। পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিতে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রনীতি নিয়ে হিন্দুত্বের সঙ্গে লড়াই করা যায় না। ভারতীয়ত্বর আর এক নাম হিন্দুত্ব যা বিস্মৃতপ্রায় যুগ থেকে চিরভাস্বর। কোনও রাজনীতি, কোনও রাষ্ট্রনীতি, কোনও সন্ত্রাসবাদ বা পররাষ্ট্রীয় চাপ সেই হিন্দুত্বকে মুছে দিতে পারবে না।
দেশর সেই জাতীয়তাবোধ, সেই হিন্দুত্ববোধ যদি পরীক্ষার মুখে দাঁড়ায়, দেশের মানুষই এর জবাব দেবে। হয় বুলেটে, নয় ব্যালটে।
সনাতন রায়