।।৭।।
কথিত আছে, একদা সৌদরা থেকে কিছু দরিদ্র, পীড়িত , নিপীড়িত জনগন বান্দা সিং বাহাদুরের নিকট জমিদারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসেন। বান্দা তাদের অভিযোগ শুনলেন। তিনি দেখলেন মানুষ গুলো নানা মানসিক, শারীরিক ও অর্থনৈতিক অত্যাচারে জীর্ণ শীর্ণ। কোনো প্রকারে পৃথিবীর ভার বয়ে চেলেছেন। বান্দা মনে মনে বড় কষ্ট পেলেন। প্রচন্ড রাগ হল। চিৎকার করে ডাকলেন সেনাপতি বাজ বাহাদুর কে… হুকুম দিলেন আক্রমণ করার।
প্রজাগন বান্দার এত ক্রুদ্ধ রূপ দেখে অবাক হলেন। বান্দার এরূপ রাগের কারন তাঁরা জিজ্ঞাসা করতে বান্দা চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, ” তোমার এত এত জন…সংখ্যায় প্রায় হাজার হাজার খানেক…তবুও তোমরা এমুঠো পিঁপড়ের মত জমিদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারছ না। নিজেদের রক্ষা করতে পারছ , আমার কাছে সাহায্য চাইছ? লজ্জা হওয়া উচিত তোমাদের।”
এরপর বান্দা সিং বাহাদুর সৌদরার যুদ্ধে সৈয়দ ও শেখেদের পরাজিত করে সেই নিপীড়ত প্রজাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
বান্দা সিং বাহাদুরের প্রবল প্রতাপ উক্ত অঞ্চলগুলিতে দস্যুসম দুষ্ট , জমিদারদের ধ্বংস করেছিল। দেশমাতৃকার জন্য লড়াইয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে ও ধর্ম সংস্থাপনের নিমিত্ত দূর দূরান্ত থেকে শত শত যুবক বান্দা সিং এর সৈনিবাহিনীতে যোগদান করতে থাকেন। সরহিন্দ ভূমিতে আক্রমনের পূর্বে বান্দার বহু শক্তি সঞ্চয় করার প্রোয়জন ছিল। ১৭১০ সালে ফ্রেব্রুয়ারী মাসে সাতৌড়া থেকে পাঁচ ক্রোশ দূরে শিবালিকের উপত্যকায় মুখলিসর নামক স্থানে নিজের রাজধানী স্থাপন করে। বান্দা বাহাদুর এর নাম দেন লৌহগড়। লৌহগড় দুর্গ ছিল পর্বতের মাথায়। খুব শীঘ্রই লৌহগড় দুর্গ মুঘল বিরোধতার প্রতীকে পরিনত হল। দুই দিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি সূচিত হল…..
।।৮।।
এরপূর্ব সময় ১৭০৯ সালে বান্দা সিং বাহাদুর ,তাঁর চরম শক্তিশালী শিখ যোদ্ধাদের নিয়ে মুঘলদের দ্বারা অত্যাচারিত , নিপীড়িত হিন্দু তথা সাধারন জনগণকে সাহায্য করেন ও। সামানা যুদ্ধে অবর্তীন হন। এই যুদ্ধে প্রায় দশ হাজার মুঘল সৈনিক কে পরাজিত করা হয়।
এই যুদ্ধের পর বান্দা সিং বাহাদুর একজন অসীম শক্তিশালী যোদ্ধা শাসকে পরিনত হন। কিন্তু তাঁর হৃদয় তখনো বিচলিত ছিল। যত দিন না তিনি তাঁর গুরুর পুত্রদের হত্যার প্রতিশোধ না নিতে পারেন ততদিন পর্যন্ত মনের বহ্নি জ্বালার নির্বাণ হওয়া সম্ভব ছিল না।
এসেছে সে এক দিন
লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে
না রাখে কাহারও ঋণ।
জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,
চিত্ত ভাবনাহীন।
পঞ্চনদীর ঘিরি দশ তীর
এসেছে সে এক দিন।
সরহিন্দ এ মুঘল সালতানাতকে উচিত শিক্ষা প্রদানের নিমিত্ত যখন বান্দা সিং নিজের শক্তি সঞ্চয় করছিল, সেই সংবাদ বজির খানের কানে পৌঁছল। বজির খান বাতাসের গন্ধ শুঁকে ছিল। বাতাস মৃত্যুর গন্ধে পরিপূর্ণ ছিল। বাতাস বলছিল যুদ্ধ হবে ভয়ঙ্কর….সাম্রাজ্য বাদী নাড়া দিয়ে চারিদিক মুখরিত করে তুলে বজিরও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগল।
ঐদিকে বান্দা বাহাদুর্রর প্রবল পরাক্রম জন উৎসাহ বৃদ্ধি করে ছিল। জনে জনে , গৃহে গৃহে বান্দার নাম ঈশ্বরের সমান উচ্চারিত হতে লাগল। শিশুদের বান্দার মত হবার জন্য উপদেশ দিতে লাগলেন বয়স্করা। কিশোর ,যুবকরা বান্দাকে নিজেদের আদর্শ বানাল। লোকে বলতে লাগল , ” বান্দাকে কেউ মারতে পারে না। বান্দা গুরুর আশীর্বাদে অমর.. তিনি শিবের মত …তিনি চাইলে নিজের পুরো সেনা কে অদৃশ্য করতে পারেন, তিনি চাইলে নিজের আত্মা থেকে লক্ষ সেনা উৎপাদন করতে পারেন। স্বয়ং পবন দেবতা তাঁর কথা শোনেন। তিনি সূর্যের বর পুত্র। তাই সূর্যদেব যদি মনে করেন তাহলে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অন্ধকার নেমে আসে। উনি যদি চান যে কাউকে পশু পাখি বানিয়ে খাঁচায় বন্ধী করতে পারেন। তিনি দৈব অস্ত্র শস্ত্র প্রাপ্ত। তাঁর নিকট সাধারণ অস্ত্র তো ধুলো…”
নিজ বীরত্বে কারনে বান্দা লৌকিক মুখে অলৌকিকে পরিণত হয়েছিলেন। সেই অলৌকিক বান্দার খবর যখন মুঘলরা শুনল তখন তাদের হৃদয় ভয়ে কম্পিত হল। কিভাবে আক্রমন করলে বান্দা পরাস্ত হবে সেই ভেবে তাদের ঘুম উড়ল।
বান্দা সিং বাহাদুর তিনমাস সময় নিয়েছিলেন নিজের প্রশাসন কে সুস্থিত করতে। এর পর তিনি আর সময় নষ্ট করতে চাইলেন না। তিনি লক্ষ্যভেদের খুন নিকটে ই , অর্জুনের মত তিনিও পাখীর চোখ দেখতে পাচ্ছেন। এই চোখের জন্যই তো তিনি একবছর ধরে পথ চলেছেন। এই জন্যই তিনি শিবালিক উপত্যকায় অবস্থান করেছেন। তিনি তাঁর শক্তিশালী জন সৈন্য নিয়ে সরহিন্দ আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন….
দুর্গেশনন্দিনী
(ক্রমশ)