(পূর্ব অংশের পর)

।।৯।।


সরহিন্দ যাবার পূর্বে চপ্পরচিড়ি নামক একটি স্থান অতিক্রম করতে হত। এখান থেকে সরহিন্দ কুড়ি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেই চপ্পরচিড়ি নামক স্থানে বান্দা সম্মুখ যুদ্ধে উপস্থিত হলেন তার চরম শত্রু বজির খানের বিরুদ্ধে। ১৭১০ সালের ১২ ই মে ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ যোগ্য দিন হয়ে থাকল। চপ্পড়চিড়ির যুদ্ধ চলেছিল দুই দিন। ১৪ ই মে বজির খানের মস্তক ভূপতিত হবার সঙ্গে সঙ্গে এই যুদ্ধ সমাপ্ত হয়। যুদ্ধ পরিচালনাকারীর মৃত্যু হলে এমনি তার সৈন্য বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। বান্দার এক সৈন্য বজির খানের কাটা মাথা নিয়ে হাতির উপর হাওদায় চড়ে বসলেন….বান্দা সিং বাহাদুর গুরুর প্রতি জয় উৎসর্গ করে এগিয়ে চললেন সরহিন্দ এর দিকে….

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

দুপুর পেরিয়ে বিকাল হল। বান্দা সিং তার অমোঘ শক্তিশালী শিখ সৈন্যবাহিনী নিয়ে সরহিন্দ দুর্গের এর সামনে উপস্থিত হলেন। বিজয়ী বীর শিখ সৈন্যদের জয়ধ্বনিতে দুর্গের দেওয়াল কম্পিত হয়ে উঠল…সূর্য দেব পশ্চিমে অস্ত যেতে যেতে সমগ্র আকাশ গৈরিক আবির ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন। সন্ধ্যা নেমে এল…বৈশাখের উত্তপ্ত বেলায় রণক্লান্ত বান্দার ঘুম নেই, দূর্গ দখলে র নীতি বানাতে বসলেন….

পরের দিন প্রাতে দূর্গ আক্রমণ করলেন বান্দা। বান্দা ও তার অসীম শক্তিশালী সৈন্য বাহিনীর পরাক্রমের নিকট দুর্গের তোরণ দ্বিপ্রহরের মধ্যেই তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল। সরহিন্দ প্রান্ত বান্দার দখলে এল, মুঘল শাসনের অন্তঃ হয়েগেল। সরহিন্দ এর শাসন ভার কিছু সুযোগ্য ব্যক্তির হাতে অর্পণ করে বান্দা সিং নিজ রাজধানী লৌহগড় প্রত্যাবর্তন করলেন।

১৪ মে ১৭১০ সালে সরহিন্দ এর স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে বান্দা বাহাদুরের লাহোর কে স্বাধীনতার রণনীতি সূচিত হয়েছিল। ১৭১০ সালে র জুন মাসের এক সকালে বান্দা সিং তারঁ সেনাবাহিনী লাহোরের দিকে অগ্রসর হলেন। সেই পথে পড়ল মলেরকটলা , মোরিন্ডা , হশিয়ারপুর, জলনধর, বাটালা, অমৃত্সর…বান্দা এই সমস্ত স্থানকে মুঘল সত্তা থেকে মুক্ত করে লাহোরের দরজায় কড়া নাড়লেন।

পুরো লাহোরকে বান্দা ও তাঁর সৈন্য বাহীনি ঘেরা বন্দী করলেন। এসময় লাহোরের সুবেদার ছিল সৈয়দ বংশের ইসলাম খান। সৈয়দ রা ভারতে এসেছিল আরব থেকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও ধর্ম বিস্তারের উদ্দেশ্যে, কিন্তু পরবর্তীকালে তারা মুঘলদের সঙ্গে মিশে যায় ও উত্তর পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অংশে নিজ অধিকার জমিয়ে বসে। ইসলাম খান এর পূর্বেই বান্দার পরাক্রম সম্পর্কে অবগত ছিল। বান্দা শহরকে ঘেরা বন্দি করছে দেখে তাড়াতাড়ি শহরের সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসে রইল। ফলত, লাহোরের অন্দরে বান্দা প্রবেশ করতে পারলেন না কিন্তু শহরের বাইরের বিস্তীর্ন অংশ বান্দা দ্বারা স্বাধীনতা প্রাপ্ত হল….প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সময় লাহোর থেকে দিল্লি যাবার পথে সমস্ত এলাকা স্বাধীনতা লাভ করেছিল। এর সঙ্গেই দিল্লিতে মুঘল শাসনের অন্তিম ঘন্টা বেজে উঠেছিল।

।।১০।।


শীত আসতে আসতে প্রথম বাহাদুর শাহ বান্দা সিং এর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করল। চারিদিকে গুপ্তচর , গুপ্তঘাতকে ছেয়ে গেল। বান্দার মাথার দাম অনেক অনেক…কিন্তু কোথায় বান্দা? কেউ কোথাও তন্ন তন্ন করে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও তাঁকে খুঁজে পেল। হঠাৎ যেন বান্দা সিং উবে গেছে…পৃথিবী তাকে হয়ত গর্ভে ধারন করেছেন ?বাতাস থেকে মিলিয়েছেন ? সূর্য তাকে আলো করে দিয়েছেন? তিনি কি পঞ্চভুতে লীন হয়ে সবার উপরে নজর রাখছেন?

সাধারণ মানুষের মধ্যে তো লৌকিক বান্দা কে নিয়ে বিভিন্ন অলৌকিক কথা প্রচলিত ছিল… ফলত মুঘলদের নাভিশ্বাস উঠল চিন্তায়। যখন বান্দার জন্য পুরো পাঞ্জাবে মুঘলরা চিরুনি তল্লাশি করছে তখন তিনি পুস্তন এলাকার পর্বতের গভীরে চলে গিয়েছিলেন। পাহাড়ের গভীরে সূচিত হয়েছিল তাঁর নতুন জীবন ,নতুন সংসার।বিবাহ করেছিলেন তিনি। হয়েছিল এক দেবশিশুর মত সন্তানের জন্ম। বান্দা তাঁর সন্তানের নাম রাখলেন অজিত সিং।

এদিকে বান্দার নেতৃত্বে তাঁর সাম্রাজ্য ক্রমশ বিস্তার লাভ করে যমুনা তট পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তাঁর রাজধানী , তাঁর রাজ্য সমৃদ্ধির মুখ দেখছিল। বান্দা বাহাদুর আইন করে তাঁর রাজ্যে মুঘল মুদ্রা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রথম শিখ কৌমের নামে মুদ্রা চালু করলেন তাঁর সাম্রাজ্যের মধ্যে। এরপর তিনি তাঁর সৈন্য বাহিনীর একটি অংশকে উত্তর প্রদেশের দিকে রওনা করলেন।

উত্তরপ্রদেশের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে খালসা পন্থের হাতে মুক্তি পেল সহরানপুর, জালালাবাদ, মুজাফফরনগর ও অন্যান্য আশপাশের অঞ্চল গুলি। শুধু তাই নয়, শিখ সৈন্যগণ এখানের মুঘল দ্বারা নিপীড়িত , কাতর জনগণকে ত্রাণ দান করে তাঁদের বাঁচার নতুন আলোক প্রদর্শন করেন।

কিন্তু আর কত দিন গুপ্ত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা যায়? শিবালিকের যোদ্ধা কেন ভয়ে বাঁচবেন? তাঁর গুরু তাঁকে তো ন্যায়ের জন্য লড়তে শিখিয়েছেন….বান্দা সিং পুনরায় ফিরে এলেন রণক্ষেত্রে র বুকে। এবার তিনি সৈন্য সমাবেশ ঘটালেন গুরুদাসপুরের নিকট গুরদাস নোংগল নামক একটি স্থানে। সরহিন্দ এর পর এবার গুরুদাসপুর নোঙ্গলে ভারতের নতুন ইতিহাস রচিত হতে চলেছিল….

দুর্গেশনন্দিনী

(ক্রমশ)


(পরবর্তি অংশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.