পুলওয়ামার নৃশংস ঘটনার পর দেশবাসীর বৃহদংশই সরকারের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছে, সরকারকে কড়া পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়েছে। ভারতের অধিকাংশ মানুষ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন। তাঁরা জানেন এবং এতদিনে ভালোভাবে বুঝে গেছেন যে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার দিন শেষ। অতীতে বহুবার আলোচনায় বসা হয়েছে, তা সত্ত্বেও পাকিস্তান ভারতের উপর হামলা চালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যথার্থই বলেছেন যে ‘টেরর’ এবং ‘টক’ একসঙ্গে চলতে পারে না। বাংলায় একটা কথা আছে—‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’, কথাটা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রযোজ্য।

পুলওয়ামার ঘটনার পর সারাদেশ শোকাহত। চল্লিশজন জওয়ান দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিলেন। দেশের প্রায় সকল মানুষ প্রতিবাদের জন্য একজোট হয়েছেন। গত সত্তর বছরে বহু ভারতীয় জওয়ান পাকিস্তানের অস্ত্রাঘাতে প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু এবার ভারতীয় জনমানসে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, এমনটা আগে দেখা যায়নি। ভারত সরকার উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করার পরেই পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের হদিশ পেয়েছে। তার উপর ঘটনার অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানে লালিত-পালিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জয়েশ-ই-মহম্মদ ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারপরেও ওই দেশের মিলিটারির কোলে আশ্রিত ইমরান খান প্রমাণ চেয়ে যাচ্ছেন।

ভারত সিন্ধুনদের বাড়তি জল মানবিকতার খাতিরে পাকিস্তানকে দিয়ে যাচ্ছিল এতদিন ধরে। এবার মোদী সরকার সেটা বন্ধ করেছে। এটা বহুদিন আগেই করা উচিত ছিল। পাকিস্তান থেকে ভারতে আমদানি করা হচ্ছিল সিমেন্ট, সৈন্ধব লবণ, চিনি, ফল, চামড়ার কিছু সামগ্রী। এবার আমদানি শুল্ক ভারত সরকার ২০০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে, অর্থনৈতিক দিক থেকে বিপর্যস্ত পাকিস্তান এবার হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে যাচ্ছে।

ভারতের অভ্যন্তরে যে পাকিস্তান বান্ধবরা বিরাজ করছে, তারা পুলওয়ামার ঘটনাটাকে নিয়ে রাজনীতির খেলায় মেতেছে। জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা ওই আত্মঘাতী জঙ্গিটিকে বলছে ‘Home grown terrorist’ অর্থাৎ একটি গৃহপালিত বা ঘরে তৈরি সন্ত্রাসবাদী। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে ‘তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী’ বলতেও দ্বিধা করছে না। অর্থাৎ সে ভারতেরই তৈরি অথবা সে মোটেই সন্ত্রাসবাদী নয়। এই সব নেতা নিজেরাই এক একটি Home-grown বা ঘরে তৈরি এনিমি। এরা বুঝতে পারছে না যে আমজনতা এদের সঙ্গে নেই। এরা এখনও ডায়লগের মাধ্যমে ‘আমন কী আশা’ নিয়ে বসে আছে। এরা কি বোঝে না যে এদের এই সব বক্তব্য পাকিস্তানকে ভারত বিরোধিতায় আরও বেশি উৎসাহ দিচ্ছে? মিডিয়ার একটি বড়ো অংশও মোদী বিরোধী হতে গিয়ে পাকিস্তানপ্রেমী হয়ে বসেছে। এদের মধ্যে পাকিস্তানের কুখ্যাত জঙ্গি পাণ্ডা হাফিজ সইদের অতি প্রিয় একজন সাংবাদিকও আছে।

ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্রে এটাও জানা যাচ্ছে যে, পাকিস্তানের আইএসআই বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে ভারতে অবস্থিত কতিপয় দেশবিরোধী সংস্থার কাছে ফান্ড সাপ্লাই করে। বিভিন্ন ছোটো ছোটো দেশে, যেমন মালদ্বীপ, বাংলাদেশে সেমিনার, কনফারেন্স ইত্যাদি আয়োজিত হয় যেখানে ভারত থেকে স্বার্থান্বেষী প্রতিনিধিরা যায়। এদের মধ্যে অনেক সিনিয়র সাংবাদিক এবং সিনিয়র রাজনীতিবিদও আছেন। এই বিষয়টা নিয়ে সত্যিকারের তদন্ত হওয়া দরকার।

ভারত তার নিজের ভাগের জল পাকিস্তানকে দেওয়া বন্ধ করেছে বলে কিছু পাকিস্তানপ্রেমী লোক কেঁদে কঁকিয়ে একশা। এরা জানে না যে জওহরলাল নেহরু যে চুক্তি করেছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে, সেই চুক্তি অনুযায়ী (Indus Water treaty) চব্বিশ ভাগ জল ভারতের পাওয়ার কথা, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ভারত পেতে থাকল ঊনিশ ভাগ জল, ভারতেরই ভাগের বাড়তি জলটা চলে যেতে থাকল পাকিস্তানে। এটা কি দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা নয় ? নেহরুর সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছেন মোদীজী।

পাকিস্তান এত বছর ধরে ভারতের ‘Most Favoured Nation’ বলে নানা ধরনের সুবিধা, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভোগ করে আসছিল। এবার সেই স্পেশাল স্টেটাস ভারত উঠিয়ে নিয়েছে। প্রতিবেশীর প্রতি বন্ধুত্ব একতরফা হতে পারে না, বিশেষ করে সেই প্রতিবেশী যদি সদাসর্বদা শত্রুতা করে চলে।

পাকিস্তানি কোনও গায়ক-গায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী বা অন্য শিল্পীদের ভারত ভিসা দেবে না। আশার কথা, এবার বলিউডও পাকিস্তানকে বয়কট করেছে। তবে অবশ্য এই বয়কট কতদিন স্থায়ী হবে, বলা যাচ্ছে না।

ক্রিকেট জগতে বিসিসিআই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধনী ক্রিকেট বোর্ড। তারা কিন্তু আরও টাকার লোভে পাকিস্তানের সঙ্গে খেলায় অরাজি নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারতের নামজাদা ক্রিকেটার শচীন তেন্ডুলকার এখনও পাকিস্তানের সঙ্গে খেলতে রাজি। আর কত টাকা চাই তার ? টাকাটাই সব? দেশ কিছু নয় ? যে দেশ তাঁকে প্রচুর ধনসম্পদ, নাম-যশ এবং ‘ভারতরত্ন’ খেতাব দিয়েছে, তার প্রতিদানে কি কিছুই দেবার নেই? রাহুল দ্রাবিড়, অনিল কুম্বলে, সুনীল গাভাসকার, ধোনী—এরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। এদের প্রত্যেকের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া উচিত। একমাত্র সৌরভ গাঙ্গুলী এবং তার সতীর্থ হরভজন সিংহ, বীরেন্দ্র সেওয়াগ ব্যতিক্রম। এরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন।

শুনলে অবাক হতে হয়, ভারত থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘ক্যারাভান’ সম্প্রতি লিখেছে যে, পুলওয়ামার নিহত সিআরপিএফ জওয়ানরা সকলেই নীচু কাস্টের লোক। তারা লিখছে যে ভারতে উঁচু জাতের লোকরা সৈন্যবাহিনীতে কখনো আসেনা। নীচু জাতির, ওবিসি এবং সাধারণ গরিব লোকজনই আর্মিতে যোগ দেয়। পুলওয়ামায় শহিদদের জাত নিয়ে তারা সর্বৈব মিথ্যা লিখছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই ধরনের পত্র-পত্রিকাও যা খুশী তাই লিখে পার পেয়ে যাচ্ছে। কতখানি নিম্নস্তরের মানসিকতা হলে এই ধরনের মিথ্যার বেসাতি করতে পারে শহিদ সৈনিকদের মতৃদেহ নিয়ে? শুধু কি তাই? এই খবর পাকিস্তান লুফে নিয়েছে। এই রিপোর্ট বেরোবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান আর্মির প্রেস কনফারেন্স ডাকা হলো এবং বিবৃতি দিয়ে জানাল যেটা ক্যারাভান লিখেছে। ইন্ডিয়ান আর্মির কম্পোজিশন সম্বন্ধে একই কথা তাদের বিবৃতিতে প্রকাশ পেল। এটা কি একেবারেই কাকতালীয় ? ব্যাপারটা সন্দেহজনক হয় কি?

পুলওয়ামায় আক্রমণ করে জওয়ানদের হত্যা ভারত সরকারকে অ্যাকশন নিতে বাধ্য করেছে। গত ৭০ বছর ধরে বিশেষ করে গত তিরিশ বছরে পাকিস্তান এবং তাদের দ্বারা লালিত পালিত টেররিস্টরা ভারতের অনেক প্রাণ হরণ করেছে, বহু পরিবারকে সর্বস্বান্ত করেছে, বহু শিশুকে পিতৃহারা করেছে, বহু নিরীহ মানুষকে বিকলাঙ্গ করেছে। ভারত এবার আর গান্ধীজীর পন্থা অবলম্বন করেনি, নেতাজী সুভাষের পন্থাই গ্রহণ করেছে। এয়ার ফোর্স পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসবাদী ডেরাগুলোর ওপর বোমা মেরে গুড়িয়ে দিয়েছে, ১০০০ কেজি বোমা ফেলা হয়েছে। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের চিফ এয়ার মার্শাল স্বয়ং জানিয়েছেন যে, তাদের যেটা করবার ছিল, সেই কাজে তাঁরা সম্পূর্ণরূপে সফল।

আমাদের দুর্ভাগ্য, পাকিস্তানপ্রেমী কিছু রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, মিডিয়ার একাংশ, কিছু পলিটিকাল অ্যানালিস্ট, কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ভারতের তরফ থেকে যে বিমানহানা করা হয়েছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং প্রমাণ চাইছেন। তাঁরা বলছেন কজন টেররিস্টকে মারা হয়েছে ‘আমরা জানতে চাই’। এয়ারফোর্সের তরফে জানানো হয়েছে মৃতদেহ গোনা তাদের কাজ নয়। এইসব পাকিস্তানপ্রেমীদের প্রশ্নগুলি পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকার প্রথম পাতার হেডলাইন হয়েছে। হবেই তো, পাকিস্তান তো আনন্দে আটখানা। তাদের শত্রু হিন্দুস্থানে তাদের এত মিত্র রয়েছে, কেয়া বাত!

ভারতের পাকিস্তানপ্রেমীরা বলছে যে ভারতের এয়ারফোর্স কতগুলো গাছে বোমা মেরে ফিরে এসেছে। পাকিস্তানের এক মন্ত্রী তাদের আইনসভায় দাঁড়িয়ে পরিষ্কার জানিয়েছে যে, যেসব মাদ্রাসার ভেতরে জঙ্গি প্রশিক্ষণ চলত, আগ্নেয়াস্ত্র চালানো শেখানো হতো, সেগুলোর আর অস্তিত্বই নেই।

আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে পাকিস্তানের আবোটাবাদে লাদেনের গোপন ডেরায় আমেরিকার মিলিটারি হানা চালিয়ে লাদেনকে হত্যা করে। তার মৃতদেহটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। ওবামা ছিলেন ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট। ওই সময় বিরোধীপক্ষ ছিল রিপাব্লিকান পার্টি। এই পার্টির কেউ কিন্তু লাদেনের মৃতদেহ দেখতে চাননি। আমেরিকার ওই অ্যাকশনে বিপাব্লিকান পার্টির কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেনি, প্রমাণ দেখতে চায়নি। বরং দুহাত তুলে অভিনন্দন জানিয়েছে সরকারকে, মিলিটারিকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- ‘পাকিস্তানকা ঘরমে ঘুসকে মারেঙ্গে’। সেটাই হবে পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার সব থেকে জোরালো অ্যাকশন। জয়েশ-ই-মহম্মদ এবং লস্কর-ই- তৈবা পাকিস্তানেরই প্যারামিলিটারি শাখা। পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনকর্তা হলো সেদেশের মিলিটারি। তাদের পাপেট প্রাইম মিনিস্টার ইমরান খানের কোনও নিজস্ব মতামত বা কর্মক্ষমতা নেই। কিন্তু আমাদের দেশে তার অনুরাগীর অভাব নেই, তারা ইমরানকে ‘শান্তির দূত’ বলে মনে করে। এরাই নিউইয়র্ক টাইমস্, ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টগুলিকে ধ্রুবসত্য মনে করে যারা ভারতের এয়ারস্ট্রাইক নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। তাদেরই কথাগুলিকে এদেশের দিগ্বিজয় সিংহরা কোট করেন, কপিল সিবালরা ওই পত্রিকাগুলির নাম করে বলছেন যে ওদের কথা কি অবিশ্বাস করা যায়? এমনকী আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলেন— আসল সত্যটা কী? বোমাগুলি কি সত্যিই টারগেটে পড়েছিল, না অন্য কোথাও।

ভারতের অভ্যন্তরে জামাত-এ-ইসলাম নামে একটি সংগঠন আছে যাদের জেহাদি কার্যকলাপ ভারতের ঐক্য ও সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক। তারা কাশ্মীরে দীর্ঘদিন ধরে অশান্তি সৃষ্টিকরে যাচ্ছে। এদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের জন্য এদের দুবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের উচিত হবে সতর্ক থাকা। দেশের অখণ্ডতা, একতা, জাতীয়তাবোধ যেন কোনো ভাবেই বিনষ্ট হয়। যে যেভাবে পারি, মানুষকে বোঝাতে হবে, বিশেষ করে নবীন প্রজন্মকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের পাঠ্যপুস্তকে, ইতিহাস গ্রন্থে দেশের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। সূর্যসেন, বিনয়, বাদল, দীনেশ, মাতঙ্গিনী, প্রীতিলতার নাম ওরা শোনেনি, বিবেকানন্দ, লাল-বাল-পাল, ভগৎ সিংহ, নেতাজী সুভাষ, শ্যামাপ্রসাদ এদের কাছে শুধুই কতগুলি নামমাত্র, তার বেশি নয়। ওদের দোষ দেব না, ওদের জানতে দেওয়া হয়নি, ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। যাদের কাছে জীবন-মৃত্যু ছিল পায়ের ভৃত্য, মুক্তির মন্দির সোপানতলে যারা প্রাণ দিল বলিদান, তারা হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। বিবেকানন্দের স্বপ্নের ‘জাতীয় চরিত্র’ তৈরি হয়নি। তবে আমরা আশা ছাড়বো না, চেষ্টা চালিয়ে যাবো। মানুষের মনে, তরুণ প্রজন্মের মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে হবে, কাজটা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়।

ড. রমা বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.