হঠাৎ করে ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। এখন বৃষ্টি গ্রীষ্ম থেকে শীত হেমন্ত থেকে বসন্ত সব ঋতুতে বিরাজমান। দৈনন্দিন জীবনের নিত্য সঙ্গী। সুস্মিতার ভালো লাগে না বৃষ্টি। রাতের দিকে বৃষ্টি হলে গা ছমছম করে। লোডশেডিং-এ ঘরের ভিতর আলো-আঁধারি। বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টির ফলে বিদ্যুতের ঝলকানিতে ঘরের ভিতরটা মাঝে মাঝে আলোকিত হচ্ছে। ভয় ভয় করছে। ঘুম আসছেনা। অথচ ঘুমের দরকার। পরীক্ষা চলছে স্কুলে। মেয়েদের স্কুলেও শুরু হয়েছে বাৎসরিক পরীক্ষা। সকাল সাতটার মধ্যে দুই মেয়েকে কারপুলে তুলে দিতে হয়। মাধ্যমিকের ইনভিজিলেটার এর দায়িত্ব পালন করার সুবাদে মেয়েদের স্কুলে পরীক্ষা চললেও দুই কন্যাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারেনা সুস্মিতা। বড়মেয়ের ছুটি বেলা এগারোটায় আর ছোটোজনের বেলা একটা। অনিচ্ছাসত্তেও দুই মেয়েই কারপুলে ফিরবে। বড়মেয়ে প্রিয়াংকা একটা নাগাদ বাড়ি ফিরে তালা খুলে স্নান করে খেয়ে খানিক বিশ্রাম করে উঠতে না উঠতে কলিংবেল বেজে উঠবে। দিদি দরজা খুললেই ছোটবোন পিয়ালী প্রথমে দিদিকে জড়িয়ে ধরে। তারপর তার বকবক শুরু হয়।
বড়মেয়ের ডাকে সম্বিৎ ফেরে সুস্মিতার। প্রিয়াংকা বলে সে বাথরুমে যাবে, অন্ধকারে তার ভয় লাগছে। সুস্মিতারও গা ছমছম করছে, কিন্তু সে কথা না বলে সে জানায় ইমার্জেন্সি জ্বালিয়ে বাথরুমে যেতে। তারপর দুই মেয়েকে পাশে নিয়ে সুস্মিতা শুয়ে পড়ে। স্বামী জয়ন্ত চাকরি সুত্রে মুম্বাইএ থাকে। ছুটিছাটায় জয়ন্ত আসে। আর বছরে দুবার করে সুস্মিতারা যায় মুম্বাইতে। ভাবতে ভাবতে সুস্মিতা ঘুমের দেশে চলে যায়।
সকালে মেয়েদের কারপুলে চাপিয়ে প্রয়োজনীয় বাজার করে বাড়ির সামনে আসতেই সুস্মিতা দেখে রান্নার দিদি সুমিদি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। সুস্মিতার হাত থেকে বাজার নিয়ে আজ রান্না কী করতে হবে জেনে সুমিদি রান্নাঘরে চলে যায়। সুস্মিতা খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে ধুমায়িত চায়ের কাপ হাতে সুমিদি চা নিয়ে আসে। চা শেষ করে বাড়ির টুকিটাকি কাজ করার পর সুস্মিতা যখন স্নান খাওয়া সেরে রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বেরোয়, ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা দশটা।
আজ সে মাধ্যমিক পরীক্ষার ইনভিজিলেটার হিসেবে গড়িয়ার এক স্কুলে যাবে। ভেবেছিল ক্যাবে করে যাবে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে সিদ্ধান্ত বদলে মেট্রোয় যাবে ঠিক করে। উল্টোডাঙ্গা থেকে অটো করে শোভাবাজারে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে দশটা বেজে যায়। এসি রেকে উঠেই বসার জায়গা পেয়ে যায়। কখন যে সুস্মিতা ঘুমিয়ে পড়ে। আসলে গত রাতে ঠিক ঘুম হয়নি। ঘুম ভাঙ্গে পার্ক স্ট্রীটে। তারপর একে একে ময়দান, রবীন্দ্রসদন আরও বিভিন্ন স্টেশন পেরিয়ে গীতাজ্ঞলি মেট্রো ষ্টেশনে পৌঁছায়। সুস্মিতা নিজেকে গুছিয়ে নেয় পরের ষ্টেশন কবি নজরুলে নামবে বলে। মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে সোজা স্কুলের দরজার সামনে পৌঁছায়।
আজ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিন। নির্দিষ্ট সময় পরীক্ষা শুরু হয়। ছাত্রীরা খাতায় নাম ইত্যাদি লিখতে ব্যস্ত। সুস্মিতার চোখ চলে যায় একটি ছাত্রীর দিকে। খাতার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে। সুস্মিতা এগিয়ে গিয়ে অ্যাডমিট কার্ড কোথায় জানতে চায়। মেয়েটি যেন ঘোরের মধ্যে আছে। সুস্মিতা ভাবে জীবনে প্রথম বোর্ডের পরীক্ষা। একটু ভয় পেতেই পারে। সুস্মিতা আবার জানতে চায় কোথায় অ্যাডমিট কার্ড ? মেয়েটি বলে ‘মায়ের কাছে’। মনে হল খসখসে গলার একটা স্বর, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। অথচ মেয়েটি সুস্মিতার পাশেই আছে।
আশেপাশের কিছু মেয়ের মুখ কিরকম ভীত সন্ত্রস্ত। সুস্মিতা বলে, ‘অ্যাডমিট কার্ড ছাড়া কী করে পরীক্ষা দেবে?’ মেয়েটি কোনো উত্তর দেয়না। সুস্মিতা মেয়েটির বাড়িতে ফোন করে অ্যাডমিড কার্ড আনার ব্যবস্থা করতে বলে। সেইমত স্কুলের তরফ থেকে ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফোন করা হয়।
আজ সকাল থেকে লাহা বাড়ির রেখা লাহা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কত চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এই দিনটার জন্য সেই কবে থেকে সে ও তার মেয়ে সমাপ্তির কত জল্পনা-কল্পনা, কত না প্রস্তুতি। এই দিনটা যে এই ভাবে আসবে রেখা তা স্বপ্নেও ভাবেননি। রেখার স্বামী এক মাস ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী। না! কোনো শারীরিক অসুস্থতার জন্য নয়, নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। এই সেদিনও লাহা বাড়ির মানুষগুলো আনন্দে- উল্লাসে মেতে থাকতো। মা, বাবা, একছেলে ও একমেয়ে নিয়ে ছিল সুখী পরিবার। ছেলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আর মেয়ে এবার মাধ্যমিক দেবে। ছেলের মতো মেয়েও পড়াশুনোয় ভালো। কিন্তু এক মাস আগের সেই দিনটা লাহা বাড়ির মানুষগুলোর জীবন ওলট পালট করে দেয়।
দিনটা ছিল সমাপ্তির জন্মদিন। ছেলে মেয়ের জন্মদিন লাহা দম্পতি নিজেদের মতো করে কাটান। জন্মদিনে ছেলে-মেয়েদের পছন্দসই রান্না হয়; আর পায়েস ও কেক তো সঙ্গে থাকেই। সমাপ্তির বহুদিনের ইচ্ছে একটা সাইকেল। সে দাদার সাইকেলে সাইকেল চালানো শিখেছে। তবে বড় রাস্তায় চালানোর মত হাত শক্ত হয়নি। সমাপ্তির জন্মদিনের ঠিক আগের দিন রাতে সমাপ্তির বাবা সমাপ্তির জন্য একটা সাইকেল কিনে আনেন। সমাপ্তি সাইকেল দেখে আনন্দে নেচে ওঠে। রাতে আনন্দে দুচোখের পাতা এক করতে পারছিল না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাইকেল নিয়ে পাড়ায় সাইকেল চালানো শুরু করে। মা পইপই করে বড় রাস্তায় না যাওয়ার জন্য বলেন।
হঠাৎ করে ফোনের যান্ত্রিক আওয়াজে রেখা লাহার সম্বিত ফিরে আসে। ‘হ্যালো’ বলার সঙ্গে সঙ্গে অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে ‘আপনার মেয়ে অ্যাডমিটকার্ড ছাড়াই পরীক্ষা দিতে এসেছে। আপনি অবিলম্বে অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে আসুন’।
রেখা লাহা কথা বলতে পারছেন না। তবুও কান্না মেশানো ধরা গলায় বলেন, ‘সমাপ্তি এক মাস আগে সাইকেল দুর্ঘটনায়…’ কথা জড়িয়ে আসে। রেখা অবাক! কী করে সম্ভব? যদিও মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করবে বলে অনেক স্বপ্ন ছিল সমাপ্তির। প্রস্তুতি ছিল বহু দিনের।
রেখা ভাবেন সেই অভিশপ্ত দিনের কথা — সাইকেল চালাতে চালাতে এক বন্ধুর সঙ্গে পাড়ায় দেখা হয়ে যায়। সেই বন্ধু সাইকেল নিয়ে বড় রাস্তার উপর কোনও দোকানে যচ্ছিল। সেই বন্ধু বোধ হয় সমাপ্তিকেও তার সঙ্গে যেতে বলে। সেই সময় নতুন সাইকেলের আনন্দে মায়ের নিষেধবাণী বোধ হয় মনে ছিল না। যাওয়ার সময় বন্ধুর সঙ্গে দোকান অব্দি গেছিল; কিন্তু ফেরার সময় বাসের ধাক্কায় সেখানেই সমাপ্তি মারা যায়। সেই সময় সমাপ্তির বাবা বোধ হয় অফিস যাচ্ছিলেন। মেয়ের এই অবস্থা দেখে সেই যে উনি অসুস্থ হন আজও সুস্থ হননি। বেঁচে আছেন এই অব্দি। কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন। এখন বাড়িতে সারা দিন শুয়েই থাকেন।
এদিকে স্কুলে হইচই পরে যায়। পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে যে মেয়েটিকে খাতা হাতে দেখা গেছিল সেই মেয়েটি যেন কর্পূরের মত উবে গেছে। সিসিটিভিতে সুস্মিতাকে ফাঁকা একটা চেয়ারের সামনে কথা বলতে দেখা গেলেও চেয়ারে কাউকে দেখা যায় না। সমাপ্তির স্কুলের সহপাঠীরাও জানত সমাপ্তির মৃত্যুর কথা। কিন্তু হঠাৎ ক্লাসরুমে সমাপ্তিকে দেখে তারা খুশি হয়ে ভেবেছিল খবরটা হয়তো তারা ভুল জেনেছিল। কিন্তু ঘাবড়ে গেছিল তার গলা শুনে। এতদিনের পরিচিত, মিশুকে বন্ধুকে তাদের অচেনা লেগেছিল। একে একে স্কুলের সব শিক্ষিকারা সেই ক্লাসরুম একবার করে দেখে যান। এমনকি প্রধান শিক্ষিকাও বাদ যাননি। সমাপ্তির সহপাঠীরা জানায় মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে মেধাবী ছাত্রী সমাপ্তি খুবই আশাবাদী ছিল। সেইজন্যই হয়তো তার আত্মা এসেছিল মনের সুপ্ত বাসনা পুর্ণ করার জন্য।
ঘটনার আকস্মিকতায় সুস্মিতা দরদর করে ঘামতে থাকে। বিজ্ঞানের ছাত্রী সুস্মিতা বরাবরই ভূতে বিশ্বাসী। এই জন্য স্কুল কলেজে সে বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্র হয়েছে কিন্তু তাঁর জীবনে এরকম ঘটনার সে কখনো সম্মুখীন হয়নি। এখনো সে দরদর করে ঘামছে। সমস্ত ছাত্রীদের খাতা নেওয়া হয়ে গেলে তার চোখ চলে যাচ্ছিল সেই নির্দিষ্ট চেয়ারের দিকে। স্কুল থেকে বেরিয়েও সুস্মিতা অসুস্থ বোধ করছিল। ক্যাব বুক করবে বলে মোবাইল হাতে নিতেই মোবাইলে ফুটে ওঠে সেই মেয়েটি। সুস্মিতা জ্ঞান হারায়।
জ্ঞান ফিরলে দেখে তাকে ঘিরে অনেক মানুষ। ভিড়ে সেই মেয়েটিও আছে। আবার বোধ হয় সুস্মিতা জ্ঞান হারাচ্ছিল, একটা খসখসে গলা ভেসে আসে ‘ভয় পেয়োনা। আমি কোনো ক্ষতি করবো না। বড্ড ইচ্ছে ছিল পরীক্ষা দেবার। তাই ফিরে এসেছিলাম। আজ বুঝলাম ফিরে এলেও পরীক্ষা দিতে পারবো না। তুমি ভয় পেয়োনা আমায় আর দেখতে পাবেনা।’
সত্যি সুস্মিতা আর দেখতে পায়নি। তবে এই ঘটনার পর স্বাভাবিক হতে তার বেশ কয়েক মাস সময় লেগেছিল।
ইন্দ্রাণী সমাদ্দার