গল্প: অলীক আনন্দ

কোথায়ও একটা কোকিল ডাকছে। সামান্য বিরতি দিয়ে ডাকছে। ডেকে যাচ্ছে। 

অদূরে আরিফ সাহেবের মিলের মাঠে নিঃসঙ্গ করবী গাছটায় বসে বুঝি ডাকছে। এর আগে আমি পার্কে কোকিলের ডাক শুনেছি। ভালো লেগেছে। আজ ডাকটা বড় মধুর লাগছে। কেন? জীবন ফুরিয়ে আসছে বলে?

আমি বিছানায় শুয়ে আছি পাঁচ দিন। এক মাস ছিলাম হাসপাতালে। ‍‌৩০ বছরের ধূমপানে আমার ফুসফুস এখন মরণ বিষে ডুবে আছে। মাথার চুল শিথিল হয়ে ঝড়ে গেছে ঝরা পাতার মতো। ডাক্তার বলেছেন, ‘উনি যা খেতে চায় খেতে দিন। যা করতে চায় করতে দিন।’ একটু দূরে গিয়ে কথাটা বলেছিলেন ডাক্তার। আমি বুঝতে পেরেছি। এর অর্থ আমি জানি। এখন আমি স্বাধীন পুরুষ। এতদিন সোনালীর কত বাধা নিষেধ ছিল। আজ আর সোনালী কোন ব্যাপারে আপত্তি করবে না। জানে তো মানুষটা দু’দিনের অতিথি। কিন্তু ও মেনে নিতে পারছে না। ওর চোখ দুটো বর্ষায় ভেজা গাছের পাতার মতো আর্দ্র। আমার কিছু বিষণ্ণতা বেঁচে ছিল রক্তে। এখন তারা মরে গেছে। কোকিলের ডাকটা বড্ড মিষ্টি লাগছে। সুরেলা কণ্ঠ। কেউ একজন বলেছিল, ‘কোকিল কেন ডাকে জানো?’

‘না, জানি না।’ আমি বলেছিলাম।

‘কোকিলাকে ডাকে?’

‘তাই!’

‘কেন ডাকে জানো?’

বলেছিলাম ‘জানি না।’

‘তুমি দেখছি কিছুই জানো না!’ লোকটা একটু অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। 

মানুষ তো সারা জীবনে নিজেকেই জেনে উঠতে পারে না। কোকিলকে কি জানবে? আমি বলতে গিয়েও কথাটা বলিনি।

লোকটা বলেছিল। ‘মৈথুন। মৈথুন! মৈথুন মানে জানো তো?’

মাথা নেড়ে ছিলাম। এটা জানি।

মনে পড়ছে বিয়ের প্রথম দিককার রাতগুলির কথা। তখন দুটো শরীরে প্রতিদিন বহ্নি উৎসব জেগে উঠতো। অর্ধরাত জুড়ে এই উৎসব চলতো। একদিন বাদ গেলেই মনে হতো জীবনটা খালি খালি শূন্য শূন্য। সোনালীর ঘুম ভাঙিয়ে উৎসবের চেষ্টা করেছি। কোনদিন সোনালী বলত, ‘রক্ত’! পরদিন, ‘রক্ত’, তারপর দিনও সেই রক্ত। রেগে উঠতাম। কেন এই ঋতু! চতুর্থ দিন থেকে আবার শরীরের খেলা শুরু। সারা দিন নিরলস কাজ করতাম, রাতের খেলাটার জন্য। মাঝে মাঝে মনে হতো পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে এই খেলাটার জন্য। এই খেলাটা যেদিন মুছে যাবে পৃথিবীতে নেমে আসবে নিকষ অন্ধকার। মানুষ হবে বিরল প্রজাতির প্রাণী। তারপর একদিন ডায়নোসোরের মতো নিশ্চিহ্ন! এই শরীরের খেলা থেকে এল তিতলি। আমাদের একমাত্র কন্যা সন্তান।  সেদিন সোনালীর মুখে মেঘভাঙা রোদ্দুর। সে ছিল মেয়ে। তারপর হলো স্ত্রী, আজ হল মা। চরম পাওয়া। আর আমি ছিলাম ছেলে, তারপর হয়েছি স্বামী। চরম স্তৃপ্তি পিতা। এই পর্বান্তর মনুষ্য জীবনের মহার্ঘ্য আনন্দ। আজকের আনন্দটা অন্যরকম। আর দু’চারটে দিন পর পৃথিবীতে থাকবো না। তার জন্য দুঃখ হচ্ছে না। ষাটটা বছর তো থাকলাম। কম কি! চলে যাবার জন্য দুঃখ কেন হবে? সোনালীর চোখে, তিতলির চোখে আসন্ন বর্ষা। কেন? আমি চলে যাচ্ছি, তাই ওদের কষ্ট। 

আমার মনে পড়ল ভীষ্মের দেহ ত্যাগের কথা। পিতামহের চোখে জল দেখে অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, ‘কৃষ্ণ। পিতামহ এত জ্ঞানী, তবু তার চোখে জল কেন? উনি কি শোকে কাঁদছেন? কৃষ্ণ বললেন, ‘ওকেই জিগ্যেস কর না।’ ভীষ্ম বললেন, ‘কৃষ্ণ তুমি বেশ ভালই জানো সে জন্য আমি কাঁদছি না। এই ভেবে যে, যে পাণ্ডবদের স্বয়ং তুমি সহায়, তাদেরও দুঃখ কষ্টের শেষ নেই। তাই কাঁদছি।’ তোমার লীলা কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাই কাঁদছি। আমার কেন যেন মনে হল ভীষ্মের মতো সব মানুষই এই জীবনের লীলাখেলা না বুঝে কাঁদে। কিন্তু আমি কাঁদছি না। আমি জানি জীবনের এই লীলা খেলার শেষে সকলকে যেতে হবে। আজ না হয় কাল। নিজের জন্য তো নয়ই। কারো জন্যও আমার কষ্ট হচ্ছে না। একটা আনন্দ অলীক আমার শরীরে নাচানাচি করছে। আমি খাটে শুয়ে খোলা জানলা দিয়ে আকাশ দেখছি। কি আশ্চর্য, কোন দিন যা মনে হয়নি, আজ তাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে নীল আকাশটা যেন সীমাহীন সমুদ্র। সাদা মেঘগুলো পালতোলা নৌকো। আমাকে ডাকছে সেই নৌকোর ভেসে অজানা কোন দ্বীপে চলে যেতে। আর সেই নীল সমুদ্রের বুকে একটা অজানা পাখি শুধু ডিগবাজি খাচ্ছে। এতটুকু ভয় হচ্ছে না ওর? কি আশ্চর্য। আমি কি বোকা। পাখির তো ডানা আছে। ও উড়বে। ভল্ট খাবে। যখন খেলা শেষ হবে এই মর্ত্যে নেমে আসবে প্রাণহীন দেহটা। পাখির মতো মানুষও খেলে এই সবুজ উপত্যকায়। এই খেলায় আনন্দ বেদনা, যন্ত্রণা, রক্তপাত সবই অদৃশ্য হয়ে থাকে। এই খেলা শেষে তুমি যাবে। যেমন আমি এখন যাচ্ছি। এখন আমার শুধু আনন্দ, আর আনন্দ। কোন কাজ তো বাকি রাখিনি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। সোনালীর জন্য এফ.ডি. করে দিয়েছি। জীবনের কাজ হয়েছে সারা। এখন অফুরন্ত সুখ।

সোনালী জিগ্যেস করলো, ‘তোমার কী ইচ্ছে করছে কৃষ্ণ এখন?’  

‘একবার জানালার কাছে নিয়ে যাবে আমায়।’ সোনালীর কাঁধে হাত রেখে  জানালার সামনের চেয়ারটায় আমাকে বসিয়ে দিল সোনালী। একরাশ রোদ্দুর আমাকে আলিঙ্গন করলো। গরমের দিনে রোদ্দুরের ভিতর সাইকেল চালিয়ে কাজ করতাম, তখন তীব্র রোদকে কত গালমন্দ করেছি। সেই রোদ আজ আমাকে প্রিয়জনের মতো জড়িয়ে ধরল। রোদেরও যে প্রাণ আছে কে জানতো? অদ্ভুত একটা গন্ধ পাচ্ছি। রোদেরও নিজস্ব গন্ধ আছে, কোনদিন অনুভব করিনি। বুঝতে পারছি জৈবিক কাজে এত বেশি মগ্ন থাকে আমাদের মন, আমরা ভুলে যাই, আমার চার পাশে যে পৃথিবীটা আবর্তিত হচ্ছে, তার সব কিছুর মধ্যে প্রাণ আছে, গন্ধ আছে। অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় বুঝি রোদ নিঃশেষ হয়ে গেছে। আকাশ দখল নিয়েছে এক বিশাল মেঘ। একটু পরে বৃষ্টি ধারা নামল। আমি বাড়িয়ে দিলাম দু’টো হাত জানালার বাইরে। আমার আঙুল, করতল, হাত ভিজে যাচ্ছে বিশুদ্ধ জলে। মনে পড়ল, বৃষ্টির ভিতরই সোনালীকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে ছিলাম একদিন ছাদে। আমি তখন ২৮। তখনই বুঝে ছিলাম বৃষ্টির ভিতরও আগুন আছে। আমরা মিশে যাচ্ছিলাম একে অপরের দেহে দারুণ উত্তাপ নিয়ে।

দুপুরে খেলাম সামান্য। 

বিকেল শেষ হতে দেখলাম বট ঝুড়ির মতো চারপাশে নেমে এসেছে অন্ধকার। আকাশটা এখন এক জাদুকরের কালো কাপড়। সেই কালো কাপড়ে কেউ যেন নিপুণ হাতে বসিয়ে দিয়েছে অজস্র চুমকি। তারা জ্বলছে, নিভছে। কেউ ছুটে যাচ্ছে নিচের দিকে। একটা তারা ছুটে যাচ্ছে আর এক তারার অভিমুখে। রাতের আকাশে নক্ষত্রদের খেলা শুরু। তার মানে মানুষের মতো নক্ষত্ররাও খেলে। নক্ষত্ররা, কক্ষ চ্যুত হয়, মানুষের মৃত্যুর মতো। একটা ফুলের গন্ধ আসছে। বারান্দায় অনেক ফুল গাছ। আমিই এনেছি। তারা কেউ গন্ধ দিয়ে আমাকে আনন্দ দিতে চাইছে। এই আনন্দ পেয়েছিলাম ফুলশয্যার রাতে। সোনালীকে দেখাই যাচ্ছিল না। সেদিন চারপাশে ফুল আর ফুল। সোনালীর সারা শরীরে ফুল। হাতে, গলায়, বুকে মাথায়, চোখেও কি ফুল ছিল? সোনালীর সারা শরীরের ফুলের ভিতর আমি ডুবে গিয়েছিলাম। সেদিনের মিলন অম্লান হয়ে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে সেদিন কি আমি সোনালীর সঙ্গে সঙ্গম করেছিলাম না ফুলের সঙ্গে? কোকিলটা এখন আর ডাকছে না। বোধ হয় সঙ্গীকে পেয়ে গেছে। কিংবা না পেয়ে ছুটে গেছে অন্য প্রান্তে। 

আবার সোনালী আমায় বিছানায় নিয়ে এলো। এত ভালো লাগছে এখন, মনে হচ্ছে আনন্দের স্রোত বইছে আমার রক্তে। হঠাৎই বুকের বাঁ দিকটা লাফিয়ে উঠলো। শ্বাস নিতে কেমন একটু কষ্ট হচ্ছে। সোনালী বলল, ‘কৃষ্ণ, কষ্ট হচ্ছে নাকি?’ 

‘না, কোন কষ্ট হচ্ছে না। জানো সোনালী, তোমার মতো তো ১০০ শতাংশ ঈশ্বরে বিশ্বাসী হতে পারিনি এ জীবনে। তবে মানুষকে বিশ্বাস করেছি। কেউ দুঃখ দিয়েছে। আবার কেউ আনন্দ দিয়ে ভুলিয়ে দিয়েছে সেই দুঃখ। মানুষই আলো, মানুষই অন্ধকার। তবে এই আলোর জন্য আবার আমি ফিরে আসব। এটা আমার বিশ্বাস হয়ত তোমার কাছে নয়। অন্য কোন নারীর কাছে। এখানে নয়, অন্য কোন প্রান্তে। ফিরে আসতে হবে আবার দুঃখ পাবার জন্য! ফিরে আসবো ভালোবাসা পাবার জন্য। আসতে হবে আবার নিষ্পাপ কৈশোর পাবার জন্য। ফিরে আসবো কোকিলের ডাক শুনতে ফিরে আসবো ফুলের সঙ্গে সংগ্রাম করবে। ফিরে আসবই। পৃথিবীর কাছে যত ঋণ আছে, তা শোধ করতে। ক’টা জীবন লাগবে তা জানি না।

ধীরে ধীরে আমার চোখ বুজে আসছে। শ্বাসযন্ত্র ঘুমিয়ে পড়ছে। বহু দূর থেকে সোনালীর কণ্ঠ ভেসে আসছে। ‘কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ। তিতলির কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, বাবা, বাবা, বাবা…।

আমার বুকের ভিতর তখনও একটা অবর্ননীয় আনন্দ ছোট্ট মাছের মতো বিচরণ করছে। 

‘শুনছো?’

‘কে তুমি?’

‘আমি তৃণা। তোমার প্রথম প্রেমিকা।’

‘তুমি এখানে এই সময় কেন? তুমি তো আত্মহত্যা করেছিলে? আমার সন্তানকে তুমি হত্যা করেছিলে!’

‘বিয়ের পরে আমার স্বামী জানতে পারে। তাই আত্মহত্যা করেছি।’

‘তুমি দুটো মানুষের হত্যাকারী।’ 

‘তুমি তো ফিরে আসবার কথা বলেছ, হ্যাঁ, খুনি একবার হলেও তার খুনের জায়গায় ফিরে আসে।’

‘আঃ অলীক আনন্দে তুমি আমায় মরতে দেবে না?’

সোনালী আর তিতলী দেখল এবং খুব অবাক হল, কৃষ্ণের চোখে জল। 

দেবদাস কুণ্ডু 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.