উত্তর:
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ‘জামাতি’ ও ‘বামাতি’ শব্দদুটিকে আক্ষরিক অর্থে না লইয়া রূপকে ব্যাপকতর অর্থে ধরাই বেশি যুক্তিসঙ্গত। প্রথমটি ‘জামাত’ নামের ইসলামিক মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাসী সংগঠনকে বুঝাইলেও সামগ্রিকভাবে ইসলামি মৌলবাদের প্রতিনিধি স্থানীয় শব্দ ধরিয়া লওয়া হইল। আর বাম+অতি =‘বামাতি’ এই সন্ধিবদ্ধ পদটিকেও শুধু অতি বাম নকশাল বা মাওবাদীদের এদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখিয়া সামগ্রিকভাবে বামপন্থী অর্থে ব্যবহার করা যাইতেই পারে। কারণ পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থাকিলেও ভারতের মতো অসহিষ্ণু মৌলবাদী রাষ্ট্রের বিরোধিতায় সবকটি ইসলামিক দল যেমন এককাট্টা, অনুরূপে মাওবাদীদের দাপটে বৈধ বাম সরকারগুলি নাস্তানাবুদ হইলেও দক্ষিণপন্থী বিরোধিতায় বেআইনি মাওবাদীদেরও যে পরম সমর্থক হইয়া উঠে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বুদ্ধা ইন ট্রাফিক জ্যাম’ চলচ্চিত্রটির প্রদর্শন বন্ধের তৎপরতা তাহার নজির রাখিয়াছে। অর্থাৎ ‘অতি’ বিশেষণ বা এখানে অনুসর্গটি প্রয়োজনে গজাইয়া উঠে, আবার সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে ক্ষমতা দখলের স্বার্থে ঝরিয়াও যায়।
আপাত দৃষ্টিতে কিন্তু জামাতি অর্থাৎ ইসলামি মৌলবাদের সহিত বামাতি বা কমিউনিস্ট চিন্তাধারার সংঘাতই অনিবার্য মনে হয়। কারণ কমিউনিস্টরা ধর্মকেই মানে না, ধর্ম তো জনগণের আফিম – সর্বনাশা মাদক। যে ধর্মে অতিরিক্ত গোঁড়ামি, তাহার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সহাবস্থান তো অসম্ভব ব্যাপার। তাই বিংশ শতাব্দীতে পূর্বতন ইউএসএসআর এবং পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রী দেশগুলিই মুসলিমদের সঙ্গে সংঘাতে জড়াইয়াছে বেশি। ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে কমিউনিস্ট দেশগুলো এতটুকু সহিষ্ণুতা দেখায় নাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙিয়া রাশিয়া, বসনিয়া, হরজ়াগোবিনা ইত্যাদি দেশগুলো বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় দেখিয়াছি মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার গোলাগুলি বিনিময় নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। স্বাধীনতাকামী চেচেন জঙ্গিদের রাশিয়া কঠোরভাবে দমন করিয়াছে। আর এই সংঘর্ষে বাস্তহারা মুসলিমদিগকে পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলোর কেহ আশ্রয় দেয় নাই, দিয়াছে গণতান্ত্রিক কিছু দেশ মানবাতার খাতিরে। তাদের অধিকাংশ যেমন ফ্রান্স বেলজিয়াম ইত্যাদি এখন তার প্রতিদান পাইতেছে। মাঝে মধ্যে বোমা বিস্ফোরণ ছাড়াও ঐ দেশগুলোর শত-শত কন্যা জেহাদিদের সেবায় প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যে চালান হইয়া যায়, বা উপযুক্ত মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের পর স্বেচ্ছাতেও জেহাদি আদর্শে ব্রতী হইয়া সিরিয়ায় গমন করে।
কিন্তু ভারতবর্ষে এর বিস্ময়কর ব্যতিক্রম, যেখানে দেশে বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গে ইসলামি মৌলবাদ বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ বন্ধুত্বে এমনভাবে শেকড় চারাইয়াছে, যে মুসলিম-তুষ্টি রাজ্য-রাজনীতির শাখা-প্রশাখায় শিরা-উপশিরায়। বর্তমানে নূন্যতম আড়াল না রাখিয়া যে ভাবে সরাসরি জামাত সিমি ইত্যাদি মৌলবাদী এমনকি জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া চলিতেছে, তাহাতে সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হইলেও বামপন্থীদের তরফে সেই লইয়া কোনও অভিযোগ নাই। বরং তাহারা নিজেদের আরও বেশি মুসলিমপ্রেমী ও হিন্দুবিদ্বেষী, এমনকি ভারত বিদ্বষী প্রমাণ করিয়া হৃত জমি ফেরত পাইতে মরিয়া। এখানে ধর্মান্ধতা বিরোধী আদর্শ অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট পতাকাবাহী তাদের দ্বিতীয় পিতৃভূমি চিন রাষ্ট্রটির ভারতবিরোধী ‘জামাতি’ দেশগুলো সম্পর্কে অবস্থানটি; ঠিক যেমন পবিত্র ভূমি পাকিস্তান স্থির করিয়া দেয় কাফের অধ্যুষিত হিন্দুস্তানের প্রতি ভারতীয় মুসলিমদের মনোভাব কেমন হইবে। দেখিয়া শুনিয়া মনে হয়, সারা বিশ্বের কমইউনিস্টরা জেহাদিদের প্রতি যে অবিচার করিতেছে, তার ক্ষতিপূরণ করার দায়িত্ব লইয়াছে ভারতীয় কমরেডরা।
সাদৃশ্য:
তলাইয়া দেখিলে ‘মাকর্সবাদ’ ও ‘মৌলবাদ’এর মধ্যে নীতিগত ও কাঠামোগত দূরত্ব খুব কম। নৈকট্যগুলি নিম্নরূপ:
(১) দুটোরই কারণ অর্থনৈতিক এবং উৎস দুটি পুস্তক। কমিউনিজ়মের গোড়ার কথা কার্ল মার্কস প্রণীত ‘দাস ক্যাপিটা’ নামের একটি অর্থনীতির বই। আর ইসলামের জন্ম ‘কোরান’ নাম ধর্মপুস্তক, যাহার প্রণেতা হজরত মহম্মদও নিজের মশলার ব্যবসা নিষ্কণ্টকভাবে প্রসারের স্বার্থেই আরব দেশীয় উপজাতিগুলোকে ধর্মের নামে ঐক্যবদ্ধ করিয়াছিলেন।
(২) Islamic Fraternity-র প্রশ্নে যেমন সারা বিশ্বের মুসলমানরা এক, তেমন মার্কসবাদের খাতিরেও ভারতীয় বিশেষত বঙ্গভাষী কমিউনিস্টরা বিশ্বনাগরিক, Communist International বা Comintern-এর সদস্য।
(৩) ইসলামিক মৌলবাদ যেমন সারা বিশ্বের মুসলমানদের এককাট্টা হইয়া ধর্মযুদ্ধে শামিল হওয়ার প্রেরণা দেয়, কমিউনিস্ট মৌলবাদও তেমন কাল্পনিক বিপ্লবের জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। এভাবে দুটো মতবাদই সারা বিশ্বে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখে।
(৪) ধর্মের খাতিরে মৌলবাদী মুসলিমরা যেমন ক্ষেত্রবিশেষে দেশদ্রোহিতাকেও পরম ধর্ম বলিয়া মনে করে, ‘মার্কসীয়’ আদর্শের খাতিরে তেমনি ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি কমিউনিস্টরা দেশ-বিরোধিতাকেই অবশ্য পালনীয় কর্তব্য জ্ঞান করে।
(৫) ব্যক্তিহত্যা ও সন্ত্রাস প্রসারের নীতিতেও যে আশ্চর্য মিল, তাহাও নকশাল হইতে ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনগুলো প্রমাণ করিয়া দিয়াছে।
(৬) উভয়েই অনমনীয়। কার্ল মার্কস বা অ্যাঞ্জেল বাঁচিয়া থাকিলেও নিজেদের তত্ত্বের এমন বিচিত্র সমর্থক দেখে উল্লসিত হইতেন কিনা সন্দেহ; বরং তাঁদের মতবাদকে অনমনীয়, অপরিপবর্তনীয়, অযুগোপযোগী ঈশ্বর উবাচ ‘বাইবেল’ বা ‘কোরান’ বানানো হইয়াছে দেখিলে নাস্তিক হিসাবে কষ্ট পাওয়ারই কথা। অনেককেই বলিতে শুনি, “মার্কস্বাদ একটি বিজ্ঞান’। তাঁহারা কি জানেন না, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কোনও প্রচলিত তত্ত্ব নতুন আবিষ্কারের নিরিখে খারিজ হইতে পারে বা পুরোনো সূত্র সংশোধিত হইতে পার? সমাজবাদ উন্নততর বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের একটা সামাজিক তত্ত্ব, কোনও স্বতোসিদ্ধ সূত্র বা নিয়ম (law) নহে। এর উদ্দেশ্য মহান, তবে তার প্রয়োগকে যে যুগোপযোগী হইতেই হবে, তাহা যুক্তিবাদী কমরেডদের মাথায় না রাখিলেও চলে।
(৭) উভয়েই আবার যথেষ্ট নমনীয় ও স্থানকালপাত্র বিশেষে পরিবর্তিত হইতে পারে – নেতা তথা ধর্মবেত্তাদের কায়েমি স্বার্থে। মানবিক দাবি দাওয়াগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে অনড়, কিন্তু হুজুরদের স্বার্থে ও খামখেয়ালে পবিত্র বইয়ের বাণী গোপন বা অপব্যাখ্যা চলিতেই পারে। সম্প্রতি ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ ও ‘হালালা’ যা আদৌ কোরান সম্মত নয়, এমনকি ভারতের শরিয়তি আইনসম্মতও নয়, তাহাদিগকেই প্রথা বানাইয়া ভালোই বাণিজ্য ও বিকৃত যৌনতার চর্চা চলিতেছিল। সেই যথেচ্ছাচার আইনত অপরাধ ঘোষিত হইতেই মৌলানারা কোরান হাদিসের মর্যাদা রক্ষার করার জন্য ভারত সরকারের উপর প্রসন্ন হওয়ার পরিবর্তে খাপ্পা উইয়া উঠে। কারণ অপরিবর্তনীয় ইসলামি কানুনের পুরুষ স্বার্থান্বেষী পরিবর্তন বা বিকৃতিকেই ব্যালটাস্ত্র বানাইয়া নারী নিগ্রহ চলিতেছিল। অনুরূপে দাস ক্যাপিটাই হোক বা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো হোক – প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক সূত্র ঘোষণা করিয়াও নিজেদের সুবিধা মতো নেতারা সেগুলির বিকৃতি ঘটাইয়া থাকে। তাই “বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস যদি জনগণ সাথে থাকে” কমিউনিস্ট প্রবচন হইতে দ্বিতীয়ার্ধ অর্থাৎ জনগণ পরিত্যক্ত হইয়া শুধু বন্দুকের নল সবকিছুর সমাধান হইয়া যায় – অবশ্যই যদি সেটি স্বপক্ষের দখলে থাকে। বিপক্ষ পাল্টা শক্তি প্রদর্শন বা আত্মরক্ষার চেষ্টা করিলেই ধর্ম (ইসলাম), মানবতা, গণতন্ত্র – সবকিছু রসাতলে যায়; মুহুর্তে জেহাদ বা বিপ্লবের উদ্দেশ্যে অবলম্বিত পন্থা রাষ্ট্রীয় হত্যা হিসাবে পরিগণিত হয়। পরিবর্তন নেতিবাচক হইলে স্বাগত, ইতিবাচক হইলে জেহাদ ও বিপ্লব দুইটাই ব্যাহত। বস্তুত ‘জেহাদ’ শব্দটিকে ছাত্রীকালে নৈতিক ধর্মযুদ্ধ হিসাবেই জানিয়াছিলাম, নাশকতা নয়!
(৮) দু ক্ষেত্রেই নেতারা জনসাধারণকে যাহা উপদেশ দেন, তাহা নিজেদের বা নিজের সন্তানদের বেলা প্রযোজ্য নহে। কট্টর মৌলবাদী নেতারা অনেকেই বিলাস ব্যসনে থাকে, শ্লীলতা নিয়ে কড়াকাড়িতে নারীকে আপাদমস্তক শৃংখলিত রাখে, অথচ সেই নারীকেই বহু পুরুষের ক্ষুধা মিটাইতে যৌন দাসত্বে বাধ্য করে। কাশ্মীরের হুরিয়ত নেতারা গরিব ছেলেদের পাথর ছোঁড়া, গোলাগুলিতে অনুপ্রেরণা দিলেও নিজেদের সন্তানদের বিদেশে রাখিয়া পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে। ওদিকে চাউসেস্কু হইতে জ্যোতি বসু হইয়া মায় কারাত দম্পতি পর্যন্ত, রাজকীয় বিলাসে ডুবিয়া থাকা সর্বহারা নেতারও অভাব নাই। পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষা হইতে ইংরিজি তুলিয়া পরম মাতৃভাষাদরদীগণের আপন সন্তানকে ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর নজিরও আছে। চিনে তো নারী নির্যাতন ও শিশু শ্রমিকের শোষণ খুব নিয়মিত ব্যাপার। এই সমস্ত সর্বহারার প্রতিনিধিরা ঠাণ্ডা ঘরে বসিয়া বোতলের পর বোতল বিলিতি ফাঁক করিতে করিতে বহুদিন পর্যন্ত অল্প শিক্ষিতদের মগজে শ্রেণী চেতনার বীজমন্ত্র ও অশিক্ষিতদের মগজে জঙ্গিপনার উৎসাহ ঢুকাইয়া দিতে দারুণ সফল। আবার ইহাও স্বীকার করিতে হয়, মদ না ছোঁয়া ধর্মভীরু মুসলমানের মতো ব্যক্তিগতভাবে সৎ নীতিবাগীশ বামপন্থীর নিদর্শনও খুব বিরল নহে।
(৯) ২০১৭-য় নির্বাচিত আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তার কারণে কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের ভিসা বাতিল লইয়া বামাতিদের তুমুল শোরগোল, কিন্তু ঐ দেশগুলিতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, নারকীয় নারী ও শিশু নিগ্রহ লইয়া কোনও মাথাব্যথা নাই। এটি শুধু ‘বামাতি’ বা ভারতীয় বামপন্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর কোনও কমিউনিস্ট দেশের এমন সৃষ্টিছাড়া অবস্থান নহে, অন্তত নিজের দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়া তো নহেই।
(১০) চীন বর্তমানে আদৌ সাম্যবাদী আদর্শ অনুসরণ না করিলেও যেমন কমিউনিস্ট দেশ হিসাবে আমাদের বামাতিদের দ্বারা পূজিত, তালিবান বা ISIS ইত্যাদিরা ইসলামের নামে যথেচ্ছাচার চালাইয়াও জামাতিদের কাছে ইসলামের যথার্থ প্রতিনিধি। আর জামাতিদের এই ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ বা লিঙ্গবৈষম্যে মদত দেওয়াকেই বামাতিরা ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল সাব্যস্ত করিয়া রাখিয়াছে। মার্কসবাদ ও মৌলবাদের মতো এই মডেলও অপরিবর্তনীয়।
(১১) বামাতি ও জামাতিগণ কোনও দেশে যতক্ষণ জনসংখ্যা অথবা জনসমর্থনে লঘু, ততক্ষণ তাহারা ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, শান্তি, সম্প্রীতি ইত্যাদি লইয়া সবিশেষ চিন্তা ব্যক্ত করিয়া নিজেদের অত্যাচারিত অবদমিত রূপে বিশ্বের দরবারে তুলিয়া ধরিতে সদা সচেষ্ট থাকে। কিন্তু শিকারের ছদ্মবেশে থাকিয়া ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা দখলমাত্র বিরোধী শক্তিগুলির কণ্ঠরোধ পূর্বক নিশ্চিহ্ন করত মানবতা তথা শান্তির অনন্ত জয়যাত্রা নিশ্চিত করিয়া ফেলে।
(১২) দেশের নাগরিকত্বের প্রশ্নেও দুই সহোদরের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো। আপন অঙ্গবিচ্ছিন্ন প্রতিবেশী দুই সুশীল রাষ্ট্রের ভয়াবহ সংখ্যালঘু নীতির কারণে ভারতের নাগরিকত্ব বিষয়টি স্বাধীনতার সাত দশক পরেও বেশ জটিল ও অমীমাংসিত রহিয়া গেছে। ফলত পূর্বতন বামিস্লামিক ঘনিষ্ট কংগ্রেস সরকারের দ্বারা গৃহীত নাগরিকত্ব সংজ্ঞায়িত করার নীতি গৈরিক সরকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ লওয়া মাত্র তাহাদের সম্মিলিত নাচন-কোঁদন ভিন্ন মাত্রা পাইয়াছে। অত্যাচারিতরা প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় লইলে অত্যাচারীদিগকেও এই দেশে আসিয়া তাহাদের ধর্মসম্মত অত্যাচার প্রকল্প জারি রাখিবার অধিকার দিতে হইবে – এই বিচিত্র দাবিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ (CAA 2019) ও নাগরিকপঞ্জী (NRC)-র বিরোধিতা করিতে গিয়া দেশময় অগ্নিসংযোগ করিয়া ও নিজেরাই দগ্ধের অভিনয় করিয়া বিশ্বের দরবারে দেশের মুখ পুড়াইতে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করিয়াছে। বহুভাষাভাষী ও প্রাদেশিক সংস্কৃতির দেশে যেখানে আইন দুটির অপব্যবহার বন্ধ করিতে সোচ্চার ও সহযোগী হওয়ার কথা, সেখানে মার্কস-মাও ও মহম্মদপন্থীদের জনদরদী শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ড জনগণনার (NPR) মতো আবশ্যিক রাষ্ট্রীয় কর্মসূচীর শিকড়ে কুঠারাঘাত করিতে সমর্থ হইয়াছে।
(১৩) ভারতভূমিতে ইসলামিক ও বলশেভিক সাম্রাজ্যবাদ দুটি বিস্তারেই বাঙালীরাই অগ্রণী ভূমিকা লইয়াছিল। ১৯০৬ সালে এই বাংলারই বুকে ঢাকায় নবাব সেলিমুল্লার প্রাসাদে প্রথম অধিবেশনের মাধ্যমে গঠিত হইয়াছিল ‘মুসলিম লীগ’ নামক অগ্নিকুণ্ড, আর ১৯২০ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ানের তুর্কিস্তানের তাশকন্দে বাঙালী বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় ওরফে নরেনচন্দ্র ভট্টাচার্যের পৌরহিত্যেই সূত্রপাত হইয়াছিল ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’, তাহাও আবার ধর্মান্ধ মুজাহিদ মুসলিমদের ধর্মবিরোধী বলশেভিক আদর্শে দীক্ষিত ও জঙ্গিপনায় প্রশিক্ষিত করিয়াই। যদিও সিপিআই পার্টির মূল রূপকার মানবেন্দ্র রায় ও সহযোগী অবনী মুখোপাধ্যায় নামক দুই বাঙ্গালী, তবে ডিএনএ পরখ করিলে তাহার পিতৃত্ব ইসলামি জেহাদকেই দিতে হয়। কারণ মহম্মদ আলি (আহমেদ হাসান), মহম্মদ শাফিক সিদ্দিকি, ভোপালের রফিক আহমেদ, সুলতান আহমেদ খান তারিন প্রমুখ ফরিস্তাসহ মুজাহিদ বাহিনীর ঔরসেই তুর্কিস্তানের গর্ভসঞ্চার করিয়া ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ (Communist Party of India – CPI)-র জন্ম দেন এই দুই ব্রাহ্মণসন্তান। অবিলম্বে CPI বাংলায় মুজাফ্ফর আহমেদ, যুক্তপ্রদেশে শৌকত উসমানি, পাঞ্জাব ও সিন্ধুপ্রদেশে গুলাম হুসেনের মতো উত্তরাধিকারী লাভ করে, যাঁহাদের জাতীয়তাবাদ বিরোধী কমিউনিটার্ন আদর্শের দৌলতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কোনওদিন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি হওয়ার চেষ্টা করে নাই, বরং তেমন প্রবণতাকে সংশোধনবাদী বলিয়া তীব্র ঘৃণায় ত্যাগ করিয়াছে যাহার উজ্জ্বল নিদর্শন আমরা ১৯৬২-র ইন্দো-চীন যুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ করিয়াছি, যাহার জেরে স্বদেশবিরোধিতার মহান আদর্শে জারিত হইয়া ১৯৬৪-তে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি CPI (M)। এইরূপ সমৃদ্ধ জিনগত উপাদান (Genetic Composition) লইয়া বর্তমানে এই বামাতি ও জামাতিরাই বঙ্গীয় ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা-সাহিত্য ও ইতিহাসের আরবীকরণ দ্বারা বাঙালী জাতিসত্তার ঠিকাদার বনিয়া গিয়াছে, প্রকৃত সনাতনী বাঙ্গালীকে সর্বতোভাবে ছিন্নমূল করিয়া।
লক্ষণীয় ভারতীয় কমিউনিস্টরা স্বদেশের জাতীয়তাবোধে উগ্রতা বা ফ্যাসিজ়ম খুঁজে পান, কিন্তু ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদে কেবল বিপন্ন মানবতার আর্তি দেখেন। তাই জিন্নাহ, সোহ্রাবর্দি বা ভাসামির অখণ্ড সাম্প্রদায়িক বাংলার দুরন্ত আবেগে ইঁহারা আজও আপ্লুত। কাস্তে হাতুড়ি ব্যানারটুকু ধরিয়া রাখিয়া চীন পাকিস্তানকে সরাসরি ভারত বিরোধী নাশকতায় মদত দিয়া যাইতেছে। একদা সন্দেহ হইত ‘হয়তো’, আর এখন সন্দেহাতীত প্রত্যয়ে বলিতে পারি, হয়তো নহে ‘নিশ্চিত’ শুধু সেই কারণেই ভারতীয় কমরেডরা সন্ত্রাসবাদীদের স্বাধীনতাসংগ্রামী সাব্যস্ত করিয়া, এমনকি ভারত বিরোধী স্লোগান দিয়া খোলাখুলি তালিবানদের সমর্থক হইয়া গিয়াছে, আর সনাতন আদর্শে জাতীয়তাবাদী সেবা প্রতিষ্ঠান ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’-কে মরূঘাতক ‘আইসিস’ সাব্যস্ত করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। ‘তালিবান’ শব্দটিও রূপকার্থে ব্যপ্ত যাহার দ্বারা ‘আল-কায়দা’ হইতে ‘তাবলিগী জামাত’ সর্বপ্রকার বিধ্বংসী চিন্তাধারা সূচীত।
স্পষ্টত বর্তমানে ভারতবর্ষে আর বামপন্থী ও জামাতপন্থীদের সত্তা পৃথক করিবার উপায় নাই। তাহাদের যৌথ কর্মসূচী নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করিয়া ২০১৯-এর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ হইতে দেশের সর্বত্র নাশকতা বিস্তারে পারস্পরিক ও মিডিয়ার সমর্থন জুটাইয়া এতটাই সাহস সঞ্চয় করিয়াছিল, যে ২০২০-র ফেব্রয়ারির শেষ সপ্তাহ জুড়িয়া ভারতের রাজধানীতেই সংখ্যাগুরু নিধনের সর্বপ্রকার নৃশংসতা ও উদ্ভাবনী শক্তির সাক্ষ্য রাখিতে সমর্থ হইয়াছে। আবার মিডিয়া ও বৌদ্ধিক মাধ্যমের সদ্ব্যবহার করিয়া নিজেদের সুপরিচিত ‘ভিক্টিম প্লে’ দ্বারা সারা বিশ্বে ঘটনার বিপরীত তথ্য ও উপস্থাপনা ছড়াইয়া দিতে সমর্থ হইয়াছে। এই যৌথ কর্মসূচীর মধ্যে চীনের বিচিত্র খাদ্যাভ্যাস তথা উহান প্রদেশের গবেষণাগার নিঃসৃত ভাইরাসটিকেও হাতিয়ার হিসাবে পাইয়া বিশেষ পুলকিত। তবে বিশ্বময় সংক্রমণ ও কড়াকাড়ির জেরে ‘পঞ্চাশ কোটি ভারতীয় হিন্দু’ নিধনের শান্তিপূর্ণ ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াও চূড়ান্ত প্রাপ্তি ও কোল্যাটারাল ড্যামেজের হিসাবটি কষা হয় নাই। ইতালির বামাতিরা যেরূপ আপন দেশের সমূহ সর্বনাশ সাধনে সাফল্য উদযাপন করার অবকাশ পাইয়াছে, তাহা ভারতের কমিউনিস্টগণ এখন জামাতিবর্গ ও তাহাদের অন্যতম পৃষ্টপোষকরাও করিতে উদগ্রীব।
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার ভারতে নাশকতায় মদত দিলেও চীন যে নিজের দেশে ইসলামিক ধর্মান্ধতা তো বটেই মামুলি ধর্মাচারণ পর্যন্ত বরদাস্ত করে না, তাহার প্রমাণ উইগুর মুসলিম গোষ্ঠীকে কঠোরভাবে দমন হইতে আজান দেওয়া, রাস্তায় নমাজ় পড়া নিষিদ্ধ করা, গারদে পুরিয়া মস্তিষ্কের চিকিৎসা, উইঘুর রমণীদের অমুসলিম পুরুষ সহবাসে বাধ্য করা ইত্যাদি দ্বারা বুঝাইয়া দিয়াছে। রাশিয়াও চেচেন জঙ্গি দমনে ও ইসলামি সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে অনমনীয়তা দেখাইয়াছে। তাহাদেরই অনুসারী হইয়া ভারতীয় কমিউনিস্টদের তাহা হইলে আপনার দেশে এই আত্মঘাতী অবস্থান কেন? এদেশের জামাতিরা জঙ্গি সংগঠনগুলো হইতে অর্থ পায়। তাহা হইলে সাদৃশ্য ক্রমাঙ্ক অসীম (∞) – বামাতিরাও তেমন কিছু পাইতেছে বলিয়া একদা যে সন্দেহ হইত, এখন আর সেই অবকাশ নাই।
বৈসাদৃশ্য:
এতদ সাদৃশ্যের মধ্যে বৈসাদৃশ্য এযাবত একটিই উল্লেখ করিতে পারি। বৃহত্তর জামাতি গোষ্ঠী সামগ্রিকভাবে অদ্যাপি হীনবল হয় নাই, বরং দেশে দেশে আপনাদের অনিয়ন্ত্রিত প্রজনন ও জাতিগত নির্মূলীকরণ কর্মসূচি দ্বারা জ্যামিতিক অনুপাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখিতে সক্ষম হইয়াছে। অন্যদিকে বামাতিরা কিছু জনজাতির বঞ্চনাকে আশ্রয়পূর্বক তাহাদের খেপাইয়া উদ্দেশ্যহীন জঙ্গি সংগঠন ব্যতীত মূল স্রোতের রাজনীতি হইতে প্রায় বিলুপ্ত হইতে বসিয়াছে। কে জানে, হয়তো এই কারণেই বামপন্থীরা আপন ঘোষিত আদর্শবিরোধী উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদকে ধর্মনিরপেক্ষতার ছত্রছায়ায় প্রতিপালন করিয়া অস্তিত্বরক্ষার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাইতে চাহিতেছে।
দর্পণা রায়