কলাসেবী বিমুক্তির পথের দিশারী আমীরচাঁদ অমৃতলোকে।

নমন ১৮৫৭।
উত্তরপ্রদেশের বিঠুর।ছোট গ্রাম। ঐতিহাসিক সেই কেল্লা আজও সাক্ষী হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে রুটি আর পদ্ম ফুল নিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধের সংকল্প করেছিলেন তাঁতিয়া টোপি,বাহাদুরশাহ জাফরের মত যোদ্ধারা। সেই স্থানেই অনুষ্ঠানের যোজনা করলেন তিনি। প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা কে জয় ক’রে অনুষ্ঠান সফল করাই তার লক্ষ্য। তার জন্য নিলেন সংকল্প।সারা দেশ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্মভূমি, কর্মভূমির মাটি মাথায় নিয়ে সকলেরই গন্তব্য বিঠুর। ঐ সমস্ত ঐতিহ্যবাহী স্থানের মাটি কে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে ভারতের নদ নদীর জল সিঞ্চিত করে একীভূত করা হ’ল। শুরু হ’ল তিন দিনের ঐতিহাসিক কার্যক্রম। নমন ১৮৫৭।
যিনি এই কার্যক্রমের যোজনা তৈরি ক’রলেন তিনি এক তরতাজা প্রাণবন্ত এক কার্যকর্তা। তিনদিনের এই অনুষ্ঠানে লক্ষ্য করলাম, কখনও তিনি মঞ্চে উঠলেন না। অনুষ্ঠান চলাকালীন পায়ে চটি পরলেন না। কারণ জিজ্ঞাসা করলাম!
উত্তর এল, “সংকল্প আছে। মঞ্চে অনুষ্ঠান চলাকালীন চটি পরব না।”
মঞ্চকে এমন মর্যাদা কেউ দিয়েছেন?
যিনি দিয়েছেন, দিতে শিখিয়েছেন,
তিনিই আমীরচাঁদজী ।

একেই বোধ হয় বলে সংকল্প! সারা জীবন যিনি সংকল্প ও লক্ষ্য থেকে সরে যাননি।

১৯৬৫ সালের ১ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলা সদর থেকে ৫ কিমি দূরে হনুমানগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম অবোধকিশোর এবং মাতা গুলজারিয়াদেবী, মোট সাত ভাই বোনের মধ্যে ষষ্ঠ সন্তান, আমীরচাঁদ ছোটবেলা থেকেই তার ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। স্কুল জীবনেই ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আচার -অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই আকর্ষণেই স্কুল জীবনে সঙ্ঘের শাখায় যাওয়া শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি আজমগড় থেকে সংঘের প্রচারক জীবন শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে সংস্কার ভারতী পূর্ব-উত্তরপ্রদেশ অঞ্চলের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেই শুরু, তারপর থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতি রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ আমীরচাঁদ। দায়িত্ব বাড়ল। সংস্কার ভারতীর অখিল ভারতীয় সহ সংগঠন সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেন আমীরচাঁদ। কাজও গতি পেল। ঠিক এমনই সময়ে ভারতীয় সংস্কৃতির উপর চরম আঘাত এল।

কাশীর গঙ্গা ঘাটে দীপা মেহেতা ‘ওয়াটার’ সিনেমার সেট তৈরি ক’রে শুরু করলেন শুটিং। যে সিনেমার চিত্রনাট্যে কাশীতে দেবাদিদেব মহাদেবের চরণপ্রান্তে আশ্রয় নেওয়া ভারতের বিধবা রমণীদের ভোগ্যবস্তু হিসাবে দেখানো হ’য়েছিল। এহেন ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিরোধী সিনেমার প্রতিবাদে প্রথম গর্জে উঠল সংস্কার ভারতী। সারা বেনারস জুড়ে শুরু হ’ল জনজাগরণ। যে আন্দোলনের নেপথ্য নায়ক সেই আমীরচাঁদ। আন্দোলন যখন বেশ জোরালো হ’য়ে উঠেছে, তখন কাশীর উপর দিয়ে ট্রেনে ক’রে প্রবাসে যাচ্ছেন সঙ্ঘের অখিল ভারতীয় সর কার্যবাহ এইচ.ভি.শেষাদ্রিজী। খবর পেয়ে ছুটলেন আমীরচাঁদ।
এক মিনিটের জন্য ট্রেন থামল স্টেশনে। শেষাদ্রিজী জানলা দিয়ে আমীরচাঁদ কে ইঙ্গিত করলেন, “ওরা এখনও আছে কেন?”
সঙ্ঘের ইশারা মিলতেই জনজাগরণকে গণআন্দোলনে পরিণত ক’রলেন আমীরচাঁদ।সংস্কার ভারতীর প্রবল আন্দোলনের চাপে সেদিন দীপা মেহেতাদের শুটিং বন্ধ ক’রে পালিয়ে আসতে হ’য়েছিল। তখন এমনই চাপ তৈরি হয়েছিল যে, বাংলার সংবাদপত্রেও আমীরচাঁদজীর নাম উল্লেখ ক’রে বড় বড় খবর হ’য়েছিল।

পরমপূজনীয় গুরুজী বহু আগেই সতর্ক ক’রে বলেছিলেন, “পূর্বোত্তর জ্বলছে, সতর্ক হও।” সেই থেকে সঙ্ঘ ও সংস্কার ভারতীর লক্ষ্য হ’য়ে উঠল “দৃষ্টি পূর্বোত্তর”। সংস্কার ভারতীর সংরক্ষক শ্রদ্ধেয় বাবা যোগেন্দ্রজী নজর দিলেন ।পরবর্তীকালে তাঁর নির্দেশেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য গুলিতে ছুটলেন আমীরচাঁদ। কারণ খৃষ্টানমিশনারীদের মদতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে তখন ভারত বিরোধী শক্তি অতি সক্রিয়। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার দিয়ে লড়াই শুরু ক’রলেন আমীরচাঁদ। ভারতীয় সংস্কৃতির পুনর্জাগরণে আমীরচাঁদজী পূর্বোত্তরের শিল্পী কলাকুশলীদের ভিশন দিলেন- “আমাদের সংস্কৃতি আমাদের পরিচয়।” আসাম, মিজোরাম, অরুণাচল, ত্রিপুরা, মেঘালয়, সিকিমের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকেই অগ্রাধিকার দিতে শুরু ক’রলেন আমীরচাঁদ। আর তাতেই আপন হ’য়ে উঠলেন জনজাতি সমাজের মধ্যে। প্রবল প্রতিকূল আবহাওয়া, বিপরীত আহার, কিন্তু পিছু হটেননি তিনি। ভিত শক্ত হতেই ২০০৩ সালে রঙ্গোলী বিধা’র প্রকাশ্য অনুষ্ঠান। নববর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হ’ল গুয়াহাটিতে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে। নতুন সূর্যকে সাক্ষী রেখে নদী বক্ষে অর্ঘ্য প্রদান ক’রলেন ভারত বিখ্যাত শিল্পীরা। ভুপেন হাজারিকা, অনুপ জলোটা আরও কত নাম। এক অপুর্ব ভাবনা! রূপকার আমীরচাঁদ। এহেন প্রকাশ্য অনুষ্ঠানের ফলে, সম্পূর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রভাব বিস্তার ক’রতে শুরু ক’রল সংস্কার ভারতী।
কলকাতার কেশব ভবনকে কেন্দ্র ক’রেই আমীরচাঁদজী উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের পাহাড় পর্বত চষে বেরিয়েছেন। খুঁজে বার ক’রেছেন প্রাচীন জনজাতির অপূর্ব সব শিল্পকলা। তাদের সংস্কৃতিকে এই প্রথম কেউ মর্যাদা দিল। এমনই অনুভব ক’রতে শুরু করল ভাষা না জানা নাগাল্যাণ্ড মিজোরামের অরণ্য অধ্যুষিত মানুষেরা, যাদের কথাই কেউ মনে রাখেনি। তাদের আবার সংস্কৃতি? তাদের শিল্প ধারাকে আমীরচাঁদের উদ্যোগেই পৌঁছে দেওয়া হ’ল দেশের রাজধানীর রাজপথে। সালটা ২০০৫, পূর্বোত্তরের শিল্পীদের নিয়ে এসে মঞ্চ দিলেন নতুনদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন প্রাঙ্গণে। সঙ্গীত, নৃত্য, বাদ্যে পরিপূর্ণ পূর্বোত্তরের সংস্কৃতি যে আমাদের দেশের সংস্কৃতি তা অনুধাবন করালেন সংস্কার ভারতীর মাধ্যমে। সালটা ২০১১, পূর্বোত্তরের সাত রাজ্যের ৫ হাজার প্রতিভাবান শিশুশিল্পীদের নিয়ে “বাল কলা সঙ্গম”-এর রূপকার আমীরচাঁদ।

সবসময় সৃষ্টিশীল, অভিনব, অপূর্ব সব ভাবনা চিন্তা মাথায় খেলত। তাই তো ‘এ্যায় মেরে বতনকী লোগো, জারা আঁখমে ভরলো পানি।’ এই একটি গানকে কেন্দ্র ক’রে প্রাণপ্রিয় রাজ্য অরুণাচলের ইটানগরে কার্যক্রমের যোজনা তৈরি ক’রলেন তিনি। নাম দিলেন “শরহদ কী স্বরাঞ্জলি”। ১৯৬২ চিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই এই কার্যক্রমের পরিকল্পনা। ঐ যুদ্ধের শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মাননা। নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেওয়া যে, এই দেশের জন্য তোমাদের পূর্বজ’রা প্রাণ বলিদান দিয়েছেন। সারা অরুণাচল জুড়ে একদিনে এক সময়ে গীত হ’য়েছিল লতাজী’র সেই বিখ্যাত গান। বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতবাদের সরকার ছিল সেখানে কিন্তু সংকল্পকে বাস্তবায়িত ক’রতে ততোধিক দৃঢ়চেতা ছিলেন আমীরচাঁদজী।শতবাধা সত্ত্বেও সফল হলেন। সংস্কার ভারতীর প্রভাবে তৎকালীন অরুণাচল সরকার স্থায়ী সংগ্রহশালা তৈরি ক’রলেন ইটানগরে।
কিন্তু এর মাঝেই কলকাতায় তাঁর কেন্দ্র হওয়ার কারণে সমগ্র বাংলা জুড়ে কাজের বিস্তারের জন্য শাখায় শাখায় প্রবাস ক’রেছেন। নিজেকে বাঙালি ক’রে তুলেছিলেন। বাংলা বলা, বোঝা কোনটাই অসুবিধা হ’তনা তাঁর। বাংলার প্রতি, শাখার প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ দৃষ্টি। ২০১৪ সালেই তাঁর কেন্দ্র বদল হ’ল। দিল্লি গেলেন। দেশ জুড়ে রাষ্ট্রবাদী ভাবনার সমস্ত শিল্পী কলাকুশলীদের নিবিড় সম্পর্ক গ’ড়ে তুললেন। তাঁর আপন সখ্যতায় ঐসব প্রতিভাবান, জগৎবিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে সংস্কার ভারতীর কাজে জোয়ার আনলেন তিনি। ২০১৮ য় দিল্লিতে আয়োজিত অখিল ভারতীয় সাধারণ সভায় আমীরচাঁদজী’র হাতেই তুলে দেওয়া হ’ল সংগঠনের নেতৃত্বভার।তিনি অখিল ভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে এলেন।

দেশ যখন ভয়ঙ্কর করোনা অতিমারীর কারণে বিধ্বস্ত তখনও স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষে উৎসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করলেন। দেশ জুড়ে প্রবাস শুরু ক’রলেন আমীরচাঁদজী। সঙ্ঘের বরিষ্ঠ কার্যকর্তা অরুণকুমারজী ও নন্দকুমারজী এবং আমীরচাঁদজী সারা দেশ ঘুরে ঘুরে বৈঠক ক’রলেন। কত পরিকল্পনা, ভাবনা, প্রস্তুতি ছিল তাঁর। দেশ জুড়ে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবকে প্রভাবী ক’রে তুলতে শুরু করেছিলেন সুচারু পরিকল্পনা। সংস্কার ভারতীর সংগঠনের অন্দরে একাধিক পরিবর্তন আনলেন তিনি। আরও যুগোপযোগী ক’রে তুললেন প্রিয় সংগঠনকে।

হিমালয়ের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ছিল তাঁর।
অরুণাচল যে তাঁর বড় প্রিয় জায়গা। পাহাড় ঘেরা প্রতিটি গ্রাম তাঁর চেনা। জনজাতির মানুষজন সঙ্গে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠতেন বার বার। সেই পূর্বোত্তরের অমোঘ আকর্ষণেই ফের গেলেন নাগাল্যাণ্ড, আসাম হ’য়ে অরুণাচল। পৌঁছলেন তাওয়াং। গত এক বছরের মধ্যেই পূর্বোত্তরকে ভালোবেসে অমৃত পথে যাত্রা করেছেন বিমল লাটজী, শুকদেব বিশ্বাস। তাদের ছেড়ে হয়তো থাকতে বড় কষ্ট হ’চ্ছিল আমীরচাঁদের। তাই অরুণাচলেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন আমীরচাঁদজী।

দেশমাতৃকার সেবক। দেশরক্ষায় অরুণাচলেই রয়ে গেলেন। ১৬ অক্টোবর ২০২১, দেশ হারালো ভারতীয় সংস্কৃতি রক্ষায় আজীবন সমর্পিত, কলাসেবী, সংস্কৃতি সংরক্ষক আমীরচাঁদকে। আমরা হারালাম আমাদের আমীরচাঁদজীকে।

তিলক সেনগুপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.