বেলেঘাটার মুন্সী পরিবারের কজন মেম্বার গোনা যাক।
১। শিবনাথ মুন্সী – – বাড়ির কর্তা ( ছিলেন একসময়, এখন বসে শুয়েই দিনরাত কাটে)।
২। প্রতিমা মুন্সী– শিবনাথবাবুর স্ত্রী ( এখনো দাপটের সঙ্গে রান্নাঘর দখলে রেখেছেন)।
৩। সুমন মুন্সী– শিবনাথবাবুর বড় ছেলে ( রাজ্য সরকারের অর্থ দপ্তরে চাকরি করে)।
৪। রিমা মুন্সী — সুমনের স্ত্রী ( ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের টিচার। সিক্স, সেভেন, এইটে অঙ্ক করায়)।
৫। ঋতম মুন্সী — সুমন – রিমার ছেলে ( ক্লাস ইলেভেনে কমার্স পড়ে। এঁচোড়ে পক্ক যাকে বলে)।
৬। শোভন মুন্সী — শিবনাথাবাবুর ছোট ছেলে ( ব্যবসা করে। আয়ুর্বেদিক সামগ্রী বানানোর প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঁচা মাল সাপ্লাই করে)।
৭। কমলিকা মুন্সী– শোভনের স্ত্রী ( বাড়িতে বসেই অনলাইনে কনটেন্ট রাইটিং করে দিব্বি রোজগার করে)।
৮। কিঙ্কিণী মুন্সী — শোভন- কমলিকার মেয়ে ( আট বছর বয়েস। ক্লাস টু তে পড়ে। অবশ্যই ইংলিশ মিডিয়ামে)।
৯। সুজাতা বাসু — শিবনাথবাবুর মেয়ে। সবার বড় ( কানাডায় থাকে। বছরে একবার কলকাতায় এসে মাস খানেক থেকে যায়। এবার এসে লকডাউনে আটকে গেছে)।
১০। শীলা মণ্ডল– মুন্সী বাড়ির ২৪ ঘণ্টার কাজের মেয়ে ( বছর তিনেক আছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মিনাখায় বাড়ি। অবিবাহিত)।
১১। পরিমল দাস– বাড়ির নিরাপত্তা দেখাশোনা করে ( কিছু মাস হল কাজে লেগেছে। ওর বাবা পঁয়ত্রিশ বছরের ওপর কাজ করে বয়েসের কারণে অবসর নিয়েছে)।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মুন্সী পরিবারের ন’জন মেম্বার আর বাইরের দুজন, আপাতত তারা মুন্সী পরিবারেই আছে অর্থাৎ এগারোজন মিলে আছে ৪২/বি বেলেঘাটা মেন রোডের এই বাড়িতে।
বিশেষ এক রোগের কারণে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষিত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সমস্ত কাজ বন্ধ, যানবাহন চলছে না, জরুরি কাজ ছাড়া মানুষের রাস্তায় বেরোনোই মানা। এই অবস্থায় দেখে নেওয়া যাক মুন্সী বাড়ির এই এগারোজন কী ভাবছে।
শিবনাথ– ইহ্, কি যে দিনকাল পড়ল। এক অনুজীবীর ভয়ে মানুষ গত্তে ঢুকে বসে রইল। যুদ্ধ দেখলাম, দুর্ভিক্ষ দেখলাম, মহামারীও দেখিনি তা নয়। ওই কলেরা। কিন্তু এমনতারা জম্মে দেখিনি। হাত-পায়ের নখগুলোর এমন অবস্থা, নাড়ুটা না এলেই নয়। এত শক্ত নখ যে নরুন ছাড়া তো কাটাও যাবেনা। কবে যে উঠবে এইসব বন্ধ্! আচ্ছা, নাড়ু পুলিশের পারমিশন নিয়ে আসতে পারবে না?
প্রতিমা– মেয়েটা বছরে একবার মাত্র আসে, একটু সজনে ফুলের বড়া খাওয়াতে পারলাম না এখনো অবধি। সুমু রে, দেখনা যদি জোগাড় করা যায়।
সুমন– চারবেলা চব্য চোষ্য খাওয়া জুটছে এটাই অনেক মনে করো মা। দেশের অর্ধেক লোক খেতে পাচ্ছে না। দিদিভাই তো এখনই যাচ্ছে না। সিচুয়েশন নরমাল হলে আনা যাবে। আমাদের কম্পানির যা লস হচ্ছে, কটা ঘাড়ে যে কোপ পড়বে, গড নোস। আমার চাকরিটাও থাকলে হয়!
রিমা — উফ্, অনলাইন ক্লাস নিয়ে নিয়ে হাঁপিয়ে গেলাম বাবা। বাকিরা তো দিব্বি ফূর্তিতে আছে। আজ শ্যাম্পুও করতে পারলাম না। উনি ( ননদ) ঢুকে বসেছিলেন প্রায় এক ঘন্টার ওপর। কিছু বলা যাবে না, বিলিতি কিনা! কি প্যাতা প্যাতা লাগছিল আজ আমাকে দেখতে। ডিসগাস্টিং! গেলে বাঁচি।
ঋতম– সুইটহার্ট শোনো ( কানে ইয়ারফোন, মুখে সিগারেট। সকাল এগারোটায় ছাদে), এই ডিস্ট্যান্সের ফলে আমাদের লাভ যে কতটা ইনটেন্স সেটা বুঝতে পারছ তো। এই সময় আমাদের অনেক বন্ধুদের রিলেশন কাট অফ হয়ে গেছে, জানো? মিট করতে পারছে না তাই কনটিনিউ করবে না। ওয়াট কাইন্ড অফ লাভ দোস আর? আর আমি? রোজ তোমাকে আরো বেশি করে ভালোবাসছি।
আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো অনলাইন অ্যাকাউন্টসের ক্লাস সেরে এলাম। জীবনে শান্তি নেই মাইরি! সারা পৃথবীতে লোক মরে হাপিস হয়ে যাচ্ছে আর এরা এক ঘণ্টা ক্লাস করিয়ে পন্ডিত তৈরি করছে। যত্ত সব আল বা… সরি, সরি। মাথাটা চড়ে যায়। ওক্কে, রাতে কথা হবে। এখুনি ডাক পড়বে, চান কর, খা, ঘুমো। সবকটা বাড়িতে বসে আছে আর মাথা খাচ্ছে আমার। বাই বেব, মুয়াহ।
শোভন– আমার এক লরি মাল আটকে আছে বর্ডারে, ঢুকতে পারছেনা। সব পচে যাবে রে। গেলো এবার আমার ব্যবসা! র ‘মেটেরিয়াল খারাপ হলে কম্পানিগুলো তো আর নেবেনা। মালের দাম, ট্রান্সপোর্ট খরচ — সব দিতে হবে কিন্তু আমদানি? – – আ বিগ জিরো। শালা চীন! উড়িয়ে দেওয়া উচিত ওই বরাহ নন্দন দেশটাকে।
কমলিকা– আমার তো যথা পূর্বং তথা পরং! পার্সোনালি নতুন কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, তুমি বাড়িতে আছ ( কর্তা) বলে খ্যাচাখেচিটা একটু বেশি হচ্ছে। এত আনরিজনেবল কথা বললে সহ্য করা মুশকিল। এখন থেকে আর ওসব বোকা বোকা কথায় পাত্তা দেবনা, জাস্ট ইগনোর করব। বিরক্তিকর।
কিঙ্কিণী– বাপি, পার্কে নিয়ে চলোনা। সিস চড়ব… ও বাপি, চলোনা। কতদিন পার্কে যাইনা। দাদাভাই নিয়ে যাচ্ছে না। কাকে যেন কিসি দিচ্ছে। নাহলে আইসক্রিম এনে দাও। ওই ওরিও কোন। দাও না। ও বাপি…
সুজাতা — এসব মিটলে লিভিং রুমের জন্য একটা নতুন শ্যান্ডেলিয়ার কিনো রিমা। একদম বাজে দেখতে হয়ে গেছে। আমাদের ওখানে হলে তো এই নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে যেত। আর বাবা- মায়ের খাটটা একটু পালিশ করাস, বুঝলি সুমন। টিক উডের খাট, এখন এর ভ্যালু কত জানিস? এসবের যত্ন করতে হয়। মাকে গ্লুকোসেমাইন অ্যালং উইথ ক্যালসিয়াম খাওয়াস। ইস্, ব্যাথায় কত কষ্ট পায় মা। আমাকে বললে তো আমিই নিয়ে আসতে পারতাম। তোদের জামাইবাবু তো এই ওষুধের জোরে দাঁড়িয়ে আছে। ইনফ্যাক্ট, হি ইস রানিং নাউ! অ্যামেজিং ওষুধ। মা বাবার একটু খেয়াল তো রাখতে পারিস তোরা।
শীলা– সব কটা বাড়ি বসে আছে আর কাঁড়ি কাঁড়ি গিলছে। আমার প্রাণ যায় যায়। শীলা, একটু পেঁয়াজি ভেজে রাখিস তো, বিকেলে মুড়ি দিয়ে খাব সবাই… শীলা, জমিয়ে একটু ডিমের ডালনা রান্না করিস তো, কতদিন খাইনা। ওহ্, যেন খেতে পায়নি অ্যাদ্দিন। আমি কিনা বাড়ির চিন্তায় মরছি, আর এনারা খেয়ে মরছেন। যত্তসব। লড্ডাউন না কি ছাতার মাথা, উঠলে বাঁচি।
পরিমল– দেড়মাস বয়েস হয়ে গেল মেয়েটার। কবে যে সোনামায়ের মুখখানা দেখব!
চুমকি চট্টোপাধ্যায়