।।৩।।
এতদিন যে লড়াই রাজস্থানের ধূসর মরুভূমিতে লড়া হচ্ছিল তা পাঞ্জাবের মধ্যে সঞ্চারিত হল।
মুঘল বংশ যত পুরুষের পর পুরুষ এগতে লাগল , তত তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ছিল। ১৬৫৮ সালে আওরঙ্গজেব মুঘল সিংহাসন আরোহণ করে। এই সময় কিন্তু ভারতের ধর্মীয় ডেমোগ্রাফি গোঁড়া সুলতানের হাতে পড়ে ভয়ঙ্কর ভাবে বদলাতে শুরু করে। ফলত এই সময়ে মুঘলদের বিরোধিতার জন্য বহু দরজা উন্মোচিত হয়।
এই সময় শিখ গুরু ছিলেন গুরু তেগ বাহাদুর। গুরু তেগবাহাদুর ” হিন্দ কা চাদর ” নামে সুবিখ্যাত ছিলেন। মুঘল অত্যাচার, ধর্মান্তর ইত্যাদি সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হন। তিনি মুঘল বিরোধী আন্দোলনকে একটি সুসংহত রূপ প্রদান করেছিলেন। ফলত , তাঁকে বন্দী বানিয়ে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ভয়ঙ্কর অত্যাচার করে হত্যা করা হয়। তিনি শহীদ হন বটে, কিন্তু শিখ আন্দোলন তখন একটি মজবুত আন্দলনের রূপ গ্রহণ করেছে।
এদিকে ভারতের উত্তর পূর্ব অংশ আওরঙ্গজেবের বাহিনী ঘিরে ছিল। ভারতের উত্তর-পূর্ব বিপদে ছিল। সেই বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন লাচেত বরফুকন। তিনি অসম্ভব শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন। সরাইঘাট যুদ্ধে লাচেত বরফুকনের ভয়ঙ্কর পরাক্রম মুঘল বাহিনীকে শুধু অবাকই নয় ভীতও করেছিল।
ওই দিকে দক্ষিণাত্যে উত্থান ঘটল এক পরাক্রমী বীরের । সেই গৈরিক যোদ্ধার নাম হোলো শিবাজী। যিনি মারাঠা সাম্রাজ্যকে সূর্যের ন্যায় উদিত করেছিলেন। যাঁর যুদ্ধনীতি , কূটনীতি, রাজনীতি মুঘল শাসনের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল। যিনি মুঘল শাসনকে পরিহাস করে একটি ঐক্য বদ্ধ হিন্দু রাজ্য প্রতিস্থাপন করে , রাজা হিসাবে অভিষিক্ত হন। মুঘল সুলতানদের প্রকৃত অন্ত তাই মারাঠা সাম্রাজ্যেই হয়ে গেছিল।
।।৪।।
পাঞ্জাবে মুঘল শাসনের ভিত্তি গুরু গোবিন্দ সিং টলিয়ে দিয়েছিলেন। পূর্বেই বলেছি যে বাবরের মাধ্যমে শুরু হওয়া মুঘল সাম্রাজ্য আওরঙ্গজেব পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে ভিত নষ্ট হয়ে গেছিল। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণে চারটি দিকের জাতীয়তবাদ মুঘলদের ঘিরে ধরেছিল। শেষ প্রহার করলেন গুরু গোবিন্দ সিং। মুগল সাম্রাজ্যের পতন হয়তো আরো আগে হয়ে যেত। কিন্তু বিভিন্ন ঘর শত্রুরা বিষয়টি কে দূর অবধি টেনে নিয়ে গেছিল।
১৬৯৯ সালে তিনি খালসা পন্থ এর স্থাপনার উদ্দেশ্যে শিবালিক পর্বতের উপত্যকায় একটি মহাশিখ রাষ্ট্রীয় সম্মেলন করেন। এখানেই খালসা স্থাপনা হয় , যে খালসা কালক্রমে মুঘল সাম্রাজ্যের মহাকাল রূপে সিদ্ধ হয়েছিল।
গৃহ যুদ্ধ সহ বিভিন্ন অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল হল, আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর লাল কেল্লা র শক্তি দুর্বল হয়ে ওঠে। আরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর, গুরু গোবিন্দ সিং জি সেই দিকেই গেলেন যেখানে শিবাজী মুঘল কর্তৃত্বকে পরাজিত করেছিলেন। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, তিনি একটি যোগ্য চরিত্র খুঁজছিলেন। বান্দা সিং বাহাদুর গুরু জির অনুসন্ধানের একমাত্র উত্তর ছিলেন।
গোদাবরী তীরে , স্থানীয় লোকজন মাধো দাস দ্বারা খুব প্রভাবিত ছিলেন, তাদেঁর মুখে সন্ন্যাসী মাধো নাম শুনে তাই গুরু গোবিন্দ সিং তাঁর সাথে দেখা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন।
আশ্রমে গুরু গোবিন্দ সিং উপস্থিত হলেন। মাধো দাস ধ্যান ভেঙে স্মিত হাসিতে গুরুজী কে স্বাগত করলেন। মধো দাসের দিকে তাকিয়ে গুরু গোবিন্দ সিং চমকে উঠলেন। একি? এ যে সন্ন্যাসী যোদ্ধা। রাজযোগ সম্পন্ন এক যোদ্ধা যিনি অন্যায়কে দমন করবেন তিনি এখানে সর্ব ত্যাগী হয়ে দিন কাটাচ্ছেন? গুরুজী অনুভব করলেন যে মাধো এমন এক অগ্নি যা ধ্বংস না সুরক্ষা দানের জন্যই জন্মেছেন। গুরুজী মাধো দাসকে বললেন, “রাজপুত ভাইরাগ নেবে, তাহলে অসহায় মানুষ কে রক্ষা করবে?”
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর ।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ ॥॥
তস্মাৎ, অসক্তঃ, সততম্, কার্যম্, কর্ম, সমাচর,
অসক্তঃ, হি, আচরন্, কর্ম, পরম্, আপ্নোতি, পুরুষঃ ॥॥
গুরুজী ও তাঁর পুত্রের কথা বললেন। বললেন তাদের লড়াইয়ের কথা। যে লড়াই তাঁরা শুরু করেছেন ধর্ম রক্ষার জন্য , ভারতকে রক্ষার জন্য। বললেন সেই যোদ্ধা গুরুদের কথা যাঁরা জনস্বার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলন। গুরু নানক থেকে গুরু তেগবাহাদুর , এক অসম্ভব লড়াই , এক কৌমের উত্থান , সেই লড়াই , সেই বীরত্ব সেই ত্যাগের কাহিনী শুনে মাধো দাসের চোখে প্রথমে জল এল, তারপর তার দেহের ঘুমন্ত যোদ্ধা রক্ত ঘুমন্ত পৃথিবীর বুকের জ্বলন্ত লাভার ন্যায় ফুটে উঠল। বিদেশি শাসন থেকে উদ্ধার করে এই ভারত ভূমিকে আগামীর জন্য বাসযোগ্য করে যেতে হবে। সন্ন্যাসীর হাতে অস্ত্র উঠে এল।
১৭0৮ সাল , শরৎ আসছে । প্রকৃতি তার শুভ আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছে। এসো দেবী এসো এ আলোকে….সামনেই নবরাত্রি….পৃথিবী বুকে অমৃত লোক থেকে নেমে আসবে পূর্ব পুরুষেরা..তারপর হবে দেবীর পুজা.. মন্দিরে মন্দিরে তারই আয়োজন।
একদিন প্রাত:কাল ব্রাহ্ম মুহূর্তে মাধো দাস উঠলেন গোদাবরী র জলে স্নান করে। আজ তিনি ক্ষত্রিয় ধর্মে দীক্ষা নেবেন।বাতাসে হিম , গাছের পাতা , ঘাসে শিশির , কি একটা নাম না জানা পাখি ডাকে….শরতের পবিত্র গন্ধ প্রকৃতি কে মাতিয়ে রেখেছে…
মাধো দাস গুরু গোবিন্দের সামনে এসে হাত জোড় করে বসলেন… গুরু গোবিন্দ মাধো দাসকে দিলেন ক্ষত্রিয় আত্মার যোদ্ধা হয়ে ন্যায়ের পথে চলার , ধর্ম রক্ষার ও দেশ উদ্ধারের জন্য মুক্তির মন্ত্র।
” এক ওমকার সৎনাম কর্তাপুরুষ।
নির্মোহ নির্ভর আকাল মুরত।।
অজুনি সভাম ।
গুরু প্রাসাদ জপ আদ সচ যুগাদ সচ।।
হ্যায় ভি সচ নানক হোস ভি সচ…..”
মাধো দাসকে গুরুজী বললেন, ” তুমি নিজের মুক্তির সন্ধানে ব্যস্ত , কিন্তু তোমার দেশ মাতৃকা আজ শৃঙ্খলে বন্দিনী , তিনি ভয়ে ভীত । তাকে উদ্ধারের জন্য যোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বের আবশ্যকতা আছে। তুমি যোদ্ধা। তুমি আজ হতে সেই দায় নাও..” বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীর ধর্ম থেকে দেশ ও জাতি কে রক্ষার মন্ত্র মাধো দাসকে মুক্তি দিল। মাধো দাস পরিণত হলেন বীর বান্দা সিং বাহাদুর।
সেই পবিত্র মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল গোদাবরী, সাক্ষী হল শরতের সোনা ঝরা রৌদ্র, সাক্ষী হল পেঁজা তুলোর আকাশ, ঝিরি ঝিরি ভোরের বাতাস, নাম জানা না জানা পাখিরা…ক্ষত্রিয় পেলেন অমৃতের স্বাদ …খালসা নিয়ে ঝন ঝন রবে অস্ত্র উঠল গর্জে…অলখ নিরঞ্জন।
দুর্গেশনন্দিনী
(ক্রমশ)