এবং উবাচ –শ্রীরামচন্দ্রের পূজা ঘরে ঘরে করার উপদেশ স্বয়ং বিবেকানন্দের।

“সব জানবি ঘোর তমোভাবাপন্ন — full of morbidity! তাই বলছি দেশটাকে এখন তুলতে হলে মহাবীরের পূজা চালাতে হবে,শক্তিপূজা চালাতে হবে,শ্রীরামচন্দ্রের পূজা ঘরে ঘরে করতে হবে।তবে তোদের ও দেশের কল্যাণ।নতুবা উপায় নেই।”(উদ্বোধন প্রকাশিত ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’,শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী,পূর্ব ও উত্তর কাণ্ড,Aug 2017 পুনর্মুদ্রণ,পৃ:১৫৪)।
স্বামীজির শ্রীরাম-সাধনার কথা বলবো।আমরা হয়তো অনেকেই জানি না শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গৃহদেবতা ছিলেন রঘুবীর,অর্থাৎ ভগবান শ্রীরামচন্দ্র।তাঁর প্রিয় শিষ্য যে রামভক্ত হবেন,এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।কিন্তু দেশজুড়ে যে শ্রীরামের পুজো চালাতে হবে,এই নিদানটি তিনি দিলেন,এর একটি গভীর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে।স্বামীজি আসলে বীরের সাধনার কথা বলছেন এখানে।শ্রীরামচন্দ্র মানেই শক্তিপূজা,সনাতনী হিন্দু সমাজকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছেন তিনি।
১৮৮৬ সালের ৭ই জানুয়ারি;তখনও নরেন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেন নি। কল্পতরু দিবস অতিবাহিত হয়ে গেছে (১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি);শ্রীরামকৃষ্ণ তখন খুব অসুস্থ।তাঁকে নরেন্দ্রনাথ বলছেন, এখন থেকে তাকে প্রত্যহ বলে দিতে হবে সেদিন সাধন ভজন কীভাবে করবেন।শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন তাঁর আদরের নরেনকে নিজের কুলদেবতা রামের ইষ্টমন্ত্র দিলেন।নরেনের শ্রীরাম ভজনা এইভাবে শুরু হল।শ্রীম (মাস্টারমশাই)-র দিনলিপি উদ্ধৃত করে স্বামী প্রভানন্দ লিখেছেন সেই কথা।১৩ ই জানুয়ারি শ্রীম দেখছেন,নরেন্দ্রনাথ পাগলের মতো রামনাম গাইছেন;অবশেষে ১৬ ই জানুয়ারি নরেনকে শ্রীরাম সন্ন্যাসীবেশে দর্শন দিলেন।আর ১৯ শে জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথসহ নিরঞ্জন প্রমুখ সেই সন্ন্যাসী-রূপী রামের মতো রামাইৎ সাধুর বেশ ধারণ করলেন।নরেনের গেরুয়াবেশে মা ভুবনেশ্বরী যারপরনাই চিন্তিত হলেন।নরেন যে সপার্ষদ সন্ন্যাসী হতে চান এবং তা ক্ষত্রিয় রামের সন্ন্যাস-বেশী রূপে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর আদরের নরেনকে শক্তিমান পুরুষ, ধর্মযোদ্ধা,ন্যায়-পরায়ণ হয়ে ওঠার জন্যই কী রামনামে আবিষ্ট করলেন না!
পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরাম বনবাসী হয়েছিলেন,কিন্তু তাঁর ক্ষাত্রধর্ম অক্ষুণ্ণই ছিল।বনবাস-জীবনে কখনও অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখেন নি রাম,যখনই প্রয়োজন হয়েছে অস্ত্র চালাতে দ্বিধা বোধ করেন নি।তাছাড়া বীরপুরুষ শ্রীরামচন্দ্র কেনই বা অস্ত্র পরিত্যাগ করবেন!এ যে ক্ষাত্রধর্ম!
শ্রীরামের এই অনন্য রূপের মধ্যেই রয়েছে চিরন্তন ভারতবর্ষের চিন্তন;শৌর্যশালী অথচ তাপসমালী রাম।ভারতবর্ষের তপোবনে ভারতীয় সভ্যতার অনন্য উপাচার আর নগর-রাজধানীতে বিক্রমশালী প্রজারঞ্জন রাজা — এ দুয়ের এক অমিত মেলবন্ধন হল শ্রীরামচন্দ্রের মধ্যে।স্বামী বিবেকানন্দ যে বীর সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছেন তা হয়তো এই রঘুবীরেরই সাধনায়।গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় শিষ্যকে কুলের ইষ্টনাম দিয়ে সেই সাধনার ধারাকে পরিপুষ্ট করেছেন,বাঙ্গলাতে শ্রীরাম সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করে দিয়ে গেছেন।বাঙ্গলার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে শ্রীরামচন্দ্রকে পূজন-আরাধন যে প্রচলিত ছিল তা কবি কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’-ই অমোচ্য প্রমাণ।

বীর হনুমানের প্রতিও স্বামীজির অগাধ ভক্তি ছিল।সন্ন্যাসী হবার পরেও মাঝেমাঝে মহাবীরের কথাপ্রসঙ্গে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন এবং অনেক সময় মঠে শ্রীমহাবীরের একটি প্রস্তরমূর্তি রাখবার সঙ্কল্প করতেন।ছেলেবেলায় তাঁর রামায়ণ-গান শুনবার বড় ঝোঁক ছিল।… একদিন রামায়ণ -গানে শুনলেন — হনুমান কলাবাগানে থাকে।অমনি এমন বিশ্বাস হল যে,সে রাত্রে রামায়ণ -গান শুনে ঘরে আর না ফিরে বাড়ির কাছে কোন এক বাগানে কলাগাছতলায় অনেক রাত্রি পর্যন্ত হনুমানের দর্শনের আশা করে অতিবাহিত করেছিলেন।

@কচ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.