স্বাধীনতার ৭৫ বছর — কৃষি প্রধান দেশের গ্রাম বিকাশ।

ভারতবর্ষ কৃষি প্রধান দেশ। শুধুই কী কৃষি অঙ্গনের জন্য? শুধুই কী কৃষি পরিসংখ্যানের জন্য? জলা-জঙ্গল, জমি-জরিপের জন্য? কেবল পরিসংখ্যান ভারতবর্ষকে কৃষিপ্রধান দেশ গড়েনি। ভারতের অন্তরাত্মায় কৃষির অনবদ্য অন্দরমহল আছে। গ্রাম-ভারতের মধ্যে কৃষির আন্তরিকতা আছে। সাহিত্য অঙ্গনের মধ্যেও বিছানো আছে সবুজ কেয়ারি। ভারতবর্ষের দেবতাও কৃষিকাজ করেন। হলধর বলরাম, মহাদেব শিবের বৃত্তিও কৃষিকর্ম। তাই ভারত কৃষিপ্রধান দেশ।

কৃষির দেবতা শিব।
শূণ্যপুরাণের কবিতা শুনছেন ভারতবর্ষের দত্তক নেওয়া নিবেদিতা; শোনাচ্ছেন সাহিত্যের দিকপাল গবেষক ড. দীনেশচন্দ্র সেন। “শিব কেন তুমি ভিক্ষা করে খাও? ভিক্ষা বড় হীনবৃত্তি। কোনোদিন কিছু জোটে, কোন দিন রিক্ত ভাণ্ডে ফিরে আস, যদি তুমি চাষ করো, ধান ভানো, তাহলে তোমার কষ্ট দূর হবে। হে প্রভু, কতদিন তুমি উলঙ্গ হয়ে কেঁদো বাঘের ছাল পরে কাটাবে? যদি কাপাস বুনে তুলো কর, তবে কাপড় পরতে পাবে,কত সুখী হবে।”
রামেশ্বরের ‘শিবায়ন’-এর কথা মনে পড়বে।
“চষ ত্রিলোচন চাষ/চষ ত্রিলোচন।/নহো উদাসীন হও/ছাড় পরিজন।”
নিবেদিতা শুনছেন আর উত্তেজনায় কেবলই বলছেন, ‘আশ্চর্য, আশ্চর্য!’
“ও দীনেশবাবু, এটা একটা আশ্চর্য জিনিস!” উপাসক উপাস্যের কাছে চাইবেন কী! ভগবানের প্রতি অনুরক্ত হয়ে নিজেকে ভুলে গেছেন, ঠাকুরের কষ্ট কিভাবে নিবারণ হবে, সেটাই তার চিন্তা।
ভারতবাসী উপাস্যকে কেমনভাবে দেখেন, অবাক করে দিল নিবেদিতাকে। কৃষিচিন্তা ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতার অতল গভীরে। গ্রাম-ভারতের উন্নয়ন বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের উন্নতি হতেই পারে না।

‘নিবেদিতা’ ভারতের সবুজসার।
জৈবকৃষিতে ‘সবুজ সার’ কথাটা আমরা শুনেছি। সবুজ সার বা গ্রীন ম্যানিওর। এর বৈশিষ্ট্য বোঝাতে আমরা ভগিনী নিবেদিতার উদাহরণ আনতে পারি। নিবেদিতার জীবনবোধটি সবুজ সারের খাঁটি উদাহরণ। নিবেদিতা দেশভক্তির সমার্থক।তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কবি মোহিতলাল মজুমদার বলেছিলেন,বাংলার নবজাগরণের মাটিতে হলকর্ষণের পর বীজবপন হল, বৃষ্টিপাতও হল। দিকে দিকে নতুন অঙ্কুর দেখা দিল। তারই মধ্যে একটি বীজ সকলের থেকে দূরে এক কোণে অঙ্কুরিত হল। নিজেকে ফুলেফলে বিকশিত করবার জন্য নয়। অন্য ফসলের সার হিসাবে ব্যবহার হবার জন্য। এই ফসল বাজার পর্যন্ত পৌঁছায় না।কেবল সার হবার ফসল। পরাধীন ভারতবর্ষে অনেক দেশহিতৈষী মানুষ, সাধুসন্ত, বিপ্লবী মানুষ ভারত মা-কে শৃঙ্খল মোচনের জন্য সবুজ সার হয়েছেন। নিজেরা নিঃশেষ হয়ে দেশসেবা করেছেন। তাদের কেউ কেউ পল্লী ও গ্রামোন্নয়নে জীবনের লক্ষ্য স্থির রেখে গেছেন।

খনার বচন বাংলার কৃষি সম্প্রসারণের নথি।
বলবো, এক মহিলা কৃষিবিদ খনা-র কথা। যে দেশের অর্থনীতি কৃষিকাজের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে দেশের লোকসংস্কৃতিতেও কৃষিজগতের ছবি খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিশিক্ষার পূর্বে ভারতের কৃষক আবহমান কাল ধরে লোকায়ত ধারার মধ্যে উন্নতির চেষ্টা করেছে। বাংলা, আসাম, ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামে প্রচলিত ‘খনার বচন’ এমনই মণিমাণিক্যেপূর্ণ কৃষি-লোকজ্ঞান। ড. নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ডাক ও খনার বচনগুলি প্রাক্ তুর্কী আমলের প্রবাদ সংগ্রহ। পর্যবেক্ষণ-ভিত্তিক ছিল এই লোকজ্ঞান, কিন্তু মানুষের অন্তরাত্মায় আজও প্রোথিত, সমান টেকসই। খনার বচন বাংলা সাহিত্যের ‘অণুগল্প’-এর মতো, কৃষক সমাজের কাছে উল্লেখযোগ্য সূত্র, কৃষকের সমষ্টিগত উপাদান। কৃষিকাজের সমৃদ্ধিই তখন ছিল গ্রামোন্নয়ন। বাস্তবাশ্রিত, নির্ভেজাল এই কৃষিতত্ত্ব; দরিদ্র নিরক্ষর কৃষকের কাছে সহজে পৌঁছানো কৃষি প্রযুক্তির প্যাকেজ।

সামগ্রিক কৃষি মানুষের যাযাবর বৃত্তি থেকে থিতু করলো।
যাযাবর শিকারির জীবন, খাদ্য সংগ্রহকারীদের জীবন ছিল যথেষ্ট চাপের। অনন্ত প্রচেষ্টায় খাদ্য আর অস্থায়ী বাসস্থানের খোঁজ পেতে হত। শান্তিপূর্ণ অবসরযাপনের অবকাশ ছিল না। তাই গঠনমূলক বৌদ্ধিক সাধনাও সম্ভব ছিল না। ফলে কৃষি ও গ্রামীণ জীবনের গোড়াপত্তন হল। কৃষি মানুষকে যাযাবর জীবন থেকে থিতু করল। স্থায়ীজীবনে কঠিন করুণ অবস্থা থেকে মুক্ত করল। খাদ্য নিরাপত্তা পেল। মানুষের অবসর জীবন সুখের হল, আনন্দের হল। সেই অবসরে বৌদ্ধিক সাধনা চরিতার্থ করতে সক্ষম হল। বৈদিক সাহিত্যের যে টেক্সট, তার major theme হল, কৃষি সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা, গবাদি পশু সংক্রান্ত কার্যকলাপ। বৌদ্ধযুগেও দেখা যাচ্ছে ব্রাহ্মণেরা জমি চাষ দিচ্ছে, ফসল ফলাচ্ছে, প্রাণিসম্পদ রক্ষা করছে, কৃষির অন্যান্য কাজ করছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র হল জ্ঞান ও তথ্যের মহা মূল্যবান ভান্ডার। ভারতবর্ষের কৃষি অর্থনীতি নিয়ে বহু তথ্য সংবেশিত হয়েছে। ইউরোপের মানুষ যখন অসভ্য অবস্থায় দিনযাপন করছে, ভারতবর্ষের মানুষ তখন কৃষিতে থিতু হয়ে সাহিত্য রচনা করছে।
এই কৃষি কেবল ভূমিতে কর্ষণ নয়, মৎস্যচাষ আর শিকার, মৌমাছি পালন, রেশমচাষ, লাক্ষাচাষ, হাঁস মুরগি, ছাগল, গোরু প্রতিপালন, ফসল প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ — সব কিছু মিলেই সামগ্রিক কৃষি। খাদ্য সংগ্রহের নানাবিধ প্রয়াস, কারিগরি, খাদ্যপ্রস্তুতির নানান প্রযুক্তি আর কৃষিশিল্প — সব মিলিয়েই সামগ্রিক কৃষি। খাদ্যের প্রয়োজনেই সভ্যতার নানান কর্মকাণ্ড, অনন্ত যুদ্ধবিগ্রহ, যুগ যুগান্তর ধরে রাজ্য ও সাম্রাজ্যের উত্থানপতন, শোষণ-বঞ্চনা, ছলনা প্রতারণা। কৃষি হচ্ছে ‘সভ্যতা’ নামক এক বিপুল, বহুজটিল প্রক্রিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তার ভিত্তি। এই মজবুত ভিতের উপরই গড়ে উঠেছে সভ্যতার নানান অধিরূপ।

ব্রিটিশভারতের কালপর্ব।
প্রথম ১৭৫৭ থেকে ১৮১৩ ছিল বণিকপর্ব। সরাসরি লুঠ আর ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া কারবার এই পর্বের মুখ্য বিষয়।
দ্বিতীয় ১৮১৩-১৮৫৭, শিল্প বিপ্লবের পর ব্রিটেনের সুবিধামত অবাধ ব্যবসা ও শিল্প-ভিত্তিক শোষণ পর্ব।
নীল চাষ আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। ১৮১৩ সালের সনদ আইনের ফলে একচেটিয়া অধিকার লোপ পেল। তখন ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করল। কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হল। 
তৃতীয়, ব্রিটিশ ব্যাঙ্ক আর বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে ভারতে পুরোদস্তুর লগ্নি-ঘাঁটি নির্মাণ। কেমন সেই পর্ব? রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতাটি মনে পড়বে।
“বেতন পঁচিশ টাকা,
    সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
        খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
               ছেলেকে পড়িয়ে।
        শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
           সন্ধেটা কাটিয়ে আসি,
        আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।”

ব্রিটিশ আমলে দুর্ভিক্ষ, খাদ্যসংকট লেগেই ছিল। ১০ টি বৃহৎ মন্বন্তরের সাক্ষী ভারতবাসী। তাতে লক্ষ-নিযুত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। ১৭৬৯-৭০ সালের সেই কুখ্যাত বেঙ্গল ফেমিন। বাংলা সমেত পূর্বভারত পর্যুদস্ত। এক মিলিয়ন মানুষ মারা গেল। যারা বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ। মানুষ বেঁচে থাকতে মৃতদেহের মাংস ভক্ষণ শুরু করল। ১৮৯৯-১৯০০ সালের সেই দুর্ভিক্ষ, দাক্ষিণাত্য, মধ্য ভারত, রাজপুতানা, পাঞ্জাবের বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনে নেমে এল ভয়ঙ্কর দুর্গতি। ১৯৪৩ সালে পঞ্চাশের মন্বন্তর, যেখানে ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি।

মধ্যযুগের কৃষি।
অষ্টম থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে কৃষকের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। ৯৯৮ থেকে ১০৩০ সালের মধ্যে তুর্কি মহম্মদ গজনভি বারেবারে ভারতবর্ষ আক্রমণ করে লুঠতরাজ ও হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করে। কোনো তুর্কি সম্রাট, এমনকি দাস-বংশীয় রাজারাও কৃষির উন্নতি করেন নি, হিন্দু কৃষকের দুর্গতি দূর করেন নি। আলাউদ্দিন খলজির সময় হিন্দু কৃষকের দুর্গতি চরমে পৌঁছেছিল। দারিদ্র্যই তাদের চিরসম্বল ছিল। ১৩২৫-১৩৫১, মহম্মদ বিন তুঘলক রাজধানী দিল্লি থেকে সরিয়েও রাজস্ব বৃদ্ধি করতে সমর্থ হলে না। বরং গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলের হিন্দু রায়তদের শুল্ক আদায়ে অতিষ্ঠ করে ভিখিরি বানিয়ে ছেড়েছিলেন। তবে মুসলমান শাসনে ব্যতিক্রম কিছু ছিল, যেমন গিয়াসউদ্দিন তুঘলক, শেরশাহ, আকবর, যারা কিছুটা কৃষকদরদি ছিলেন। আকবরের কৃষক মঙ্গলের চিন্তার মূল ব্যক্তিত্ব রাজার তোডরমল।
মোঘল সম্রাটেরা সামগ্রিকভাবে কৃষি বিষয়টি অবহেলিতই রেখেছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারের History of Science in India গ্রন্থে লেখা আছে, The Mughals who would understand fully that food was most essential for life, always presumed that there would be others (inferior in quality) who would produce it for them. Only in case of ornamental horticulture and gardening there were skilled Muslim gardeners who differed considerably from those ploughing the field and doing other hard work in the sun and rain throughout the day.” যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমি চষে, খাদ্যোৎপাদন করে তারা ছিলেব নিকৃষ্ট প্রকৃতির মানুষ, কেবলমাত্র দক্ষ মুসলমান মালীদের সম্মান ছিল মুঘল যুগে, যারা বাগান রচনা করে। ঔরঙ্গজেবের অসহনীয় শুল্ক অত্যাচারে হিন্দু চাষীরা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। এই ঘটনাই মোঘল সাম্রাজ্য পতনের কারণ ঘটিয়েছিল।

প্রাচীন যুগের কৃষি।
প্রাচীন হিন্দুযুগের কৃষি অগ্রগতি ছিল চোখে পড়ার মত, সেজন্যই দেশ ছিল সমৃদ্ধ। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময় এনিমেল হাসব্যান্ড্রিকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখা হত। গরুকে আঘাত করা হত না, গোহত্যায় মারাত্মক পাপ আর শাস্তি ছিল। গোপ্রজননে বিশেষ দৃষ্টি ছিল, গো উন্নয়নের চেষ্টা চলত। ভেটেরিনারি সার্ভিস এক বিশেষ পরিষেবা ছিল।
হিউয়েন সাঙ ৫০০ সাল নাগাদ রাজস্থানে টেরাকোটার বালতি নির্মিত পার্সিয়ান হুইল সেচের কাজে ব্যবহার হতে দেখেছেন। বিজ্ঞানী রান্ধোয়ার মতে, এটির নাম মোটেই পার্সিয়ান হুইল হওয়া উচিত নয়, এটি ইন্ডিয়ান হুইল। এটি প্রাক-ইসলামিক যুগের, মোটেই ইরান থেকে আসে নি। রাজপুত রাজারা পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলমান আগ্রাসন ও লুঠতরাজ বন্ধ করবার জন্য এবং কৃষিকাজের সুস্থিরতার জন্য লড়াই করেছিলেন। গৌড়ের পাল রাজারা ৭৬০-১১২৩ সালের মধ্যে সেচের সুবিধার্তে অসংখ্য লেক ও পুকুর খনন করেছিলেন।

বঙ্কিম রচিত ‘বঙ্গদেশের কৃষক’।
কৃষকের বন্ধু ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর অনবদ্য প্রবন্ধ ‘বঙ্গদেশের কৃষক’। দেশের শ্রীবৃদ্ধি, প্রকৃত অবস্থা, জমিদারের শোষণ, অত্যাচারীর স্বরূপ, প্রজার অনুন্নতি, দেশীয় কৃষি আইনের বিস্তৃত আলোচনা আছে। বাংলার অসহায় কৃষক-সমাজের দুর্দশা, অবর্ণনীয় দুর্গতি, অর্থনৈতিক অবস্থার বিস্তারিত ছবি। প্রবন্ধে ‘রামা কৈবর্ত ও হাসিম শেখ’-কে হিন্দু বা মুসলমান হিসাবে দেখান নি তিনি; দেখিয়েছেন কৃষিজীবী একটি শ্রেণী হিসাবে। আশ্চর্য হতে হয়, মার্কসবাদী দীক্ষায় চালিত না হয়েও কিভাবে মানুষকে ভালোবেসেছেন! মাক্সবাদীরা তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে দেগে দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলায় সাম্যবাদের যে ‘বীছন’ বুনেছিলেন, তাই অঙ্কুরিত হয়ে মহীরুহ হয়েছে। তিনি হিতবাদী দেশপ্রেমী মানুষ; কৃষিজীবী মানুষের দুঃখে সংবেদনশীল। বাংলায় এমন সাম্যবাদী মানুষ আরও অনেকে জন্মেছেন; স্বামী বিবেকানন্দ। আদ্যন্ত সাম্যবাদী। সাম্যবাদ প্রচারের জন্য তাই বঙ্গদেশে ‘বিদেশী ঠাকুর’ পুজোর দরকার ছিল না।

স্বামী অখণ্ডানন্দের গ্রামবিকাশ।
নিজের মোক্ষলাভ আর জগতের উন্নয়নের জন্য রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম সেবাব্রতী শাখাকেন্দ্র খোলা হল দুর্ভিক্ষপীড়িত সারগাছিতে। ১৮৯৭ সালে স্বামী শুদ্ধানন্দকে স্বামীজি লিখছেন, “অখণ্ডানন্দ মহুলাতে অদ্ভুত কর্ম করছে বটে কিন্তু কার্য-প্রণালী ভাল বলে বোধ হচ্ছে না। মনে হয়, তারা একটা গ্রামেই তাদের শক্তিক্ষয় করছে, তাও কেবল চাল-বিতরণের কার্যে। জনসাধারণকে যদি আত্মনির্ভরশীল হতে শেখানো না যায়, তবে জগতের সমগ্র ঐশ্বর্য ভারতের একটা ক্ষুদ্র গ্রামের পক্ষেও পর্যাপ্ত সাহায্য হবে না।” অর্থাৎ স্বামীজি সমগ্র গ্রাম-ভারতের উন্নয়ন ও বিকাশ চাইছেন। বলছেন, We help them to help themselves. তারা যাতে নিজেই নিজেদের কাজ করতে পারে, এইজন্য তাদের সাহায্য করতে হবে। এখন যাকে বলা হয় Participatory Development, সহভাগী-উন্নয়ন। উদ্ধারেৎ আত্মনাথানাং, নিজেই নিজেকে উদ্ধার করবে। স্বামীজি বলছেন, ওরা যখন বুঝতে পারবে নিজেদের অবস্থা, উপকার এবং উন্নতির আবশ্যিকতা, তখনই তোমার ঠিক কাজ হচ্ছে জানবে।”

ভারতীয় প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ উন্নয়নের সংজ্ঞা।
প্রথম, গ্রামাঞ্চলে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সর্বোচ্চ উৎপাদন। দ্বিতীয়, গ্রামীণ শিল্পের উন্নয়ন এবং কুটির শিল্পের উপর জোর। তৃতীয়, সর্বোচ্চ সম্ভাব্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে দুর্বল শ্রেণীর জন্য। চতুর্থ, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। পঞ্চম, মৌলিক সুযোগ -সুবিধা প্রদান; যেমন — পানীয় জল, বিদ্যুৎ, বিশেষ করে উৎপাদনশীল উদ্দেশ্যে বিদ্যুতের জোগান, গ্রামগুলিকে বাজার কেন্দ্রের সাথে সংযুক্তকরণ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার সুযোগ সুবিধা।

লোকহিত কোনপথে?
কীভাবে, কোন মানসিকতায় গ্রামের উন্নতি করতে হবে তা ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে খুব সুন্দরভাবে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে বলছেন। বুঝিয়ে বললে এইরকম —
পরের উপকার করব মনে করলেই উপকার করিতে পারি না। উপকার করবার অধিকার থাকা চাই। যে বড়ো সে ছোটোর অপকার অতি সহজে করতে পারে, কিন্তু ছোটোর উপকার করতে হলে কেবল বড়ো হলে চলবে না, ছোটো হতে হবে, ছোটোর সমান হতে হবে। মানুষ কোনোদিন যথার্থ হিতবাদী কাজকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করবে না, ধার হিসাবেও না, কেবলমাত্র প্রাপ্য বলেই গ্রহণ করতে পারে।
আমরা লোকহিতের জন্য যখন মাতি তখন অনেক সময় মাতলামির মধ্যে একটি অভিমানের মদ থাকে। লোকের মধ্যে সব বিষয়ে বড়ো এই কথাটাই রাজকীয় চালে ভোগ করবার জন্যই আমরা লোকহিতের আয়োজন করি। এরকম ক্ষেত্রে আমরা লোকের অমঙ্গল করি, নিজেদেরও মঙ্গল করি না।
ভালোকাজ করবার একটিমাত্র ঈশ্বরদত্ত অধিকার আছে, সেটি হল প্রীতি। প্রীতির দানের মধ্যে কোনো অপমান নেই। কিন্তু নিজেকে প্রচার করার দানে মানুষ অপমানিত হয়। মানুষের সবচেয়ে খারাপ করবার উপায় হল, তার কিছু উপকার করা অথচ তাকে প্রীতি না-করা, ভালো না বাসা।

রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন চিন্তা।
রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়নের প্রয়াস শুরু তাঁর পারিবারিক জমিদারি এলাকায়। ১৮৯১ সালে তিনি পারিবারিক জমিদারির ভারপ্রাপ্ত হলেন। এর ফলে গ্রামের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের বিচিত্র দিক খুব কাছ থেকে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। গ্রামোন্নয়নে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের অবদানও রয়েছে। কবিপুত্রও খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে জটিল কৃষি বিষয়কে সরল বাংলা ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। ভালো বিজ্ঞান জানা না থাকলে মাতৃভাষায় তা প্রকাশ করা যায় না। কৃষিবিজ্ঞান গবেষণা ও সম্প্রসারণে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একটি অনবদ্য ভূমিকা ছিল। বিশ শতকের কুড়ির দশকে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘বৈজ্ঞানিক কৃষিকার্য’ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন সরলাদেবী।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে কৃষিচিন্তার কথা দেখি। তাঁর ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসের উদ্যানভাবনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিদ্যা পড়ে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, আর পুত্রবন্ধু সন্তোষ মজুমদারকেও বিদেশে কৃষিবিদ্যা আর গোপালন বিদ্যাশিক্ষার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। ১৮৯৯ সালে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে এবং অর্থে শিলাইদহে নতুন জাতের ধান চাষ শুরু হয়েছিল; হয়েছিল মার্কিনী ভুট্টা, নৈনিতাল আলুর চাষ; পাটনাই মটর, আখ, কপি ও রেশম চাষের প্রচেষ্টা। কুঠিবাড়ীর চারপাশের জমিকে কেন্দ্র করে প্রজাদের মধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলেন তিনি। পতিসরে কৃষকদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ করে দিতে কৃষি ব্যাঙ্ক স্থাপন করলেন। গঠিত হল তাঁত শিক্ষার কেন্দ্র। গ্রামীণ মানুষকে নিয়ে তাদের নিজেদের দ্বারা পল্লী উন্নয়নের চেষ্টা শুরু হল, হল গ্রাম পুনর্গঠনের কাজ। শক্ত এঁটেল মাটি ট্রাক্টর দিয়ে চাষের বন্দোবস্ত করা হল, কৃষি ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হল, ধর্মগোলা তৈরি হল। অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিজনিত ক্ষয়ক্ষতি হলে খাজনা মুকুবের ব্যবস্থা হল। নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা পতিসরের ব্যাঙ্কে রেখে মূলধনের সমস্যা খানিকটা মেটানোর ব্যবস্থা করলেন। শাহাজাদপুরের গোপালকদের তিনি উন্নত জাতের গাভী ও চারণভূমি দান করেন। রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতন প্রকল্পেও গ্রামীণ কৃষি উন্নয়ন একটি সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে।

শ্রীঅরবিন্দের গ্রামবিকাশ ভাবনা।
শ্রীঅরবিন্দ মনে করতেন ভারতবর্ষের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য গ্রাম-সমিতি গঠন অপরিহার্য। আত্মনির্ভরশীল গ্রাম-সমিতি গঠনের উপরেই নির্ভর করে পূর্ণ স্বরাজের রূপায়ণ। এই সমিতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চেতনা জাগ্রত করতে হবে, সচেতন করতে হবে। গ্রামীণ সাধারণ মানুষের অনুভবের ব্যবস্থা করাই গ্রাম সমিতির দায়িত্ব বলে শ্রীঅরবিন্দ মত প্রকাশ করেছিলেন।
পল্লী উন্নয়ন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বাস্তব চিন্তা-ভাবনা ও কাজকর্ম করার আগেই শ্রীঅরবিন্দ বিশ শতকের প্রারম্ভে পল্লীসমিতি গঠন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন, তাঁর সম্পাদিত নানান পত্রিকায়। বন্দেমাতরম ১৯০৫-০৬, যুগান্তর ১৯০৬-০৮, ধর্ম ও কর্মযোগিন ১৯০৯-১০। এরপর অরবিন্দ পন্ডিচেরী চলে যান। ১৯২৬ সালে শ্রীঅরবিন্দ কর্তৃক আশ্রমের সমস্ত দায়িত্ব পাবার অনেক পরে শ্রীমা পন্ডিচেরীর কাছে ১৯৬৮ সালে ‘অরোভিল’ বা প্রভাতনগরী বা ভোরের শহর পত্তন করেছিলেন। শ্রীঅরবিন্দের দর্শনের উপর ভিত্তি করেই এই নগরীর পত্তন। সেখানে গ্রিনবেল্ট, সবুজ গাছপালা, খামার, বনজ সম্পদ, খাদ্য, ভেষজের আয়োজন।

গ্রাম বিকাশের দ্বারা ডি.এল. রায় হলেন ‘দয়াল রায়’।
বলবো কৃষিবিদ ডি. এল. রায়ের কথা। নাট্যকার, সঙ্গীতকার দ্বিজেন্দ্র লাল রায় একজন কৃষি বিশেষজ্ঞও ছিলেন, বিলেত থেকে পড়ে এসেছিলেন কৃষিবিজ্ঞান; চাকরি করেছিলেন জরিপ ও ভূমি-রাজস্ব বিভাগে। ১৯০৬ সালে রচনা করেছিলেন কৃষি বিষয়ক জনপ্রিয় গ্রন্থ Crops of Bengal। সমগ্র বাঙ্গলা জুড়ে তাঁর নিজস্ব কৃষি পর্যবেক্ষণের ফলাফল তাতে যুক্ত রয়েছে।
কৃষিবিদ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় চেয়েছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী কৃষিকাজে নিয়োজিত হোক, অন্যদেরও উৎসাহ দিক। তখন বাংলা বা ভারতে শিল্পের বিকাশ তেমন ছিল না, শিক্ষিত বিরাট এক সংখ্যাকে চাকরি দেবার সুযোগও ছিল না, অথচ শিক্ষিত শ্রেণী গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছিল। ভৌমকৃষি বা প্রাণীপালনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এই অবস্থায় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। তিনি Research Farm গুলির উন্নততর তদারকি চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন Experimental Farm-এর পরীক্ষিত তথ্যগুলি Demonstration Farm – এ নিয়মিত প্রদর্শিত হোক। যেন প্রতিটি ডিভিশন পিছু অন্তত একটি করে Agricultural Demonstration Farm থাকে। চেয়েছিলেন জেলায় কৃষি সমীক্ষা নিয়মিতভাবে চলুক এবং তা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। শুধু চাকরি নয়, কৃষি স্নাতকেরা সরকারী উৎসাহে নিজেরা আদর্শ কৃষি খামার গড়ে তুলুক। ভারতের কৃষি কলেজে চাষির ছেলে, জমির মালিকের ছেলেরা প্রশিক্ষণ নিতে আসুক — এটা ভীষণভাবে চেয়েছিলেন। এখন সেটা সবসময় হয় না৷ কৃষি নিয়ে পড়েই সরকারি চাকরি চায়!
দেশীয় প্রজাদের উপর অন্যায় খাজনা বৃদ্ধি তিনি মেনে নেন নি। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মোতাবেক যে জরিপ ব্যবস্থা দেশে বলবৎ ছিল, তার পরিবর্তন করে বেআইনী জরিপ ব্যবস্থার নিয়মে কর ধার্য করা তিনি উচিত মনে করেন নি। কাজেই সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সংঘাত শুরু হল। প্রজাদের সংঘটিত করে জুলুমবাজির বিরুদ্ধে কোর্টে যাওয়া হল। বিবাদি পক্ষে ছিল জমিদারেরা। কোর্ট জমিদারের পক্ষে রায় দিল। দ্বিজেন্দ্রর প্রমোশন বন্ধ হল। তিনি দমে গেলেন না। প্রজাদের সংগঠিত করে উচ্চতর আদালতে পাঠালেন। রায় এবার উল্টালো। সরকার রাজস্ব ম্যানুয়াল থেকে আপত্তিকর অনুচ্ছেদ তুলে নিতে বাধ্য হল। অমিত-বিক্রমে বাংলার দরিদ্র কৃষকের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে তিনি ‘ডি. এল. রায়’ থেকে হয়ে উঠলেন ‘দয়াল রায়’। পরে তিনি লিখছেন, “আমি ইহা সত্যই শ্লাঘার বিষয় বিবেচনা করি যে, আমি এই ক্ষুদ্র ক্ষমতাতেই উক্ত কার্যে নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করিলেও সমস্ত দেশব্যাপী একটি উপকার সাধিত করিয়াছি — নিরীহ প্রজাদিগকে অন্যায় করবৃদ্ধি হইতে বাঁচাইয়াছি।” এটাকেই বলে পার্টিসিপেটরি উন্নয়ন। লোকহিত। প্রীতির সঙ্গে গ্রামবাসীর সঙ্গে থেকে তাদের দিয়েই হিতৈষণার কাজ করানো।

ভারতে সবুজ বিপ্লবের অন্যতম প্রাণপুরুষ বশীশ্বর সেন।
তিনি ছিলেন মা সারদা, সিস্টার নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ ও আচার্য জগদীশ চন্দ্রের স্নেহধন্য উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। ১৯২৪ সালে কলকাতার ৮ নম্বর বোসপাড়া লেনে স্থাপন করেছিলেনন ‘বিবেকানন্দ ল্যাবরেটরি’। ১৯৩৬ সালে স্বামীজির প্রিয় পাহাড় আলমোড়ায় সেটি স্থানান্তর করলেন। তিনিই ভারতে প্রথম গম, ভুট্টা, জোয়ার, বাজরার সফল সঙ্করায়ণ ঘটান। তাঁর উদ্ভিদ কোষতত্ত্ব, শারীরতত্ত্ব, উদ্ভিদ হর্মোন সংক্রান্ত গবেষণা উচ্চপ্রশংসিত হয়েছিল। পঞ্চাশের মন্বন্তর তাঁকে ফলিত উদ্ভিদ বিদ্যা গবেষণায় প্রেরণা যুগিয়েছিল। উত্তর প্রদেশে তিনি কৃত্রিম মাশরুম চাষের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। মানুষ হিসাবে তিনি একজন হৃদয়বান পুরুষ ছিলেন। দরিদ্র, বুভুক্ষু মানুষের জন্য কৃষি বিজ্ঞানে কাজ করে ১৯৫৭ সালে তিনি পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে ‘ওয়াতুমল ফাউন্ডেশন পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। ভারতে সবুজ বিপ্লবের তিনি অন্যতম পুরুষ। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৭৪ সালে উত্তর প্রদেশ সরকার আলমোড়ার গবেষণা কেন্দ্রটি কেন্দ্রীয় সরকারের আই.সি.এ.আর-কে হস্তান্তর করে। এর নতুন নাম হয় ‘বিবেকানন্দ পার্বত্য কৃষি অনুসন্ধানশালা’।

গান্ধীজির গ্রাম-উন্নয়ন ভাবনা।
রবীন্দ্রনাথের পল্লী পুনগর্ঠনের ভাবনা আর গান্ধীজির গ্রামীণ উন্নয়নের ভাবনার মধ্যে ফারাক ছিল। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, বিশ্বপ্রকৃতিতে সৃষ্ট পরিমন্ডলের অংশ হিসাবে গ্রামকে সম্পূর্ণভাবে গড়ে তুলতে হবে। গান্ধীজি গ্রামকে একটি স্বয়ংশাসিত অংশ বা রিপাবলিক হিসাবে মনে করেছেন এবং সেই গ্রামে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। প্রতিটি গ্রাম হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভর, অথচ পরস্পরের সম্পর্কে মহীয়ান, এমনই স্বরাজ। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গী হল সভ্যতা মানে সভার মধ্যে আপনাকে পাওয়া, সকলের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি। তাই স্বরাজের থেকেও বড় হয়ে দাঁড়ায় জনসমবায়ে সৃষ্ট জীবন। গান্ধীর স্বপ্ন গ্রামজীবনের সংস্কার। রবীন্দ্রনাথের চাওয়া হচ্ছে, লোকালয়কে সমগ্র করে তোলা। এবার গান্ধী পরিকল্পিত গ্রামবিকাশের কথা বলবো।

গান্ধীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ‘আদর্শবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত। ‘রাম রাজ্য’ ধারণাটি সেই আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার বা গান্ধীজির ধারণার ভিত্তি। গান্ধী রাম রাজ্যকে “নৈতিক ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে মানুষের সার্বভৌমত্ব” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। এই পরিকল্পনায়, ‘রাম’ হচ্ছেন God, ঈশ্বর বা নিজের ‘অভ্যন্তরীণ কণ্ঠ’। গান্ধীজি একটি গণতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন, যেখানে মানুষই সর্বোচ্চ। তাদের আধিপত্য অবশ্য পরম নয়। একটা নৈতিক মূল্যবোধ সাপেক্ষেই তা সর্বোচ্চ। গ্রাম হল আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক একক। গান্ধীর আদর্শ গ্রাম ব্রিটিশ-পূর্বকালীন সময়ের গ্রাম, যখন ভারতীয় গ্রামগুলি স্ব-শাসিত ছিল, স্বায়ত্তশাসিত ছিল, প্রজাতন্ত্রের ফেডারেশন গঠনের কথা ছিল। ব্রিটিশদের প্রবর্তিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং পরিবহন ব্যবস্থা সেই গ্রামগুলির “প্রজাতন্ত্র” চরিত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। প্রাচীন ‘প্রজাতন্ত্র’ বিষয়ক গান্ধীর গ্রামীণ পরিকল্পনার মডেলে অত্যাচার নেই, শোষণ নেই। একটি ভারতীয় গ্রাম তখন একটি মডেল ইউনিট হিসেবে কাজ করছে।
গান্ধীজি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমেই গ্রাম-প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলা যায়। এই ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাজ্য এবং জাতীয় রাজধানীর পরিবর্তে গ্রাম পঞ্চায়েতের উপর ন্যস্ত থাকবে। এই ধরনের বিকেন্দ্রীভূত রাজনীতি মানে বিকেন্দ্রীভূত অর্থনীতি। এই অর্থনীতি স্বয়ংসম্পূর্ণতার মাধ্যমেই অর্জন করা যায়। গ্রামে যতদূর তার মৌলিক চাহিদা — খাদ্য, বস্ত্র এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা — স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া উচিত। গ্রামকে কিছু জিনিস আমদানি করতে হবে যা সে গ্রাম উৎপাদন করতে পারে না। আমাদের তাই আরও বেশি উৎপাদন করতে হবে, যাতে বিনিময়ে আমরা যা উৎপাদন করতে পারি না, তা পেতে পারি। গ্রামের সকলকে পূর্ণ কর্মসংস্থান দিতে হবে। সেভাবেই গ্রাম অর্থনীতির পরিকল্পনা করা উচিত। প্রত্যেক ব্যক্তির কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, যাতে সে গ্রামে তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে, শহরে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য না হয়।

গান্ধীজি বলেছিলেন, শিল্পায়ন শুধুমাত্র কয়েকজনকে সাহায্য করবে, will lead to concentration of economic power. শিল্পায়ন গ্রামে প্যাসিভ বা সক্রিয় শোষণের দিকে নিয়ে যায়, জনশক্তিকে প্রতিস্থাপন করে এবং তাই বেকারত্ব বাড়ায়। গ্রাম ও কুটির শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। তারা গ্রামবাসীর চাহিদা পূরণের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে এবং গ্রামের স্বয়ংসম্পূর্ণতা সহজ করে। গান্ধীজি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে ট্রাস্টিশিপের নীতির উপর জোর দিয়েছিলেন। জমি ঈশ্বরের। একজন জমির মালিককে তার জমির ট্রাস্টি হতে রাজি করা উচিত। তাকে নিশ্চিত হওয়া উচিত যে তার মালিকানাধীন জমি তার নয়। জমি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত এবং অবশ্যই সম্প্রদায়ের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। তারা নিছক ট্রাস্টি। যদি জমির মালিকরা দরিদ্র শ্রমিকদের বাধ্য না করে এবং তাদের শোষণ অব্যাহত রাখে, তবে তাদের বিরুদ্ধে অহিংস, অসহযোগ, নাগরিক অবাধ্যতার সংগ্রাম সংগঠিত করা উচিত। গান্ধীজির সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্য আমদানীকৃত প্রযুক্তির চেয়ে স্বদেশী নৈপুণ্যকে পছন্দ করতেন।

ভিশনারি আর্কিটেক্ট, রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়ী এবং ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ।
দত্তপন্থ ঠেংড়ী ছিলেন ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা। গ্রাম সংসদকে সমৃদ্ধ করে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখানোর তিনি অন্যতম কারিগর। স্বনির্ভর কৃষক, সমৃদ্ধ পরিবার, বিকশিত গ্রাম, আত্মনির্ভর ভারত ছিল তাঁর মূলমন্ত্র। তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে এবং যোগ্য উত্তরসূরী নির্মাণে ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ কৃষক সংগঠনের অবয়ব লাভ করেছে। রাজস্থানের কোটা শহরে ১৯৭৯ সালের ৪ ঠা মার্চ ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা। এই সংগঠন তিনি কেন গড়লেন? ১. আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শিক্ষাগত অবস্থার উন্নতির জন্য কৃষকদের একত্রিত, সংগঠিত করার জন্য গড়লেন। কৃষি-শিল্পের সক্রিয়তা বৃদ্ধি করে জীবন-জীবিকার জন্য, টিকে থাকার জন্য, স্থায়ী পথ খুলে দেওয়ার জন্য গড়লেন। ২. কৃষি-প্রযুক্তিতে নতুন প্রবর্তন, উন্নয়ন এবং পদ্ধতিগুলিকে কৃষকদের মধ্যে সম্প্রসারণের জন্য কৃষিজীবী মানুষকে উৎসাহিত করলেন। ৩. সনাতনী, পুরাতনী কৃষি-কলাকৌশল ও পদ্ধতিগুলিকে গুরুত্ব আরোপ করে তার সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করলেন। পরিবেশ-নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে মাটির উর্বরতা, জল, বীজ, গবাদিপশু, উদ্ভিদ, জৈব বৈচিত্র্যের কোন সংকট ঘনীভূত না হয়, তার জন্য চেষ্টা করলেন। ৪. প্রচলিত দেশীয় পুরাতন কৃষি পদ্ধতিগুলি সংগ্রহ, পরীক্ষণ, উদ্ভাবন, উন্নতিকরণ ও বহুল প্রচলনের মাধ্যমে তার সুফল গ্রহণ করা সংগঠনের উদ্দেশ্য হল। তা যাতে পেটেন্টকৃত হয়ে কোন সুবিধাবাদী ব্যক্তি বা সংগঠনের কুক্ষিগত না হয় তার বন্দোবস্ত করার কথা ভাবলেন। ৫. কৃষি-বিষয়ক অধ্যয়ন, ভ্রমণ, প্রদর্শনী, আলোচনা সভা, মিলোনোৎসব, শোভাযাত্রা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সংগঠিত করার জন্য, যাতে কৃষিজীবী মানুষের সমস্যার সমাধান করা যায় এবং তা কৃষকের প্রয়োজনে লাগে, তার চেষ্টা করলেন। ভারতীয় গো-বংশ ও অন্যান্য প্রাণীকূলকে সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করার জন্য চেষ্টা শুরু হল। ৯. ভারতীয় কৃষক এবং কৃষি-শ্রমিকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও হৃদ্যতা বাড়ানো সংগঠনের লক্ষ্য হল। গ্রামীণ পেশাগত কাজে নিযুক্ত ছুতার, কামার প্রভৃতি লোকগোষ্ঠী যাতে গ্রামে যথোপযুক্ত পরিবেশে তাদের সৃষ্টিমূলক কাজ চালিয়ে যেতে পারেন তার চেষ্টা হল। ১১. জমি, জল, শক্তি, সম্পদ ও বাস্তুতন্ত্র ব্যবস্থাপনার জন্য নানান সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তা গ্রহণ করে কৃষককে প্রশিক্ষিত করার কথা বললেন। ১২. উন্নত সেচ ব্যবস্থাপনার জন্য এবং জলের অপচয় রোধ করতে নানান সাজসরঞ্জাম ও পদ্ধতি উদ্ভাবন, গ্রহণ ও তার সম্প্রসারণ করা। এ সবই এক কৃষিপ্রধান দেশের গ্রামবিকাশের যোজনা।

স্বদেশী জাগরণ।
দেশে অনেক মানুষের মধ্যে স্বদেশী ভাবনা নেই, সংস্কৃতির সংরক্ষণ নেই, কিন্তু তাদের মধ্যে আন্তর্জাতিকতার মানস-সিংহাসন মজবুত। কোথায় স্বাবলম্বনের বেড়া দিতে হয়, কোথায় দেশরক্ষার জন্য আত্মবলিদান করতে হয়, তার নির্দেশ নেই যে মতাদর্শে, যে মস্তিষ্কে — তার ভরকেন্দ্র ভারতবর্ষ নয়। ভারতবর্ষের বাইরে, বিদেশি শক্তির মন্ত্রগুপ্তির শপথে। তাদের সঙ্গে দেশব্রতী মানুষের বিচার ধারার মূল পার্থক্য হল এইরকম — রাষ্ট্রবাদী মানুষ মনে করেন, “আগে দিয়ে বেড়া/তবে ধরো গাছের গোড়া।” দেশকে আত্মনির্ভরতা দিয়ে, অর্থনৈতিক সুরক্ষা দিয়ে প্রতিটি জীবনবৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তাই রাষ্ট্রীয় বেড়া দিতে হবে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশী জাগরণের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। প্রথম আয়োজনটি হওয়া উচিত পুঞ্জীভূত যে ধার, যে মানসিক ঋণ, তা মেটানোর কার্যক্রম নিতে হবে; এতদিনের মানসিক ঋণের বোঝা দূর করতে হবে। স্বদেশী ঘরানার মানসচর্চা কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত বিস্তৃত, কোথায় তার সমৃদ্ধি, কোথায় তার বিকাশ, কোথায় সম্ভাবনা — তার সুলুকসন্ধান কতটা হয়েছে? এটাই নিত্যকর্ম হবে জাগরণের-পূজারীদের ও প্রচারকবৃন্দের।

সাবলম্বী ভারতের একটা বৃহৎ মানে হল, ভারতের গ্রামগুলিকে যথাসম্ভব উৎপাদনে ও আয়োজনে, জীবনচর্যায় আগের মতোই সাবলম্বী করে তোলা, যেটা নেহেরু জামানায় রুশ মডেলে আইটিআই-ধাঁচের কিছু কারিগর বানিয়ে তাদের শিল্প কারখানায় পাঠিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। গ্রামের মানুষ আর কামারের বানানো জিনিস কিনলো না, কুমোরের তৈরি পাত্র দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগালো না, গ্রামের স্যাঁকরার ব্যবসা উঠে গেলো, মুচি তার জুতো বানানো বন্ধ করে দিল। সবাই ছুটলো কলের জিনিস কিনতে, শহরের দোকানে বহুজাতিক কোম্পানির জুতোয় ছেয়ে গেলো। প্রয়োজন হচ্ছে ভারত-মনস্ক দেশীয় উদ্যোগপতিদের উদ্যম, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সততা। নানাবিধ উৎপাদনের জন্য দেশীয় উদ্যোগপতিদের এগিয়ে আসা। যে জিনিস খুব সহজে, সুলভ প্রযুক্তিতে কম পুঁজি ব্যবহারে ক্ষুদ্র উদ্যোগপতিরা গ্রামে, শহরে তৈরি হতে পারে, তা দেশজুড়ে তৈরি হোক। 

গ্রামীণ জীবনচর্যায় ও মানসচর্চায় স্বাবলম্বন ও বীজনীতি।
কৃষি পণ্য ও সামগ্রীতে স্বাবলম্বন আনতে হবে। কৃষির ক্ষেত্রে স্বাবলম্বিতা মানে হল বীজ, সার, কীটঘ্ন ও কৃষি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে স্বাবলম্বন। বীজ নীতি এমন হওয়া উচিত, যাতে কৃষক চাষের কাজে নিজের বীজ নিজেই তৈরি করে নিতে পারে, কোনো বহুজাতিক বীজ কোম্পানিগুলোর উপর অন্যায়ভাবে নির্ভর করতে না হয়। এতে বীজের খরচ কমে। বহুজাতিক কোম্পানিরা নির্দিষ্ট ফসল চাষ করিয়ে, বীজ ব্যবহার করিয়ে কৃষককে পরিচালিত করে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। যে কৃষকের বীজ উৎপাদন করা সম্ভব নয়, সরকারী খামারগুলি স্থানীয়ভাবে তাদের জন্য বীজ উৎপাদনের ব্যবস্থা করুক। কোনো বীজ খামারকেই ফসল বিহীন পতিত করে রাখা চলবে না। প্রয়োজনে কৃষকের জমিতে পার্টিসিপেটরি সীড প্রোডাকশনের জন্য কৃষক, প্রজননবিদ ও সীড সার্টিফিকেশন আধিকারিকরা জুড়ে থাকুক। রাসায়নিক সারের জন্য প্রচুর বিদেশি নির্ভরতা আছে। জৈবিক চাষাবাদের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে শূণ্যে আনাটাই সবচাইতে বড় স্বাবলম্বন।

জৈবকৃষি।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, জৈবসারের গুণগত মানের ক্ষেত্রে কৃষিজীবী মানুষ কোনো দুর্নীতি সহ্য করবেন না। সমন্বিত কীটশত্রু ব্যবস্থাপনা বা ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট করার মধ্যে যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করতে হবে, তারই নাম স্বাবলম্বন। দেশীয় গরু, বলদকে কৃষিকাজে সংযুক্ত করে তাদের গোবর-গোমূত্র ব্যবহার করার মধ্যে যে কৃষি-আধার তার সামগ্রিকতা, তার নাম হচ্ছে স্বাবলম্বন। দেশীয় ধারার ফসল বৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করে দেশীয় কারিগরি দিয়ে সহজ-সরল-সুলভ যন্ত্রপাতি নির্মাণের নাম স্বাবলম্বন। আশাকরি আগামী দিনে কৃষি গবেষক, প্রশাসক, আধিকারিকেরা এই স্বনির্ভর কৃষির দিকে ধাবিত হবেন। কৃষিজীবী মানুষের সন্তান যতক্ষণ না পর্যন্ত জমি, ফসল, প্রকৃতি ভালোবাসতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই স্বাবলম্বী ভাব আসবে না। আর এই ভাব আনতে হলে কৃষি ও কৃষককে শহরবাসী প্রবুদ্ধ মানুষের দ্বারা মান্যতা দিতে হবে। জীবনের সবচাইতে বড় শিল্প হল প্রাকৃতিক পরিবেশে দেশীয় উপায়ে কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি ও উৎকর্ষ মানের ফসল পাওয়া। গ্রামীণ যাবতীয় উৎপাদনের মার্কেটিং এর ব্যবস্থা করে দেওয়াটা সবচাইতে বড় কাজ, এটা যেকোনো মূল্যে করতে হবে। 

কৃষি আইনের মধ্যে গ্রামবিকাশের সুযোগ কতটা।
কৃষক কতটা উপকৃত হবেন। পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ দিয়েই বলি। রাজ্যের ৯৬ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী। গড়পড়তা বার্ষিক আয় মোটো আটচল্লিশ হাজার টাকা। ভারতীয় কৃষকের গড় আয় আটাত্তর হাজার টাকা। পশ্চিমবঙ্গের চাইতে বেশি। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকের আয় ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডের চাইতে কম। ফসল কাটার পর ব্যবস্থাপনার বিস্তর অভাব, বিপণনের পরিকাঠামোতে সুযোগ নগণ্য। গ্রাম বিকাশ করতে হলে কৃষকের আয় বাড়াতে হবে। কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব যদি ফসলের সুনিশ্চিত দাম পাইয়ে দেওয়া যায়। সেই সঙ্গে রাজ্যের কৃষি ও আনুষঙ্গিক বিভাগগুলিকে সুষ্ঠু ও সমন্বিতভাবে কাজ করানো যায়। ফসল প্রাণিসম্পদ মৎস্য ভিত্তিক চিরায়ত কৃষিকর্মের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়।
গ্রাম বিকাশ করে হাজার হাজার ফার্মাস প্রোডিউসিং অর্গানাইজেশন তৈরি হলে কৃষকদের একত্রিত করে ফসলের দাম পেতে দর কষাকষি সম্ভব হবে। FPO তৈরি করিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সেই কাজটিই করতে চলেছে।
ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের দারিদ্র্য মোচন আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন তখনই হবে, যখন ফসলের বাজার তৈরি করা যাবে, ফসলের দাম পাওয়ার ব্যবস্থা হবে, ফসল লাগানোর সময়ই চুক্তিচাষে নিশ্চিত হওয়া যাবে কতটা মূল্য সে পেতে পারে। নতুন কৃষি আইনে সে সুযোগ আছে।

জাতীয় শিক্ষানীতিতে কৃষি শিক্ষা ও গ্রামবিকাশ কতটা সম্ভব।
৩৪ বছর পর নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন হল। New Education Policy 2020 গ্রামবিকাশের বাস্তব জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। শিক্ষাকে সর্বাঙ্গীণ জীবন বিকাশের উপযোগী করে তোলার জন্য Vocational পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মেকলের নীতি অনুসরণ করে কেরানী তৈরি করা হত এতদিন। কিন্তু সনাতন ভারতে কিশোর কিশোরীররা বাবা-মায়ের কাছে পিতৃপুরুষের পেশাগত দক্ষতায় ট্রেইণ্ড হতেন। পরিবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সনাতনী পেশাশিক্ষার কথা রয়েছে। স্কিল ও পেশাভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা। ক্লাস সিক্স থেকে ভকেশনাল ট্রেনিং পাবে। তার অন্যতম কৃষি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক শিক্ষা। দ্বিতীয় যে কথাটি বলতে হয়, বড় বদল হয়েছে স্কুল এডুকেশনে, তাতে বেশি উপকৃত হবে গ্রামাঞ্চলের শিশুরা। এদের প্রথামাফিক অনুশীলন শুরু হত ৬/৭ বছর বয়সে। কিন্তু শহরের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিশু বিগত ৩/৪ দশকে ৩/৪ বছর বয়সে অনুশীলন শুরু করেছে৷ গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থায় কিশলয়ে শিশুরা পিছিয়ে ছিল ৩ বছর। এগিয়ে গেল। বৈষম্য গোড়াতেই কেটে গেল। শিক্ষার সূচনাতে সমান সমান।

ভিক্ষা দিয়ে, ভর্তুকি দিয়ে, কী গ্রাম বিকাশ সম্ভব?
স্বামীজি বলছেন, “নূতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধ’রে, চাষার কুটির ভেদ ক’রে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, তুণাওয়ালার উকুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝোড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে।” এরা হাজার হাজার বৎসর অত্যাচার সহ্য করেছে। পায়ের নীচে দলিত হয়েছে। “যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।” গ্রামবিকাশ মানে পুরো গ্রামকে মুক্ত করা। ভিক্ষা দিয়ে কাউকে মানুষের মতো বাঁচানো যায় না। সকলকে শিক্ষা দেওয়া, পরিষেবা দেওয়া। তবে গ্রাম জুড়ো আনন্দের হাওয়া বইবে; গান-বাজনা কীর্তনপাঠ চলবে; রামায়ণ মহাভারতের পাঠ হবে, ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে’ চলবে। এই কাজ টুকরো করে হলে চলে না। একতাই বল। ‘একলা মানুষ টুকরো মাত্র’। মানুষে মানুষে মিলতে হবে, তবে ভরসার পরিবেশ রচিত হয়। পঞ্চাশজনে জোট বাঁধলে তবেই ভরসার জায়গা তৈরি হয়৷ এরজন্য দেশকে জানা দরকার। নিজের দায়িত্ব কর্তব্য এড়িয়ে এড়িয়ে কেবল ভিক্ষার অধিকার প্রাপ্তি নয়। আত্মবিশ্বাস আর শক্তিতে যতক্ষণ দেশকে জয় করতে না পারছি, ততক্ষণ এদেশ আমার নয়।।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, ‘আজ শুধু একলা চাষীর চাষ করিবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে’। বিদ্বান, বিজ্ঞানী কি কৃষকের জন্য কৃষক-বান্ধব হয়ে সত্যিই এগিয়ে আসবেন? না, কৃষিতে অজস্র দালালের বান্ধব হয়ে কাজ করে যাবেন! এটাই আজ কোটি টাকার প্রশ্ন।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.