কলিযুগে অযোধ্যায় এক রাজা ছিলেন, তাঁর নাম ছিল সঞ্জাত বা সুজাত। এঁর জন্ম হয়েছিল সেই ইক্ষাকু বংশে, যে বংশে ত্রেতাযুগে জন্ম হয়েছিল রামচন্দ্রের। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘মহাবস্তু অবদানম’ এবং হিন্দুদের ‘বিষ্ণু পুরাণ’ থেকে জানা যায় যে, রামপুত্র কুশের একান্নতম অধস্তন পুরুষ ছিলেন সুজাত। সুজাতের ছিল পাঁচ পুত্র ও পাঁচ কন্যা। পাঁচ পুত্রের নাম–ওপুর, নিপুর, করকন্ডক, উল্কামুখ এবং হস্তিকশীর্ষ। আর পাঁচ কন্যার নাম হল–শুদ্ধা, বিমলা, বিজিতা, জনা এবং জলী।
পুত্রকন্যাদের নিয়ে রাজা বেশ সুখেই ছিলেন। তবু তারই মাঝে একদিন কামতাড়িত রাজার মতিচ্ছন্ন হল। তাঁর অন্তঃপুরে বেশকারিণীর একটি অতীব সুন্দরী ও যুবতী কন্যা ছিল, যার নাম ছিল জেন্ত। তার রূপে সুজাত এমন পাগল হলেন যে, পূর্বপুরুষ দশরথের দুরবস্থা তাঁর মনেই পড়ল না! উল্টে, যা চাইবে তাই দেবার অঙ্গীকার করে তার দেহ ভোগ করতে চাইলেন। রাজাকে কামনা করতেন জেন্তও, তাই রাজার প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে গেল। শুধু বলল যে, যা চাইবার সে সুযোগ সুবিধে মতো কিছু একটা চেয়ে নেবে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল রামায়ণের অনুর্বতন! জেন্ত ও সুজাতের একটি পুত্রসন্তান হল, যার নাম দেওয়া হল জেন্তি।
ছেলে বড় হতেই একদিন জেন্তর মনে হল, এবার রাজার কাছে ইচ্ছেপূরণের সময় এসেছে। বেশকারিণীর মেয়ে জেন্তর মনে খুব একটা প্যাঁচ ছিল না। সে গেল তার বাপমায়ের কাছে পরামর্শ চাইতে। বাপমাও তারই মতো। তারা বলল, কি আর চাইবি? চেয়ে নে ছেলের যাতে খাওয়াপরার অভাব মেটে এমন একটা গ্রাম।
বাপমা আর মেয়ের এইসব কথাবার্তা যখন চলছে, সেই সময় সেখানে ছিল এক ভিখারিণী। সে ঢুকে বসল তাদের কথার মধ্যে। সে বলে বসল, ওরে বোকা, তুই বেশকারিণীর মেয়ে, তুই কি কোনদিন রাজার পাটরানি হতে পারবি, না তোর ছেলে কোনদিন রাজা হবে! এই সুযোগে তুই বরং রাজাকে বল পাঁচ ছেলে পাঁচ মেয়েকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তোর ছেলেকে রাজা করে দিতে!
একথাটা সবারই বেশ মনে ধরল। সুজাতর কাছে এসে জেন্ত তাই চেয়ে নিল। সুজাতও দশরথের মতো বাধ্য হলেন কথা রাখতে। সন্তান শোকে ভাসতে ভাসতে পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়েকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন। রাজ্যের প্রজারা তাদের খুব ভালোবাসত। অনেকেই তাদের সঙ্গে গেল। যারা সঙ্গে গেল তাদের ওপর খুব খুশি হলেন সুজাত। তাদের হাতি, ঘোড়া ও সম্পদ দান করলেন।
বিতাড়িত রাজকন্যা ও রাজপুত্রদের আশ্রয় দিলেন কাশীকোশলের রাজা। কিন্তু অল্পদিনেই সে দেশের প্রজাদের কাছে এই রাজপুত্র ও রাজকন্যারা যখন রাজার থেকেও বেশি প্রিয় হয়ে উঠল, তখন রাজা প্রমাদ গণলেন। তাড়িয়ে দিলেন রাজ্য থেকে।
তখন রাজপুত্র রাজকন্যারা পাড়ি দিলেন আরও উত্তরের দিকে। হিমালয়ের কাছাকাছি যেখানে কপিলা ঋষির আশ্রম ছিল, সেখানে এক শকোটি বন ছিল, সেখানেই তারা এসে আশ্রয় নিলেন। বসতি গড়ে তুললেন। এই বসতিই পরবর্তীতে ঋষির নামে কপিলাবস্তু নাম হয়েছিল।
এই বসতিতে একটা সমস্যা দেখা দিল। এদের সঙ্গে বাইরের কেউ মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলো না বা এদের মেয়ে বাইরের কেউ ঘরে তুলতে চাইলো না। ফলে, বিয়েসাদির ব্যাপার নিজেদের রক্তের সম্পর্কের মধ্যেই করতে বাধ্য হল তারা। এমনি করে দিন যেতে লাগল। কপিলাবস্তু পরিণত হল সমৃদ্ধ জনপদে। সেখানকার বণিকেরা বাণিজ্যের জন্য যেতে লাগল ভারতবর্ষের নানান প্রান্তে। তারা অযোধ্যাতেও গেল। তাদের কাছেই বৃদ্ধ রাজা সুজাত খবর পেলেন পুত্রকন্যাদের, জানলেন তাদের রক্তসম্পর্কের মধ্যে বিবাহে বাধ্য হওয়ার কথা। তাই শুনে রাজা দুশ্চিন্তায় পড়লেন। তাহলে কি তাঁর পুত্রকন্যারা পতিত হয়ে গেল! তিনি রাজপন্ডিতদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর সংশয়ের কথা। পন্ডিতেরা বললেন, রাজকুমারেরা যা করেছেন তা তারা করতে পারেন, কারণ তাঁরা রাজকুমার। সেই বিধায় তাঁরা শক্য। ‘শক্য’ কথার অর্থ ‘নির্দোষ’। এই কথা থেকেই এই কুমারদের বংশের নাম হল, ‘শাক্যবংশ’।
এই বংশেই সুজাতের জ্যেষ্ঠপুত্র ওপুরের অধস্তন সপ্তম পুরুষরূপে জন্ম নিয়েছিলেন শাক্যসিংহ বা শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ।