বাংলার মাটিতে সহজিয়া ধর্মমত চিরকালই মানবসভ্যতার ইতিহাসের হিংস্রতম ধর্মীয় ফ্যাসিবাদটির শিকার হয়েছে। উনিশ শতকে মৌলবী আবদুল ওয়ালির সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল বাউল-ফকিরদের। ১৮১৮ সালে মৌলবী আবদুল ওয়ালি ফকিরদের সম্পর্কে ঘৃণার সঙ্গে লিখছেন, “a life of abomination, of guilt, of shame, and of filth, for the purpose of subverting the existing order of things.” বাউল ফকিরদের ধর্মাচরণের মূল শিকড় যে বাঙালীর তন্ত্রে, সে প্রসঙ্গেও উচ্চবর্গীয় আরব ওয়ালি আরও বলছেন, “The illiterate, the lowly Hindus and Muhammadans are the classes from among whom these faqirs and mendicants are generally recruited… so far as I am aware, their beliefs were formerly confined to a class of Hindu Tantrics and Bairagis of the Baula order, but since a period of 30 and 40 years men of other castes, e.g., Musalmans of the lower order, are believing in their satanic beliefs. “

পরবর্তী শতাব্দীতে বাংলার মাটিতে লীগের হাত ধরে ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতি ও দ্বিজাতিতত্ত্বের চর্চা শুরু হলে এই ঘৃণা আরো পরিণত রূপ পায়। বিশ শতকে বাউল ধ্বংস ফৎওয়ায় বলা হয়েছিল, “…ন্যাড়ার ফকিরগণ লালন সাহার সম্বন্ধে কোনোই পরিচয় না জানিয়ে হুজুগে মাতিয়া হিন্দু বৈষ্ণবদিগের দেখাদেখি লালন শার পদে গা ঢালিয়া দিয়া মোছলমান সমাজের কলঙ্কস্বরূপ হইয়াছে ইহা অতিশয় পরিতাপের বিষয়।” ১৯২৫ সালে বাউল ধ্বংস ফৎওয়া বইতে বলা হল, “বাউল ন্যাড়ার দল এছলামের ভিতর দিয়া যে কুৎসিত জঘন্য মত গজাইয়া তুলিয়াছে ও পবিত্র শরিয়তের সীমা লংঘন করিয়াছে…. যদ্যপি মোছলমান বাদশাদের রাজ্যে তাহাদের বাস হইত তাহা হইলে তাহাদের অবস্থা যাহা ঘটিত তাহা তাহারা একবার ভাবিয়া দেখিলেই…” ইত্যাদি।

ব্রিটিশ শাসনে বাউলফকিরদের পিটিয়ে ঠাণ্ডা করার যেটুকু বাধা ছিল, দেশভাগ হবার পরে আর সে দায় রইল না। এমনকি বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরেও এই বিদ্বেষের ধারা ছিল সতেজে বহমান। ১৯৮৬ সালে ইসলামী রাষ্ট্র বাংলাদেশে ম.আ.সোবহান ‘জালালী ফয়সালা’ বইতে লালন মাজার ধ্বংস করার ডাক দেন। পশ্চিমবঙ্গও নেহাৎ পিছিয়ে থাকেনি। শক্তিনাথ ঝা ‘বাউল ফকির ধ্বংস আন্দোলনের ইতিবৃত্ত’ বইতে সাতের দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাউল ফকিরদের উপর সংগঠিত নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছেন। গত দশকে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত রাজপাট উপন্যাসে দেখানো হয়েছিল, বাউল ফকিরদের প্রতি মূলধারার ছংখ্যালঘুদের তীব্র বিদ্বেষ এবং তার ধারাবাহিকতায় আখড়া আক্রমণ, ফকিরদের জোর করে মাংস খাওয়ানো ইত্যাদির প্রসঙ্গ।

অতঃপর আর একটি সেনসাস গিয়েছে, এবং পৃথিবীর হিংস্রতম ধর্মীয় ফ্যাসিবাদটি ডেমোগ্রাফিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গে আরো একটু শিকড় শক্ত করেছে। অত্যাচারের কাহিনী ফিকশন থেকে বেরিয়ে বাস্তবেও আমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে এখন। বাউল ফকির সংঘ জানাচ্ছেন,শাস্ত্রীয় হিন্দুধর্ম বাউল ফকিরদের বিস্তর নিন্দা ও সমালোচনা করলেও ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী তা সমালোচনাতেই থেকে থাকে। শক্তিনাথ ঝা বলছেন, ১৯৭০ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাউল নির্যাতনের একটি মাত্র ঘটনা ঘটেছে হিন্দু সমাজে, বাকি কয়েক শত অত্যাচার হয়েছে আরব মৌলবাদীদের প্রযত্নে। বাংলার সহজিয়া লোকধর্মের উদারতার কথা প্রচার করা পশ্চিমবঙ্গীয় যে বাম সেকুলার লিবারবালরা ‘ইহাও খারাপ, উহাও খারাপ’ বলে পিঠ বাঁচান, তাঁরা একবার এই পরিসংখ্যানটি খতিয়ে দেখতে পারেন। বস্তুত আরব সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যাচার ঠেকানোর জন্যই ১৯৮৩ সালে বাউল ফকির সংঘ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ২০১৬-১৭ মুর্শিদাবাদ জেলায় বাউল ফকিরদের একঘরে করা, হুমকি দেওয়া, জোর করে মূলধারার ধর্মপালন করতে বাধ্য করার ঘটনাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। গান শিখতে বাধা দেওয়া হচ্ছে ফকির পরিবারের মেয়েকে। বাউল ফকিরদের ধর্মীয় উপাসনাস্থল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনিক সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ। হাড় হিম করা অত্যাচারের বিস্তারিত বিবরণ বাউল ফকির সংঘের লিফলেটটা পড়ে দেখলে জানা যাবে। বাউল ফকির সংঘের সদস্যরা আশঙ্কিত, “ইসলামিক রাষ্ট্রের অলিখিত আইন কার্যকরী হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে।” প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, মুর্শিদাবাদের বিপদসূচক ২০১১ সালে ছিল প্রায় ৬৭%।

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় ধারাবাহিকভাবে এই জিনিস চলছে ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কলরোল করার জন্য বিখ্যাত বাম প্রগতিশীল ফেসবুক প্রোফাইলগুলির একটি থেকেও এই নিয়ে সচরাচর আধখানা বাক্যও উচ্চারিত হতে দেখি না। লেফট লিবারবাল যাঁরা নন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র সপ্তডিঙার তমাল দাশগুপ্তর ফেসবুক পেজে বাউল ফকির সংঘের আবেদনটি শেয়ার হতে দেখলাম। তমালবাবুর সাথে গুচ্ছ মতপার্থক্য ছিল এবং হয়ত ভবিষ্যতেও থাকবে, কিন্তু এই ঘটনা সামনে আনার জন্য তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

তথ্যসূত্র:

১. ব্রাত্য, মন্ত্রবর্জিত লালন ফকির। সুধীর চক্রবর্তী। চতুরঙ্গ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯২।
২. কেন লালন চাই। আবুল আহসান চৌধুরী। আরশিনগর, দ্বিতীয় সংখ্যা, ২০১২।
৩. আকবর আলি সেখ প্রকাশিত বাউল ফকির সঙ্ঘের আবেদনপত্র।

সোহম পাল






Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.