পাপ-পুণ্যের মেলা নিয়ে 

নলেন গুড়ের মিষ্টি মুখে এসেছে পৌষ সংক্রান্তি…

পৌষ মাসের শেষ দিন অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তি ভারতীয় উপমহাদেশে মকর সংক্রান্তি নামে পরিচিত। মকর সংক্রান্তির দিনটি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে এক উৎসব – তবে বহু নামে পালিত হয়। রাশিচক্রের বিচারে এই দিনটিতে সূর্য মকর রাশিতে প্রবেশ করে – শুরু হয় সূর্যের উত্তরায়ন।

পশ্চিমবঙ্গে এই সময় মাঠ থেকে ঘরে আসে নতুন ধান। শীতকাল মানেই নলেন গুড়। নতুন ধান আর নতুন গুড়ের পার্বণ চলে পুরো বাংলা জুড়ে। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ যেমন – তামিলনাড়ুতে এই সময় হয় পোঙ্গাল উৎসব, কর্নাটকে মকর সংক্রমনা, আসামে চলে বিহু উৎসব।

মকর সংক্রান্তির দিন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সাগরদ্বীপে মকরের পুণ্যস্নান উপলক্ষে বহু পুণ্যার্থী সমাগম হয়। পুণ্যস্নানের ক্ষেত্রে কুম্ভের পরেই থাকবে গঙ্গাসাগর। গঙ্গাসাগরে স্নান করে কপিল মুনির আশ্রমে পূজার প্রচলন আছে। পৌরাণিক মতে কপিলমুনি ছিলেন শ্রী বিষ্ণুর অবতার এবং একজন মহান সাধক। তিনি তাঁর কুটিরে তপস্যায় লিপ্ত থাকতেন। সগর রাজা নামে এক পৌরাণিক রাজার অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়াকে দেবরাজ ইন্দ্র কপিলমুনির আশ্রম এর পিছনে লুকিয়ে রাখেন। এদিকে যজ্ঞের ঘোড়া খুঁজতে সগর রাজা তার ষাট হাজার পুত্র কে পাঠান। অনেক সন্ধানের পর তারা যখন কপিল মুনির আশ্রমে ঘোড়াটিকে দেখতে পায় তখন তারা কপিলমুনিকেই এই চৌর্য্যবৃত্তির দায়ে দায়ী করে। মিথ্যা অপবাদে কপিলমুনি কুপিত হয়ে ক্রোধে সগর রাজার ষাট হাজার পুত্রকে ভস্মীভূত করেন। অবশেষে সগর রাজার পৌত্র ভগীরথ অনেক প্রার্থনা করে কপিল মুনি কে শান্ত করেন। কপিলমুনি ভগীরথকে উপদেশ দেন মা গঙ্গাকে মর্ত্যে আনতে পারলে, মা গঙ্গার পূর্ণ বারিতেই পাপমুক্ত হবে সগর রাজার পুত্রেরা। ভগীরথ তাঁর ঐকান্তিক প্রার্থনায় মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে তাঁর জটা থেকে মা গঙ্গাকে মুক্ত করে মর্ত্যে নিয়ে আসেন। মা গঙ্গার মর্ত্যে আসার সেই পূর্ণ দিনটি হলো মকর সংক্রান্তি।

মানুষের পাপ-পুণ্য তার কর্মফল এর উপর নির্ভরশীল হলেও গঙ্গাসাগরে পুণ্যস্নানের আকর্ষণ বেশ জনপ্রিয়। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের হুজুগে একে ঘিরে চলে মেলা, উৎসব। এছাড়া ঘরে ঘরে চলে নতুন চালের গুঁড়োর আলপনা ও মা লক্ষ্মীর আরাধনা। বাঙালির উৎসবে মিষ্টির কথা তো সর্বজনবিদিত। আর মকর সংক্রান্তির সময় নতুন চাল ও নতুন গুড়ের সংমিশ্রণে পিঠেপুলি তাতে অন্য মাত্রা যোগ করে। দিন বদলেছে ঢেঁকি বা শিলনোড়ার জায়গা নিয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। তবে বিশেষ দিনে বাড়িতে বানানো পিঠের স্বাদ ! আহা ! তার তুলনা চলে না – সরুচাকলি, পাটিসাপটা, সেদ্ধ পুলি বা দুধপুলি যাই হোক সবই অনবদ্য, অসাধারণ। এ তো শুধু মিষ্টিই নয় নস্টালজিক বাঙালি এতে খুঁজে পায় তার মা, ঠাকুমা, দিদিমার স্নেহের, আদরের স্পর্শ। উৎসাহ, আনন্দে ভরা এই উৎসবের সাথে পৌরাণিক কাহিনী, পুণ্য সঞ্চয়ের পাশাপাশি জড়িয়ে থাকে আবেগ, আকুলতা।

সুচরিতা চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.