পাহিমাংদেহিমহালক্ষ্মী – চতুর্থ পর্ব

Hindu Cosmos - Lakshmi with her owl 1871-1930,... | Hindu art, Kali  goddess, India art

চতুর্থ পর্ব

অনেকেই বলেন , যে গাড়ুব্রত আসলে দশমহাবিদ্যার অন্যতম ধূমাবতীর পূজা। ধূমাবতী হলেন সপ্তম মহাবিদ্যা। গুহ্যাতিগুহ্য তন্ত্র গ্রন্থে দশ মহাবিদ্যাকে বিষ্ণুর দশ অবতারের উৎস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই গ্রন্থ মতে মৎস্য অবতারের উৎস হলেন ধূমাবতী। মুণ্ডমালা গ্রন্থেও একটি অনুরূপ তালিকা রয়েছে; তবে উক্ত গ্রন্থ মতে বামন অবতারের উৎস হলেন ধূমাবতী।

শাক্ত মহাভাগবত পুরাণে দশমহাবিদ্যার উৎপত্তির কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই কাহিনি অনুযায়ী, দক্ষের যজ্ঞে নিমন্ত্রিত না হয়ে দক্ষকন্যা তথা শিবের প্রথমা স্ত্রী সতী অপমানিতা হন। তিনি বিনা আমন্ত্রণেই যজ্ঞে উপস্থিত থাকতে চাইলে, শিব বারণ করেন। সতী অনুনয়বিনয় করে শিবকে রাজি করানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু সফল হন না। তখন ক্রুদ্ধ হয়ে সতী দশমহাবিদ্যার রূপ ধারণ করে দশ দিক দিয়ে ঘিরে ধরেন। এই সময় ধূমাবতী দক্ষিণপূর্ব দিকে দণ্ডায়মান ছিলেন। অপর একটি কিংবদন্তিতেও অনুরূপ কাহিনি পাওয়া যায়; তবে এই মতে সতীর স্থলে প্রধান মহাবিদ্যা ও অপরাপর মহাবিদ্যাগণের উৎস কালীকে স্থাপন করা হয়েছে।দেবীভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, দশমহাবিদ্যা হলেন শাকম্ভরীর রূপভেদ ও সহযোদ্ধা।

শক্তিসংগম তন্ত্র গ্রন্থে উল্লিখিত কাহিনি অনুযায়ী, সতী দক্ষের যজ্ঞকুণ্ডে আত্মবলিদানের উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দিলে সতীর দগ্ধ দেহের কালো ধোঁয়া থেকে ধূমাবতী উত্থিতা হন। তিনি হলেন “সতীর দেহাবশেষ” এবং তাঁর অপমানিতা অবতার।প্রাণতোষিণী তন্ত্র গ্রন্থে ধূমাবতীর বিধবা বেশের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। একদা সতী শিবের কাছে অন্ন প্রার্থনা করেন। শিব তাঁকে অন্ন দিতে অস্বীকার করলে, সতী তাঁর প্রচণ্ড ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য শিবকেই ভক্ষণ করেন। শিব যখন তাঁকে নিষ্কৃতি দিতে অনুরোধ করেন, তখন সতী শিবকে পুনরায় উগরে দেন। এরপর শিব তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিধবার বেশ ধারণ করার অভিশাপ দেন। আর একটি লোকপ্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী, দুর্গা শুম্ভ ও নিশুম্ভ অসুরদ্বয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ধূমাবতীকে সৃষ্টি করেন। ধূমাবতী প্রাণঘাতী ধূমের সাহায্যে দৈত্যনাশ করেন।

প্রাণতোষিণী তন্ত্র ধূমাবতীর ধ্বংসাত্মিকা শক্তি ও প্রচণ্ড ক্ষুধার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। উল্লেখ্য, বিশ্ববিধাতা শিবই তাঁর ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে সক্ষম। এটি ধূমাবতীর বিধবাবেশী অমঙ্গলসূচক রূপ এবং তাঁর স্বামীভক্ষণকারী সত্ত্বার প্রতীক।

ধূমাবতী প্রলয়ের প্রতীক। তিনিই সৃষ্টির পূর্বে ও প্রলয়ের পরে বিদ্যমান “মহাশূন্যের” মূর্তিস্বরূপ। ধূমাবতী সাধারণত অমঙ্গলকর বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যদিও তাঁর সহস্রনাম স্তোত্রে তাঁর কয়েকটি সদগুণেরও বর্ণনা করেছে। তিনি কোমলস্বভাবা ও বরদাত্রী। ধূমাবতী মহাগুরু; তিনি কল্যাণ ও অকল্যাণের বহু ঊর্ধ্বে স্থিত জগৎ চরাচর সম্পর্কে সর্বোচ্চ জ্ঞান প্রদান করেন। তাঁর কুৎসিত রূপটি প্রকৃতপক্ষে একটি রূপক; এই রূপ সাধককে বাইরের নকল সৌন্দর্যের পরিবর্তে জীবনের অন্তর্নিহিত সত্যটি অনুসন্ধান করতে ও জানতে শেখায়।

হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, ধূমাবতী সিদ্ধি বা অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন; তিনি সকল বিপদ থেকে ভক্তকে উদ্ধার করেন এবং জ্ঞান ও মোক্ষফল সহ সকল অভীষ্ট বস্তু প্রদান করেন। শত্রুনাশের উদ্দেশ্যে তাঁর পূজা করা হয়। ধূমাবতীর পূজা আইবড়, বিধবা বা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের পক্ষেই প্রশস্ত বলে মনে করা হয়। বারাণসীতে অবস্থিত ধূমাবতী মন্দিরে দেবী অমঙ্গলসূচক বিষয়গুলির ঊর্ধ্বে স্থানীয় রক্ষাকর্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেছেন। এখানে বিবাহিত যুগলেও তাঁর পূজা দিয়ে থাকেন। যদিও ধূমাবতীর মন্দিরের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম, তা সত্ত্বেও শ্মশান বা বনাঞ্চলে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁর নিয়মিত পূজা হয়ে থাকে।

গাড়ুব্রতে ধূমাবতীর প্রভাব থাকতেই পারে। তবে অলক্ষ্মী বিতাড়ন প্রসঙ্গকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। অনেক স্থানে গাড়শি ব্রতের দিন , কাক ডাকার পূর্বে বাড়ির সকলে ঘুম থেকে উঠে গায়ে হলুদ মাখেন।তারপর মাটি দিয়ে তৈরি করেন একটি আসত শূকর মূর্তি। পূজা করে কুলো বাজিয়ে এই মাটির শূকর বলি দিয়ে ফেলে দিয়ে আসেন রাস্তায় ত্রিমাথায়। যেমন আমরা পূজা করা গোবরের অলক্ষ্মীকে কুলো বাজিয়ে বিদেয় দি রাস্তার তিন মাথার ধারে। 

সমাজ সংস্থানের বস্তু ভিত্তি হল ধন-সম্পদ । এই ধন সম্পদ যে শুধু ব্যক্তির পক্ষে তার জীবন ধারণ , শিক্ষাদীক্ষা, ধর্ম-কর্ম  ইত্যাদির নিমিত্ত অপরিহার্য তাই নয়, একটি গোষ্ঠী ও সমাজের পক্ষেও এটি সমানভাবে অপরিহার্য । সমাজ নিরপেক্ষ মঙ্গলের নিমিত্ত অথবা তপশ্চর্যা বিশুদ্ধ ধর্ম জীবনযাপনের জন্য কোন উদ্দেশ্যে সমাজের বাইরে একান্ত ভাবে জীবন যাপন করেন তাঁদের কেউ কেউ এমন মুক্ত পুরুষ আছেন যাঁরা ধন কামনা করেন না। কিন্তু সমাজ ইতিহাসে তাঁরা আলোচনার বিষয় নন। বাঁচার জন্য ,অন্ন বস্ত্র বাসস্থান একান্ত প্রয়োজন ।সামাজিক নানা বিধিবিধান, প্রয়োজন আয়োজন দ্বারা শাসিত সমাজ ধর্মী যে ব্যক্তি…তাঁর দৈনন্দিন জীবনে ধন-সম্পদ অপরিহার্য বস্তু। কেবলমাত্র রত্ন ,মুদ্রা ,ধাতু, টাকা ইত্যদিকেই ধন সম্পদ  বলে না।  ধন সম্পদ বলতে কিছু উপাদানকে বোঝায় ,যেরকম – কৃষি , শিল্প , ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি । 

Lakshmi ,9th century,LACMA collection, USA.

অর্থ সম্পদ ব্যতীত সমাজ রাষ্ট্র বিকল হয়ে পড়বে । যাঁরা সমাজ পরিচালনা করেন অর্থাৎ প্রশাসক, শিক্ষক , কৃষক , শ্রমিক , কুমোর, মুচি, ঝাড়ুদার প্রমুখদের কায়িক অথবা মানসিক শ্রমের জন্য বেতন দিতে হবে এবং তা মুদ্রা দিয়ে হোক বা শস্য দিয়ে বা প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়ে। শুধু রাষ্ট্রের কথা বলি কেন, ধর্ম, কর্ম, শিল্প ,শিক্ষা-সংস্কৃতি ,কিছুই এই সম্পদ ছাড়া চলতে পারে না এবং সমাজ সংস্থানের যে কোন ব্যাপারেই একথা সত্য।

  কৃষি ও ভূমিজাত সম্পদই একটি সমাজ পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। ভারত হল একটি কৃষি প্রধান দেশ। সুপ্রাচীনকালের বেদ , রামায়ন, মহাভারতে বার বার ভূমির উর্বরতার কথা বলা হয়েছে। কৃষি ও তদবিষয়ক নানা জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে। 

সুপ্রাচীন কাল থেকে  তাই বৈদিক ঋষিরা সমগ্র বিশ্বজগতের কল্যাণের জন্য মন্ত্র উচ্চারণ করতেন
ভূমি-মঙ্গলম / উদক-মঙ্গলম / অগ্নি-মঙ্গলম / ভ্যু-মঙ্গলম/ গগনা-মঙ্গলম / সূর্য- মঙ্গলম/ চন্দ্র  মঙ্গলম /  জগ-মঙ্গলম/ জীবন-মঙ্গলম / দেহা-মঙ্গলম /  মানো-মঙ্গলম /আত্মা-মঙ্গলম / সর্ব-মঙ্গলম ভবতুহ ভবতুহ ভবতুহ স্বাহা সর্বমঙ্গলম ভবতুহ ভবতুহ ভবতুহ স্বাহা ভবতুহ ভবতুহ……

Gajalakshmi , late 9th-early 10th century, Sandstone, Museum of Cham,Vietnam.

কৃষিকাজ একটি  সমাজের স্থিতিস্থাপকতার প্রথম ও অন্যতম লক্ষণ। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে মানুষ যখন গুহাবাসী ভারতবাসী তখন ছিল উন্নত কৃষি ব্যবস্থার ধারক। শুধু কৃষির উল্লেখ নয় শস্য, চাষ, সেচ, খাল, নালি, কূপ, জলাধার ও শস্যাধার- কৃষি সম্পর্কিত সকল বিষয় বেদ বর্ণনা করেছে, যা থেকে প্রমাণ হয় যে বৈদিক যুগে কৃষিব্যবস্থা বহুগুণে উন্নত ছিল। কৃষি সম্পর্কিত বেদের কিছু মন্ত্র-

বলীবর্দসমূহ সুখে বহন করুক, মনুষ্যগণ সুখে কার্য করুক, লাঙ্গল সুখে কর্ষণ করুক। ঋগ্বেদ, ৪/৫৭/৪
ফাল সকল সুখে ভূমি কর্ষণ করুক, রক্ষকগণ বলীবর্দের সাথে সুখে গমন করুক, পর্জন্য মধুর জল দ্বারা পৃথিবী সিক্ত করুক। ঋগ্বেদ, ৪/৫৭/৮

লাঙ্গলগুলি যোজনা কর, যুগগুলি বিস্তারিত কর, এস্থানে যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে তাতে বীজ বপন কর, আমাদের স্তবের সাথে আমাদের অন্ন পরিপূর্ণ হোক, কাস্তে নিকটবর্তী পক্বশস্যে পতিত হোক। ঋগ্বেদ, ১০/১০১/৩

হে দ্যূতকার ! পাশা খেল না, বরং কৃষিকার্য কর। ঋগ্বেদ, ১০/৩৪/১৩
কৃষিতে জলসেচ তথা ঘটিচক্রের ব্যবহার প্রথম বেদে পাওয়া যায় যা বর্তমানের পাওয়ার পাম্পের প্রাচীনরূপ। ঘটিচক্রের পরিধিতে অনেক ঘটি থাকে ঘূর্ণনের কারণে জলের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে জলপূর্ণ হয়ে তা পুনরায় উপরে জল ঢেলে দেয় ।

যেরূপ যুদ্ধের সৈন্যগণ বারবার অগ্রসর হয় অথবা ঘটিচক্র শ্রেণিবদ্ধ হয়ে অগ্রপশ্চাতভাবে উঠতে থাকে, আমার স্তবগুলিও সেরূপ। ঋগ্বেদ, ১০/৯৩/১৩

লাঙ্গল ও জলসেচ ব্যবস্থা সেসমাজে এত পরিচিত সেসমাজকে আর যাই বলা হোক যাযাবর পশুপালক বলা সম্ভব নয়। কারণ এই সমাজই শস্য জমা রাখার পদ্ধতিও তৈরি করেছিল যা বর্তমানে হিমাগারের সাথে তুলনা করা চলে।

হে অধ্বর্যুগণ! ইন্দ্র স্বর্গীয় ও অন্তরীক্ষস্থ এবং পৃথিবীস্থ ধনের রাজা যবদ্বারা যেরূপ শস্য রাখবার স্থান পূর্ণ করে, ইন্দ্রকে সোম দ্বারা সেরূপ পূর্ণ কর। ঋগ্বেদ,২/১৪/১১

বাঙ্গালীর জীবনে বারো মাসের তেরো পার্বন সেখানে পূজা, ব্রত , মঙ্গলকাব্য সবই প্রকৃতি বিষয়ক। সর্বত্রই মানুষ চান ধরিত্রী যেন হয় সুজলা সুফলা।

Vishnu and Lakshmi,  12th century , chlorite, West India, Matsuoka Museum of Art,Tokyo.

যেমন : #পৃথিবী ব্রত ….মেয়েরা চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে সারা বৈশাখ মাস ধরে একমাসব্যাপী এই ব্রত পালন করে। এটি চার বছর পরপর পালন করতে হয়। ব্রতের উদ্দেশ্য হল শস্য শ্যামলা ধরণী, বৃষ্টি সাংসারিক অমঙ্গল দূরীকরণ।
“এসো পৃথিবী, বসো পদ্মপাতে,
তোমার পতি শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম হাতে
তিনি বৈকুণ্ঠেশ্বর নারায়ণ, আজকে পূজব তার দু’চরণ
খাওয়াব ক্ষীর, মাখন, ননী যেন জন্মে জন্মে হই রাজার রাণী
নাওয়াবো দুধে মাখাব ঘি জন্মে জন্মে হব রাজার ঝি।।”
আরো আছে #যমপুকুর ব্রত :
সুষনি কলমি ল ল করে
রাজার বেটা পক্ষী মারে
মারল পক্ষী, শুকোয় বিল
সোনার কৌটো রূপোর খিল
খিল খুলতে লাগল ছড়
আমার বাপ-ভাই(বা স্বামী)হোক লক্ষেশ্বর।।
ব্রতের ছড়ায় যথেচ্ছ পাখি মারা, পুকুর শুকিয়ে যাওয়ার অতি জরুরি প্রসঙ্গও আছে।

আর যেমনটি আছে #পুণ্যিপুকুর ব্রত ….বাংলার হিন্দুসমাজের অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলি ব্রতগুলির অন্তর্গত একটি কুমারীব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি ঘরে পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী কুমারী মেয়েরা চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ মাসের শেষদিন (সংক্রান্তি) পর্যন্ত একমাসব্যাপী এই ব্রত পালন করে। ব্রতের উদ্দেশ্য হল বৈশাখ মাসের খরায় যাতে পুকুর জলশূন্য না হয় অথবা গ্রীষ্মঋতুতেযেন গাছ না মরে।
আর আছে ইতু পূজা । সূর্যের অপর নাম আদিত্য। এই আদিত্য থেক ইতু শব্দটি এসেছে। শাক্তধর্মের প্রভাবে ইতু ক্রমশ দেবীতে পরিণত হয়েছেন। সূর্যদেবতা থেকে ইতু শষ্যদেবী লক্ষ্মীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এইকারণে তিনি #ইতুলক্ষ্মী নামে রাঢ়বাংলায় পূজিত।

Lakshmi, 12th-13th century AD, granite, South India, Matsuoka Museum of Art ,Tokyo. 

আচার্য সুকুমার সেন একেবারে বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন – ইতু হলেন প্রাচীন ইন্দ্রপুজোর দৃষ্টান্ত। তাঁর মতে ঋকবেদীয় সূক্তগুলির নাম ছিল ইন্দ্রস্তূত। তার থেকে কালক্রমে ইন্দথথু> ইতু। ইন্দ্র বৈদিকযুগের প্রধান দেবতা। আবার বিয়ের দেবতাও ছিলেন তিনি। মেয়েদের ব্রত আচার কৃত্যে ইন্দ্র ক্রমশ স্থান লাভ করেন। ইন্দ্রের মত বরের কামনায় আজও ইন্দ্রদাদ্বশীর দিন মেয়েরা ইন্দ্রপুজো করে। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন বছর শুরু হতো। এই সময়ে রবিশস্য লাগানো হতো। কৃষির সঙ্গে প্রজনন সমার্থক। সুতরাং বোঝাই যায় ইতু আসলে সেই রবিশস্যের অঙ্কুরোদ্গমের কৃষি উৎসব।
অষ্টচাল অষ্টদূর্বা কলসপত্র ধরে ।ইতুকথা একমনে  শুন প্রাণ ভরে।।

পুজোর উপকরণ সেই শস্য। সরায় মাটি দিয়ে তাতে গোটা ধান, হলুদ, কলমী , হীনচে , কড়াই ইত্যাদি পুঁতে সারা মাস ব্যাপী জল দিয়ে পুজো করা হয়। সংক্রান্তির দিন অবধি সরা ভরে গাছ গজিয়ে ওঠে। এমন কত ব্রতর কথা বলব। সেই বারোমাস্যা লক্ষ্মী পূজা থেকে শুরু করে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা , নবান্ন , মা দুর্গার বোধন থেকে নবপত্রিকা স্থাপন, নানান ষষ্ঠী পূজা ,মনসা পূজা , মাকাল ঠাকুর পূজা ইত্যাদি সর্বত্রই প্রকৃতির উপাসনা। 

‘আখসোর হা/পোকামাকড় দূরে যা।/সগারে ধান টুনিয়া মুনিয়া/হামার ধান কাইঞ্চতা সোনা।’ 
ছড়ার সুরে এভাবেই লক্ষ্মীকে আহ্বান জানায় রাজবংশী সমাজ তাঁদের ডাক লক্ষ্মীপুজোয়। জমিদারি ব্যবস্থা যখন চালু ছিল তখন গ্রামের জোতদার বা জমিদাররা এই #ডাকলক্ষ্মী বা খেতি লক্ষ্মীর পুজো করতেন। পরবর্তী কালে প্রজারাও এতে অংশগ্রহণ করেন। মূর্তিবিহীন ডাকলক্ষ্মীর পুজো আদতে কৃষি উৎসব।

লোকমুখে প্রচলিত, মূলত বিভিন্ন শস্যবীজের মান পরীক্ষার জন্য গ্রামবাংলায় এক সময় ভাঁজো বা ভাজুই উৎসবের সূচনা হয়। গ্রামবাসীদের একাংশের বক্তব্য, বর্তমানে বীজ সংরক্ষণ, সংশোধন ও সর্বোপরি কৃষিতে এসেছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। ধারাবাহিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্র দখল করেছে উন্নত প্রজাতির উচ্চফলনশীল বীজ। সেই হিসেবে ওই উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা আজ আর নেই। তবু আজও মহাসমারোহে  ভাঁজো ব্রত বা উৎসবে মেতে ওঠেন মহিলারা। 

 তথাকথিত অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মেয়েরাই ওই ব্রত পালন করে থাকেন। শস্য কামনায় ওই ব্রত করা হয় বলে ভাজুইকে ‘শসপাতার ব্রত’ও বলা হয়। ‘শস’ অর্থে শস্য আর ‘পাতা’ অর্থে বিছানো। পাত্রে শস্য বিছিয়ে অঙ্কুরোদ্গম ঘটানোই ওই ব্রতের উদ্দেশ্য।সাধারণত ভাদ্র মাসের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে ‘#ইন্দধ্বজ’ উৎসব বা #ইন্দপুজোর পরের দিন হয় ভাজু ব্রতের সূচনা। সেই হিসেবে ইন্দপুজোর পরিবর্তনের সঙ্গে ভাজুব্রতেরও সময়কালের হেরফের হয়। সাধারণত ছোট মেয়েরাই ওই ব্রত পালন করে থাকে। তবে কোথাও কোথাও বিবাহিত মেয়েদের মধ্যেও ওই ব্রত পালনের চল রয়েছে।  সে ক্ষেত্রে তাঁদের ব্রত ‘বড়ো ভাজুই’ আর বাচ্চাদের ব্রত ‘ছোট ভাজুই’ হিসেবে পরিচিত হয়।  

Gajalakhsmi, Angkor Vat, Cambodia.

পশ্চিমবাংলায় #তুষ_তুষালী নামে একটি মেয়েলি ব্রত রয়েছে। অগ্রহায়ন মাসের সংক্রান্তির দিন থেকে আরম্ভ করে পৌষ মাসের সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত এই ব্রত উদযাপন করতে হয় । পুজার পদ্ধতি সম্পর্কে আশুতোষ মহাশয় বলেছেন “এতে গোবরী সঙ্গে  তুষ মিশিয়ে কতগুলো নাড়ু তৈরি করা হয়। তারপর তাকে দূর্বা দিয়ে পুজো করার পর তা একটি মাটির মালসায় তুলে রাখতে হয়। তারপর মকর সংক্রান্তির দিন সেই গোবরের নাড়ু সমেত মালসা গুলো মেয়েরা মাথায় করে নিয়ে গিয়ে কোন পুকুর কিংবা নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় ।কোন কোন জেলায় ছড়া বোলে নাড়ু গুলোর পুজো করা হয়।”
ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, “তুষ তুষালী ব্রত কৃষি সংক্রান্ত প্রজনন শক্তির পূজা”।
 পৌষ মাস হলো লক্ষ্মী মাস। তুষ মানে ধানের খোসা। শস্যের সাথে সম্পর্কিত । শস্য কৃষি পরিবারের ঘরে তোলার পর এই পূজা হয় । কাজেই এ লক্ষ্মী পূজা ।অনেকে মনে করে #টুসু দেবী গঙ্গা দেবীর পূজা।

Lakhsmi arising from the milk-ocean after the Samudramanthan or churning of the ocean,Mamallapuram, Tamil Nadu.

বৃক্ষরোপণ, বৃক্ষশাখায় রাখি পরানোর কর্মোৎসব, #করমপরব বা করমডোর যা ভারতের বহু জনজাতি এখনও নিঃশব্দে পালন করে চলেছেন।ভাদ্রের শুক্লা অষ্টমীতে দূর্বা ঘাসের পুজোর পর একাদশীতে অঙ্কুরিত বীজ, করমগাছ পুঁতে, শাল(সারিকরম) ও অরণ্যমায়ের বন্দনা করে মেয়েরা প্রথমে করমডালে ও পরে পরস্পরের হাতে রাখি বাঁধে।এই কর্মরাখির সখীরা বনে জঙ্গলে পরস্পরকে রক্ষা করে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ, রাখিবন্ধন, শিল্পোৎসবের মিলিত আদিরূপ। আমরা ভুলে যাই যে মা দুর্গা নবপত্রিকা শাকম্ভরী অরণ্য মা বা জাহেরা (সাঁওতাল), সারণা (ওঁরাও) বা ধরতী মায়ে (মুন্ডা)।
বিল্ববৃক্ষ মূলে ডালিম, কদলী, কচু শস্য দূর্বাঘাস-অথবা চার-পাঁচ স্তরে বনস্পতি বৃক্ষ গুল্ম বীরুৎলতা নিয়ে মাটি পাথর আঁকড়ে ধরা মা (সিংহ, হাতি, ময়ূর, হাঁস, পেঁচা, সর্প, মহিষ, নীলকণ্ঠ পাখি প্রাণিকুল নিয়ে দশ হাতে দশ দিক থেকে,  অশুভ থেকে সৃষ্টি রক্ষা করে চলেছেন)। 

Lakshmi with Narayana, 11th century, stone, National Museum, New Delhi.

করম পরবে দেশজ গুল্ম ও বৃক্ষ রোপণে এই অরণ্যউৎসবের সূচনা হত, যা এখন শুধু করম গাছের খুঁটি বা দুর্গাপূজার কলাবউ পোঁতায় সীমাবদ্ধ। 

Lakshmi ,10th century,sandstone,  Museum of Vietnamese History, Ho Chi Minh City.

বীজবপন, ধানরোপণ, বৃক্ষরোপণের কর্ম পরব বিলাপগাথা নয়। করম বিনতির প্রাচীন গান— ‘সিংচান্দ, বৃষ্টি, সবুজ ধানখেতের হাওয়ায়, অরণ্য মায়ের দয়ায় করম ধরম দু’ভাই পেল জীবন’। ‘প্রথম বৃষ্টিতে অঙ্কুরিত গাছ, গত বছরে জন্মানো গাছের পাতারা দুলছে। এসো, ওকে জাহের থানে (পবিত্র ভূমি)-তে পুঁতি’। 

 Lakshmi,brass, 17th-18th century,Odisha,LACMA,USA.

“সবুজ অরণ্যের শান্তির হাওয়া, শিশুদের দয়া কর’। ‘আম জাম কাঁঠাল গাছে পাকা পাকা ফল, খেয়ে অরণ্য মাকে পুজো করি নাচি গাই’। ‘জলে ভেসে গেছে মাঠ, ঘরে বসে ঝুড়ি বোনা এখন আমার করম’। 
‘করমগাছ, তোমার কুঠারে ডালপালা কাটব, শীতের জ্বালানি ঘরে তুলব। ডগা কাটলে গাছ ঝোপড়া, পাশে কাটলে লম্বা’। ‘শহরে লোকে আমায় দেখে, অরণ্যে যখন ফিরি, জাহেরা (অরণ্যমা) আমায় দেখে’। ‘জীবন কম হলে, জাহেরা দেয় জীবন আর শান্তি’। 

অথর্ববেদের পৃথিবীত সূক্তে(১২/১/৬) বলা হয়েছে 
“বিশ্বমভরা বসুধানী প্রতিষ্ঠা হিরন্যবক্ষা জগতো নিবেসিনী।

বৈশ্বনরং বিভ্রতি ভূমিরগ্নিমিন্দ্র ঋষভা দ্রবিনেনোদধাতু।”

শ্রাবণে আমন ধান রোপণ এবং পাট জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো বঙ্গের গ্রামের অতি পরিচিত দৃশ্য। 

খনার বচনে রয়েছে, 
‘শ্রাবণের পুরো, ভাদ্রের বারো/ধান্য রোপণ যতো পারো’, 
‘আষাঢ় কাড়ান নামকে/ শ্রাবণে কাড়ান ধানকে’
‘পান পুঁড়লে শ্রাবণে/ খেয়ে না ফুরায় বারণে’
 ‘বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ হলুদ রুইবে/ অন্য কাজ ফেলিয়া থুইবে? আষাঢ়-শ্রাবণে নিড়াই মাটি/ ভাদরে নিজাইয়া করবে খাঁটি’।

Gaja Lakshmi, Goddess of Fortune8th century
India (Jammu and Kashmir, ancient kingdom of Kashmir)

“ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, বিফল জনম তার নাহি যার চাষ”- মধ্যযুগীয় বাঙ্গালা সাহিত্যের গৌরব কবি কংকন মুকুন্দরাম প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে বিখ্যাত ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে এভাবেই অগ্রহায়ণ বন্দনায় চাষের কথা বলতে মত্ত হন। সে যুগের কৃষিজীবীর গোলাঘর এই মাসে ধানে ধানে পূর্ণ হয়ে উঠতো। অর্ধ-সহস্রাব্দ পরের বঙ্গের চিত্রও সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা মাত্র যেন। সুজলা-সুফলা বঙ্গ তথা ভারতের প্রধান কৃষি ফসল ধান আর তা থেকে প্রক্রিয়াজাতকৃত ভাত প্রধান খাদ্য।
বাঙ্গালী সমাজের বিশ্বাস অণুযায়ী, অগ্রহায়ণ মাস বিবাহের পক্ষে বিশেষ শুভ মাস। 

Gaja Lakshmi, Goddess of Fortune8th century
India (Jammu and Kashmir, ancient kingdom of Kashmir)


পশ্চিমবঙ্গের লোকসমাজে অগ্রহায়ণ মাসকে ‘লক্ষ্মীর মাস’ মনে করা হয়। এই কারণে এই মাসেই নবান্ন উৎসব ও লক্ষ্মীপূজার বিশেষ আয়োজন করা হয়। আদিকাল থেকেই   #নবান্ন উৎসব উদযাপন করতো গ্রাম বাংলা। ধান কাটা সারা হলে গ্রামবাংলায় পড়বে নিমন্ত্রণ এর ধুম। কৃষানী বধূ ও কন্যারা খেজুর রসে নতুন  পায়েশ, নকশী পিঠা ইত্যাদি তৈরি করবে। এসব বিলোবে পরিবার-পরিজন ও প্রতিবেশীদের। এটিই #মার্গশীর্ষ অগ্রহায়ণের চিরায়ত ঐতিহ্য।ঠিক তেমনি রাঢ় অঞ্চলের বেশ কিছু  গ্রামে পূজা হয় ধানশুয়রী দেবীর। অবাক লাগছে? ইনি বাস্তু দেবি। যেমন, ক্ষেত্রপাল , আখিন দুয়ারি , বন বুড়ি তেমনি ধান শুয়ারী। অগ্রহায়ণের সময় ধান কাটার আগের এইসব ক্ষেতে র  বাস্তু দেবদেবীর পূজা প্রদান করা হয়।

Shri Lakshmi lustrated by elephants, Uttar Pradesh, Kausambi, 1st century B.C.


উপৈতু মাং দেবসখঃ কীর্তিশ্চ মণিনা সহ ।

প্রাদুর্ভূতোঽস্মি রাষ্ট্রেঽস্মিন্ কীর্তিমৃদ্ধিং দদাতু মে ॥ 

ক্ষুত্পিপাসামলাং জ্যেষ্ঠামলক্ষ্মীং নাশয়াম্যহম্ ।

অভূতিমসমৃদ্ধিং চ সর্বাং নির্ণুদ মে গৃহাত্ ॥

 গংধদ্বারাং দুরাধর্ষাং নিত্যপুষ্টাং করীষিণীম্ ।

ঈশ্বরী⁠ সর্বভূতানাং তামিহোপহ্বয়ে শ্রিয়ম্ ॥ 

মনসঃ কামমাকূতিং বাচঃ সত্যমশীমহি ।

পশূনাং রূপমন্নস্য ময়ি শ্রীঃ শ্রয়তাং য়শঃ ॥ 

কর্দমেন প্রজাভূতা ময়ি সম্ভব কর্দম ।

শ্রিয়ং বাসয় মে কুলে মাতরং পদ্মমালিনীম্ ॥


ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ .শ্ৰী শ্ৰী চণ্ডী

২. মেয়েদের ব্রত কথা

৩. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
8.বাংলার মুখ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.