“আপ্রা দ্যাবা পৃথিবী চান্তরীক্ষয়ং সূর্য আত্মা জগৎস্তস্থূষশচ”….

 সূর্য ….এক দীপ্তিমান দেবতা… যার উত্তাপে প্রাণ উজ্জীবিত হয় । ইন্দ্রিয়ের কোষে কোষে চৈতন্যের প্রেরণা জেগে ওঠে । ঋগবেদে বলা হয়েছে সূর্য অনন্ত শক্তির আধার , জঙ্গম ও স্থাবর সকলের আত্মার স্বরূপ । সূর্যের প্রখর তাপ রোগ জীবাণু নষ্ট করে এবং বায়ুমন্ডলকে শুদ্ধ করে । সূর্য একদিকে যেমন ভয়ঙ্কর অপরদিকে করুণাময়। সৃষ্টিলগ্ন থেকে বিশ্বের  মূল উৎস ও আধার হলো সূর্য।  সূর্য তোমনাশক ও পাপনাশক…

প্রাচীন পৃথিবী,  তার মূল ধর্ম সনাতন…সনাতন অর্থাৎ যা প্রাচীন ও যা প্রকৃত… ভারত থেকে ব্যাবিলন, মিশর ,সুমেরীয় , চৈনিক সভ্যতা প্রত্যেকেই উপাসনা করে এসেছেন সূর্যের । বৈদিক যুগের এবং পরবর্তী ভারতবর্ষের ধর্মীয় জীবনের এই সূর্যের গুরুত্ব ছিল অন্যতম। পাথরের উপর রক্ত মন্ডলাকার সূর্য অংকন করে সূর্য উপাসনা প্রচলিত ছিল।

শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে ” আদিত্য বা এতদ  আসিৎ “…

ঋকবেদে মন্ত্র গুলিতে সূর্য সম্পর্কে শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে , তার নানা গুণাবলী এবং কার্যাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। সনাতনের অন্যতম মূল পূজা কার্যের মধ্যে সূর্য প্রনাম এক ও অদ্বিতীয়ম রীতি। যদিও আমরা আধুনিক মানুষরা আজ হাতে গোনা কয়েকজন সেই রীতি পালন করেন..তন্ত্র উপাসনা ও শাস্ত্রেও সূর্য উপাসনার কথা বলা আছে।

সূর্য উপাসকদের সৌরগণ সম্প্রদায় বলা হয়।

তৎকালিন সৌরগণ  সম্প্রদায়ের  ছয় টি করে উপবিভাগ ছিল।  

প্রথম উপবিভাগের সৌরগণ প্ৰাতঃ-সুৰ্য্যকে ব্ৰহ্মা বা সৃষ্টি-কৰ্ত্তা হিসাবে উপাসনা করতেন ; 

দ্বিতীয় সম্প্রদায়ের সৌরগণ মধ্যাহ-সুৰ্য্যকে ঈশ্বর অর্থাৎ ধ্বংস-কৰ্ত্তা ও পুনঃ-সৃষ্টি-কৰ্ত্তা হিসাবে তার উপাসনায় ব্ৰতী হতেন ; এবং তৃতীয় সম্প্রদায় অন্ত-গমনোন্মুখ সুৰ্য্যকে রক্ষা-কৰ্ত্তা বলে মনে করতেন।

 চতুর্থ সম্প্রদায় প্ৰাতঃ-সুৰ্য্য, মধ্যাহ-সুৰ্য এবং সায়ং-সুৰ্য্য-সুৰ্য্যের ত্ৰিবিধ অবস্থাকে, সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-কৰ্ত্তা ত্ৰিমূৰ্ত্তি জ্ঞানে, তিন অবস্থারই আরাধনায় রত হতেন। 

পঞ্চম সম্প্রদায়ের সৌরগণ কেশ-শ্মশ্ৰ-সমন্বিত সুৰ্য্যের মূৰ্ত্তি গঠন করে তার পূজা করতেন। 

ষষ্ঠ সম্প্রদায় মানস চক্ষে সূর্য মূর্তি কল্পনা করে মনে মনে দেবতার উপাসনায় প্রবৃত্ত হতেন। এই শেষোক্ত শ্রেণীর সৌরগণের ললাটে, বাহুদ্বয়ে এবং বক্ষঃস্থলে উত্তপ্ত লৌহ-শলাকা দ্বারা বৃত্তাকার চিহ্ন অঙ্কিত থাকিত। ষড়বিধ সৌর-সম্প্রদায়ের মধ্যে এখন প্ৰায় কোনও সম্প্রদায়ই দৃষ্ট হয় না। তবে এখন যারা সৌরপৎ বলে অভিহিত হন তারা কপালে রক্তচন্দন ও গলদেশে স্ফটিক-মাল্য ধারণ করেন। 

সৌরগণের আর এক বিশেষত্ব-তারা রবিবারে আহাৰ্য্য দ্রব্যের সহিত লবণ ভক্ষণ করেন না ; সংক্রান্তাদির দিন তাহারা উপবাসী থাকেন। এবং পর দিন সুৰ্য্য-দর্শন না হলে কোনরূপ ভক্ষ-দ্রব্য গ্ৰহণ করেন না ।

মার্কণ্ডেয় পুরাণ  এবং “মালতীমাধব “কাব্যের₹ সূর্যের স্থান সবকিছুর উপরে চিহ্নিত করা হয়েছে । “শঙ্কর বিজয় ” কাব্যে সূর্যকে উচ্চ আসন প্রদান করা হয়েছে ।হর্ষবর্ধনের সভাসদ ময়ূরের রচিত “সূর্য শতক” কাব্য বিশেষভাবে বিখ্যাত। ময়ূরের কুষ্ঠ রোগ হয়েছিল …কুষ্ঠ রোগ থেকে নিরাময় লাভ করার পর  ময়ূর সূর্য বন্দনা করে ” সূর্য শতক ” কাব্য রচনা করেছিলেন ….

হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক অনেক রাজন্যবর্গকে পরম আদিত্যভক্ত হিসাবে এক হতে দেখা গিয়েছে। শক কুষান যুগে মথুরা  ও তার নিকটবর্তী অঞ্চল সূর্য উপাসনার একটি প্রধান কেন্দ্র উল্লেখ্য ছিল। 

 প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এই অঞ্চল থেকে প্রচুর সূর্য মূর্তি পাওয়া গিয়েছে । বিভিন্ন প্রস্তর লিপি থেকে গুপ্ত পূর্ব  এবং গুপ্ত উত্তর যুগে  সূর্য মন্দির স্থাপন এবং সূর্য উপাসনার কথা জানা গেছে। পঞ্চম শতকে  প্রথম কুমার গুপ্তের মান্দাসর শিলালিপি থেকে এক সুবিশাল ও মনোহর সূর্য মন্দিরের কথা জানা যায় ।বার্জেস তাঁর রচনায় , মূলতান থেকে কচ্ছ পর্যন্ত প্রচুর সূর্য মন্দির দেখতে পাওয়া গিয়েছে উল্লেখ করেছেন। ডঃ এইচ.ডি. সংকলিয়া বলেছেন বিভিন্ন উৎকীর্ণ লিপি উল্লেখ করে বলেছেন যে সমগ্র গুজরাট জুড়ে সূর্য পূজা ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল।

 কাশ্মীরের মার্তণ্ড মন্দির অষ্টম শতকে নির্মিত হয় । দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোরের সূর্য মন্দিরের কথাও জানা গেছে ।

সাম্ব পুরাণে বলা হয়েছে বলা হয়েছে “শব্দমাত্র শ্রুতিমুখা ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবদয়ঃ/  প্রত্যক্ষেয়ং পর দেব সূর্য- স্তিমির- নাশক”

সূর্য দেবতা…. তার রক্ষী কারা? কেই বা তার উপাসক? কি বা তার প্রতীক? সাম্ব পুরানে  বলা হয়েছে ” রক্ষন্তয়দ্যত শাস্ত্রস্ত্র যক্ষ, রাক্ষস , পন্নগঃ ” অর্থাৎ যক্ষ, রাক্ষস, নাগ কুল অস্ত্র হাতে সূর্য কে রক্ষা করে।

এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিক্স এর থেকে সূর্যের সঙ্গে নিম গাছের একটি নিকট সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে । প্রাচীনকালে ভারতবর্ষের সৌর সম্প্রদায় যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবশালী ছিল । শাক্তদের নিকট যে রকম ৫১ পীঠ,শৈব দের কাছে দ্বাদশ মহাতীর্থ,  সেরকম সৌরসম্প্রদায়ের কাছে ভারতবর্ষের প্রান্তের সাতটি ক্ষেত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। মারতন্ড, মাধেরা, গোয়ালিয়র সূর্য মন্দির, কোনারক, সূর্য পাহাড় আসাম ইত্যাদি…

 সৌর সম্প্রদায়ের কাছে নিম বৃক্ষ একটি পবিত্র বৃক্ষ হিসেবে নির্দেশিত হয় । এদেরই একটি  নিম্বার্ক পন্থী হিসাবে পরিচিত । লক্ষণীয় যে কুষ্ঠ রোগ নিরাময়ের সঙ্গে সূর্যের একটি সম্পর্ক রয়েছে তেমনি রয়েছে নিম গাছের সঙ্গে। এই রোগে নিমপাতা একটি অন্যতম ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত করা হয় ।।

কুষ্ঠ ভয়াবহ রোগ ছিল প্রাচীন কালে। প্রাচীন পৃথিবীর বিভিন্ন  গ্রন্থগুলিতে এই রোগ সম্পর্কে ঘৃণার সঞ্চার করা হয়েছে । মানুষ একে চিকিৎসার অসাধ্য বলে বিবেচনা করতো। মিশরীয় , গ্রিকরা মনে করত এই রোগ শারীরিক মৃত্যুর আগে আরো ভয়ঙ্কর এক মৃত্যু। মধ্যপ্রাচ্যে প্রাচীন এবং মধ্যযুগ এই রোগীদের পাথর ছুড়ে হত্যা করা হতো। অনেকেই মনে করত পূর্ব জন্মের কৃত পাপের ফলে এই ধরনের রোগ হয় ।অনেকে মনে করত বিশ্বাসঘাতকতা করলে এই রোগ হয় । অনেকে আবার মনে করত যে নিষ্পাপ লোকদের হত্যা করলে বা অভিশাপের ফলে এই রোগ হয়। আবার অনেকে মনে পড়তো এই রোগ ক্রুদ্ধ সূর্য দেবতার অভিশাপ এর ফল।

একমাত্র অর্থব বেদে এই রোগের নিরাময়ের বিধান আছে। তার মধ্যে একটি হলো নিম গাছের তলায় অনাবৃত অবস্থায় ১২ বছর অতিবাহিত করা। এছাড়াও অথর্ব বেদে কিন্তু এই রোগের ঔষধ হিসাবে ক্যাকটাস গাছের কথা বলা হয়েছে ।

ধন্বন্তরী নিঘুন্টতে বলা হয়েছে 

মহা নিম্ব রসে তিক্ত শীত পিত্তকফাপহর।

কুষ্ঠ রক্ত বিনাশীচ বিসুচিং হনতি শীতলঃ।।

ডক্টর সি .আর মিত্র তাঁর নিম গ্রন্থে বলেছেন , “কুষ্ঠ রোগের ক্ষেত্রে চালমুগড়ার আনুষঙ্গিক হচ্ছে নিম।” এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ” আমাদের মধ্যে অদ্ভুত বিশ্বাস প্রচলিত আছে তা হল  যে সব প্রেত মৃত দেহ সংগ দেয় , তারা নিম পাতার সংস্পর্শে অস্বস্থি বোধ করে ।মৃতদেহের কাছ থেকে প্রেতদের তাড়াতে নিমপাতা নাকি সাহায্য করে। আদিম  একটি বিশ্বাস,  তবুও যেমন শব দাহ করে গৃহে ফিরে এসে আগুনের তাপ নিয়ে নিমপাতা দাঁতে কাটতে হয়।”

 ভারতে কুষ্ঠ রোগের কথা জানা যায় মহাভারতেরও পূর্ব সময় থেকে , সেই বৈদিক যুগ থেকে । যদিও খ্রিস্টপূর্ব চৌদ্দশ সাল বা তার নিকটবর্তী সময় থেকে রোগটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল । এই রোগটিকে চোখে দেখাও তো খুব ভয়ঙ্কর, স্বাভাবিক কারণ একটি সুস্থ সবল মানুষ বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে থাকে, মানুষ রূপান্তরিত হয় একটি বীভৎস চেহারায় ….

বর্তমানে সুচিকিৎসা রোগটিকে সম্পূর্ন নিরাময় করে। এমনকি এটি ছোঁয়াছেও নয়। আদিম সমাজে এই রোগের ব্যাপকতা  প্রাচীনকালে ভীষণভাবে ছিলো। সূর্যের উত্তাপ যে রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে এ বিশ্বাস প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে । এ কাল ব্যাধি থেকে মুক্তি পাবার জন্য সূর্যের উদয় স্থান ,মধ্যস্থান, অস্তাচলস্থানে তার কিরণ শরীরে নেওয়া বিধিসম্মত। এই বিশ্বাস এর জন্যই প্রাচীন কাল ঠেকর  আমাদের কাছে সূর্য হয়ে উঠেছেন উপাস্য দেবতা। শুভ দিনের শুরুর জন্য আজও আমরা সূর্যের অনেকেই সূর্যের উপাসনা করি ।বিভিন্ন আদিম উপজাতি রা নানা নামে তারা সূর্যের উপাসনা করে থাকে ।ভেরিয়ার এলুইন এর ট্রাইভেল মিথস অফ উড়িষ্যা গ্রন্থের প্রচুর আদিবাসী লোককথা সংগৃহীত রয়েছে। অধিকাংশ কাহিনীতে কিন্তু এই রোগের উল্লেখ রয়েছে। তাই যিনি এই রোগটি নির্মূল করতেন তিনি অবশ্যই মানুষের কাছে শ্রেষ্ঠ দেবতা হিসেবে পূজ্য….

©দুর্গেশনন্দিনী

(নীচের ছবিটি ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের অনন্তপুর জেলার কালাগাদুতে কৃষিক্ষেত্রে খনন কালে প্রাপ্ত সূর্যদেবতার মূর্তি। এইটি আনুমানিক দশম শতাব্দীর প্রতিমা।)

তথ্যঃ  কোনারক সূর্য মন্দিরের ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.