৯ নম্বরের সেই আড্ডা টা আজ আর নেই

রাজনীতি তখন ছোট হতে হতে তাঁর সারাদিনের কেবল কয়েক ঘন্টায় বন্দি। হেসে বলতেন, “শোনো, বউ ছেলেমেয়েকে আকছার মজা করে বলি, “পলিটিক্স আমার কাছে প্রফিট নয়, অলওয়েজ অ্যান অফিস অফ লস!”

২০০৫ সালের কথা। বাজপেয়ী সরকারের পতন হয়েছে ততদিনে এক বছর কেটে গিয়েছে। সরকার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইন মন্ত্রকের দায়িত্বও চলে গিয়েছে। তার পর মাস দেড়েক এদিক ওদিক করে সময় কেটেছে কী কাটেনি, আইনজীবীর গাউনটা পরে নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর চেনা উঠোনে। ওটাই তাঁর প্রথম ভালবাসা। আইনি পেশা ও সুপ্রিম কোর্ট। প্রাক্তন আইনমন্ত্রী অরুণ জেটলি তখন ফের দুঁদে আইনজীবী। ঈর্ষা করার মতোই তাঁর পসার। পরে একবার আড্ডার ফাঁকে বলেছিলেন, আইনের পেশা থেকে তাঁর রোজগার কত? সে বছর ব্যক্তিগত আয়করই বা দিয়েছেন কত? (অঙ্কটা ইচ্ছাকৃত ভাবে উল্লেখ করলাম না।)

সাংবাদিকতা পেশার সূত্রে আমার দিল্লি পোস্টিং হয়েছিল ২০০৩ সালের একেবারে গোড়ায়। বাজপেয়ী সরকার, তাদের ‘ফিল গুড’ তখন মধ্য গগনে। মন্ত্রী অরুণ জেটলি-র সঙ্গে সে সময় ব্যক্তিগত পরিচয় বিশেষ ছিল না। আমার তৎকালীন সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্ত সম্পর্কে খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি। জরুরি অবস্থার সময়ে দু’জনেই জেল খেটেছেন। বরুণবাবুর প্রসঙ্গ টেনে এনে মন্ত্রী অরুণ জেটলি-র সঙ্গে খবরের ব্যাপারে কয়েক বার কথা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক তখনও তৈরি হয়নি। তা হয়েছিল, সরকার চলে যাওয়ার পর। এবং খুবই ঘরোয়া ভাবে। ৯ নম্বরের আড্ডায়।

৯ নম্বর মানে, নয়াদিল্লির অশোক রোডের ৯ নম্বর বাংলো। পাশেই ১১ নম্বর অশোক রোডের বাংলোটি ছিল বিজেপি-র সদর দফতর। মন্ত্রিত্ব চলে গেলেও রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন অরুণ জেটলি। সেই সুবাদেই ৯ নম্বর অশোক রোডের বাংলোটি সরকারি ঠিকানা ছিল তাঁর। আদতে অবশ্য থাকতেন কৈলাস কলোনিতে তাঁর নিজের বাড়িতেই। কিন্তু রোজ, নিয়ম করে বিকেল চারটে বাজলেই সুপ্রিম কোর্ট থেকে সোজা চলে আসতেন ৯ নম্বরে। তার পর কোর্টের পোশাক ছেড়ে, কুর্তা পাজামা পরে বসে পড়তেন সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডায়।

আড্ডা মানে নিখাদ আড্ডাই। কোনও দিন সেই আড্ডার বিষয় থাকত কর্পোরেট জগত। কোনও দিন ক্রিকেট। কোনও দিন তাঁর বিদেশ সফরের গল্প,- আলাস্কা ক্রুজ, লন্ডনে শপিং, হোয়াইট শার্ট, ইতালি-র জুতো, সুইস ঘড়ি, পেন। কোনওদিন খাওয়াদাওয়া,- কনাট প্লেসের গেলর্ড রেস্তোরাঁর শাগ-মিট, চাঁদনি চকের পাপড়ি চাট, জিলিপি..। তো কোনও দিন স্রেফ গসিপ। আর শেষ পাতে অবশ্যই রাজনীতির কথা।

আসলে ওই শেষ পাতের জন্যই ওঁত পেতে থাকতেন বিজেপি বিটের সব সাংবাদিক। জেটলিজি আজ কি স্পিন দেবেন? কারণ, ওই স্পিন থেকেই খবর,- সরকারের বিরুদ্ধে দলের কৌশল থেকে বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ রাজনীতি মায় সবকিছুই থাকত তাতে।

রাজনীতিতে তাঁর এই স্পিনের জন্য কম বিখ্যাত ছিলেন না জেটলিজি। মনে পড়ে, সংসদের অলিন্দে একবার জেটলিজিকে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছিলেন, “রাজনীতিতে আমরা বিরোধী হতে পারি। কিন্তু আমি আপনার ফ্যান। আপনি অসাধারণ স্পিনার,- বেদি, প্রসন্ন, চন্দ্র, ভেঙ্কটও হার মানবে”।

শুধু স্পিন নয়, দিল্লির রাজনীতিতে জেটলি পরিচিত ছিলেন তাঁর বিখ্যাত সব ‘ওয়ান লাইনারের’ জন্যও। আগে ৯ নম্বরের আড্ডার পাতে সে গুলো ফেলে দেখতেন, কেমন রেসপন্স। তার পর রাজনীতির ময়দানে ছেড়ে দিতেন সে সব কথা। মনে পড়ে ২০০৮ এর কর্ণাটক নির্বাচনের আগে তখন বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম ওপিনিয়ন পোল দেখাতে শুরু করেছে। জেটলিজি তখন কর্ণাটকের অবজার্ভার। সেই ভোটের স্ট্র্যাটেজিস্ট তিনিই। অধিকাংশ ওপিনিয়ন পোল তখন জানান দিচ্ছে, বিজেপি ডাহা হারছে। কিন্তু জেটলিজি বলতেন, এগুলো হল ‘পার্টিসিপেটরি সেফোলজি’ (participatory psephology। মানুষের মত নয়। শেষ মেশ বিজেপি জিতে যেতে ‘পার্টিসিপেটরি সেফোলজি’-র কয়েনেজ নিয়ে তাঁর সে কী উচ্ছ্বাস!

৯ নম্বরের আড্ডায় তাঁর কাছ থেকেই শোনা নয়াদিল্লির সেন্ট জেভিয়ার স্কুলে পড়াশুনা করেছেন জেটলিজি। দ্বাদশ শ্রেণিতে যখন পড়েন, তখন মার্কসবাদ সম্পর্কে খুব আগ্রহ জন্মেছিল। বলতেন, “আসলে ওই বয়সে বামপন্থার রোমান্টিসিজম সহজেই উন্মাদনা তৈরি করে”। পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তে গিয়ে বিদ্যার্থী পরিষদের সদস্য হন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার পর জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এবং অচিরেই সেই আন্দোলনের ছাত্র ও যুব সংগঠনের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর হয়ে উঠেছিলেন।

জেটলিজির কাছেই শোনা,- জরুরি অবস্থার সময় শেষমেশ গ্রেফতার হলেও, প্রথমবার পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তখন দিল্লির নারাইনা এলাকায় থাকতেন। বাড়িতে পুলিশ হানা দিতেই তাঁর বাবা আইনি বিষয় নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তর্ক চালিয়ে যান। সেই ফাঁকে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পাঁচিল টপকে পালিয়েছিলেন জেটলি।

জেল থেকে বেরোনোর পর ৭৭ সাল থেকে দীর্ঘ সময় সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবশ্য কিছুটা দূরে ছিলেন অরুণ জেটলি। বরং স্ত্রী, সংসার, পেশায় বেশি মন দেন। পরে বলতেন, “আসলে আইনজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়াই আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল। কখনওই ফুল টাইম রাজনীতি করার ইচ্ছা ছিল না”।

তবে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ফের ক্রমশ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন জেটলি। বফর্স কেলেঙ্কারির সময় বিজেপি আইডিওলগ গুরুমূর্তির সঙ্গে মিলে রোজ রাজীব গান্ধীর উদ্দেশে দশটি করে প্রশ্ন ছুঁড়তেন। একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে তা নিয়মিত ছাপাও হত। পরে জনতা দলের সঙ্গে বিজেপি-র আসন সমঝোতার অন্যতম কারিগর হয়ে ওঠেন তিনি। তখন বয়সই বা কত তাঁর! মাত্র ৩৭ বছর। ওই বয়সেই ৮৯ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ সরকারের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল হয়েছিলেন জেটলি।

মাঠে নেমে রাজনীতি করা কখনওই ধাতে ছিল না তাঁর। বরং নিজেকেও স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসাবে দেখতেই বেশি পছন্দ করতেন জেটলি। ২০০৩ সালে মধ্যপ্রদেশ নির্বাচন, ২০০২-২০০৭-২০১২ সালে গুজরাত নির্বাচন, ২০০৫ সালে বিহার নির্বাচন, ২০০৮ সালে কর্ণাটকে বিধানসভা ভোট,- সবেতেই তিনি ছিলেন সফল কৌশলী। অনেকে বলতেন, জেটলি নিজে কোনওদিন ভোটে না জিতলেও নির্বাচনে কখনও হারেন না! বিজেপি-তেও কারও কারও ঈর্ষা ছিল সে কারণে।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এ হেন অরুণ জেটলি-র ক্রমশ গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে ২০০৯ সালের পর থেকে। দার্জিলিং থেকে যশবন্ত সিংহ লোকসভায় নির্বাচিত হওয়ার পর বিজেপি নেতৃত্ব তাঁকে বেছে নেয় রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা পদে। সুপ্রিম কোর্ট ও আইনি পেশা থেকে অব্যহতি নিয়ে সেই থেকে ফের ফুলটাইম রাজনীতিক হয়ে উঠেছিলেন জেটলি। সংসদে ও সংসদের বাইরে রাজনৈতিক তর্কে খুবই তীক্ষ্ণ ও ধারালো হলেও, বিজেপি-র দলগত রাজনীতির উর্ধ্বে তাঁর বন্ধু আরও বেড়ে গিয়েছিল তার পর থেকেই। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছিল সে কারণেই। এমনকী কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারে একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব থাকলেও বহু সময়েই দেখা যেত, সংসদের সেন্ট্রাল হলে বিরোধী দলের রাজনীতিকদের সঙ্গে বসে খোশগল্প করছেন তিনি। অথবা বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার এনে সংসদে তাঁর কক্ষে রাজনীতির বন্ধুদের লাঞ্চ খাওয়াচ্ছেন।

নয়াদিল্লির অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেন, আজীবন বিজেপি-র রাজনীতি করলেও টিপিক্যাল হিন্দু নেতা বলে কখনওই পরিচয় ছিল না জেটলিজির। উনি নিজেও বলতেন, ১৫২৮ সালের আগে অযোধ্যায় বিতর্কিত স্থানে যে রাম মন্দির ছিল তা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। তবে রাজনীতিতে হিংসা, ভাঙচুর, মানুষের মৃত্যু আমার পথ নয়।

নয়াদিল্লি-র ক্ষমতার রাজনীতিও জেটলি-কে কখনওই আডবাণী-মোদী-র উগ্র হিন্দু মেজাজের সঙ্গে এক বন্ধনীতে ফেলে দেখেনি। বরং তাঁর সঙ্গে মজা করে অনেকে বলতেন, “ইউ আর এ রাইট ম্যান ইন রং পার্টি”। আবার কেউ কেউ বলতেন, কংগ্রেসের সমস্যা হল তাঁদের এক জন অরুণ জেটলি নেই!

৯ নম্বরের আড্ডা পাঁচ বছর আগেই উঠে গিয়েছিল। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার গঠনের পর তাঁর সরকারি বাসভবনের ঠিকানা ছিল ২ নম্বর কৃষ্ণমেনন মার্গ। আসলে ৯ নম্বর প্রতীকী মাত্র। জেটলিজি যেন বোঝাতেন, মেজাজটাই আসল রাজা! আর মজা করে যে কথাটি বলতেন, পরে তার মর্মও বুঝেছিলাম। পলিটিক্স অলওয়েজ অ্যান অফিস অফ লস,- বলার মধ্যে হয়তো ওনার একটা গর্ব ছিল, ছিল আত্মবিশ্বাসও। হয়তো বোঝাতে চাইতেন, রাজনীতি হল তাঁর মতাদর্শগত লড়াইয়ের জায়গা, রুটি-রুজির অন্য ব্যবস্থা রয়েছে। বাস্তবে অরুণ জেটলি-র ধমনীতেই ছিল রাজনীতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.