কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ

১৮৬১ সালের ২ আগস্ট অবিভক্ত বঙ্গের যশোহর জেলার রাড়ুলি গ্রামে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্ম । ভারতে আধুনিক রসায়নচর্চার জনক । আধুনিক বাঙালির সারস্বত জীবনে বিজ্ঞান শিক্ষার ভগীরথ । স্বজাতি বাঙালি কবে , কীভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে – এই ছিল আচার্যের ধ্যানজ্ঞান । জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি –
আলস্য আর আক্ষেপে দিনযাপন আম বাঙালির একটি সাধারণ ব্যধি । আর‌ও দুটি রোগের একটি যদি হয় পরচর্চা পরেরটি তবে হুজুগ । তবে বাঙালি যখন ভাগ্যের বিপরীতে‌ নিজ পরাক্রমে আস্থা রেখে উদ্যমী হয়ে শুভ অভিযানে নামে তখন তাকে আপন লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা সহজ নয় । উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা এমন অনেক কর্মযোগী মনীষীর জন্ম দিয়েছিল বলেই বাঙালির ভাগ্যের চাকা ঘুরেছিল । সাহিত্যে যাঁকে দেখে আমাদের বিস্ময়ের ঘোর আজ‌ও কাটে না তিনি রবীন্দ্রনাথ । বিজ্ঞানে সেই স্থান নিয়েছেন একজন‌ই । তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় । তিনি ভগীরথ । বাঙালির সারস্বত জীবনে আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার যে ধারাটি বহমান তাকে বয়ে এনেছেন যেই পুরুষ তাঁর নাম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় । ১৮৬১ – এক‌ই বছরে আবির্ভাব রবীন্দ্রনাথ ও প্রফুল্লচন্দ্রের । চির রুগ্ন । আজন্ম ভগ্নস্বাস্থ্য । কিন্তু বাল্যকাল থেকেই প্রখর মেধা আর তীব্র অনুসন্ধিৎসা । কর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগ আর পরিশ্রমী সঙ্গে গভীর অন্তর্দৃষ্টি । অভীষ্ট লাভে অবিচল । সংক্ষেপে এই হল প্রফুল্লচন্দ্র রায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বাঙালির কবিগুরু , গুরুদেব । প্রফুল্লচন্দ্র রায় তেমনি আমাদের আচার্যদেব । বাঙালির আচার্য । আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ।

বিজ্ঞানের জগতে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পরিচয় একজন রসায়নবিদ হিসেবে । তাঁকে ভারতে আধুনিক রসায়নচর্চার জনক বললে অত্যুক্তি হবে না । ইংরেজি আত্মজীবনীতে তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘ বেঙ্গলি কেমিস্ট ‘ বলে । মারকিউরাস নাইট্রাইট বা পারদ সংক্রান্ত এগারোটি মিশ্রধাতুর আবিষ্কার করে রসায়নবিদ্যার আন্তর্জাতিক দরবারে রীতিমতো বিস্ময় জাগিয়ে ছিলেন পিসি রায় । রসায়ন শাস্ত্রের প্রতি প্রফুল্লচন্দ্রের আগ্রহ শৈশব থেকেই । তাঁর আত্মচরিত শুরু হয়েছে এইভাবে – ‘ ১৮৬১ সালের ২রা অগস্ট আমি জন্মগ্রহণ করি । এই বৎসরটি রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় , কেননা ঐ বৎসরেই ক্রুকস ‘ থ্যালিয়াম ‘ আবিষ্কার করেন । ‘ কিন্তু পিসি রায় তো শুধু বাঙালিকে রসায়নশাস্ত্র‌ই শেখান নি । কী করে ব্যবসাবাণিজ্য দ্বারা দুটো পয়সা কামাতে হয় বাঙালিকে হাতে ধরে শেখাতে চেয়েছেন । দুর্যোগের দিনে কীভাবে সংঘবদ্ধভাবে আর্তের পাশে দাঁড়াতে হয় সেটাও শিখিয়েছেন স্বজাতিকে । ছাত্রদের মনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে গেছেন আমৃত্যু । কপিবুক পড়ালেখা নয় কীভাবে মৌলিক গবেষণায় নিজেকে সমর্পণ করতে হয় ছাত্রদের শিখিয়ে গেছেন আচার্য । প্রেসিডেন্সি কলেজ ও রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের ল্যাবরেটরি প্রফুল্লচন্দ্রের কাছে ছিল উপাসনা গৃহের মতো । তিনি ছিলেন সেই উপাসনা গৃহের ঋষি । সত্যেন্দ্রনাথ বসু , মেঘনাদ সাহা , জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ – বাঙালি এই বিজ্ঞান রত্নদের গুরু একজন‌ই । তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ।

আচার্যের জীবনযাপন ছিল ঋষির মতোই ।
শিষ্য বিজ্ঞানী জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ গুরু সম্পর্কে লিখেছেন – ‘ স্বার্থ বলিতে তাঁহার অবচেতন মনেও কিছু ছিল না । দেশের দরিদ্রনারায়ণের পরিত্রাণের জন্য তিনি আপনাকে বিলাইয়া দিয়াছিলেন । বৈরাগীর উত্তরীয় পতাকা করিয়া ল‌ইয়া এই সর্বত্যাগী বৃদ্ধ , কর্মবীর মহাপুরুষ জীবনসন্ধ্যায় কালের ভ্রূকুটিকে অগ্রাহ্য করিয়া গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে ঘুরিয়া দেশবাসীকে আহ্বান করিয়াছেন দেশসেবায় জনহিতকর কার্যে নিজেদের উৎসর্গীকৃত করিতে । ‘ বিজ্ঞানতাপসেরা সাধারণত ল্যাবরেটরির চার দেওয়াল আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন না । কিন্তু আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বহুমুখী কাজের ব্যাপ্তি ছিল বিস্তৃত । তিনি আত্মভোলা ছিলেন কিন্তু পরের দুঃখ আচার্যকে কাতর করে তুলত । কীসে স্বজাতির ভাল হবে এই চিন্তায় শরীরপাতে‌ও দ্বিধা ছিল না তাঁর। কোটি কোটি মনুষ্য প্রাণের মধ্যে স্থূল শরীরে কদাচিৎ এমন প্রাণের উদ্ভাস হয় যাঁকে আমরা মহাপ্রাণ বলে ডাকতে পারি । আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন তেমন‌ই এক মহাপ্রাণ ।

অধ্যয়ণে নিমগ্ন প্রফুল্লচন্দ্র ।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নাম উচ্চারিত হলেই তিনটি প্রসঙ্গ আলোচনায় আসবেই । প্রথমটি মারকিউরাস নাইট্রাইট । আচার্য আবিষ্কৃত পারদ সংক্রান্ত এগারোটি মিশ্রধাতু , যা তাঁকে রসায়ন শাস্ত্রের আন্তর্জাতিক পরিসরে বিখ্যাত করে তুলেছে । দ্বিতীয়টি , ‘ দ্য হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি ‘ র প্রণয়ন । প্রাচীন ভারতের রসায়ন শাস্ত্রের উপর রচিত অসামান্য এক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ । তৃতীয়টি , বেঙ্গল কেমিক্যাল , যা ছিল আচার্য পিসি রায়ের স্বপ্নের প্রকল্প । আত্মচরিতে আচার্য লিখেছেন , ‘ বাংলাদেশে কতকগুলি টেকনিক্যাল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করাই সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নহে ; সফল ব্যবসায়ী বা শিল্পপ্রবর্তক হ‌ইতে হ‌ইলে যে সাহস, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব , কর্মকৌশলের প্রয়োজন , বাংলার যুবকদের পক্ষে তাহাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন হ‌ইয়া পড়িয়াছে । কলেজে শিক্ষিত যুবক এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার‌ই পরিচয় দিয়াছে, তাহার মধ্যে কাযপরিচালনার ‌শক্তি নাই – বড় জোর সে অন্যের হাতের পুতুল বা যন্ত্রদাসরূপে কৃতিত্ব দেখাইতে পারে । ‘ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র স্বজাতির কী চেয়েছিলেন এই উদ্ধৃতি থেকে তা স্পষ্ট । শুধু প্রত্যাশা নয় , শুকনো বাণী নয় , হতাশাব্যঞ্জক কোন‌ও বিলাপ‌ও নয় । বিজ্ঞানী হয়েও নিজে শিল্প-বাণিজ্যে নেমে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় স্বজাতিকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন , কীভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য , শিল্প স্থাপন করতে হয় ‌।

প্রফুল্লচন্দ্রের স্বপ্নের প্রকল্প বেঙ্গল কেমিক্যাল।
ব্যবসা করতে নেমে অনেক বিড়ম্বনায় পড়েছেন । কিন্তু হাল ছাড়েন নি প্রফুল্লচন্দ্র । ফসফেট অব সোডা উৎপাদন করতে গিয়ে শুরুতেই যে নাকাল হয়েছিলেন তাতেই অনেক বাঙালি যুবকের ব্যবসার শখ চিরদিনের মতো মিটে যেতো । কিছুদিন বাদে অনেক চেষ্টার পর ব্যবসা যখন কিছুটা দাঁড়িয়েছে তখন দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন তরুণ সহকর্মীকে । আচার্য লিখেছেন, ‘ যুবক সতীশ আমার সহকর্মী হ‌ইল , সে কিছু মূলধন‌ও ব্যবসায়ে দিয়াছিল । রাসায়নিক কাজে এ পর্যন্ত বলিতে গেলে আমি একক‌ই ছিলাম এবং আমার পক্ষে অত্যন্ত পরিশ্রম‌ও হ‌ইত । তাছাড়া যে অবসর সময়টুকুতে আমি অধ্যয়ণ করিতাম , তাহাও লোপ হ‌ইয়াছিল , আমি সতীশকে আমার উদ্ভাবিত নূতন প্রণালীর রহস্য বুঝাইতে লাগিলাম এবং সে শিক্ষিত রাসয়নিক বলিয়া শীঘ্রই এ কাজে পটুতা লাভ করিল । আমরা দুইজন একসঙ্গে প্রায় দেড় বৎসর উৎসাহ সহকারে কাজ করিলাম এবং আমাদের প্রস্তুত বহু দ্রব্যের বাজারে বেশ চাহিদা হ‌ইল ‌‌। কোন কোন চিকিৎসক তাঁহাদের ব্যবস্থাপত্রে যতদূর সম্ভব আমাদের ঔষধ ব্যবহার করিতে লাগিলেন । কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা আমাকে ভীষণ অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়া উত্তীর্ণ হ‌ইতে হ‌ইবে । ‘ বিধাতা কী অগ্নিপরীক্ষার ফেলেছিলেন তা আচার্যের মুখেই শোনা যাক – ‘ একদিন বৈকালে আমি অভ্যাসমত ভ্রমণে বাহির হইয়াছিলাম। রাত্রি আটটার সময় বাড়ি ফিরিয়া শুনিলাম , সতীশ আর নাই । বজ্রাঘাতের মত‌ই এই সংবাদে আমি মুহ্যমান হ‌ইলাম । দৈবক্রমে হাইড্রোসায়ানিক বিষে তাহার মৃত্যু হ‌ইয়াছে । আমি প্রায় জ্ঞানশূন্য অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দিকে ছুটিলাম । সেখানে সতীশের মৃতদেহ স্ট্রেচারের উপরে দেখিলাম । আমি নিশ্চল প্রস্তরমূর্তির মত বাহ্যজ্ঞানশূন্য হ‌ইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম – বহুক্ষণ পরে প্রকৃত অবস্থা আমি উপলব্ধি করিতে পারিলাম । ‘ এরপরে প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছেন , ‘ এক তরুণ যুবক জীবনের আরম্ভেই কালগ্রাসে পতিত হ‌ইল , পশ্চাতে রাখিয়া গেল তাহার শোকসন্তপ্ত বৃদ্ধ পিতা-মাতা এবং তরুণী বিধবা পত্নী । অমূল্য ও আমার মানসিক মানসিক যন্ত্রণা বর্ণনার ভাষা নাই । আমাদের বোধ হ‌ইল , আমরাই যেনো সতীশের মৃত্যুর কারণ । সেই ভীষণ দুর্ঘটনার পর ৩২ বৎসর অতীত হ‌ইয়াছে , কিন্তু এখনও এই সমস্ত কথা লিখিতে আমার সমস্ত শরীর যেন বিদ্যুৎস্পর্শে শিহরিয়া উঠিতেছে । ‘

এই আকস্মিক দুর্ঘটনার পর সমস্ত আশা-ভরসা হারিয়ে স্থবির পড়েছিলেন কর্মযোগী । কিন্তু কর্ম‌ই যাঁর জীবনের ব্রত , তিনি কি নিয়তির দাস হয়ে থেমে থাকতে পারেন । শোকের উচ্ছ্বাস থিতু হতেই কাজে ফিরলেন প্রফুল্লচন্দ্র । তিনি লিখেছেন, ‘ আমি আর পশ্চাতে ফিরিতে পারি না । পুনর্বার আমাকেই সমস্ত গুরু দায়িত্ব স্কন্ধে তুলিয়া ল‌ইতে হ‌ইল । কঠোর দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে আমি সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিবার জন্য প্রস্তুত হ‌ইলাম । ‘ বিজ্ঞানী হয়ে ব্যবসা ধরেছেন । ব্যবসা করে সফল হয়েছেন । ব্যবসায় মগ্ন ছিলেন বলে সমাজকে , দেশকে কখনও অবহেলা করেন নি । ১৯২১ সালে গ্রামবাংলা যখন বন্যা আর দুর্ভিক্ষে উজাড় হতে বসেছিল রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের বাসগৃহে দরজায় খিল দিয়ে বসে থাকেন নি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় । আর্ত মানুষের উদ্ধারে বিদেশী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি থেকে বেঙ্গল রিলিফ কমিটি গঠন করে স্বদেশী যুবকদের নিয়ে ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়া – সবেতেই সবার আগে এই ক্ষীণকায় মহাপ্রাণ বিজ্ঞান সাধক । এমন দেশপ্রেমিক , এমন স্বজাতি অন্তপ্রাণ বিজ্ঞানী বাঙালির ঘরে আর কখনও আসে নি । রবীন্দ্রনাথের গানের পঙক্তি উদ্ধৃত করে আচার্য সম্পর্কেও বলা যেতে পারে –

কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ
জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস ।
সাধক ওগো , প্রেমিক ওগো ,
পাগল ওগো , ধরায় আস ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.