কাঁটাতার থেইহ্যা ঝুইল্যে ঝুইল্যে কইত্যেসি

এক বছর আগের লেখা।যতোদিন সিএএ নাহয় ততোদিন এই লেখা বোধহয় প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে।

দেশভাগ নিয়ে গল্প লেখার ইচ্ছা অনেকদিন। কিন্তু যে সমস্যার কারনে গল্প লিখতে পারিনি এতোদিন সেটা হোল লেখার মধ্যে ভাষার ফ্লেভারটা কিছুতেই আনতে পারছিলামনা। এই সময়ই একটা আইডিয়া পেলাম অভীক মূখার্জীর পোস্ট থেকে। সেটা হোল গ্রুপ রাইটিং। অর্থাৎ একজন মূল গল্প লিখবে, একজন তাতে ভাষা দেবে এরকম আরকি।

সেই ভাবনা থেকেই পরীক্ষামূলক ভাবে একটা ছোট লেখার চেষ্টা করলাম। লেখার মূল ভাবনা আমার আর ভাষার কারিকুরি আমাদের জ্যোতির। যেহেতু ও নিজে বাংলাদেশের ফলে ডায়লেক্টটা ওর জানাই আছে।

সেই লেখাটা আপনাদের জন্য এখানে দিলাম। কেমন লাগল মতামত জানালে ভালো লাগবে। ঠিকঠাক হলে এরকম ছোটখাটো পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে হয়ত একদিন গল্পটাও লিখে ফেলব।

লেখার বিষয়বস্তু এক উদ্বাস্তু মানুষের চিঠি। তিনি চিঠিটি কাকে লিখেছেন এবং সেখানে ঠিক কথা লিখেছেন কিনা তা চিঠির বিষয়বস্তু পড়ে আপনারাই বলুন।


কাঁটাতার থেইহ্যা ঝুইল্যে ঝুইল্যে কইত্যেসি

হুজুর,

মুই রাখাল চন্দ্র মন্ডল আপনেরে জানাই সবিনয় প্রণাম। আপনে আমারে চেনবেননা, কিন্তু মুই আপনেরে চিনি। অবশ্য এইডা কোন বড় কথা না। বড়মানুষরে বেবাক লোকে চেনে, কিন্তু হেরায় মোগো মত ছোট মানষেরে সচরাচর চেনেনা। তবে মোরে আপনি চেনলেও চেনতে পারেন। হেই ভরসা থেইহ্যাই এই চিডি লিখতাছি।

মুই রাখাল চন্দ্র মন্ডল, অধুনা ফুটপাথবাসী, বরিশাল নিবাসী। মোরে আপনে কেমনে চিনবেন! এমনিতে তো মোগো মতো মানষের লগে আপনের ওঠাবসা নাই, তায় মোগো কথা আপনের জানবার কথাও না। তবে মুই মইধ্যে কয়দিন মরিচঝাপীতে আছিলাম, হেই সূত্রে আপনে মোরে চিনতেও পারেন। মুইও হেই সৌভাগ্যবানগো মইধ্যে একজন যে আপনের দয়ায় সুন্দরবনের বাঘের হাত থেইহ্যা বাইচ্যে আসছে।

মুশকিল হইলো আপনে তো মোগোরে মরিচঝাপীর বাঘের হাত থেইহ্যা বাঁচাইছিলেন বা বাঘগুলারে মোগো হাত থেইহ্যা বাঁচাইছিলেন। যথার্থ গুরুজনের মতই আপনে মোগোরে ঐ জলা-জংলার দেশ থেইহ্যা কান ধইর‍্যে বার কইর‍্যে দেছিলেন। মোরাও বুঝি মোগো রামবাবুর মতো হুশো লোকের কথায় গুরুত্ব দেওন উচিত হয় নাই। কিন্তু কি করতাম কন? হের আগে দণ্ডকারণ্যের ক্যাম্পে যহন আছিলাম তহন সেইহানে খাইতে গেলে পোকা, উঠতে গেলে পোকা, বইতে গেলে পোকা এমনকি বাহ্য করতে গেলেও পোকার কামড়। কামড়ে কামড়ে অস্থির হইয়াই মোরা রামবাবুর কথাডা বিশ্বাস কইর‍্যে ফ্যালাইছিলাম। কিন্তু পরে আপনে যহন বোঝাইলেন যে কামডা মোগোর একেবারে অনুচিত হইছে তহন নিজেরাই ভুল বোঝতে পারছি। মানে আপনে নিজে আইস্যে তো আর বোঝাইতে পারেননা। মোগো মতো ছোটমানষের লগে আপনের মেলামেশা সাজেও না। তাই আপনে লোক পাঠাইছিলেন মোগোরে বোঝাইবার জইন্যে। মোরা পয়লা পয়লা তাগোর লগেও একটু বিয়াদ্দপি করছিলাম বটে। কিন্তু কি করতাম কন? জাতে বরিশাইল্যা তো তাই রক্তে বিয়াদপি রইয়্যে গেছে। ওইপারে এতো রক্ত ঝড়াইবার পরেও পুরাপুরি রক্ত থেইহ্যা দোষ দূর হয় নাই। তায় আপনাগো লোকেরা মোগো একটু ধমক ধামক দিয়া কান মুইল্যে দিতেই মোরা কথা বুইঝ্যে লইসি কিন্তু মুশকিল হইস্যে হুজুর তারপরে।

মরিচঝাপী থেইক্যে চইল্যে আসার পরে কই যামু, কি করমু কিছুই বুঝতে পারতেছিলাম না। এদিকে কান্ডজ্ঞান যেহেতু এক্কেবারে লোপ পায়নাই, তাই ভাইব্যে দেখলাম যে এইহানে ঘাঁটি গ্যাইড়ে বইস্যে আপনের সমস্যা বাড়ান উচিত কাম হইবেনা। তাই ভাবলাম অহন তো আর দ্যাশে পাকিস্তানিরা নাই। ইন্দীরা গান্ধী হেগো কাশ্মীর পাড় কইর‍্যে দেছেন। তাই দ্যাশেই ফিইর‍্যে যাই। যতই হোক হাড়ি কুড়ি বানান মোগো সাত পুরুষের পেশা। তাই কইর‍্যেই চাউলে মাখবার ডাউলটা হইয়ে যাইবে। জমিজমা আগে কিছু ছিল বটেক তবে সেইসব লইয়ে টানাটানি কইর‍্যে জসিমুদ্দীন চাচার বিড়ম্বনা বাড়াইয়ে আর কাম নাই। আহা মোগো জসিমুদ্দিন চাচা বড় ভালা মানুষ। কেমনে কাঁনতে কাঁনতে জসিম চাচা হেইদিন মোগোরে ইন্ডিয়া যাওয়নের লাইগ্যে অনুরোধ করছিল। শুধু মোর পিসিডারে জসিম চাচা বড় ভালোবাসত বইল্যে হেরে কিছুতেই মোগো লগে যাইতে দেয়নাই। রাইখ্যে দেছে নিজের থানে…।

মুই ভাবলাম এইপারে যহন পোকা আর বাঘের কামড় ছাড়া আর কিছুই জুটতেছেনা তাইলে বরং জসিম চাচার থানেই গিয়া আশ্রয় লই। হাজার হোক সম্পর্ক দেইখলে মোর পিসেমশাই হইবে। তায় একদিন কপাল ঠুইক্যে গিয়া পড়লাম জসিম চাচার থানে। যাওনের পথে বর্ডার পার করতে গিয়া পিঠডা কাঁটাতারের খোঁচায় একটু ছইড়ে গেছিল বটে, কিন্তু ব্যথা বেদনা তেমন হয়নাই। ওইরহম খোঁচা তো সেই পঞ্চাশে যহন এদিকে আইলাম সেই তহন থিক্যাই খাইত্যাসি। অভ্যাস হইয়ে গ্যাছে। তায় জসিম চাচার থানে গিয়া আমার পিসিডারে কোথাও দেখতে পাইলামনা। এমনকি জসিমচাচাও মোরে বিশেষ সুনজরে দেখলনা। তবে দেখলাম আমার মাইয়াটার প্রতি তেনার বিশেষ সুনজর। কিন্তু একবার যিনি পিসামশাই হইয়েছেন তারে আবার জামাই বানাইতে কেমন লাগবো ভাইব্যে আমি আবার আপনের থানে ফের আইস্যে পড়লাম। জানি কাজটা বিশেষ ঠিক হইলো না কিন্তু অন্য উপায়ও আছিলনা, বিশ্বাস করেন।

এহন হুজুর আপনের রাজত্বে তো আইস্যে পড়লাম কিন্তু কিছু বড় সমস্যা হইতেসে। মানে এমন কইতেছিনা যে সমস্যাগুলান আপনের কারনে হইতেসে! সব মোর কারনেই হইতেসে। আর আপনে মোগোর মালিক, তায় বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার। সমস্যা হইলে আপনেরে কমুনা তো কারে কমু কন? মোগোর গাঁয়ে দ্যেখছি চ্যাটার্জী মশাইরে। তায় মেসোমশাই বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার আছিলেন। মোগোর যে কোন সমস্যায় মোরা তাঁর ধারেই যাইতেম। তিনি চক্ষু বুইজ্যা মোগো সমস্যা হোনতেন আর হোনতে হোনতে গুমাইয়া পড়তেন। হেই থিহ্যাই মুইও শিখছি যে সমস্যা হইলে চক্ষু বুইজ্যে ফ্যেলতে হয়। কিন্তু হুজুর প্যাডে যদি বড় ক্ষিদা লাগে তাইলে চক্ষু বুইজ্যে ফ্যালতে সমস্যা হয়। প্যাডে একটু বেদনা হয় কিনা ক্ষিদার চোটে, তাই। আপনে ভাইবেন না হুজুর মুই আপনের কাছে ডাউল চাউল চাইবার লাইগ্যে এতো কথা ইনাইয়্যে বিনাইয়্যে কইত্যেসি। পেডের ক্ষিদার জন্যে ইউনিভার্সিটির গেটের বাইরে একখান চায়ের দোহান মুই দেইসি হুজুর। তবে সে দোহান নিয়াও মোর কোন কথা নাই। মোর কথা হইলো অন্য একখান বিষয়ে।

হুজুর মোর চায়ের দোহানে প্রায়ই পোলাপান আইস্যে বহে। চা, বিস্কুট খায়। তায় হেইয়া পোলাপাইনেরা চা বিস্কুট খাইবে এইটাই ভাল কথা। অন্তত মদ গাঁজা খাওনের থিহ্যা চা বিস্কুট খাইত্যেসে এইডা ভালো কথা। কিন্তু মুশকিল হইল হুজুর, চা বিস্কুট খাওনের পরে টাহা চাইলে তহন আর হেরায় মোর দিকে আর তাহায়না। তহন খালি কয়, “বিপ্লব আসবে”। হুজুর মোগোর গ্রামের জমিন্দার বড় বাড়ুজ্যের ছ্যামড়া বিপ্লব বিলাত গিয়াসিল ব্যারিস্টারি পড়তে। তা হেই বিপ্লব কবে দ্যাশে ফিরবে, ফিইর‍্যে চায়ের টাহা মিটাইবে হেই ভরসায় মুই ক্যামনে থাহি কন? থিহ্যা থিহ্যা পেডটা এমন মুচড় মারে যে মনে হয় মাথাডা ঘুইর‍্যে যাইবে। আর এমনেও বিপ্লব যদি বিলাত থিহ্যা আইস্যাও থাহে তাইলেও মোর তেনার সামনে যাইবার মুখ নাই। এপারে আইস্যে একদিন বড় বাড়ুজ্যেরে সামনে পাইছিলাম। হেয় তহন পাঁচটা টাহা দিছিলেন। অহনও হেই টাহাগুলান শোধতে পারিনাই। তায় হুজুর মুই পোলাপানগুলারে একদিন সাহস কইর‍্যে কইলেম যে আমার টাহা তোমরা দিয়া দ্যাও। বিপ্লব আইলে তহন তোমরা বিপ্লবের থিহ্যা লইয়ো। এই কথাগুলানের মইধ্যে কি ভুল কইছিলাম জানিনা কিন্তু হেরায় মোগোরে বেবাক মারধর কইর‍্যে দোহান ভাইঙে দিলে। যাওয়ার সময় কইয়ে গেল, “বিপ্লব দীর্ঘজীবি হউক”। আমি বুইঝতে পারলামনা হুজুর, পাঁচডা টাহার কতো সুদ অয়, আর কতোদিন চা খাওয়াইলে পড়ে হেই টাহা শোধ অয়?!

অহন হুজুর, বড্ড নাচার হইয়াই আপনেরে এই চিঠি লিখত্যেসি। ওইপারে যে দ্যাশ ছিল সে দ্যাশ আর নাই। এইপারে যে দ্যাশ হইবে ভাবসিলাম সেই দ্যাশেও জমিন্দারের পোলা বিপ্লবের অত্যাচারে প্রান যাইতাছেগা। অহন হুজুর আপনে যদি একখান মিমাংসা কইর‍্যে না দেন তাইলে মোরা বেবাক ঝামেলায় পইড়্যে যামু। না ওইধারে না এইধারে। মধ্যিখানে কাঁটাতারে ছিঁড়া জাঙ্গিয়াডার মতো ঝোলত্যেসি। আপনেই অহন পারেন মোগোরে উদ্ধার করতে। হেইলিগ্যাই এই চিঠি ল্যাখতাছি। দয়া কইর‍্যে মোর দোষ নিয়েন না। আপনে খালি বিপ্লবরে কতো সুদ দিতে অইব হেইডার একখান রফা কইর‍্যে দ্যেন যদি তাইলে বড় উপকার হয়। চ্যাটার্জী মশাই নিজে বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার ছিলেননা বইলা ঘুমাইয়ে পড়তেন। কিন্তু আপনে বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার, তাই নিশ্চিত বিপ্লবরে ঠিক কত সুদ আমার দেওনের আছে তা লিখাপড়া কইর‍্যে দেবেন। তাই আপনারে এই চিডিখান লিখলাম।

মোর প্রণাম নিয়েন।

ইতি

আপনের সেবক

রাখাল মন্ডল

দীপ্তাস্য যশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.