ইতিহাসের পাতায় ভুলে যাওয়া এক মহান চরিত্র-বীরসা মুন্ডা

            উপজাতি বিদ্রোহের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হল ছোটনাগপুরের মুন্ডা বিদ্রোহ।মুন্ডারা হল ভারতবর্ষের আদিমতম অধিবাসী। মুন্ডাদের বিভিন্ন শাখা হল সাঁওতাল,ভূমিজ,কোল ও হো প্রভৃতি উপজাতিসমূহ।ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চলে মুন্ডাদের বসতি গড়ে উঠেছিল।এদের জীবিকা ছিল বনজঙ্গল পরিষ্কার করে চাষবাস।জমির মালিকানা ছিল যৌথ।এই ভূমি ব্যবস্থাকে বলা হত "খু্ন্তকটিদার"।এই খুন্তকটিদারদের মধ্য থেকেই গ্রামপ্রধান বা 'মুন্ডা' ও গ্রাম পুরোহিত বা 'পাহান' নির্বাচিত হতেন।এদের সমাজে সবাই যেহেতু জমির মালিক- কাজেই খাজনা দেওয়ার পদ্ধতি মুন্ডা সমাজে প্রচলিত ছিল না।

কালক্রমে শান্তশিষ্ট মুন্ডা উপজাতি ইংরেজ শাসন বিরোধী হয়ে উঠেছিল এবং এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে তারা অবতীর্ণ হয়েছিল।কিন্তু কেন?

নৃতাত্ত্বিক-ইতিহাসবিদ কুমার সুরেশ সিং তাঁর The Dust-Storm and the Hanging Mist: A Study of Birsa Munda and His Movement in Chotanagpur (1874–1901)গ্রন্থে মুন্ডা বিদ্রোহের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন।প্রথমে আলোকপাত করা যেতে পারে মুন্ডা বিদ্রোহের কারণগুলির উপর।সুরেশ সিং তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন,ব্রিটিশ শাসনকালে মুন্ডাদের
যৌথ মালিকানা ব্যবস্থার পতন ঘটে,এর পরিবর্তে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়।বহিরাগত দিকুদের হাতে মুন্ডাদের জমি-জায়গা চলে যেতে থাকে।মুন্ডাদের নগদে রাজস্ব দিতে বলা হয়।নগদ অর্থে ভূমি রাজস্ব দিতে গিয়ে মুন্ডাদের দিকু ও মহাজনদের দ্বারস্থ হতে হয়।এই অজুহাতে দিকুরা তাদের বিনা মজুরিতে বেগার খাটতে(বেট বেগারি) বাধ্য করে।ক্রমশ খাজনা বৃদ্ধি পায়,ঋণের দায়ে তাদের জমিগুলি ক্রমশই দিকুদের হাতে চলে যায়।সহজসরল মুন্ডাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্প মজুরির বিনিময়ে আসামের চা- বাগানে কুলির কাজে পাঠানো হত।সেখানে তারা এবং মুন্ডা রমণীরা ইউরোপীয়দের হাতে অত্যাচারিত হত।ব্রিটিশ সরকারের অরণ্য আইনের ফলে মুন্ডারা চিরায়ত অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে লুথেরান, এংলিকান,ক্যাথলিক মিশনারি’রা মুন্ডা সমাজে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার শুরু করলে মুন্ডা সমাজে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।প্রশাসনিক সমস্ত সাহায্য থেকে মুন্ডারা বঞ্চিত হয়।ক্রমশ মুন্ডাদের মধ্যে এক জাতীয় চেতনা গড়ে ওঠে।

১৮২০ এবং ৩০ সালে মুন্ডা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল ‘খুন্তকটিদার’ গণ।কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছিল।এরপরে ১৮৬০ থেকে ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত তিন দশক ধরে মুন্ডা বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন সর্দারগণ।নব্বই-এর দশকের শেষদিকে মুন্ডা আন্দোলন এক উন্নত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়।এর মূলে ছিল বীরসা মুন্ডার সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব ও সাংগঠনিক প্রতিভা।

১৮৭৪ মতান্তরে ১৮৭৫ সালের ১৫ ই নভেম্বর রাঁচি জেলার চালকাদ(উলিহাতু) গ্রামে বীরসা জন্মগ্রহণ করেন।পিতা ছিলেন ভাগচাষী সুগান মুন্ডা,মাতা ছিলেন কারমী দেবী।বীরসা ছিলেন পিতা-মাতার চতুর্থ সন্তান।সুগান মুন্ডা পুত্র বীরসাকে চাইবাসার জার্মান মিশনারী স্কুলে ১২ বছর বয়সে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি করে দেন।পরে একটি ক্যাথলিক স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন বীরসা।এই পর্বে বীরসা খ্রিষ্টধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।কিন্তু মিশনারীদের দ্বারা মুন্ডা সংস্কৃতি বিপন্ন হলে বীরসা মনে গভীর প্রশ্নচিহ্ন দেখা দেয়।বীরসা বৈষ্ণব গুরু আনন্দ পাঁড়ের সংস্পর্শে আসেন।১৮৯৫ সালে বীরসা ‘ বীরসাইত’ নামে এক নতুন ধর্মমত প্রবর্তন করেন,তিনি নিজেকে ‘ধরতি আবা’ বা ধরণীর পিতা বলে ঘোষণা করেন।তার উপাস্য দেবতা হলেন ” সিংবোঙা” বা সূর্য দেবতা।বীরসা প্রবর্তিত নতুন ধর্মের মূলকথা ছিল-আত্মশুদ্ধি,ভালবাসা ও সমবেত প্রার্থনা।বীরসার মতবাদ ক্রমশ মুন্ডা সমাজে জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

১৮৯৩-৯৪সালে বীরসা সরকারের বনদপ্তর দ্বারা মুন্ডাদের পতিত জমি অধিগ্রহণের প্রয়াসের বিরোধিতা করেন।এই ঘটনায় মুন্ডা সমাজ বীরসার অনুগত হয়ে পড়ে।বীরসা মুন্ডা সমাজের সংস্কারের জন্য এবং মুন্ডা সমাজকে মিশনারীদের প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য একটি নির্দেশিকা চালু করেছিলেন,এতে বলা হয়েছিল-

১)মুন্ডাদের উপবীত ধারণ করতে হবে।

২) গো-হত্যা বর্জন করতে হবে।

৩)পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে হবে।

৪)মদ্যপান বর্জন করতে হবে।

৫)আমিষ খাদ্য বর্জন করতে হবে,ইত্যাদি।

বীরসার প্রভাবে মুন্ডারা ধীরে ধীরে নিজ সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।বীরসা ঘোষণা করেন ১৮৯৫ সালের ২৭ শে আগস্ট মহাপ্রলয় আসন্ন,এই মহাপ্রলয়ে ব্রিটিশ রাজ ধ্বংস হয়ে যাবে,ব্রিটিশ সেনা তাকে ধরে রাখতে পারবে না,শত্রুপক্ষের বুলেট তার মন্ত্রগুণে জল হয়ে যাবে।বীরসার এই বাণীতে বহিরাগত জমিদার এবং মিশনারীরা ভয় পেয়ে যায়।ইংরেজ সরকার কালবিলম্ব না করে বীরসাকে ১৮৯৫ সালে কারারুদ্ধ করে।দু’বছর কারাগারে বন্দী থাকার পর বীরসা মুক্ত হলে সমগ্র মুন্ডা সমাজে বীরসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। বীরসার নেতৃত্বে শুরু হয় ” মুন্ডা উলগুলান” বা তুমুল আলোড়ন।এই আলোড়নের মূল লক্ষ্য ছিল ইংরেজ এবং মিশনারীদের হাত থেকে বনবাসী সমাজকে রক্ষা এবং স্বাধীনতা লাভ।

১৮৯৮-৯৯ সালে বীরসা তার অনুগামীদের নিয়ে জঙ্গলে নৈশ সভা করেন।এই সব সমাবেশে তিনি দিকুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনের ডাক দেন।ক্রমশ মুন্ডা আন্দোলন চালকাদ থেকে ডোমবাড়ি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেন।বীরসা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মুন্ডা গ্রামবাসীদের সংগঠিত করেন এবং মুন্ডা বাহিনী গড়ে তোলেন।বীরসা মুন্ডার অনুগামীরা তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল।এরা হলেন(১) প্রচারক,(২)পুরানক,(৩)নানক।গয়া মুন্ডা ছিলেন মুন্ডা বাহিনীর প্রধান সেনাপতি। বীরসার অনুগামীরা উপবীত ধারণ করতেন এবং সংকল্প নিতেন যেভাবেই হোক ব্রিটিশদের পরাস্ত করে স্বাধীন মুন্ডারাজ স্থাপন করতে হবে।মুন্ডারা স্বপ্ন দেখেছিল রাম যেভাবে রাবন বধ করেছে,তারাও শত্রুপক্ষকে বধ করবে।এই পর্বে মুন্ডা আন্দোলন ছিল অনেক বেশি রাজনৈতিক। k.k সিং মন্তব্য করেছেন,” The movement was agrarian in its root,violent in its means and political in its end.”

যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।রাঁচি,চক্রধরপুর,কররা,তোরপা প্রভৃতি স্থানে এই কেন্দ্রগুলি ছিল।মুন্ডারা এইসময় সমবেতভাবে প্রতিজ্ঞা করেছিল,

নেরা নিয়া নুরু নিয়া
ডিণ্ডা নিয়া ভিটা নিয়া
হায়রে হায়রে! মাপাঃ গপচদ,
নুরিচ নাড়াঁড় গাই কাডা নাচেল লৌগিত্‍ পাচেল লৌগিত্‍ সেদায় লেকা বেতাবেতেত্‍ ঞাম রুওয়ৌড় লৌগিত্‍
তবে দ বোন লুনাগেয়া হো।’

অর্থাৎ – ‘স্ত্রীপুত্রের জন্য জমি জায়গা বাস্তুভিটার জন্য হায় হায় ! এ মারামারি কাটাকাটি
গো-মহিষ-লাঙ্গল ধন-সম্পত্তির জন্য,
পূর্বের মত আবার ফিরে পাবার জন্য
আমরা বিদ্রোহ করবো।’

১৮৯৯ সালের ২২ ডিসেম্বর কোটডাঙ্গায় একটি সভায় বীরসা ঘোষণা করেন সরাসরি সংঘাত আসন্ন।২৪ শে ডিসেম্বর মুন্ডারা সরাসরি সংঘাতে নেমে পড়ে।গীর্জার উপর আক্রমণ করা হয়।চক্রধরপুর,খুন্তি,চালকাদ,করো ইত্যাদি এলাকায় হাতে তীর-ধনুক নিয়ে মুন্ডারা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।জমিদার,মহাজন,খ্রিষ্টান মিশনারীদের আবাসস্থল আক্রমণ করা হয়।ব্রিটিশ প্রশাসকদের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়।১৯০০ সালের ৬ ই জানুয়ারী মুন্ডাদের সাথে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ২ জন ব্রিটিশ পুলিশ নিহত হয়।৭ই জানুয়ারী প্রায় ৩০০ জন মুন্ডা অনুগামী খুন্তি থানা আক্রমণ করে থানা জ্বালিয়ে দেয়।

ব্রিটিশ প্রশাসন বীরসা এবং তার অনুগামীদের বিরুদ্ধে ছোটনাগপুরের ডেপুটি কমিশনার আর্থার ফরবেসের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করে।দুমারি পাহাড়ে ৯ ই জানুয়ারী প্রায় ৫০০ সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর সাথে তীর-ধনুক নিয়ে প্রবল বিক্রমে মুন্ডারা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়,এই মরণপণ সংগ্রামে প্রায় ২০০ জন বিদ্রোহী মৃত্যুবরণ করেন।গয়ামুন্ডা প্রবল বিক্রমে লড়াই করে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন।৫৮১ জন মুন্ডা অনুগামীকে গ্রেপ্তার করা হয়।উপায়ন্তর না দেখে বীরসা সেই স্থান থেকে পালিয়ে গিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেন,এবং নতুন উদ্যমে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন।কিন্তু ১৯০০ সালের ফ্রেব্রুয়ারী মাসে ঘুমন্ত অবস্থায় বীরসাকে আটক করা হয়।৯ ই জুন কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে বীরসা মৃত্যুবরণ করেন। বিদ্রোহের অপর দুই নেতা ডোঙ্কা ও মাঝিয়াকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া দেয়।

সনাতনী বীর বীরসা স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার।আজও বনবাসী সমাজে বীরসার পরিচয় ‘বীরসা ভগবান’।যে মিশনারীদের করাল গ্রাস থেকে বনবাসী সমাজকে রক্ষা করার জন্য বীরসা আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন,সেই অবদানকে আমরা কতটা মনে রাখতে পেরেছি?আজ আদিবাসী সমাজে মিশনারী প্রভাব সক্রিয়,বীরসার অবদান এবং তার স্বপ্নকে সাফল্যমণ্ডিত করার প্রয়াস আমাদেরই নিতে হবে।বীরসা ইতিহাসের অন্যতম এক চরিত্র,দুঃখের বিষয় বীরসা ভুলে যাওয়া এক জাতীয় হিরো।

হে বীর, আজ তোমার জন্মদিনে তোমাকে স্মরণ করে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানালাম।

সন্দীপ মুখোপাধ্যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.