আমরাও আছি, আমাদের চা-ওয়ালার সঙ্গে

অমর্ত্য বাবু, নতুন করে আপনার কোন পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই, আপনার মেধার তুলনা শুধু আপনি নিজেই। আপনি ভারতীয় হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়ে অবশ্যই আমাদের গর্বিত করেছেন এবং দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত হয়েছেন আপনার নিজের যোগ্যতাতেই। আপনাকে প্রশ্ন করার মত ধৃষ্টতা দেখানো আমার উচিত নয় কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে  আপনার আচরণ অত্যন্ত বেদনাদায়ক, তাই কিছু  কথা না বলে থাকতে পারলাম না। 

খাদ্য সংকট নিয়ে আপনার গবেষণা আপনাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে,  খাদ্য সংকটের কারণ হিসেবে তথাকথিত FAD (Food Availability Decline)  তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে আপনি “Entitlement Failure” তত্ত্বের প্রবর্তন করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ আপনি বলেছিলেন একটি তুলা চাষীর উৎপাদিত তুলা নিজের ঘরে রেখে দেওয়া বা বিক্রি করা বা বিক্রি করে অন্য কিছু কিনে নেওয়ার Entitlement থাকা উচিত। বর্তমান ভারত সরকার  কৃষি বিপণন আইনে (APMC Act) যে সংস্কার আনা হয়েছে তাতে তো কৃষকদের উপযুক্ত Entitlement দেওয়া হয়েছে  যার ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল তাদের পছন্দের ক্রেতাকে বিক্রি করতে পারবে। আপনার গবেষণাতেই আপনি উল্লেখ করেছেন যে খাদ্য সংকটের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র একটি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা প্রাচীরের  ন্যায় কাজ করে। ১৯৫৯-৬১ তে  কমিউনিস্ট পরিচালিত চিনে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তা অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশ হলে কত কিনা  সে নিয়ে বহু অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলেছেন। অর্থাৎ Entitlement তত্ত্বকে মেনে নিয়েও একথা অনস্বীকার্য যে খাদ্যের পর্যাপ্ত যোগান না থাকলে খাদ্যসঙ্কট অবশ্যম্ভাবী। ভারতবর্ষে প্রতি বছর প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকার শস্য নষ্ট হয় পর্যাপ্ত হিমঘর না থাকার জন্য। এর জন্য প্রধান  অন্তরায় ছিল অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন (ECA Act 1955), বর্তমান ভারত সরকার এই আইনে যে সংশোধনী এনেছে তার ফলে  হিমঘরে বিনিয়োগের বিপুল রাস্তা খুলে গেছে  সাধারণ যুবক যুবতীদের জন্য। যার ফলে একদিকে যেমন উৎপাদিত শস্যের সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে, অপরদিকে  কর্মসংস্থানের রাস্তাও খুলে যাবে। এই যুগান্তকারী কৃষি সংস্কার আনার জন্য যারা বর্তমানে কৃষকদেরকে ভুল বুঝিয়ে রাস্তায় নামিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে, আপনি কি মোদি সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সরব হবেন নাকি মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগে নিজের  নোবেলজয়ী  গবেষণাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দেবেন? 

মোদির শাসনকালে  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিয়ে আপনি অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার কাছে কি সংখ্যালঘু বলতে শুধু  একটি বিশেষ ধর্মের মানুষকে বোঝায়? নিকিতা  তোমারকে যখন প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে খুন করা হয় লাভ জিহাদের জন্য  তখন কি আপনার মনে লাভ জিহাদের আগ্রাসন নিয়ে কোন প্রশ্ন জেগেছিল? সেই বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পশ্চিমবঙ্গে যখন CAA এর প্রতিবাদের নাম করে দাঙ্গা করেছিল তখন কি আপনার মনে কোন প্রশ্ন জেগেছিল? বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর যে অত্যাচার হয়ে আসছে তা নিয়ে আপনি কোনদিন সরব হয়েছেন? আপনার কাজ তো দুর্ভিক্ষের উপর, ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের উপর প্রচুর কাজ  হয়েছে। একবারও তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ভূমিকা নিয়ে একলাইনও কিছু বলেছেন? 

বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে কোন একটি দুঃখজনক ঘটনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে প্রাণ হারাতে হলে গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়ে যায় আপনার কাছে। সাইবাড়ির খুনিদের একবারও কিছু বলেছিলেন? মরিচঝাঁপির হত্যার পরে? বিজন সেতু থেকে নেতাই গণহত্যা সময় খুনিদের একবারও কোন পরামর্শ দিয়েছিলেন? 

বাকি  রইল বাকস্বাধীনতা। একাধিক ইউটিউবার ব্লগার এবং দেশের প্রথম শ্রেণীর সংবাদমাধ্যম অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন মোদি বিরোধিতা করে জনমানষে মোদির বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি করার। তাদের উপর সরকারিভাবে কোথাও কোনো কোপ নেমে আসেনি – গণতন্ত্র যেটা অভিপ্রেত। কিন্তু তা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে বাক স্বাধীনতা নিয়ে  আপনি একাধিকবার সরব হয়েছেন। জানতে ইচ্ছে করে  ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে আপদকালীন সময়ে বাকস্বাধীনতা নিয়ে আপনি কখনো প্রশ্ন করেছেন কিনা? পশ্চিমবঙ্গে বাক স্বাধীনতা না  ছিল গণশক্তির যুগে না আছে জাগো বাংলার যুগে! সন্ময় বন্দোপাধ্যায় কিংবা আরামবাগ টিভির সাংবাদিকদের উপর কি হয়েছে জানেন? CTVN এর উপর কি হয়েছিল জানেন? সামান্য একটি অনলাইন ব্লগ The Bengal owl এর সাথে কি হয়েছে জানেন? 

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের স্বপ্নের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটিকে  আপনি কার্যত  দায়িত্ব নিয়ে ডুবিয়েছেন। ৯ মাসের কন্ট্রাক্ট থেকে যিনি  ন বছর স্বাচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারেন, তিনি ১৩ ডেসিমেল জমি জবরদখল করে রাখতে পারেন এ নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা কমিটিতে থেকে আপনি আমাদের প্রিয় প্রেসিডেন্সিকে লোহিয়া-কোনার প্রাইভেট লিমিটেডে পরিণত করে দিয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক তৈরি করে লক্ষাধিক বাংলাদেশী মানুষের অর্থনীতিতে উপকার করেছিলেন মহম্মদ ইউনিস। তার জন্য তিনি নোবেল পেয়েছিলেন। অবসরের উর্ধ্বসীমা অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য তাকে সেই গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। তাহলে কেন আমাদের দেশে শুধুমাত্র নোবেলজয়ী বলে আপনাকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হতে থাকবে? 

বহুদিন বিদেশে বসে দেশের বিভিন্ন কমিটিতে বসে ভালোই দিন কেটেছে আপনার। এখন সব কমিটি হাতছাড়া। তাই বোধহয় চা-ওয়ালার ওপর আপনার খুব রাগ। যদি গান্ধী পরিবারের থেকে আবার একটা রিমোট কন্ট্রোল কাউকে এনে বসানো যায় তবেই শেষ জীবনে আপনার কোন কমিটিতে ফোকটে জায়গা হতে পারে। আপনার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের  ভাড়া করা বুদ্ধিজীবীর দল তো আছেই- চেষ্টা চালিয়ে যান। আমরাও আছি, আমাদের চা-ওয়ালার সঙ্গে। 

রুদ্র প্রসন্ন ব্যানার্জী, গবেষক 

অ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.