মহাকাল, সন্ন্যাসী তুমি।

তোমার অতলস্পর্শ ধ্যানের তরঙ্গ-শিখরে

উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে সৃষ্টি

আবার নেমে যাচ্ছে ধ্যানের তরঙ্গতলে।

প্রচণ্ড বেগে চলেছে ব্যক্ত অব্যক্তের চক্রনৃত্য,

তারি নিস্তব্ধ কেন্দ্রস্থলে

তুমি আছ অবিচলিত আনন্দে।

১৯০৫ সাল, দেশ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তাল ,স্থান মেদিনীপুর , বছর শেষ হয়ে আসছে ; হাড় হিম করা শীত পড়েছে। 

হ্যাঁ, নভেম্বর ডিসেম্বর মানে বাঙ্গালার অঘ্রাণ পৌষ মাসে  তখন বঙ্গে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা পড়ত। তায় জাগায়টা মেদিনীপুর। সেখানের মাঘ মাস আগমনের পূর্বেই শীতের প্রকোপে বাঘ নিজে থেকেই পালাত। তাছাড়া সন্ধ্যা হলেই সে সময় রাস্তাঘাট নিঝুম হয়ে যেত , তার উপর শীত কাল ,সুতরাং রাস্তায় একটা অলৌকিক নিস্তব্ধতা , নির্জনতা বিরাজ করত। 

এমনি এক সন্ধ্যায় নিঝুম মেদিনীপুরের রাস্তা দিয়ে বাইকে করে যাচ্ছিলেন হেমচন্দ্র ( দাস) কানুনগো। এমন সময় তিনি বাইকের আলোয় দেখলেন রাস্তা থেকে কিছু দূরে কয়েকজন ছেলে গুটিসুটি মেরে জটলা করে বসে আছে। এমন শীতের রাত্রে এই এমন করে কারা রাস্তার ধারে বসে থাকতে পারে ? হয় আর্ত ,না হয় চোর ডাকাত আর না তো…..আচ্ছা যা উনি ভাবছেন তাই নয়তো। আরেকটু এগিয়ে গেলেন …এমন সময় সেই জটলার মধ্যে থেকে একটি রোগা পাতলা ছোট ছেলে দৌড়ে এসে হেম বাবুর বাইক থামিয়ে অত্যন্ত সহজ সরল গলায় বললে , ” আমাকে একটি রিভলবার দিন। “

তখন হেম বাবুর নিকট রিভলবার থাকত । তিনি অস্ত্র শিক্ষা দিতেন। হেম বাবু অবাক হয়ে ভাবলেন, এমন কথা এই বাচ্চা ছেলেটি কি করে জানল ? এই বাচ্চাটি যখন জানে তাহলে ব্যাপারটা অনেকের কাছেই কানাঘুষো হয়েছে। মনে মনে বিরক্ত হয়ে হেম বাবু জিজ্ঞাসা করলেন  , ” তোমার নাম কি ?” 

দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর এল , ” আমার নাম ক্ষুদিরাম বসু ।”

হেম বাবু আপাদমস্তক ভালো করে ছেলেটিকে দেখলেন। দেখতে ছোটখাটো পাতলা হলেও শক্ত ও দৃঢ় ছেলেটির মধ্যে যেন একটা তুষ চাপা আগুন আছে। জিজ্ঞাসা করলেন , ” তোমাকে দেখে তো বেশি বয়স মনে হয় না । তোমার সঠিক বয়স কত ? “

উত্তর এল , ” আজ্ঞে , সেভাবে হিসাব করলে চৌদ্দ বছর। “

বিরক্ত কন্ঠে হেমচন্দ্র বললেন , ” তোমাকে কে বলেছে আমি রিভলবার রাখি ? আর তুমি যথেষ্ট ছোট। এসব  না করে পড়াশুনায় মন দাও । আমার কাছে ওসব নেই । পথ ছাড়ো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। “

তাতে কিছু মাত্র অপ্রতিভ না হয়ে ,অদ্ভুত জেদী কন্ঠে ক্ষুদিরাম বললে, ” আমার একটা রিভলবার লাগবে এবং সেটা আজ , এখনই। আমার কাছে পাক্কা খবর আছে যে আপনি অস্ত্র দেন এবং অস্ত্র চালনাও শেখান। না দিলে , আমি পথ ছাড়ব না। “

এমন ভাবে ক্ষুদিরামকে জেদ ধরতে দেখে হেমচন্দ্র বাবু জিজ্ঞাসা করলেন , ” কি করবে তুমি রিভলবার নিয়ে ? “

উত্তরে হিংস্র কন্ঠে ক্ষুদিরাম উত্তর দিল , ” একটা সাহেব মারব। “

হেমচন্দ্র একটি চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মধ্যে এমন হিংস্রতা , এমন আক্রোশ , এমন প্রতিহিংসার লক্ষণ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বললেন , ” কেন ? হঠাৎ সাহেব মারবে কেন ? “

তাতে ক্ষুদিরাম সাপের মতো হিসহিসে গলায় বললে, ” দেশটা তো আমাদের , দেশটার নাম তো ভারতবর্ষ। দেশ মানে তো মা। সেই মাকে ব্রিটিশরা পদলেহিত করছে। ভারতেই থেকে ভারতের মানুষকে তারই মাটি হতে বেদখল করছে। দেশের মানুষ পদে পদে ব্রিটিশ দ্বারা অত্যাচারিত। এখন বঙ্গভঙ্গ করে দেশের ঐক্য বিনষ্ট করতে চাইছে। এসবের প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে । “

হেমচন্দ্রের মন যে কেমন করে উঠল , তা কেবল তাঁর মনই জানে। এত কচি একটা ছেলে অথচ তার মধ্যে এমন স্ফুলিঙ্গ রয়েছে এমন ভাবতেও তিনি কেঁপে উঠলেন। মনে মনে ভাবলেন ,এ ছেলেকে যদি আমি ছাত্র হিসাবে পাই তবে দেশোদ্ধারের অন্যতম যোদ্ধা বানাব। এমন মহারথী নির্মাণ করব যে, তাকে যুগ হতে যুগান্তরে মানুষ হৃদয়ের আসনে মহারাজ করে রাখবে। এমন যোদ্ধা নির্মাণ করব যে ,সে কিংবদন্তিতে পরিণত হবে। মানুষের গৃহে সে পূজা পাবে যোদ্ধা রূপে। কিন্তু তখনকার মতো মনের উদ্দীপনা চেপে রেখে , রাগ ও বিরক্তির ভান করে হেম বাবু বললেন , ” চুপ করো বাচাল ছেলে। পড়াশুনা করো। তোমার বয়স কম । এসবে এখনি মাথা দিচ্ছ তা বাড়িতে জানে ? আমার পথ ছাড়ো‌।  তোমাকে এসব খবর যে বা যারা দিয়েছে সব মিথ্যা….”

হেমচন্দ্র চলে এলেন সেই হিম শীতল নিঝুম পথ ছেড়ে। মন না চাইলেও একবার তিনি ক্ষুদিরামের মুখের পানে চাইলেন। দেখলেন মনঃক্ষুন্ন হয় নি সে , তবে হেম বাবুর এমন ব্যবহারে অবাক তো হয়েছে বটেই। 

এরপর একদিন হেমচন্দ্র ( দাস ) কানুনগো  , সত্যেন্দ্রনাথের নিকট ক্ষুদিরাম সম্পর্কে সকল কথা জানতে পারলেন। সত্যেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে সেই অগ্নিযুগে মেদিনীপুর শহরে যেসব ছাত্র ও যুবা বৈপ্লবিক দলে যোগদান করেন তাঁদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ী ক্ষুদিরাম অন্যতম ছিলেন। ১৯০৮ সালের এপ্রিলে ক্ষুদিরাম হেমচন্দ্র ( দাস) কানুনগোর কলকাতার বাসগৃহ হতে চিরবিদায় নিয়ে মজঃফরপুর যাত্রা করেন।  সেই যাত্রা সমাপ্ত হয় গন্ডক নদীর তীরে।  

মৃত্যঞ্জয় ক্ষুদিরাম এবং সত্যেন্দ্রনাথ  উভয়ই হয়ে উঠেছিলেন হেমচন্দ্র কানুনগোর প্রিয় সাথী এবং শিষ্য। উভয়কেই হেমচন্দ্র বীরের সাজে সজ্জিত করে অকম্পিত হৃদয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন। হায় বিধাতা , সে বিদায় ক্ষণের ছবি কেবল মহাকালই অঙ্কন করে কালের পটে ধরে রেখেছেন।

ক্ষুদিরাম বসুর অন্যতম বিপ্লবী সহকর্মী ছিলেন উকিল শ্ৰীশচন্দ্র পট্টনায়ক ।  পট্টনায়ক মহাশয় কর্তৃক শ্রদ্ধেয় শ্ৰীঈশানচন্দ্র মহাপাত্রকে লেখা একটি পত্ৰ থেকে জানা যায় – 

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম থেকেই শ্রীশচন্দ্র পট্টনায়ক সেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। মেদিনীপুর অঞ্চলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতা ছিলেন শ্রদ্ধেয় সত্যেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়। শ্রীশচন্দ্র পট্টনায়ক, ক্ষুদিরাম , যোগজীবন ঘোষ এবং অন্যান্য কর্মীবৃন্দ তাঁর নিকট হতে উপদেশ এবং দৈনন্দিন কর্মসূচী গ্রহণ করতেন। তিনি প্রত্যেকের যোগ্যতা অনুসারে পৃথকভাবে এবং একত্রে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা , চরিত্রগঠন এবং লক্ষ্য কি হবে বুঝিয়ে দিতেন। শ্রীশচন্দ্র পট্টনায়ক , ক্ষুদিরাম এবং যোগজীবন একসঙ্গে বহুদিন ব্যায়ামচর্চা করতেন। লাঠি- তলোয়ার চালনা এবং কুস্তিতে অনেক অনেক নতুন বিষয় ক্ষুদিরাম ও যোগজীবনের নিকট হতে কর্মীরা শিক্ষা পেতেন। মাঝেমধ্যে বন্দুক ও রিভলবার ইত্যাদির ব্যবহার গোপনে শহরের পশ্চিমে একটি গুপ্ত অঞ্চলে শিক্ষা করা হত এবং ক্ষুদিরাম প্রায়ই সই সঙ্গে থাকতেন। 

সে সময় হেমচন্দ্র মেদিনীপুর অঞ্চলের বিপ্লবীদের একজন প্রধান ছিলেন। স্বয়ং সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর নিকট হতে পরামর্শ ও সহযোগিতা গ্রহণ করতেন।  শ্ৰীব্রজবিহারী বর্মন লিখিত #ফাঁসীর_সত্যেন গ্রন্থে জানা যায় যে , বিশেষ বিশেষ বিপ্লবের কর্মীরা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে হেমবাবুর গৃহে গিয়ে রিভলবার চালনা অভ্যাস করতেন। মাঝে মাঝে হেমবাবুও সকলকে নিয়ে শিকারে যেতেন। 

মেদিনীপুর শহরের পুরাতন মহারাষ্ট্র কেল্লাটি বেশ কিছুদিন ব্রিটিশ সরকার জেল হিসাবে ব্যবহার করেছিল। তাই লোকে সে সময় ওই কেল্লাকে পুরাতন জেল বলত। ১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানে একটি কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রদর্শনীর দ্বারেই ক্ষুদিরাম #সোনার_বাংলা পুস্তিকা বিতরণ করেন। সেই অপরাধে ক্ষুদিরামের বিরুদ্ধে  রাজদ্রোহের মামলা রুজু হয়। এই প্রথম বঙ্গে বিপ্লববাদের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ হয়। যদিও নির্ভরযোগ্য প্রমাণের অভাবে ব্রিটিশ সরকারকে সেই মামলা পরে প্রত্যাহার করতে হয়। এর কিছুদিন পরেই হেমচন্দ্র কলকাতায় চলে আসেন এবং নানা ঘটনাক্রমে বিস্তৃত কর্মক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে মেদিনীপুরের সঙ্গে হেমচন্দ্রের সংযোগ সাময়িকভাবে ক্ষীণ হয়ে পড়লেও – মেদিনীপুর জেলার বিপ্লবদীক্ষার অন্যতম আদিগুরু রূপে তিনি যে বীজ বপন করেছিলেন তা বঙ্গ তথা ভারতের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

হে নির্মম, দাও আমাকে তোমার ঐ সন্ন্যাসের দীক্ষা।

জীবন আর মৃত্যু, পাওয়া আর হারানোর মাঝখানে

যেখানে আছে অক্ষুব্ধ শান্তি

সেই সৃষ্টি-হোমাগ্নিশিখার অন্তরতম

স্তিমিত নিভৃতে

দাও আমাকে আশ্রয়।

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ  ১) বাংলায় বিপ্লবের প্রচেষ্টা

২) শহীদ ক্ষুদিরাম

৩) অগ্নিযুগের অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.