২০২১অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে গাড়ি বিক্রির বাজারে টাটার অংশীদারিত্ব বেড়ে ৮ শতাংশে পৌঁছেছে

মূল বক্তব্য:-

◆আন্তর্জাতিক NCAP ক্র্যাশ পরীক্ষায়, টাটা কোম্পানীর উৎপাদিত সমস্ত যাত্রীবাহী ছোট গাড়ি, চার থেকে পাঁচটি স্টার লাভ করেছে, যা এদেশের গাড়ি  কোম্পানীগুলির মধ্যে প্রথম।

◆টাটা যে সুজুকি কোম্পানীর গাড়িগুলির বিশ্রী নির্মাণমান ও প্রায় শূন্য সুরক্ষামান নিয়ে বিদ্রুপ করে, তা বিনা কারণে নয়।

ভারতবর্ষের উৎপাদন-শিল্পের মেরুদন্ড অটোমোবাইল শিল্প সমগ্র দেশের মোট শিল্প উৎপাদনের চল্লিশ শতাংশ দখল করে আছে। এর মধ্যে অর্ধেক ই হল ছোট যাত্রীবাহী গাড়ি শিল্প।

অনেক বছর, বিশেষত শেষ দশকে এই শিল্পটি সুসময়ের মধ্যে দিয়ে গেলেও, শেষ চার বছরে ‘বাধ্যতামূলক ভাবে বি. এস. ফোর (BSIV) থেকে বি. এস. সিক্স (BSVI) এ পরিবর্তন’ বা ‘পণ্য পরিষেবা কর’ এর প্রণয়নে শিল্পটি বেশ কিছুটা মন্দার মুখ দেখেছে। কোভিড সংক্রমণ এবং নোটবন্দী ও ব্যবসায় ক্ষতির কারণগুলির মধ্যে অন্যতম।

এসবসত্ত্বেও, টাটা মোটরস কোম্পানীর , বিশেষত ছোট যাত্রীবাহী গাড়ি শিল্পে চিত্তাকর্ষক হারে উন্নতি হয়েছে।

২০১৫ সালে টাটা ১লাখ ৩০হাজারের কিছু বেশী গাড়ি বিক্রি করে ৩.৫% অংশীদারিত্ব সহ গাড়ি বাজারের ষষ্ঠস্থান লাভ করে। 

গাড়ি বিক্রিতে টাটার আগে স্থান লাভ করেছিল মারুতি, হুন্ডাই, মাহিন্দ্রা ও মাহিন্দ্রা,হোন্ডা ও টয়োটা নামক কোম্পানীগুলি।

২০২০ বর্ষের শুধু ডিসেম্বর মাসেই, টাটা ২৩,৫০০-র অধিক গাড়ি বিক্রি করেছে, যা তার অক্টোবরের বিক্রিত গাড়ি থেকে কিছু কম। ২০২০ সালের অক্টোবরে টাটার গাড়ি বিক্রির পরিমাণ ছিল ২০১২ সালের পরে সর্বাধিক।

২০২১অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে গাড়ি বিক্রির বাজারে টাটার অংশীদারিত্ব বেড়ে ৮ শতাংশে পৌঁছেছে। মনে রাখতে হবে, কোম্পানীটির এই সাফল্য এসেছে মহামারীর বছরে। কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, এই লড়াইয়ে টাটা পিছনে ফেলে দিয়েছে মাহিন্দ্রা ও মাহিন্দ্রা, এবং কিয়া মোটরস-কে,, সেই কিয়া মোটরস, যে ভারতের বাজারে নতুন এসেই যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে।

এমন নয় যে টাটা এর আগে ভারতীয় ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় ছিলনা। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া, এবং সময়ের সাথে উন্নতি না করতে পারায়, তারা অন্য কোম্পানি গুলির কাছে নিজের স্থান খোয়ায়।

এস. ইউ. ভি.(SUV) প্রেমীদের জন্য টাটা সাফারী একদশকের বেশি সময় ধরে, আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল। এটি ছিল দেশের প্রথম স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল। টাটা ইন্ডিকা তার সময়ে অন্যতম সর্বাধিক বিক্রিত গাড়ি ছিল। বাজারে আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই একলক্ষের ও বেশি টাটা ইন্ডিকা অগ্রিম বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তিন বছরে এক লাখের বেশি বিক্রিত টাটা সুমো, কোম্পানির সাফল্যের অন্যতম দৃষ্টান্ত।

টাটার অন্যতম উচ্চাকাঙ্খী প্রজেক্ট “ন্যানো”বাজারে  আসা পরেই তার সাফল্যের গতি হ্রাস পায়। যাই হোক, গত পাঁচবছরে টাটা মোটরস্ তার হারানো জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা করে চলেছে, যা বোঝা যায় তার ২০১৫ সাল অব্দি বাজারে আসা সবকটি পুরনো মডেলের গাড়ির উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া দেখে। ২০১৬ সাল থেকে যে মডেলগুলি আনা হয়েছে সেগুলি সব আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। গত চারবছরের উৎপাদিত নতুন মডেলের তালিকায় রয়েছে – টিয়াগো, টিগোর, আলট্রোজ, নেক্সন, হ্যারিয়ার। টাটা তার পুরানো গাড়িগুলোরও উন্নতি ঘটিয়েছে।

টিয়াগো এবং নেক্সনের উন্নততর সংস্করণ এবছর বাজারে এসেছে।গত বছরে বাজারে আসা হ্যারিয়ারে  এবছর বেশকিছু সংযোজন ঘটানোর ফলে এটি উন্নততর হয়েছে।

পাঁচ থেকে কুড়ি লাখের মধ্যে সবরকম বাজেটের গাড়ি , টাটা তার ক্রেতাদের জন্য রেখেছে।

◆বাজেট হ্যাচব্যাকের জন্য টিয়াগো

◆প্রিমিয়াম হ্যাচব্যাকের জন্য আলট্রোজ

◆সেডানের জন্য টিগর

◆কম্প্যাক্ট SUV এর জন্য নেক্সন

◆প্রিমিয়াম SUV এর জন্য হ্যারিয়ার

হুন্ডাই, কিয়ার মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সাথে ডিজাইন, মাইলেজ, নকশা, আরাম, এসবক্ষেত্রে পাল্লা দেওয়া (যদিও বৈশিষ্ট্য ও পরিষেবা প্রদানের দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা) টাটা সুরক্ষাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক NCAP ক্র্যাশ পরীক্ষায় টাটার নতুন আসা গাড়িগুলির চার থেকে পাঁচটি স্টার প্রাপ্তি হয়েছে, যা ভারতবর্ষের গাড়ি উৎপাদকদের মধ্যে প্রথম। এমন নয় যে, কোনো কারণ ছাড়াই টাটা, মারুতির গাড়িগুলির খুব ই নিম্ন নির্মাণমান ও প্রায় শুন্য সুরক্ষামান নিয়ে উপহাস করে।

গাড়ি উৎপাদক সংস্থাগুলি ভারতবর্ষের যাত্রীদের জন্য সুরক্ষিত গাড়ি তৈরির দিকে কোনো নজরই দেয়না, অথচ তারাই ইউরোপ, আমেরিকার মত প্রথম শ্রেণীর দেশগুলিতে উন্নত মানের গাড়ি সরবরাহ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, “কিয়া সেলটস”,একটি ১৫লাখের অধিক দামসম্পন্ন গাড়ি, GNCAP ক্র্যাশ পরীক্ষায় মাত্র তিনটি স্টার পাচ্ছে। অন্যদিকে, পাঁচ লাখের অধিক দামসম্পন্ন টাটা টিয়াগো পাঁচটি স্টার ছিনিয়ে নিয়েছে সেই একই পরীক্ষায়। আবার অস্ট্রেলিয়ায় বিক্রিত এই একই “সেলটস”, এই একই পরীক্ষায় পাঁচটি স্টার পাচ্ছে।

একইভাবে, মারুতি সুজুকির এস-প্রেসো এই পরীক্ষায় শুন্যলাভ করছে, অথচ তারা তাদের দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতাবান ক্রেতাদের আশ্বস্ত করছে যে, ভারতবর্ষের বিক্রিত মডেলগুলি দক্ষিণ আফ্রিকা তে বিক্রীত মডেলের তুলনায় অনেক নিম্নমানের। এইভাবেই, ভারতবর্ষের আর্থিক বাজারে অধিকতর মার্কেট শেয়ার লাভ করেও, কোম্পানিগুলি ভারতীয় ক্রেতাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

কাজেই, এটা আশ্চর্য্যের নয় যে, টাটা সংস্থা কেন নিজেকে ভারতের সবথেকে সুরক্ষিত গাড়ি প্রস্তুতকারী হিসেবে স্থাপন করতে চাইছে। যদিও, তার পুনরুত্থানের পিছনে এটাই একমাত্র কারণ নয়, কিন্তু একটি অন্যতম কারণ।

আলট্রোজ গাড়িটিকে IPL সম্প্রচারের সময় , টাটা তার বিজ্ঞাপনে ভারতের সবথেকে সুরক্ষিত গাড়ি হিসেবে প্রচার করেছিল। এখনো অবধি, গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি বেশি মাইলেজসম্পন্ন গাড়ি প্রস্তুতকরার জন্য গাড়ির নিরাপত্তার সঙ্গে আপোষ করে এসেছে। কারণ, বেশিরভাগ ভারতীয়ের মধ্যে তারা এই মানসিকতা ঢুকিয়ে দিয়ে পেরেছিল যে “কিতনা দেতি হ্যায়”, অর্থাৎ গাড়ীটির মাইলেজ কত। এজন্য তারা পাতলা ও সস্তা সামগ্রীর দ্বারা গাড়ি তৈরি করছিল, কিন্তু উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর জনসংখ্যাবৃদ্ধির সাথে সাথে এই মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে।

দেশে  SUV গাড়ির বিক্রি ক্রমবর্ধমান, কিন্তু যদি SUV উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি অসুরক্ষিত গাড়ি তৈরি করতে থাকে, তাহলে নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়বে।ঠিক এই কারণেই টাটার গাড়ি বিক্রির বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ।

কেন্দ্রীয় সরকারের ও এবিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন, যাতে গাড়ি প্রস্তুরকারী সংস্থাগুলি গ্রাহকদের বোকা না বানাতে পারে। উৎপাদনকারী অনেক বিষয়ে দোষী হলেও, কেন্দ্রীয় সরকার ও এবিষয়ে প্রশ্নের ঊর্ধে নয়। যাত্রীবাহী গাড়ি তৈরির ব্যাপারে বর্তমানের নীতিগুলির আশু পর্যালোচনা একান্ত প্রয়োজনীয়।

শুধুমাত্র গাড়ির দৈর্ঘ্যের ওপর প্রযুক্ত কর নির্ণয় না করে, নিরাপত্তাকে মূল মাপকাঠি হিসাবে গণ্য করা উচিত। ক্রেতাদের ডিজেল গাড়ি কেনার থেকে নিরুৎসাহীত করতে করের হার ইঞ্জিনের আকারের ওপর ভিত্তি না করে, সেটি পেট্রোল না ডিজেল গাড়ি সেই ভিত্তিতে হওয়া উচিত।

ভারতে গাড়ির ওপর করের হার অদ্ভুতভাবে বেশি। কমদামি হ্যাচব্যাক গাড়ির ক্ষেত্রে তা ৩০% থেকে দামী SUV এর ক্ষেত্রে ৭০% অবধি হয়ে থাকে। GSTর হারকে পরিবর্তিত করে, অধিক নিরাপত্তাসম্পন্ন উন্নতমানের গাড়িগুলি প্রস্তুতিতে উৎসাহ দেওয়া যেতেই পারে।

যে গাড়িগুলি ক্র্যাশ টেস্টে ভালো ফল করে, সেগুলির ক্ষেত্রে করের বোঝা কমানো যেতে পারে। এভাবে মারুতি সুজুকির মতো যে সংস্থাগুলি সারা গাড়িবাজারের অর্ধেকের ও বেশি জুড়ে আছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গ্রাহকদের চাপ তা করতে বাধ্য করবে।

টাটার সাম্প্রতিক সাফল্য অন্যান্য গাড়িপ্রস্তুতকারী সংস্থার কাছে একটি বার্তাস্বরূপ। কিন্তু, যতক্ষন না সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে, এই কোম্পানিগুলি নিজেদের সংশোধন করবে না, কারণ গাড়িবিক্রির ক্ষেত্রে সবথেকে ওপরে থাকা দুটি সংস্থাই একচেটিয়াভাবে বাজারের ৭০% নিয়ন্ত্রণ করে।এখন আইনপ্রণেতাদের আগের নীতিগত ত্রুটি গুলি সংশোধন করে নেওয়া প্রয়োজন।

DEBDAS

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.