পরতেন কম দামের মোটা খোটা ধুতি, চাদর, গেঞ্জি অথবা গায়ে একটি কোট। খাওয়া দাওয়াও ছিলো একবারেই সাধারণ। সকালে মাত্র এক পয়সার নাস্তা। এক পয়সার বেশি নাস্তা হলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন তিনি। অনান্য খাবারদাবারও ছিল খুবই সাদামাটা। তখন তাঁর মাসিক আয় হাজার টাকার উপরে। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় দান করেছিলেন ১ লাখ ৩৬ হাজার বেশী। নিজের জন্য মাত্র ৪০ টাকা রেখে বাকি সব দান করে দিতেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে।
.
বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার সুফলকে যিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন গণ মানুষের কাতারে। আজীবন তাঁর সৃষ্টির সুফল ভোগ করেছে এদেশের মানুষ।
.
আজীবন প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলতেন ‘সবার আগে মানুষ, তারপর ধর্ম।’ ১৯২৫ সালে ড. কুদরতে খুদা প্রেসিডেন্সী কলেজে থেকে রসায়নে প্রথম বিভাগ পেয়েছিলেন। বহু শিক্ষক এই নাম্বার দেয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। বলেছিলো ও একজন মুসলমান হয়ে প্রথম বিভাগ পাবে এটা মেনে নেয়া যায়না। কিন্তু শত বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন, ‘ও যোগ্য। ও অবশ্যই পাবে। ও মেধাবী, ওর মেধার পরিচয় ওর খাতায়। ধর্মে নয়। ধর্ম কখনো মেধার নির্ণায়ক না।’
.
জীবনে বিয়ে করার অবসরটুকু পাননি পিসি রায়। এতো বিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও থাকতেন কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের একটি অতি সাধারণ কক্ষে। আসবাবপত্রের মধ্যে ছিলো একটি খাটিয়া, দুটি চেয়ার, ছোট একটি খাবার টেবিল, একটি পড়ার টেবিল ও জামাকাপড় রাখার একটি সস্তা আলনা। এই ছিলো তাঁর আসবাবপত্র।
.
ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নাম লেখা ছিল ‘বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী’। স্বদেশি আন্দোলনের প্রথম পর্যায় থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যখন বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন গোপনে অস্ত্র ক্রয়ের জন্য তিনি বিপ্লবীদের অর্থ সাহায্য করতেন।
.
একবার ভারতের অবস্থা জানার জন্য ইংল্যান্ডে সাইমন কমিশন গঠন করা হয়। লন্ডনেই তাঁরা কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের অনেক সুনাম শুনেছেন। তাঁরা আরও জানতে পারেন বিজ্ঞান কলেজে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী আছেন। এবং তখনই তাঁরা বিজ্ঞান কলেজ পরিদর্শনে আসতে চাইলেন। একদিন দুপুরের দিকে কমিশনের সদস্যরা বিজ্ঞান কলেজে এলে দেখেন পিসি রায় গামছা পরে ধুতিখানা রোদে শুকাচ্ছেন।
ঘরে ঢুকে দেখে এক কোণে স্টোভে রান্না হচ্ছিল। অন্যদিকে সাদামাটা একটা খাট। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল আর একটা সাধারণ চেয়ার। পোশাক রাখার জন্য একটা কমদামি আলনা। ঘরের অবস্থা দেখে তাঁরা বলেই ফেললেন, একি মানুষ নাকি দেবতা?
.
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “সংসারে জ্ঞানী তপস্বী দুর্লভ নয়, কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে চরিত্রে ক্রিয়া প্রভাবে তাকে ক্রিয়াবান করতে পারে এমন মনীষী সংসারে কদাচ দেখতে পাওয়া যায়।” রবীন্দ্রনাথের সাথে ছিলো তাঁর পরম বন্ধুত্ব।
.
পিসি রায়ের ৭০তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই মঞ্চেই প্রফুল্লচন্দ্র রায় পড়েছিলেন ‘পূরবী’, ‘বলাকা’, ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে অসংখ্য কবিতা। সম্পূর্ণ নিজের স্মৃতি থেকে মুখস্থ বলেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মজা করে লিখেছিলেন “যেসব জন্ম সাহিত্যিক গোলমেলে ল্যাবরেটরির মধ্যে ঢুকে পড়ে জাত খুইয়ে বৈজ্ঞানিকের হাটে হারিয়ে গিয়েছেন তাঁদের ফের জাতে তুলবো।”
.
শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গীতকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। আর রবীন্দ্রনাথ নিজেও তো বিজ্ঞানের সমাদর করতে অবহেলা করেননি কখনও। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় একাধারে ছিলেন একজন কবিও। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা ‘রবি প্রয়াণ’। রবীন্দ্রনাথ আর পি সি রায়ের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল মাত্র ৩ মাস।
.
তাঁর জীবনের সবটুকু জুড়েই ছিলো এদেশের মানুষ। বলতেন, ‘ আমার সমস্ত কিছুর কেন্দ্রবিন্দুই এদেশের মানুষ ভালো থাকবে বলে।’ আমরা আজ যে সমবায়ের কথা বলি তাঁর জনক ছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। আজ যে আমরা মারকিউরাস নাইট্রাইড (HgNO2) ব্যবহার করি তার জনকও তিনি, বাংলার শিল্প বিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছে তাঁর হাত ধরেই।
১৮৮৩ সালে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে প্রফুল্লচন্দ্র রায় সুযোগ পেয়েছিলেন স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। বিশ্বখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি বিএসসি পাশ করেছিলেন। এডিনবরায় তাঁর করা পিএইচডির গবেষণাপত্রটি সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে মনোনীত হওয়ায় তিনি পেয়েছিলেন ‘হোপ প্রাইজ’।
.
কিন্তু দেশ ছেড়ে ইউরোপে পড়ে থাকতে ভালো লাগেনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের। দেশের মাটি ছিলো তাঁর আত্মার অন্তরের অন্তরস্থলে। তাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৮ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় চলে এলেন স্বদেশে। দেশে ফিরে যোগ দিলেন প্রেসিডেন্সী কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। ঠিক এমন সময়ই তিনি দেখলেন বাঙালিদের ব্যবসা নিয়ে হীনমন্যতা। চাকরির পিছনে উম্মাদের মতো ছুটে চলা। এ যেন সোনার হরিণের পিছু ধাওয়া।
.
তিনি ভাবলেন দেশীয় সম্পদ আর দেশীয় শিল্প বিপ্লবের কথা। ভাবলেন নতুন করে কিছু শুরু করতে হবে। আর তাইতো ১৮৯২ সালে কলকাতায় মাত্র ৭০০ টাকা বিনিয়োগ করে গড়ে তুলেছিলেন উপমহাদেশের প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। আজীবন তরুণদের ব্যবসা করতে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। বলতেন ‘লক্ষ্য স্থির করো। ঝুঁকি নাও। কেবল মুখস্ত বিদ্যার জন্য নয়, পড়ো কারিগরি শিক্ষা অর্জনের জন্য।’ আজীবন বলতেন বাঙ্গালী তরুণদের, ‘চাকরি না করে ব্যবসা করো। একটা সমগ্র জাতি শুধুমাত্র কেরানী বা মসীজীবী’ হয়ে টিকে থাকতে পারে না।’
.
খুলনা টেক্সটাইল মিলস ও পিসি রায়ের হাতে গড়া। উপমহাদেশে যে এতো উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী গড়ে উঠেছে, এই যে ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পায়ন, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পিসি রায়ের ছিল অন্যতম প্রধান ভূমিকা। এই যে আমরা সমবায় ব্যবসায়ের কথা বলি। এই সমবায় ব্যবসায়কে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়ই।
.
সবার আগে ছিলো তাঁর মানবতাবোধ। ‘১৯২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় সমগ্র বাংলা ঘুরে ঘুরে অর্থসংগ্রহ এবং ত্রাণকার্য করেছিলেন নিজে। শুধু ১৯২২ নয়, তার আগের বছর চতুর্থ বার ইংল্যান্ড ভ্রমণ শেষে তিনি দেশে ফিরলেন। , খুলনা জেলার সুন্দরবন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলেন। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছিলেন,
‘‘দুর্গতদের সেবাকার্যের ব্যবস্থা এবং দেশবাসীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিবার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করিলাম। দেশবাসী সর্বান্তকরণে সাড়া দিল— যদিও গবর্নমেন্ট সরকারীভাবে খুলনার দুর্ভিক্ষকে স্বীকার করেন নাই।’’
.
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা কলেজে বিজ্ঞান ক্লাসে ইংরেজিতে লেকচার দিতেন শিক্ষকেরা। প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি হওয়া স্বত্বেও পিসি রায় ক্লাসে বাংলায় লেকচার দিতেন। বাংলা ভাষা ছিলো তাঁর অস্তিত্বের সাথে মিশে। প্রতিটি ছাত্রের প্রতি ভীষণ যত্নবান। ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর মতো এতো দারুণ শিক্ষক আর খুঁজে পাওয়া যায়না। আজীবন বিজ্ঞান দিয়ে মূল্যায়ন করতেন।
আজীবন আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন মানবিক ও যুক্তিনির্ভর। রসায়ন ক্লাসের ঘটনা। একবার রসায়ন ক্লাস চলছে। এক ছাত্র হাড় দিয়ে তান্ত্রিক সাধনার কথা বলতো। তিনি শুনে ছাত্রদের সামনে এক টুকরো হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে পুড়িয়ে মুখে পুরে দিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বললেন, ‘ এটা ক্যালসিয়াম ফসফেট। এছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা কোন প্রাণীর হাড় তা-ও আর চেনার উপায় নেই।’ রসায়ন দিয়ে শুধু রসায়ন শিক্ষাই নয়, ছাত্রদের মনে ধর্মান্ধতার মূল উপড়ে ফেলেছিলেন তিনি।
প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মূল মন্ত্র ছিল তাঁর দেশসেবা। চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে লেখা তাঁর চিঠি পড়লেই বোঝা যায়। তিনি লিখেছিলেন ‘‘প্রিয় ভগিনী, আমি আপনাকে নিশ্চিতরূপে বলিতে পারি যে, যখন বিজ্ঞান চর্চা করি, তখন বিজ্ঞানের মধ্য দিয়া দেশকেই সেবা করি। আমাদের লক্ষ্য একই, … আমার জীবনের অন্য কোনও উদ্দেশ্য নাই।’’ মারকিউরাস নাইট্রাইড (HgNO2) এর আবিস্কারক ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। যেটি সারাবিশ্বে আলোড়িত হয়েছিলো। কেবল এটিই নয় , ১২টি যৌগিক লবণ, এবং ৫টি থায়োএস্টারের আবিস্কারক ও তিনি।
একবার শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ৫-৬ দিন ক্লাসে না আসায় একদিন বিকেলে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁর বাসায় যান। ফজলুল হক তখনও খেলার মাঠে থাকায় তিনি তাঁর জন্য অপেক্ষা করেন। ফজলুল হক ফিরে এসে স্যারকে দেখে তিনি কতক্ষণে এসেছেন জানতে চাইলে বলেন ‘তোমাদের হিসেবে এক ঘন্টা আর আমার হিসেবে ষাট মিনিট’। ভীষণ সময়ানুবর্তিতা ছিলো আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের।
.
তাঁর ছাত্ররাও ছিলেন জগদ্বিখ্যাত। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, নীলরতন ধর, পুলিন বিহারী সরকার, রসিকলাল দত্ত, মেঘনাদ সাহা, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বিজ্ঞানী কুদরত-ই খুদা, হেমেন্দ্র কুমার সেন, বিমান বিহারী দে, প্রিয়দা ভঞ্জন রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্র লাল দে, প্রফুল্ল কুমার বসু, বীরেশ চন্দ্র গুহ, অসীমা চ্যাটার্জির মতো কিংবদন্তিরা।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এমন এক বিজ্ঞানী ও মানব দরদী মহামানব তা হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যাবেনা। এই প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তীর কারণে এদেশের বিজ্ঞান চর্চা এগিয়ে গেছে কয়েক যুগ।
প্রয়াণ দিবসে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।