১৩০০ কোটি বছর আগের ‘মহাজাগতিক ভোরের’ আলো ধরা দিল পৃথিবীতে বসে থাকা টেলিস্কোপে! তখন সদ্য মহাবিস্ফোরণ হয়েছে, যার পরিচিত নাম ‘বিগ ব্যাং’। স্থান এবং কালের জন্ম হয়েছে সদ্য। মহাবিশ্বের সেই শিশুকালে সবে ফুটে উঠছে নক্ষত্রেরা। গড়ে উঠছে ছায়াপথ। সেই আদিকালের মাইক্রোওয়েভ বিকিরণই এ বার ধরা পড়ে গেল দক্ষিণ আমেরিকার চিলির পর্বতে বসানো টেলিস্কোপে। বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেই।
এর আগেও মহাজাগতিক ভোর বা ‘কসমিক ডন’-এর সময়কার বিকিরণের হদিশ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এত দিন তার বেশির ভাগই পাওয়া গিয়েছে মহাকাশে— হাবল স্পেস টেলিস্কোপ কিংবা স্পিটজ়ার স্পেস টেলিস্কোপে। কিন্তু এ বার পৃথিবীতে বসানো টেলিস্কোপেও ধরা দিল ১৩০০ কোটি বছর আগের মহাজাগতিক বিকিরণ! উত্তর চিলির আন্দিজ় পর্বতমালার এক উঁচু জায়গায় বসানো ‘ক্লাস’ (কসমোলজি লার্জ অ্যাঙ্গুলার স্কেল সার্ভেয়ার) টেলিস্কোপ ব্যবহার করে এই ‘কসমিক ডন’-এর হদিশ মিলেছে। বিশেষজ্ঞ মহলের মত, সাম্প্রতিক এই আবিষ্কার থেকে মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা সম্পর্কে নতুন তথ্য মিলতে পারে।
এই ঘটনাকে বিরল এবং উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক সাফল্য বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, ‘কসমিক ডন’ থেকে যে তরঙ্গ বিকিরিত হয়, তা অত্যন্ত ক্ষীণ। সাধারণ মহাজাগতিক বিকিরণের তুলনায় এগুলি প্রায় ১০ লক্ষ ভাগ দুর্বল! এই মাইক্রোওয়েভ সঙ্কেতগুলির তরঙ্গদৈর্ঘ্য এক মিলিমিটারেরও কম। রেডিয়ো সম্প্রচার, রেডার সংকেত, কৃত্রিম উপগ্রহ, এমনকি বাতাসের আর্দ্রতা কিংবা তাপমাত্রা সামান্য এদিক ওদিক হলেই এই খুদে তরঙ্গগুলি হারিয়ে যায়। তাই এই কাজের জন্য ‘ক্লাস’ টেলিস্কোপগুলিকে বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছিল। তার পর কৌশলগত ভাবে সেগুলিকে বসানো হয়েছিল চিলির উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে, যেখানে বাতাসের ঘনত্ব কম— যাতে মহাবিশ্বের নিদাগ, পরিষ্কার দৃশ্য টেলিস্কোপে ধরা দেয়।
‘মহাজাগতিক ভোর’ কী?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আজ থেকে প্রায় ১৩৭০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের পর প্রথম তারারা জন্মায়। জন্মায় স্থান, কাল। ক্রমে এক এক করে নক্ষত্র, ছায়াপথ তৈরি হয়। অন্ধকার চিরে ঠিক যেন ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ে নবীন সেই মহাবিশ্বে! সেই সময়টিই হল ‘কসমিক ডন’— মহাবিশ্বের ভোর। ভোরের সেই তারাদের মৃত্যু হয়েছে আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগে। কিন্তু তারারা না থাকলেও তাদের আলো আজও রয়ে গিয়েছে! বিগ ব্যাংয়ের পরবর্তী পর্যায়ে গোটা ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল অদৃশ্য বিকিরণ। তাতে মিশে গিয়েছিল তারাদের হারিয়ে যাওয়া আলোও। সে সব বিকিরণ এখনও লুকিয়ে রয়েছে মহাবিশ্বের আনাচেকানাচে। যুগ যুগ ধরে সেই তরঙ্গই খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীরা।
‘ক্লাস’ প্রকল্পের এই সাফল্যে মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, এমনটাই বলছেন অধ্যাপক তথা জ্যোতির্পদার্থবিদ টবিয়াস ম্যারেজ। তাঁর কথায়, ‘‘এত দিন মনে করা হত, পৃথিবী থেকে ওই মাইক্রোওয়েভ সিগন্যালের হদিশ পাওয়া অসাধ্য। এ বার তা-ই করে দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।’’ শুধু তা-ই নয়, গবেষকেরা মনে করছেন, এই তথ্য খতিয়ে দেখে মহাবিশ্বের স্থানকালের সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সেই শিশু ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে কিছুটা হলেও নতুন ধারণা মিলতে পারে। জানা যেতে পারে মহাকাশের অজানা রহস্যের ইতিহাস।