গ্রামের মেঠো পথ। সরু অলিগলি ঘুরে পথ থেমে যায় এক মাটির বাড়ির আঙিনায়। সেখানে পরিষ্কার নিকোনো উঠোনে বসে রঙিন সিনেমার পোস্টার ছিঁড়ে ছিঁড়ে ক্যানভাসে সাঁটছেন এক গ্রাম্য বধূ। অবিন্যস্ত এলো খোঁপা থেকে বেরিয়ে থাকা কয়েকটি চুল উড়ে এসে থমকে যাচ্ছে তাঁর উজ্জ্বল দুই চোখের কিনারে। আঁকাবাঁকা কাগজের টুকরোগুলি নখ দিয়ে চিরে সমান করে পিচবোর্ডের ক্যানভাসে এমন ভাবে জোড়া হচ্ছে যে, দেখে বোঝার উপায় নেই তা কাগজখণ্ডের কোলাজ, না কি তৈলচিত্র! প্রকৃতির রূপ-রঙের বৈচিত্র নিয়ে আপাতসরল নিস্পৃহতার গভীরে থাকা আশ্চর্য সব ফর্মেশন, যা বিস্ময়ে হতবাক করে দিতে পারে নগরালির শিল্পবোধকে। যে শিল্পের জন্ম হচ্ছে মাটির কুটিরে তা কোলাজ, যিনি জন্মদাত্রী তিনি কোলাজশিল্পী শাকিলা। বিশিষ্ট শিল্পী বলদেব রাজ পানেসরের মানসকন্যা শাকিলা এই মুহূর্তে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কোলাজশিল্পী।
শাকিলার কোলাজশিল্প এখন কেবল দেশে নয়, ভিন্দেশেও সমাদৃত। তাঁর শিল্পভাবনাকে নতুন রূপে সাজিয়েছে সিমা আর্ট গ্যালারি। শিল্পীর জীবনযুদ্ধ নিয়েই সিমাতে তথ্যচিত্র পরিবেশন করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে শাকিলাকে খুব কাছ থেকে দেখে সেই তথ্যচিত্রটি বানিয়েছেন ছবি নির্মাতা শুভাশিস চক্রবর্তী। বললেন, “কোনও স্টুডিয়ো নেই, কর্মশালা নেই, মাটির বাড়ির ছোট্ট ঘরে বা কখনও উঠোনেই নিজের শিল্পকে জীবন্ত করে তুলছেন তিনি। দামি রং বা তুলির ব্যবহার নেই, কেবল রঙিন কাগজ কেটে তা এত সূক্ষ্ম ভাবে মিলিয়ে দিচ্ছেন যে, তাকে খণ্ডচিত্র বলে বোঝার অবকাশই নেই। ক্যানভাস ও কাগজ মিলে জীবনের ভাঙাগড়াকে বাস্তব রূপ দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখানেই শাকিলার বিশেষত্ব। আর এখানেই তিনি সকলের চেয়ে আলাদা।”

কোলাজের গঠনশৈলী শাকিলার স্বকীয়। ভাবনাও নিজস্ব। কোথাও যুদ্ধের ছবি, কোথাও ধর্ষণের খণ্ডচিত্র তাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন কোনও নারী, আবার কোথাও ভগ্নপ্রায় মাটির বাড়িতে নিত্যকর্মে ব্যস্ত কোনও পরিবার। দৃশ্যগ্রাহ্য প্রকৃতি ও জীবনকে এক-একটি স্তর হিসেবে ভেঙে দেখিয়েছেন বার বার। শাকিলাকে জীবনশিল্পী বললেও ভুল বলা হবে না। মৃদুভাষী গ্রাম্য এক বধূ প্রথাগত আর্ট কলেজের ডিগ্রিধারী নন। অথচ গভীর জীবনবোধ থেকেই গড়ে উঠেছে তাঁর শিল্প। বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে তা পরিবেশিত হয়েছে ক্যানভাসে। সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর গ্রাম, দেশ, এমনকি বিশ্বও। গ্রামের ঘর-সংসার থেকে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের খণ্ডচিত্র উজ্জ্বল রঙে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা ও তা থেকে পরিত্রাণ পেতে মাতৃশক্তিকে আবাহন করেছেন বহু বার। তাই শাকিলার কাজের একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে দেবী কালিকার নানা রূপের ছবি। কখনও তিনি চার হাতে অস্ত্র নিয়ে সমাজকে শাসন করছেন, আবার কখনও মায়ের মতো বরাভয় মুদ্রা দেখিয়ে অবোলা জীবের প্রাণও বাঁচাচ্ছেন। লৌকিকের সঙ্গে অলৌকিকের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এমন এক মনস্তাত্ত্বিক ভুবনকে উন্মীলিত করেছেন শাকিলা, যাকে কোনও বিশেষ সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।


ফুটপাথ থেকে শুরু হয়েছিল শিল্পভাবনা। জীবনের ওঠাপড়াকে কাছ থেকে দেখেই শিখেছেন শিল্পী। সারল্যই তাঁর হাতিয়ার। শিল্পী শাকিলার কথা বলছিলেন সিমা গ্যালারির অধিকর্তা রাখী সরকার। তিনি বলেন, “শাকিলা নির্ভয়। চুপচাপ থাকে ও নিজের কাজ করে যায়। কোলাজশিল্পে প্রতিনিয়ত বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে শাকিলা। যত দিন যাচ্ছে, তার শিল্পভাবনা ও কাজ ততই সমৃদ্ধ হচ্ছে, আরও প্রসারিত হচ্ছে।”

প্রান্তিক পরিসর ও নাগরিক সমৃদ্ধির মধ্যে শৃঙ্খল রচনা করে চলেছেন শাকিলা। শুভাশিস জানালেন, শাকিলার কাজ শুরু হয়েছিল পিচবোর্ডের সাধারণ ক্যানভাস থেকে। রঙিন সিনেমার পোস্টার জমিয়ে রাখতেন তিনি। তাই ছিঁড়ে ছিঁড়ে ক্যানভাসে আঠা দিয়ে সেঁটে কোলাজ বানাতেন। রঙের সাবলীল প্রয়োগ, আলো-অন্ধকারের তারতম্য শাকিলার কাজকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। বেশ কিছু কোলাজে জ্যামিতির সমীকরণকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি বহতা নদীর মতোই গতি পায় তাঁর শিল্পে। সেখানে তিনি দেশের বিখ্যাত কোনও শিল্পী নন, সহজ-সাধারণ এক গ্রাম্য মহিলা, যাঁর নিসর্গ রচনায় এ ভাবেই সমাজবাস্তবতা প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে।