পৃথিবীতে একশ্রেণীর জীব আছেন যাদের মূল লক্ষ্য হলো পৃথিবীর ইতিহাসকে ধ্বংস করা।প্রাচীন স্থাপত্য, ভাস্কর্য ধ্বংস করে পৃথিবীর বুকে এক নতুন নৈরাজ্য স্থাপন করা।সে আফগানিস্তানে বামিয়ান বুদ্ধ হোক বা পদ্মাপারের থেমিস বা পাকিস্তানের মহারাজ রনজিৎ সিংহের।
স্মৃতির প্রেক্ষাপটে ভেসে আসে এক দৃশ্যপট,,,,,
তপসসু আর ভল্লিক এগিয়ে চলেছে ক্লান্ত পায়ে চড়াই-উতরাই লঙ্ঘন করে। চলতে হবে আরও অনেক পথ, অজানা রাজপথ,দূর্গম উপত্যকা, কত অজানা বিপদ যে সেই পথে প্রান্তরে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তার ইয়ত্তা নেই।সদ্য গুরু হারা শোকস্তব্ধ,অজানা আতঙ্কে ভীত শাক্যশিষ্য দুই বণিক এতকিছুর পরেও সেদিন অন্তরে অন্তরে ছিল নৈসর্গিক আনন্দে উত্তেজিত। যে মহামূল্যবান সম্পদ তাদের কাছে আছে, সেই সম্পদের কাছে পৃথিবীর সকল সম্পদ তাদের কাছে ছিল সেই মুহূর্তে তুচ্ছ।
আশঙ্কা আর আনন্দের উত্তেজনায় ভল্লিক আর তপসসু নিজেদের আস্তিনে লোকানো রেশমি কাপড়ে ছোট থলের উপর হাত রাখে।যেখানে লুকান আছে তাদের গুরুর শেষ স্মৃতি “শাক্যের নখ আর চুল” ভল্লিক আর তপসসু মনে এক ইচ্ছা গুরুকে অমর করে রাখতে হবে নিজের নগর গান্ধারের অসিতঞ্চনে।শাক্যের স্মৃতিসৌধ আর মূর্তি নির্মাণ করে শাক্যকে শাশ্বত করতে হবে।তাই তারা এগিয়ে চলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত আজকের মধ্য আফগানিস্থানের বামিয়ান উপত্যকার উদ্দেশ্যে।
এরপর তৃতীয় থেকে দশম শতাব্দী কেবল শাক্যময়। ২৬১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বুদ্ধ সন্ন্যাসী মহারতি আসেন গান্ধারে, বামিয়ান হয়ে ওঠে বৌদ্ধ শিক্ষার পিঠস্থান, বর্ষাব্রত পালনের জন্য প্রচুর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর আগমন হতে থাকে বামিয়ানে,বেলে পাথরের পাহাড় কেটে গড়ে ওঠে প্রচুর বৌদ্ধ সাধনার গুহা।
৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আকেকজাণ্ডার আক্রমণ করে গান্ধার, অস্থায়ী ভাবে গান্ধার চলে যায় গ্রীকিওদের হাতে।তবুও থেকে যায় শাক্য বিশ্বাস। আর এইখান থেকেই শুরু হয় ভারতীয়, গ্রীক, পার্সিয়ান শিল্পের মেল বন্ধন, শুরু হয় এক নতুন শিল্লের উন্মেষ, যার পোশাকি নাম গান্ধার শিল্প।
এই গান্ধার শিল্পের হাত ধরে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে বামিয়ানের বেলে পাথরে পাহাড় কেটে তৈরি হতে শুরু করে, অনেক অনেক শাক্য মূর্তি।
এর মধ্যে দুটি শাক্য মূর্তি ছিল সর্বচ্চ, যার মধ্যে একটি উচ্চতা ছিল প্রায় ৫৫ মিটার।এতদিনে তপসসু আর ভল্লিকের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়, সমগ্র বামিয়ান উপত্যকা শাক্যময় হয়ে ওঠে, সিল্ক রুটের কাছাকাছি থাকার জন্য বামিয়ান অঞ্চল উত্তর উত্তর সমৃদ্ধ হতে থাকে।
কিন্তু সময়ের গতিপথ দারুণ প্রপঞ্চময়, নূতনের হাত ধরে এর গতিপথ কোন ইতিহাসের খাতে প্রবাহিত হয় তা সাধারণ মানুষের বুদ্ধির বাইরে।সেদিনের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা কি তখন ভাবতে পেরেছিলেন যে ভবিষ্যতে এই স্থবির শাক্য মূর্তিগুলির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে, নতুনের আগমনে।
দ্বিতীয় আব্বাসীয় খালিফা আল মনসুরের রাজত্ব (৭৫৪-৭৭৫) বামিয়ানে ইসলাম ধর্মের যাত্রা সুরু হয়, তবে শাক্য থেকে যায় সতন্ত্র, নিঃসঙ্গ ভাবে, ৯৯৭-১০৩০ সালে সুলতান মামুদের রাজত্ব কালে সম্পূর্ণ বামিয়ানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়,তবুও শাক্য থেকে যায়।
সাল ১২২১ এর কোন এক রক্তাক্ত বিকেল গোটা বামিয়ান উপত্যকা মৃত্যুর মত নিঃশব্দ।কোথাও কোন শব্দ নেই, ধুধু প্রান্তরে একদল সৈন্যদল ঘোড়ায় চরে এগিয়ে চলেছে, দলনেতার উন্মুক্ত তরবারি তখন রক্তাক্ত, ঘোড়সওয়ার চৈঙ্গিজ ঘোড়া থেকে নামলেন। সারা মুখে তার মৃত্যু আর প্রতিশোধের আত্মতুষ্টি, গোটা বামিয়ান তিনি জীবন শূন্য করে দিয়েছেন নিজের নাতীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে, কেবল খরজম সাম্রাজ্য নয়, চৈঙ্গিজ শেষ করে দিয়েছে গোটা উপত্যকা। পুরো অঞ্চল জুড়ে কেবল মৃত মানুষের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নেই।
চৈঙ্গিজ ঘোড়া থেকে নামলেন, বিশাল শাক্য মূর্তির দিকে তাচ্ছিল্য ভরে দেখলেন, আবার ঘোড়ায় উঠে এগিয়ে চলেন নতুন ধ্বংসের দিকে।
চৈঙ্গিসের এই ধ্বংসের খেলায় প্রায় দুদশক বামিয়ানের কোন জনপদ গড়ে ওঠেনি। বামিয়ানের নাম হয়ে যায় “#শহরইঘলঘোলা” দীর্ঘ শ্বাসের শহর, একা শাক্য থেকে যায় মৃত্যুর উপত্যকায়।
তৈমুর বংশীয় শাসনকালে (১৩৭০-১৫০৭) এই সময় আবার বামিয়ানে ধীরেধীরে জনপদ গড়ে ওঠে তবে তা ছিল অনেক নিস্তেজ।
কিন্তু স্থবির বুদ্ধ থেকে যায় এক অন্যরূপে কখন জিন্দাপির বাদশাহ আওরঙ্গজেবর সৈন্যর অস্ত্র শিক্ষার চাঁদমারি হিসাবে বা কখন বা নাদিরশাহের সৈন্যের হাজার হাজার কামানের গোলা আছড়ে পরতে থাকে শাক্য মূর্তির উপর এতে সৈন্যদের নিপুণতা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি তাদের ধর্মীয় আক্রোশের চরম পরিতৃপ্তি মেলে।এতে শাক্যের সৌন্দর্যতা কমতে থাকে,তবুও শাক্য স্থবির হয়ে দাড়িয়ে থাকে হাজার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
২০০১ মার্চ শখানেক তালিবানির বিজয় উল্লাস আর ঘনঘন মর্টারে কান ফাটানো শব্দ,কোন রক্তক্ষয় নয়, চারিদিকে কেবল বারুদের গন্ধ, তালিবানরা সেদিন গর্বিত বিজয়ির দল, তারা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে ১৫০০ বছরের স্থবির শাক্য অস্তিত্বকে,,,,, সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
এর আমু,সিন্ধু,পদ্মা দিয়ে বহু জল প্রবাহিত হয়ে সাগরে মিশেছে কিন্তু সেই ট্রাডিশনের অবসান হয়নি
কাল বাংলাদেশে থেমিসতো আজ পাকিস্তানে রনজিৎ সিংহের মূর্তি ধ্বংস হয়েছে উন্মাদ, অপ্রকৃতস্থ, বর্বর প্রাণীদের হাতে।
হে মহারাজ রনজিৎ সিংহ, হে দেবী থেমিস, হে মহান শাক্য আমার তোমাদের উপর বিশ্বাস থাকুক না থাকুক, তোমরা থাকবে এই পৃথিবীতে সগৌরব, পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে সবসময়ে বর্বর আক্রোশ তোমাদের মহান ইতিহাসকে মিটিয়ে দিতে পারবেনা।
এইবার বাস্তব কথা বলি এইবার,,,, আমার অনেক মন্দির,দেবালয়,বিশ্বাসের মূর্তি ধ্বংস হয়ে উন্মত্ত জানোয়ারদের হাতে, আমার পূর্বপুরুষদের অস্তিত্ব বারংবার বিপন্ন হয়েছে এই নারকীয় পশুদের হাতে কেউ প্রতিবাদ করেনি, কারুর মুখ থেকে প্রতিবাদ সূচক একটা শব্দ ব্যবহার হয়নি, তাই আমি আর ব্যথিত হইনা অপরে দুঃখে যখন আমি নিজেই জন্মগত যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষ।
আর বিশেষ করে যাদের জন্য সমবেদনা জানাব তারা উলটে আমার ভারত সত্ত্বার ধ্বংস বা খণ্ডন চায়, তাই ভাই বাস্তবিক আমার কোন দুঃখ নেই কারণ আমার অনুভূতি বহু আগেই মৃত। গাঁড় মারাক শাক্য তাতে আমার একটিও কেশাগ্র আন্দোলিত হবেনা।
ধন্যবাদ।
সুমিত ভরদ্বাজ