কাষ্ঠদহির ব্রহ্মদৈত্য – পর্ব ১

পর্ব ১

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন – 

অজেহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানীমীম্বরোহপি সন্।

প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।

 যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।

যিনি ভাগবতোত্তম, তিনি সর্বভূতে আত্মার আত্মাস্বরূপ ভগবানকেই দেখেন এবং আত্মার আত্মাস্বরূপ পরমাত্মাকে সমস্ত জীবকে দেখেন।

সর্বভূতেষু যঃ পশ্যেদ্ভগবদ্ভাবমাত্মনঃ ।

ভূতানি ভগবত্যাত্মন্যেষ ভাগবতোত্তমঃ ।।

অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্ ।

বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি ॥

 যা সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, তাকে তুমি অবিনাশী বলে জানবে৷ সেই অব্যয় আত্মাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়।

তেমনি এক আত্মার উপাসনা করা হয় এই বঙ্গে হুগলীর আরামবাগে। আত্মা অনুরূপে পরমাত্মার অংশ। সেই বেদ , উপনিষদ ,গীতা হয়ে পরমব্রহ্মের  উপাসনা লৌকিকরূপে এসে মিলিত হয়ে আপন আপন নাম , নিয়ম, রীতি, আচার ধারণ করেছে। 

অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ বেদান্তের মহাবাক্যসমূহের মধ্যে অন্যতম।

সর্বং হ্যেতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম; সোহয়মাত্মা চতুষ্পাৎ।। (মাণ্ডুক্য উপনিষৎ ২)

অর্থাৎ এই সমস্তই ব্রহ্ম, এই আত্মা ব্রহ্ম; উক্ত আত্মাই চতুষ্পাৎ। এখানে চতুষ্পাৎ বলতে জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয় অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে।

হুগলীর আরামবাগে কাষ্ঠদহি গ্রাম। সেখানে পূজিত হন মহাপ্রভু। মহাপ্রভু অর্থাৎ  এক্ষেত্রে শ্রী চৈতন্যদেব নন। এখানে মহাপ্রভু হলেন এক ব্রহ্মচারীর আত্মা। বহুকাল পূর্বে  কাষ্ঠদহি একসময় জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। কানানদীর বন্যায় একসময় দুই পাড় প্লাবিত হতো। ভৌগলিক কারণে কানা নদীর পাড়ে পলি সঞ্চিত হয়ে অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমি গঠিত হয়। বন্যাকবলিত আশেপাশের গাঁ ঘরের মানুষজন সেই উচ্চভূমিতে বনজঙ্গল পুড়িয়ে পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করেন। বনবাদাড়ের কাঠ ইত্যাদি দহন করে এই গ্রাম গড়ে ওঠায় , ওই গ্রাম বা জনবসতির নাম হয় #কাষ্ঠদহি। গ্রাম নামের উৎস স্বরূপ এইরূপ লোকবিশ্বাস এতদঞ্চলে প্রচলিত আছে। 

এখানে #দে পদবী ধারী দ্বাদশ তিলি সম্প্রদায় আছেন বেশ কয়েকঘর। দুই চার ঘর দুলে এবং ব্রাহ্মণ আছেন দুইঘর। মহাপ্রভু হলেন কাষ্ঠদহি গ্রামের লৌকিক গ্রাম দেবতা। অপদেবতা কিনা তা নিয়ে তর্ক বিতর্ক আছে। তবে গাঁ ঘরে যা জনশ্রুতি আছে সে কথাই আমি বলি – 

একজন গ্রামস্থ ব্রাহ্মণকুমার উপনয়নের সময় ত্রিদিবস গৃহবন্দী থেকে ব্রহ্মচারী অবস্থায় মারা যান। গাঁঘরের সাধারণ মানুষের মধ্যে লোকবিশ্বাস আছে যে বাউনের ছেলে পৈতার দিন বা অপঘাতে মারা গেলে ব্রহ্মদৈত্য হয়। ব্রহ্মদৈত্য অর্থাৎ প্রেতযোনি প্রাপ্ত ব্রাহ্মণ কুমার। গ্রামের প্রান্তসীমায় পথের ধারে এক নির্জন স্থানে বিল্ববিটপের বা নিম্ববৃক্ষে সেই প্রেতযোনি অধিষ্ঠান করেন। তবে ক্ষতি কারুর করেন না। সন্ধ্যার আলোআঁধারিতে তিনি নিজমূর্তি ধারণ করেন। মাটি চটাতে আসা মেতুয়ারা তাঁর দেখা পান। রহস্যময় তাঁর রূপ। কখনো ব্রাহ্মণ বেশে , কখনো জটাজুট ধারী সন্ন্যাসী পুরুষ-গলায় তাঁর রুদ্রাক্ষ, পরনে কৌপিন, হাতে ত্রিশূল ,পায়ে খড়ম। আগে ঝোপে ঝাড়ে , বেলতলায়, নিমতলায় তাঁর দর্শন পেয়ে মূর্ছা যেতেন গ্রামবাসীরা। এহেন রুদ্র দেবতাকে শান্ত করার জন্য কাষ্ঠদহির নির্জন সীমান্ত মন্ডলপাড়ায় কানা নদীর তীরে মনসাডাঙাগামী মোরামপথের ডানদিকে একটি বেলগাছের তলায় মহাপ্রভু জ্ঞানে তাঁর পূজা আরাধনা শুরু হয় । সে কবে হয় কেউ বলতে পারেন না ? কারণ গাঁয়ে পরম্পরায় এই নিয়ম ,এই পূজা, আচার মেনে আসছেন। 

মহাপ্রভু শব্দের আভিধানিক অর্থ পরমেশ্বর , শিব , জগন্নাথ। 

সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি৷

ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ৷৷

সমাধিবান পুরুষ সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শী হইয়া স্বীয় আত্মাকে ব্ৰহ্মাদিস্থাবরাস্ত সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে স্বীয় আত্মাতে দর্শন করেন। 

সেই বেল গাছের তলায় একটি ত্রিশূল পোঁতা আছে। আদিতে এখানে বেলগাছ, নিমগাছ থাকলেও বর্তমান বাঁশঝাড়ে আবৃত মহাপ্রভুর থান দিবাদ্বিপ্রহরেও রহস্যময় ছায়ায় মোড়া। লোকে বলে #বাবার_তলা। তিনি গাঁয়ের কুলদেবতা , তিনি গাঁ ঘরের লোকদের নিকট পিতৃতুল্য, সীমান্ত রক্ষক লৌকিক দেবতারূপে লোকসমাজে স্বীকৃত। অতীতে মাটির উপর কেবল একটি ত্রিশূল পোঁতা ছিল। বর্তমানে প্রায় ত্রিশ বর্গফুট স্থান জুড়ে  মহাপ্রভুর থান বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। মন্ডলপাড়ার পুকুরটি বাবার পুকুর নামে খ্যাত । লোকবিশ্বাস অনুসারে গভীর রাতে মহাপ্রভু এই পুকুরে স্নান করতে আসেন।

পূর্বে যে দুই ঘর ব্রাহ্মণ পরিবারের কথা উল্লেখ করেছি, তাঁদের পরিবারেরই কেউ উপনয়নের সময় ব্রহ্মচারী অবস্থায় মারা যান কিনা তা জানা যায় না। তবে অনেকের বিশ্বাস কাষ্ঠদহি ব্রহ্মশাপদগ্ধ উচ্চভূমি। 

উপনয়ন কি তা আমরা সকলে জানি। পৈতা অর্থাৎ যজ্ঞোপবীত ধারণরূপ সংস্কারই হল উপনয়ন। উপনয়ন’ শব্দের অর্থ ‘নিকটে নিয়ে যাওয়া’। যে অনুষ্ঠানের পর ছাত্রকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য গুরুর নিকটে নিয়ে যাওয়া হত তার নাম ছিল উপনয়ন।উপনয়ন শব্দের সহজ অর্থ যজ্ঞপবীত বা পৈতা ধারণ। বর্তমানে এই উপনয়ন সংস্কারটি আমাদের সমাজে ভিন্ন রূপে আছে। আগের মত আজকাল আর গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষার জন্য প্রেরন না করা হলেও শিক্ষা জীবনের শুরুতে হাতেখড়ি বলে একটি অনুষ্ঠান আজও প্রচলিত আছে যেটা কিনা সাধারনত সরস্বতী পূজার সময় করা হয়।

উপনয়ন ও যজ্ঞোপবীতঃ

উপ = নিকটে, নয়ন = চোখ। উপনয়ন একটি হিন্দু শাস্ত্রানুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সনাতনী বালকেরা সনাতন সংস্কারে দীক্ষিত হয়। ঐতিহ্য অনুসারে, এটি হিন্দু বালকদের শিক্ষারম্ভকালীন একটি অনুষ্ঠান।

 ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের জন্য উপনয়নের ন্যূনতম বয়স যথাক্রমে সাত, তেরো ও সতেরো বছর। কিন্ত অনেকে প্রশ্ন করেন বাকিরা কি দোষ করলেন ? দোষী কেউই নন। তেমন হলে ঐলুষ কবষ, সত্যকাম জাবালা , লোমহর্ষণ ও তাঁর পুত্র উগ্রশ্রবার সৃষ্টি হত না। শৌনক ঋষি চার বর্নের প্রবর্তক তিনি তার চার পুত্রের স্বভাব অনুসারে চারজনকে চার শ্রেনীতে ভাগ করেছেনঃ—

ব্রহ্ম বলছেন যে শূদ্রও যদি প্রবিত্র কার্যাদির দ্বারা বিশুদ্ধ আত্মা ও জিতেন্দ্রিয় হয়, তবে তাকে ব্রাহ্মণদের ন্যায় সমাদর করা কতব্য ফলত আমার মতে (শিবের মতে) শ্রদ্ব সচ্ছরিত্র ও সৎ কর্মান্বিত হলে ব্রাম্মন অপেক্ষা প্রসংশনিয় হয়,কেবল জন্ম,সংঘাত শ্রাস্ত্র জ্ঞান এখান ও কুল ব্রাহ্মণত্বের কানন নহে। সদাচার দ্বারা সকলেই ব্রম্মনত্ব লাভ করতে পারে।

(মহাভারত – অনুশাসন পর্ব ১৪ অধ্যায়)

ব্রাহ্মণ সাধারণ নামধারী যে গোপালন বৃত্তি অবলম্বন করেছিলেন, কৃষিজীবী হয়েছিলেন। তাঁরাই পিতবর্ন বৈশ্য হয়েছিলেন।

(মহাভারত শান্তিপর্ব, ১১৮ অধ্যায়)

“জম্মনা জায়তে শুদ্র, সংস্কারং দ্বিজ উচ্যতে। 

বেদ পাঠাৎ ভবেদ্ বিপ্র ব্রহ্ম জান্যতি স ব্রাহ্মণ”

অর্থাৎ কেবল ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেই উপনয়নের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ হন। উপনয়নের অধিকার সকলের আছে । এমনকি চারবর্ণের সকলেরই উপনয়নের অধিকার আছে। সেরূপে শুদ্র থেকে ব্রাহ্মণ হবার অধিকারও সকলের আছে।

অর্থাৎ ব্রহ্ম’কে যিনি জানেন তিনিই কেবল ব্রাহ্মণ কেউ ব্রাহ্মণ হয়ে জম্মগ্রহণ করেন না। ব্রহ্মগায়ত্রী মন্ত্রজপ কর তবেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায়। শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে দেখা যায় অনেক নিম্নবর্ণের সাধু– পুরুষ নিজ যোগ্যতা বলে ব্রাহ্মণ হয়েছেন। পুরুষের যদি গায়ত্রীমন্ত্র পাঠ পূর্বক উপনয়ন হয়।

 যেইরুপে শূদ্র ব্রাহ্মণ হয়, তদ্রুপ ব্রাহ্মণ এর ও শূদ্রত্ব প্রাপ্তি হয়, ক্ষত্রিয়ও বৈশ্য সম্বন্ধে ও ঐ রুপ জানিবে। (মনুসংহিতা দশম অধ্যায়)

 উপনয়নকালে বালকদের ব্রহ্মোপদেশ শিক্ষা দেওয়া হয়। এরপর তাঁরা ব্রহ্মচারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।  উপবীত প্রকৃতপক্ষে তিনটি পবিত্র সূতো যা দেবী সরস্বতী, গায়ত্রী ও সাবিত্রীর প্রতীক। উপবীত ধারণের সময় উপবীতধারী গায়ত্রী মন্ত্র শিক্ষা করে।

যজ্ঞোপবীতের/পৈতার এক এক একটি সুত্রে এক একজন দেবতা আছেন, ১ম তন্তুতে ওঁকার, ২তন্তুতে অগ্নি, ৩ তন্তুতে অনন্তনাগ, ৪ তন্তুতে চন্দ্র, ৫ তন্তুতে পিতৃগণ, ৬ষ্ঠ তন্তুতে প্রজাপতি, ৭ম তন্তুতে বসুগন, ৮ম তন্তুতে যক্ষ। ৯ম তন্তুতে শংকর৷

এই যজ্ঞোপবীতের/পৈতার ঊৎপত্তি সম্বন্ধে গৃহ্যাসংগ্রহে বর্ণিত আছে।

“ব্রহ্মেণোৎপাদিতং সূত্রং বিষ্ণুনা ত্রিগুণীকৃতম্।

রুদ্রেণ তু কৃতো গ্রন্থিঃ সাবিত্রায়াচাভিমন্ত্রিতম্.”

অর্থাৎ ব্রহ্মা সূত্র প্রস্তুত করেন, বিষ্ণু ৩ দণ্ডী করেন, রুদ্র গ্রন্থি দেন ও সাবিত্রী মন্ত্র পূত করেন৷

মনুষ্যদেহ ৯ দ্বার যুক্ত – ২ চোখ, ২ কান, ২ নাক, মুখ, লিঙ্গ ও পায়ু এই ৯ দ্বার দিয়েই আমাদের শরীরে পাপ প্রবেশ করে। এই নবদ্বার বন্ধ করার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি স্বরূপ ৯ টি তন্তু সমৃ্দ্ধ যজ্ঞোপবীত বা পৈতা৷ যজ্ঞোপবীতে ৩টি গিঁট বা “ব্রহ্ম গ্রন্থি” থাকে। এই সূত্রত্রয় কর্তব্যপরায়ণ মানুষকে তিনটি ঋণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

সেই ঋণত্রয় হলঃ—

১) ‘দেব-ঋণ’ অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি ঋন বা দায়িত্ব।

২) ‘পিতৃ ঋণ’ অর্থাৎ পিতামাতা, পরিবার পরিজান ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব।

৩) ‘ঋষি-ঋণ’ অর্থাৎ বৈদিক ঋষিগন যে মানবকল্যানের বিধিবিধান দিয়ে গেছেন তার প্রতি দায়িত্ব পালন।

উপনয়নে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার। 

নারীর উপনয়ন (পৈতা)

ওম্ অগ্নে ব্রতপতে ব্রতং চরিষ্যামি তচ্ছকেয়ং তন্মে রাধ্যতাম্। 

ইদমহমনৃতাৎ সত্যমুপৈমি।। (যজুর্বেদ ১.৫.)

অনুবাদঃ— হে ব্রতপতে অগ্নে! আমি ব্রত ধারণ করছি যে, আমি যেন অসত্যকে ছেড়ে সত্যকে জানি, সত্যকে মানি ও সদা সত্য ব্যবহার করি। হে প্রভু! তুমি আমাকে এমন সামর্থ্য প্রদান করো যেন আমার এই সত্যব্রত সদা সত্য সিদ্ধ হয়।

“স্মৃতিচন্দ্রিকা” স্মৃতিকার হারিত বলছেন—

“দ্বিবিধা স্ত্রীযো ব্রহ্মবাদিন্যঃ সদ্যঃবদ্ধশ্চ তত্র তত্র ব্রহ্মবাদিনীনাম্ অগ্নিণ্বধনম্ বেদাধ্যয়ম্ স্বগৃহে চ ভিক্ষাচর্যা ইতি।।

পুরাকালে কুমারীদের মোউংজি বন্ধন (উপনয়ন ) হত,তাদের বেদ পাঠ শিক্ষা দেওয়া হত, এবং গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণের পদ্ধতি শেখানো হত রজস্বলা হবার পূর্বে গুরু গৃহ হতে সমাবর্তনও হত।

সপ্তম শতকে মহাকবি বানভট্ট দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন কাদম্বরী ও হর্ষচরিত কাদম্বরী গ্রন্থে কাদম্বরীর উল্লেখ্য চরিত্র হল মহাশ্বেতা। মহাশ্বেতার বর্ণনা দেখি-তিনি যখন তপশ্চর্যারত তখন ব্রহ্মসূত্র বা যজ্ঞ উপবীত ধারণ করায় তাঁর শরীর পবিত্র হয়ে উঠেছিল। হর্ষচরিতে সরস্বতী সম্বন্ধে একইভাবে বলা আছে কাঁধ থেকে লম্বমান যে যজ্ঞ উপবীত, তার দ্বারা সরস্বতীর দেহ পবিত্র হয়ে উঠেছিল।

(ঋগ্বেদ ১০.০৫.৪১) মন্ত্রে বিবাহ সংস্কারে স্পষ্ট বলা হয়েছে পতির সামনে যজ্ঞ উপবীত ধারিণী কন্যা।

ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।”

(অথর্ববেদ ১১.৫.১৮)

অর্থাত্‍ ঠিক যেমন যুবক ব্রহ্মচর্য শেষ করে বিদুষী কন্যাকে বিয়ে করবে ঠিক তেমনি একজন যুবতীও ব্রহ্মচর্য শেষ করে পছন্দমত বিদ্বান যুবককে স্বামী হিসেবে গ্রহন করবে।

পাণিনি তার সংস্কৃত ব্যকরন শাস্ত্রে ছাত্রীদের ব্রহ্মচর্যের প্রতিষ্ঠান ছাত্রীশালা ও এর মহিলা অধ্যাপক আচার্যনি এর এর উল্লেখ করেছেন-

“মাতুলাচার্যাণামানুক্ত”

>পাণিনি ৪.১.৪৬

এবং “ছাস্যাদযঃ ছাত্রীশালাযাম্”

>পাণিনি ৬.২.৭৬

ব্রহ্মচারিনী ছাত্রীদের নারী শিক্ষক উপদেষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদ ১.৩.১১,১০.১৫৬.২ প্রভৃতিতে।

“চেতন্তি সুমতিনাম যজ্ঞম দধে সরস্বতী”

>ঋগ্বেদ ১.৩.১১

এখানে নারী শিক্ষিকাকে জ্ঞানদাত্রী ও প্রেরনাদাত্রীরুপে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।

পবিত্র বেদ ও শতপথ ব্রাহ্মনে আমরা দেখতে পাই যে কিভাবে গার্গী,মৈত্রেয়ী,অত্রেয়ী,বাক,অপালাসহ বিভিন্ন নারীরা ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে ঋষি পর্যায়ে উন্নীত হন।

উত্তররামচরিতমানস এর ২.৩ এ পাওয়া যায় ঋষিনী অত্রেয়ী বলছেন,

“এই অঞ্চলে অগস্ত্যসহ অনেক বিখ্যাত মহর্ষি আছেন।আমি মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম থেকে এখানে এসেছি তাঁদের কাছ থেকে বেদ অধ্যয়ন করতে।”

ওঁ শুদ্ধ পুত যোসিত যজ্ঞিয়া ইমা ব্রাহ্মনম হস্তেষু প্রপ্রতক সদায়মি।

যত্‍কামা ইদমাভিসিন্চমি বো হামিন্দ্রো মরুত্বন্স দদাতু তন্বে।।

আমার সকল কন্যাগন পবিত্র,ধর্মনিষ্ঠ,সকল ধর্মানুষ্ঠান(যজ্ঞাদি) পালনে যোগ্য।তাঁরা সকলে পবিত্র বেদ মন্ত্র নিষ্ঠার সহিত পাঠ করবে।তাঁদের সকলে বিদ্বান গুরুর নিকট বিদ্যালাভ করবে।ঈশ্বর তাদের নৈবেদ্য গ্রহন করবেন।

এর চেয়ে সুস্পষ্ট প্রমান আর কি হতে পারে বৈদিক শাস্ত্রে নারীদের উপনয়ন তথা ব্রহ্মচর্য পালনের?

সনাতন বৈদিক ধর্ম এমন একটি ধর্ম যার প্রধান ধর্মগ্রন্থের প্রাপক ও প্রচারকদের মহামনিষীদের মধ্যে নারী ঋষিকাগন ছিলেন যা পৃথিবীর অন্য কোন রিলিজিয়ন(ধর্ম একটিই,সনাতন ধর্ম,বাকীগুলো মার্গ) এর পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব।

তো , যাঁরা উপনয়ন ব্রতী ছিলেন তাঁদের ত্রিদিবস সূর্যালোক দর্শন নিষেধ । অসূর্য্যম্পৃশ্য হয়ে ব্রহ্মচর্য পালনের বিধিব্যবস্থা নির্দেশিত আছে। এখন এসব শাস্ত্র সম্মত বিধান অনেকটা শিথিল হলেও , অতীতে রক্ষণশীল সমাজে যঞ্জোপবীত ধারণকালে শাস্ত্র নির্দেশিত সংস্কারগুলি কঠোরভাবে পালন করা হতো। ব্রতী তিনদিন গৃহবন্দী হয়ে থাকতেন। এই সময়ে যদি কোনো কারণে বা অকারণে মারা যেতেন তবে তাঁকে বিল্ববিটপের তলে প্রোথিত করা হতো। শব প্রোথিতকরণের স্থান প্রেতগৃহ নামে পরিচিত ছিল। যদিও  সন্ন্যাসী , ব্রহ্মচারী প্রমুখদের নিয়মই আছে দেহ সমাধিস্থ করার। যদি কেউ চান তবে তাঁর দাহকার্য করতে পারেন। অনেক সময়ই মৃত ব্যক্তির আত্মা মুক্তি পেতেন না। কারণ , তাঁরা জাগতিকতা ত্যাগ করে নির্বাণ লাভ করতেন না। ব্রহ্মরাক্ষসের জন্ম আরও একটু বিস্তারে বলি। কেউ যদি তাঁর জন্য নির্ধারিত কাজগুলি না-করেন , বিশেষ করে ব্রাহ্মণ তবে তিনি পরিণত হন ‘ব্রহ্মরাক্ষস’-এ। ফলত, অনেক সময়ই ব্রহ্মপিশাচরূপে সম্ভৎসর বিল্ববিটপে অবস্থান করতেন।

দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ ৷

ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কূটস্থোহক্ষর উচ্যতে॥

এই জগতে দু’টি বিভাগ জানা যায়—

  শরীরাদি বিনাশশীল পদার্থ (জড়) এবং অবিনাশী জীবাত্মা (চেতন)৷ একটি হল প্রত্যক্ষ দেখা যায় যে “শরীর”, এবং অন্যটি হল তাতে অবস্থানকারী “জীবাত্মা”৷ জীবাত্মা অবস্থান করার জন্যই প্রাণ কার্য করে এবং শরীর সঞ্চালিত হয় ৷ জীবাত্মার সঙ্গে প্রাণ নির্গত হলেই শরীরের সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায় এবং শরীরের পচন ধরে ৷ লোকে তখন সেই শরীরকে পুড়িয়ে দেয়৷ কারণ বিনাশশীল এই দেহের কোনো গুরুত্ব নেই,গুরুত্ব এই দেহে অবস্থানকারী অবিনাশী জীবাত্মার। পঞ্চ মহাভূত—অাকাশ,,বায়ূ,,অগ্নি,,জল,,পৃথিবী হতে সৃষ্ট শরীর ইত্যাদি যত পদার্থ অাছে,,তা সবই জড় এবং বিনাশশীল”‘৷

                    প্রাণীদের স্থূলশরীর স্থূলসমষ্টি—জগতের সঙ্গে (১) দশ ইন্দ্রিয়,,পাঁচ প্রাণ,, মন ও বুদ্ধি—এই সতেরোটি তত্ত্ব দ্বারা যুক্ত সূক্ষ্মশরীর সূক্ষ্ম সমষ্টি—জগতের সঙ্গে এক এবং কারণ—শরীর(স্বভাব,কর্ম—সংস্কার, অজ্ঞান)কারণ সমষ্টি জগতের (মূল প্রকৃতির)সঙ্গে এক ৷ এগুলি ক্ষরণশীল(বিনাশশীল) হওয়ায় 

” ক্ষর ” নামে বলা হয়”‘৷

                               “‘যে তত্ত্বের কখনো বিনাশ হয় না এবং যা সর্বদা নির্বিকার থাকে, সেই জীবাত্মার বাচক হল এখানে “অক্ষর” পদটি ৷ প্রকৃতি জড় এবং জীবাত্মা(চেতন পরমাত্মার অংশ হওয়ায় ) চেতন”‘৷

                       “‘জগৎকে এখানে ” ক্ষরঃ ” এবং জীবাত্মাকে এখানে ” অক্ষরঃ ” পদের দ্বারা বলা হয়েছে”‘৷

                     “‘ক্ষর এবং অক্ষর—উভয় থেকে উত্তম “পুরুষোত্তম”

কথাটি প্রমাণিত করার জন্য ভগবান এখানে ক্ষর এবং অক্ষর—এই দুটিকে ” পুরুষ ” নামে উল্লেখ করেছেন”‘৷

“ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি”;—

 যে সংসার—বৃক্ষের স্বরূপ জানিয়ে তাকে ছেদন করার প্রেরণা প্রদুান করা হয়েছে, সেই (জগৎ) সংসার—বৃক্ষেকেই এখানে “ক্ষর” নামে বলা হয়েছে”‘৷

              “‘প্রাণীদের শরীরই বিনাশশীল,প্রাণী স্বয়ং নয় ৷ তাই ভূতানি পদটি এখানে জড় শরীরের উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে”।

“কূটস্থোহক্ষর উচ্যতে”;—

এই অধ্যায়ের ১৫/৭ শ্লোকে ভগবান যাকে তাঁর সনাতন অংশ বলে জানিয়েছেন, সেই জীবাত্মাকে এখানে “অক্ষর” নামে বলা হয়েছে”‘৷

                            “‘জীবাত্মা যতই শরীর ধারণ করুক এবং যতই নানা লোকে যাতায়াত করুক ; এতে কখনো বিকার উৎপন্ন হয় না ; এটি সর্বদাই একইভাবে বিরাজ করে ৷ তাই এখানে একে “কূটস্থ” বলা হয়েছে”‘৷

 ‘গীতায় পরমাত্মা এবং জীবাত্মা—উভয়েরই স্বরূপ বর্ণনা প্রায় একইরকম পাওয়া যায় ৷ যেমন পরমাত্মাকে “কূটস্থ” এবং “অক্ষর” বলা হয়েছে ,, তেমনই জীবাত্মাকেও “কূটস্থ” এবং “অক্ষর” বলা হয়েছে ৷ জীবাত্মা এবং পরমাত্মা—উভয়ের মধ্যেই পরস্পর তাত্ত্বিক এবং স্বরূপগত ঐক্য অাছে”। 

অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ ।

নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ ॥

তত্র, তম্, বুদ্ধিসংযোগম্, লভতে, পৌর্বদেহিকম্,

যততে, চ, ততঃ, ভূয়ঃ, সংসিদ্ধৌ, কুরুনন্দন ।।

এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোষ্য। তিনি চিরস্থায়ী, সর্বব্যপ্ত, অপরিবর্তনীয়, অচল ও সনাতন।সেই প্রকার জন্মগ্রহণ করার ফলে তিনি পুনরায় তাঁর পুর্ব জন্মকৃত পারমার্থিক চেতনার বুদ্ধিসংযোগ লাভ করে সিদ্ধি লাভের জন্য পুনরায় যত্নবান হন।

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি ।

তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য-

ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ॥

 মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, দেহীও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করেন। 

উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ ।

পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেহস্মিন্ পুরুষঃ পরঃ ॥

 এই শরীরে আর একজন পরম পুরুষ রয়েছেন, যিনি হচ্ছেন উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর এবং তাঁকে পরমাত্মাও বলা হয়।

ধরুন লোকসমাজে  বিশ্বাসে , ভক্তিতে নানা রূপে সেই পরমাত্মাকেই পূজা করা হয়। যেমন কাষ্ঠ দিহির মহাপ্রভু। গ্রাম্য উচ্চারণে ব্রহ্মপিশাচ বেম্মদত্তি হয়ে যান। শুদ্ধ উচ্চারণে বলা হয় ব্রহ্মরাক্ষস। সপ্তম শতকে ময়ূরভট্ট বিরচিত ‘সূর্যশতক’ কাব্যে ব্রহ্মরাক্ষসের দ্বারা উত্যক্ত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন। সেই সাক্ষ্য ধরলে, ব্রহ্মরাক্ষস মোটেও কোনও সুবিধের জীব নয়। হিন্দু পরম্পরা তাকে ভয়ানক বলেই বিবৃত করেছে।

‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘পঞ্চতন্ত্র’ ইত্যাদি প্রাচীন সাহিত্যে উল্লেখ রয়েছে ব্রহ্মরাক্ষসের। এই কাহিনিগুলিতে ব্রহ্মরাক্ষস কখনও ভয়ঙ্কর, কখনও বা দয়ালু। কোনও ব্যক্তির উপরে যদি সে সদয় হয়, তাকে সে দান করে বিপুল ধনরত্ন। তার চেহারা বর্ণনা থেকে জানা যায়, সে বিশালকায়। তার মাথায় রাক্ষসের মতো শিং আর ব্রাহ্মণের মতো টিকি রয়েছে। তারা অবশ্য সাধারণ মানুষের রূপও ধরতে সমর্থ। কাহিনিগুলি থেকে জানা যায়, ব্রহ্মরাক্ষস ভবিষ্যৎ কথনেও দক্ষ।

 কবেল বঙ্গে নয় মহারাষ্ট্র ও কেরলের বিভিন্ন জায়গায়, ব্রহ্মরাক্ষস রীতিমতো পুজো পান। বেশ কিছু জায়গায় তাঁর মন্দিরও রয়েছে। বহু মন্দিরে এমন বিশ্বাসও চলিত রয়েছে যে, সেই মন্দিরের কোনও পুরোহিতের আত্মাই আজ ব্রহ্মরাক্ষসে পরিণতিপ্রাপ্ত। দক্ষিণ ভারতের বহু দেবস্থানেই মূল মন্দিরের পাশে ব্রহ্মরাক্ষসের মন্দিরও দেখা যায়। তবে, এ বিষয়ে বিরাটভাবে এগিয়ে রয়েছে কেরল। তিরুনাক্কারের শিব মন্দিরে, ব্রহ্মরাক্ষস আলাদা দেবালয়ে স্থান পেয়েছেন। সৌভাগ্য-সন্ধানীরা নিয়মিত সেখানে পুজো চড়ান। 

তবে , ব্রহ্মরাক্ষস শিবের গণ বিশেষ হিসাবে অভিহিত হন । অর্থাৎ, দেবতাসদৃশ এই সকল আত্মা শিবজ্ঞানে জীবসেবা লাভ করে থাকেন গ্রাম্য লোকসমাজে। অঞ্চল বিশেষে তাঁর নামও বদলায়। কোথাও তিনি সন্ন্যাসী, কোথাও কুদরা, কোথাও বা তিনি গোঁসাইঠাকুর নামে পূজা পান। কাষ্ঠদহিতে তিনি মহাপ্রভু নামে সুবিদিত।  কাষ্ঠদহির ন্যায় কিছু গ্রামে তিনিই  গ্রামদেবতা, গরাম বা গড়াই ঠাকুর। তিনি পিশিত অশনকারী মহাপুরুষ দেবতা – তাঁর থানে প্রোথিত সিন্দুর চর্চিত ত্রিশূলের সুমুখে শনি মঙ্গলবার পূজাদি উৎসর্গ হয়। পুরোহিত চক্রবর্তী ব্রাহ্মণরাই সেই কার্য সম্পাদন করে থাকেন। সুতরাং , এই ব্রহ্মদৈত্য পূজা বা মহাপ্রভু পূজা বলতে পারেন এক প্রকার অর্থে লোকমানষে পূর্বপুরুষ আরাধনা। ওই যে বললাম সর্বত্র পরমাত্মা ও পরমাশক্তির পূজাই  নানা রূপে , নানা ভাবে। পৃথিবীর মায়া না কাটানো এক অতৃপ্ত আত্মা এই মহাপ্রভু।

লোকসমাজের বিশ্বাসে যে কোনো শুভকাজের পূর্বে এই পিশিত অশনকারী মহাপুরুষ দেবতাকে পূজা দিয়ে সন্তুষ্ট করেন। কারণ তিনি সন্তুষ্ট হলে , প্রসন্ন হলে সকল শুভকাজের বিঘ্নবিনাশ করে থাকেন।

গজমুণ্ড কমন্ডলু হাত এ তাহার।

কুম্ভকার চক্র হেন কর্ণে পরে হার।।

উচ্চতর কপালে বিকট দশন।

ব্রহ্মরাক্ষসের হেন বচন শুনিয়া।।…

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. হুগলী জেলার লৌকিক দেবদেবী

২. ঋগ্বেদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.