আজকাল অদূরদর্শী হিন্দুবিদ্বেষী অনেক ভারতীয় নেতা-নেত্রী ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন শিক্ষা ও ঈশ্বরদৃষ্টি বর্জিত পাশ্চাত্যের সাম্যবাদের বাণী সমাজের সর্বস্তরে প্রচার করে দম্ভসহকারে বলেন, হিন্দুত্ব বা হিন্দুধর্ম হলো সাম্প্রদায়িকতা। সুতরাং নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দেওয়া বা ভাবা সংকীর্ণতা। তার চেয়ে নিজেকে মানুষ ভাবাই উদারতা। হ্যা, একথা আমরা হিন্দুত্ববাদীরা মানি। নিজেকে হিন্দু মুসলমান, খ্রিস্ট্রান না ভেবে অথবা বৈষ্ণব-শৈব-শাক্ত-গাণপত্য – সৌব কিংবা বৌদ্ধ-জৈন-শিখ-অসমাজ-ব্রাহ্মসমাজী-রামকৃষ্ণপন্থী এভাবে পরিচয় না দিয়ে নিজেকে ‘মানুষ’ ভাবাই উদারতার নিদর্শন। আবার নিজেকে মানুষ না ভেবে ‘জীব’ভাবা তো আরও উদারতা। বাস্তবে নিজেকে ব্রহ্ম ভাবা বা জীরকুলকে সর্বব্যাপক ঈশ্বরের ওতপ্রোত অংশ ভাবা সর্বাপেক্ষা উদারতার নিদর্শন। হিন্দুশাস্ত্রে এই উদার দৃষ্টি বা ‘সর্বাত্মভাব’ বা ‘সমদর্শন’-এর কথাই বলা হয়েছে। এই উদারতা বা সমদর্শন হিন্দুত্ব ভাবধারায় এক পূর্ণাঙ্গ জীবনপদ্ধতির মাধ্যমে ক্রমশ সাধনা দ্বারা লাভ হয়। তা অহংকার, ভেদদৃষ্টি, ভোগস্পৃহা, স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা লাভ করা যায় না।
হিন্দুরা পরমেশ্বরকে বা মহাজাগতিক শক্তিকে সর্বব্যাপীরূপে সর্বত্র দর্শন করেন পারমার্থিক দৃষ্টিতে। জলে বিষ্ণুঃ স্থলে বিষ্ণু বিষ্ণু পর্বত মস্তকে। জালামালাকুলে বিষ্ণুঃ সর্বং বিষ্ণুময়ং জগৎ৷৷ হিন্দুরা শালগ্রামশিলা, রামশিলা, দেবমূর্তিতে সেই বিষ্ণুকে দেখেন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রে দেখে থাকেন। গঙ্গা-যমুনা-গোদাবরী-সরস্বতী-নর্মদাতে দেখে থাকেন। অগ্নি, বায়ু ও আকাশে দেখেন। স্থলজগৎ, সূক্ষ্মজগৎ ও কারণ জগতে দেখেন। জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তিতে দেখেন। বনস্পতি, অশ্বত্থ, বটবৃক্ষে দেখেন। ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল ও মূখেতে দেখেন। হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টানে দেখেন। মন্দির-মসজিদ-গির্জায় দেখেন। পরিবারে ও সমাজে দেখেন। বিশ্বব্যাপী ও বিশ্বাতীত রূপে সর্বত্র বিরাজমান এক মহাজাগতিক সত্তা বা চৈতন্য শক্তির অনুভব করে তার পূজা করেন। কখনও একেশ্বরবাদী বা ব্রহ্মবাদী রূপে, কখনও সর্বেশ্বরবাদী রূপে, কখনও বহু ঈশ্বরবাদী রূপে, কখনও সাকার বা নিরাকার ব্রহ্মবাদী রূপে, কখনও সগুণ বা নির্গুণ রূপে নিজেকে পরিচয় দেন।
সমগ্র হিন্দু শাস্ত্রে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত। হিন্দুরা সর্বব্যাপক ব্রহ্ম বা পরমাত্মা বা শ্রীভগবানকে সর্বভূতে সমভাবে অবস্থিত দেখেন। এই উদার,বিশ্বব্যাপক সার্বভৌম ধর্মের নাম হিন্দুধর্ম। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি। এরই আর এক নাম মানবধর্ম। এই হিন্দুত্বকে বিকশিত করেছেন ভারতবর্ষের মুনিঋষিগণ।
মানস কুমার সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.