পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর নাতনি করাচী নিবাসী সুলেখিকা ফতিমা ভুট্টো কদিন আগেই প্রকাশ্যে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি স্পষ্টতই পাক-প্রশাসনকে লক্ষ্য করে নিউইয়র্ক টাইমসে একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমরা গোটা জীবনটাই যুদ্ধ করে কাটিয়েছি। আমি আর পাকিস্তানি সেনাকর্মীর মৃত্যু দেখতে চাই না। আমি দেখতে চাই না, ভারতীয় সেনাকর্মীরও মৃত্যু। আমি চাই না, এই উপমহাদেশ অনাথাশ্রমে পরিণত হোক।”
ভারতের কাশ্মীর উপত্যকার পুলওয়ামায় পাক-সন্ত্রাসবাদের হানা, ৪০ জন জওয়ানের মৃত্যু এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-পাক যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে ওঠায় এই সংবেদনশীল লেখিকার বক্তব্য :পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাস জুড়ে রয়েছে বহু রক্তাক্ত কাহিনি। এই ভয়াবহ হিংস্রতার ফল পাক-নাগরিকদের চেয়ে বেশি কেউ ভোগেনি। পাকিস্তানের একনায়কত্বের ইতিহাস, সন্ত্রাসের অভিজ্ঞতা এবং অনিশ্চয়তার অর্থ হলো, আমাদের প্রজন্মের পাকিস্তানিদের কোনও যুদ্ধের জন্য কোনো আগ্রহ, ধৈর্য নেই। আমারই মতো আজকের পাকিস্তান নাগরিকরা আর অকারণে টেনশন বাড়াতে চায় না। আমি কখনও দেখিনি, আমার দেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিতে সহাবস্থান করছে। আবার এটাও আমাদের অভিজ্ঞতায় নেই যে দুটো পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র টুইটার অ্যাকাউন্টে যুদ্ধ করেছে।” সঙ্গস অব ব্লাড অ্যান্ড সোর্ড গ্রন্থের মধ্যবয়সী লেখিকা ফতিমা লিখেছেন, “আমাদের প্রজন্মের পাকিস্তানিরা বাক-স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। এখন শান্তির দাবিতে জোরালো দাবি তুলতেও আমরা পিছপা হব না।”
ফতিমা ভুট্টোর এই কণ্ঠস্বর আজ শুধু তার একার নয়। গোটা পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, খেলোয়াড় সকলের। সত্যিই, পাকিস্তানের নাগরিকরা এখন যুদ্ধক্লান্ত। সন্ত্রাসবাদীদের কালো ছায়ায় মোড়া পাকিস্তানের রক্তাক্ত আবহাওয়ায় তারা সিক্ত। এবার তারা মুক্তি চায়। সুস্থভাবে বাঁচবার, প্রাণ খুলে হাসবার, চোখ মেলে দেখবার সুযোগ চায়। সকলেই চাইছে, পাকিস্তান হয়ে উঠুক বিশ্বের অন্যতম একটি সভ্য দেশ। সকলেই চাইছে, একটি উন্নত দেশের পরিকাঠামো গড়ে তুলে দেশকে ধ্বস্ত অর্থনীতি এবং রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে, যাতে সমস্ত পাকিস্তানি সমবেত কণ্ঠে মাথা উঁচিয়ে বলতে পারে, “আমরা পাকিস্তানি। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের বিরোধী।”
এমনটাই হওয়ার কথা। কারণ, পাকিস্তান এখন সবদিক দিয়ে ব্যর্থ, রিক্ত একটি দেশ যার মাথা বিকিয়ে আছে দেনায়। সেই দেনার পরিমাণ এতটাই যে পাকিস্তানে প্রতিটি নবজাতক জন্ম নেয় দেড় লক্ষ পাক মুদ্রা রুপির বোঝা মাথায় নিয়ে। এরদেশে ৩০ শতাংশ নাগরিক পৌঁছেছে দারিদ্রের শেষ সীমায়। চীন ঋণ দিতে দিতে পাকিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে চীন নির্ভর হতে বাধ্য করে তুলেছে। ফলে পাকিস্তানের গোটা বাণিজ্যক্ষেত্রেই এখন চীনের দখলে এবং চীনের সবচেয়ে সস্তা এবং ডাস্টবিনে ফেলার যোগ্য উৎপাদন সামগ্রীতে ভরে গিয়েছে পাক-বাজারগুলি। ফল হয়েছে মারাত্মক। আর এসবেরই কারণ একটিই— সন্ত্রাসবাদ।
পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের সূত্রপাত আজকে নয়। প্রথম থেকেই পাক-শাসকরা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সন্ত্রাসবাদ হবে তাদের অন্যতম ধর্ম যার পোশাকি নাম হবে ‘যুদ্ধ’। এখন পাকিস্তানের প্রতিটি যুদ্ধের পিছনেই কাজ করে যায় সন্ত্রাসবাদীরা। কারণ সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দিতে দিতে পাক-দেশপ্রধানরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে গড়ে ফেলেছেন অজস্র ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যারা সব সময় হাত বাড়িয়ে রেখেছে তাদের গলার দিকে। সন্ত্রাসবাদীদের কথা না শুনলেই সাঁড়াশীর মতো চেপে বসবে ওই হাত। এভাবেই বছর বছর সরে যেতে হয়েছে তাদের। গত ৭০ বছরে ভারতবর্ষে যেখানে প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে ১৬ বার সেখানে ভারতের চেয়ে অনেক ছোটো এবং অনেক কম জনসংখ্যার দেশেও এ পর্যন্ত ২২ বার প্রধানমন্ত্রী বদলেছে। কারণ অধিকাংশ প্রধানমন্ত্রীকে জীবন বলিদান দিতে হয়েছে সন্ত্রাসবাদের যুপকাষ্ঠে।
বাড়বাড়ন্তটা চোখে পড়ল ২০০১ সালে। ১৯৮০-র দশকে পেশোয়ারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল গুপ্তচর আর জেহাদিদের গোপন ডেরা। এবং পাক সরকারের মদতেই ধীরে ধীরে গোটা পাকিস্তানে তারা ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন নামে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে। উদ্দেশ্য একটাই— গোটা বিশ্বের ইসলাম সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেওয়া, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে সবক শেখানো। সব সংগঠনের নেতৃত্বই কম বেশি এক এবং লক্ষ্যও একই। এরা প্রয়োজনে পাক-সরকার ট্যাঁ-ফুঁ করলে যেমন সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ঘুম ছুটিয়েছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরেই, তেমনি অশান্তির মৌচাক বুনেছে ভারতের মাটিতে একের পর এক।
২০০০ সালের ১৯ এপ্রিল কাশ্মীরের বাদামিবাগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৫ কর্পের হেডকোয়ার্টারের সামনে ঘটল আত্মঘাতী গাড়িবোমা বিস্ফোরণ। ২০০১-এর অক্টোবর জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় বোমা ফাটল। ১৩ ডিসেম্বর ২০০১, নয়াদিল্লিতে পার্লামেন্ট ভবনে আক্রমণ। একের পর এক। কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি ভারত সরকারের ক্ষমতায় আসার পর আক্রমণের মাত্রা বেড়ে গেল। ২০১৬-র ২ জানুয়ারি পাঠানকোটের বায়ুসেনার ঘাঁটিতে হামলা হলো। ফের ১৮ সেপ্টেম্বর উরির সেনা ক্যাম্পে আক্রমণ। ২৯ নভেম্বর নাগ্রোটায় খুন হলেন সাত ভারতীয় জওয়ান। ২০১৭-র ২৬ আগস্ট পুলওয়ামায় পুলিশের ওপর হামলা। ফের ডিসেম্বরে একই জায়গায় সেনা-সংঘর্ষ। সর্বশেষ আক্রমণ এবার ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সেই পুলওয়ামায়। নিহত ৪০ জন সি আর পি এফ জওয়ান। শুধু সন্ত্রাসবাদী হানাই নয়, পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আমলে সেনাসংঘর্ষও বেড়েছে অনেক। ২০১৮ সালে পাক সেনা ২৯৩৬ বার সেনা সংঘর্ষবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এর ফলে ৬১ জন ভারতীয়র মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৫০ জন। ২০১৭ সালে চুক্তি লঙ্ঘনের সংখ্যা ছিল ৯৭১। মৃত্যু হয়েছিল ৩১ জনের। ওই বছর ৭ জন বিএসএফ জওয়ানের প্রাণ গিয়েছিল সংঘর্ষে। ২০১৮-য় সেই সংখ্যাটা হয় ১৪।
এইই সঙ্গে ভারতীয় মুসলমান যুবকদের, বিশেষ করে কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে যোগ দেওয়ার মাত্রাও বেড়েছে অনেক। সবটা স্বেচ্ছায় নয়। অনেকটাই নৃশংস সন্ত্রাসীদের চাপে শুধুমাত্র কাশ্মীর উপত্যকায়। ২০১৫ সালে ওই সংখ্যাটি ছিল ৬৬। ২০১৮-য় তা হয়েছে ১৮১। অর্থ এবং পেট ভরে খাওয়ার চুক্তিতে টগবগে তরুণগুলিকে ভুল বুঝিয়ে জেহাদি করে তুলছে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলি।
পাকিস্তানের পাশ থেকে আজ প্রায় গোটা পৃথিবীই সরে এলেও, চীন এখনও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানকে পুরোপুরি ত্যাগ করা তাদের পক্ষে এখনই সম্ভব নয়। কারণ পাকিস্তানকে ঘিরে রয়েছে তার দীর্ঘমেয়াদি ঔপনিবেশিক পরিকল্পনা। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ডলার চীন পাকিস্তানকে ঋণ দিয়েছে। চীন জানে, পাকিস্তান তা শোধ করতে পারেন না। আর পাকিস্তান যত ঋণ শোধ করতে অপারগ হবে, চীন ততই গলা টিপে ধরবে পাকিস্তানের। পাকিস্তানের বিশাল বাজারকে সে সহজে হাতছাড়া হতে দেবেনা। ইতিমধ্যেই নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তানে যে বিশাল বিশাল পরিকাঠামোগত প্রকল্প চীন হতে নিয়েছে সেগুলো ছেড়ে বেরিয়ে আসাও সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক কারণে চীন ইতিমধ্যেই শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশকে হাতছাড়া করতে বাধ্য হয়েছে। এখন ভরসা মূলত পাকিস্তান। কিছুটা নেপাল। জোর চেষ্টা চলছে বার্মাকেও নিজেদের দিকে টানতে। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা অধিপত্য তুঙ্গে তুলতে তাই চীনের দরকার পাকিস্তানকে। কারণ পাকিস্তান হবে চীনের মূল বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা ঘাঁটি।
সবই ঠিক কথা, কিন্তু পাকিস্তানের কী লাভ হচ্ছে। কোন অনিশ্চয়তার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান? এতো সর্বনাশের পথে অগস্ত্যযাত্রার সমান। আজ পর্যন্ত পাকিস্তানি প্রশাসনে একমাত্র বেনজির ভুট্টো আর নওয়াজ শরিফই কিছুটা হলেও চেষ্টা করেছিলেন সঠিক পথে পা বাড়াতে। মোশারফ হোসেন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দমন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন এবং বিদেশে পালিয়ে বেঁচেছেন। এখন ইমরান খানকে দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। সবাই— চীন, পাক সেনা এবং আন্তর্জাতিক সস্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি। কারণ সবাই জানে ইমরান খান ক্রিকেটার। রাজনীতির জগতে তিনি কাচামাটি। শিক্ষানবিশী ইমরানকে যেভাবে খুশি ব্যবহার করা যায়। হচ্ছেও তাই। ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামার হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারের কড়া পদক্ষেপ সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্যে হলেও, পাক সরকার এবং পাক সেনা সেই লক্ষ্যের বাইরে নয়।
এমনকী ভারত এই বার্তাও চীনকে দিতে চায়— কোনো অবস্থাতেই ভারত আর মাথা নীচু করবে না। আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, পাক সরকার তথা সেনার অবিমৃশ্যকারী রাজনীতি অথবা সন্ত্রাসবাদীদের রক্তচক্ষু— কোনোটাই ভারত সরকারকে অবদমিত করে রাখতে পারবেনা। অতীতে যা হবার হয়ে গেছে। এখন গোটা দেশ, দেশের ১৩৫ কোটি মানুষ জাতীয়তাবোধের নতুন উদ্যমে উদ্দীপ্ত। এখন আর পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগই নেই। বুলেটের জবাব দেবে বুলেট। ব্যালটে যাই হোক না কেন।
জুলফিকার আলি ভুট্টোর আদরের নাতনি সম্ভবত সেই বার্তা পড়তে পেরেছেন। তিনি বুঝেছেন, অতীতের নয়াদিল্লি আর আজকের নয়াদিল্লি এক নয়। তিনি বুঝেছেন, শুধু প্রতি আক্রমণ প্রত্যাঘাতের মধ্যেই ভারত নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে না। প্রয়োজনে আচমকা হামলায় ইসলামবাদের শিরদাঁড়াটাই গুড়িয়ে দেবে ভারত। হয়তো ইমরান খানও কিছুটা হলেও সেটা বুঝেছেন। তাই যুদ্ধের দামামা থামিয়ে শান্তির ললিতবাণী শুনিয়ে আটক ভারতীয় উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে নিঃশর্তে মুক্তি দিয়েছেন। ভয় পেয়েছেন, যে দেশের জওয়ান অবলুপ্তপ্রায় মিগ-২১ নিয়ে যদি পাকিস্তানের আধুনিক যুদ্ধবিমান এফ-১৬-কে ঘায়েল করতে পারে, তাহলে ওই সেনাবাহিনীর জোশ কতটা তা দেখে।
পাক-সরকারের উচিত তাই অযথা ভারত-বিদ্বেষ ত্যাগ করে নিজেদের দেশ ও জাতি গঠনের দিকে নজর দেওয়া। পাক সেনা কর্তাদের কড়া বার্তা দেওয়া যে সরকার না চাইলে কোথাও আক্রমণ নয়। আর সন্ত্রাসবাদীদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দেশছাড়া করা। কারণ যত নষ্টের গোড়া ওই সংগঠনগুলিই।
কাজটা যে সহজ নয় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতা এড়িয়ে ইমরান খানকে এটা করতেই হবে। তা নইলে প্রতিদিন তিলে তিলে তিলে খতম হবে পাকিস্তান আর সন্ত্রাসীরা। পাকিস্তানিদের যে আল্লার স্বর্গরাজ্যে পৌঁছনোর জন্য ভুজুং ভাজুং দিয়ে দোজখের পথের পথচারী বানিয়ে দিচ্ছে, সেই পাকিস্তানিরাই পাক প্রশাসন, পাক সেনা এবং পাকসন্ত্রাসবাদীদের নরকের পথে ঠেলে দেবে অচিরেই।
সুজাত রায়