প্রত্যুষের প্রথম আভা
অরণ্যের শিশিরবর্ষী পল্লবে পল্লবে ঝলমল করে উঠল।
নক্ষত্রসংকেতবিদ্ জ্যোতিষী বললে, বন্ধু, আমরা এ সময় এসেছি।
পথের দুই ধারে দিক্প্রান্ত অবধি পরিণত শস্যশীর্ষ স্নিগ্ধ বায়ুহিল্লোলে দোলায়মান —
আকাশের স্বর্ণলিপির উত্তরে ধরণীর আনন্দবাণী।
গিরিপদবর্তী গ্রাম থেকে নদীতলবর্তী গ্রাম পর্যন্ত
প্রতিদিনের লোকযাত্রা শান্ত গতিতে প্রবহমান —
কুমোরের চাকা ঘুরছে গুঞ্জনস্বরে,
কাঠুরিয়া হাটে আনছে কাঠের ভার,
রাখাল ধেনু নিয়ে চলেছে মাঠে,
বধূরা নদী থেকে ঘট ভ’রে যায় ছায়াপথ দিয়ে।
কিন্তু কোথায় রাজার দুর্গ, সোনার খনি,
মারণ-উচাটন-মন্ত্রের পুরাতন পুঁথি?
জ্যোতিষী বললে, নক্ষত্রের ইঙ্গিতে ভুল হতে পারে না,
তাদের সংকেত এইখানেই এসে থেমেছে।
এই বলে ভক্তিনম্রশিরে পথপ্রান্তে একটি উৎসের কাছে গিয়ে সে দাঁড়ালো।
সেই উৎস থেকে জলস্রোত উঠছে যেন তরল আলোক,
প্রভাত যেন হাসি-অশ্রুর গলিতমিলিত গীতধারায় সমুচ্ছল।
নিকটে তালীকুঞ্জতলে একটি পর্ণকুটির
অনির্বচনীয় স্তব্ধতায় পরিবেষ্টিত।
দ্বারে অপরিচিত সিন্ধুতীরের কবি গান গেয়ে বলছে —
মাতা, দ্বার খোলো।
ছেলেটির বয়স কত হবে ? বারো বা তেরো। গায়ের রঙ ফরসা, টিকালো নাক, বড় বড় চোখ। আমি যতক্ষণ ভেতরে ছিলাম, দেখলাম মাথা নীচু করে বসে আছে। অন্য বাচ্চাদের সাথে আমি খেলছিলাম, ওকে অনেকবার ডেকেছি, কিন্তু সাড়া দেয় নি। সেদিন আমার মন ওর দিকেই পড়ে ছিল। চলে আসার সময় জিজ্ঞাসা করলাম ” কাল আমি আবার আসব। তোমার কিছু লাগবে ? আমায় বলতে পার। এখানে সবাই আমায় বন্ধু বলে ডাকে “। কে জানে, কথাটা শুনে মনে হল একটু ভরসা পেয়েছে এবার। বলল,” একটা আঁকার খাতা নিয়ে আসবে ? ” আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম, অন্তত একটা আঁকার খাতা দিয়ে ওর সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে।
পরদিন আঁকার খাতা ও পেনসিলের বিনিময়ে ওর জীবনের অনেক দুঃখ আমার সাথে ভাগ করে নিয়েছিল। তারপর মাত্র একদিন ই ছেলেটিকে আমি পাই। বাড়ির লোকেরা জামিন দিয়ে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু, যাবার আগে আশ্রমের দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে দিয়ে যায় তার হাতে আঁকা রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি।
সেদিন সকলে আমরা প্রার্থনা করেছিলাম-“ সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান, সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ। মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়”।।
আরো একটি গল্প বলার ইচ্ছা করছে। সেটি হল ১৯২০-২১ সালে রবীন্দ্রনা্থের ইউরোপ হয়ে আমেরিকা ভ্রমণ। সেবারও রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ছাত্র উইলিয়াম পিয়ারসন। তিনি অবশ্য তখন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক। আমেরিকা প্রবাসকালে খবরের কাগজের একটি বিজ্ঞাপন রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এক ব্যক্তি কাগজে আবেদন জানিয়েছেন, কারো যদি দুষ্টু বালকের সন্ধান জানা থাকে, তবে তারা যোগাযোগ করতে পারেন। দুষ্টু ছেলেদের জন্য ওই ভ্রদ্রলোক স্টার ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ কৌতুহল দমন করতে পারলেন না। পিয়ারসনকে বললেন, “ আমি ওই জায়গায় যেতে চাই। তুমি ব্যবস্থা কর।”
কয়েকদিনের মধ্যেই ডেট্রয়টের ওই ফাউন্ডেশন নোবেল বিজয়ী কবির সঙ্গে কথা বলতে রাজী হয়, কিন্তু মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য। হাড় জমানো শীত উপেক্ষা করে, বহু শ্রমের পর রবীন্দ্রনাথ পৌঁছালেন সেখানে। এ যেন পাহাড়ের সঙ্গে ঝর্ণার মিলন, বজ্রের সঙ্গে মেঘের! কতদিন ধরে যেন এই মিলনের অপেক্ষায় পরস্পর। রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath) যেন এ রকমই কিছু খুঁজছিলেন? অথবা তারাও!
আশ্রমের নিয়মরীতি ভেঙ্গে খড়ের গাঁদায়, রাতভর ফাউন্ডেশনের ছেলেদের সঙ্গে গল্পে আড্ডায় মশগুল হয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath)।
পরবর্তিকালে ঠিক ওই রকম কিছু না করতে পারলেও পিয়ারসন, সাঁওতাল পাড়ায় নৈশ বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন। যদিও মৃণালিনী দেবীর আনন্দপাঠশালাও তৈরি হয়েছে অনেক আগে।
আমরা যখন ছোটদের মনোজগতের বিকাশে নানা উপায় ভাবি। রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath) আমাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর। তাঁর সারাজীবনের কাব্য, সাহিত্য, সমাজভাবনা আগামী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ভিতকে মজবুত করেছে।
……… তরুণের দল ডাক দিল, চলো যাত্রা করি প্রেমের তীর্থে, শক্তির তীর্থে।
হাজার কণ্ঠের ধ্বনিনির্ঝরে ঘোষিত হল —
আমরা ইহলোক জয় করব এবং লোকান্তর।
উদ্দেশ্য সকলের কাছে স্পষ্ট নয়, কেবল আগ্রহে সকলে এক;
মৃত্যুবিপদকে তুচ্ছ করেছে সকলের সম্মিলিত সঞ্চলমান ইচ্ছার বেগ।
তারা আর পথ শুধায় না, তাদের মনে নেই সংশয়,
চরণে নেই ক্লান্তি।
মৃত অধিনেতার আত্মা তাদের অন্তরে বাহিরে —
সে যে মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং জীবনের সীমাকে করেছে অতিক্রম।
তারা সেই ক্ষেত্র দিয়ে চলেছে যেখানে বীজ বোনা হল,
সেই ভাণ্ডারের পাশ দিয়ে যেখানে শস্য হয়েছে সঞ্চিত,
সেই অনুর্বর ভূমির উপর দিয়ে
যেখানে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে বসে আছে প্রাণের কাঙাল;
তারা চলেছে প্রজাবহুল নগরের পথ দিয়ে,
চলেছে জনশূন্যতার মধ্যে দিয়ে
যেখানে বোবা অতীত তার ভাঙা কীর্তি কোলে নিয়ে নিস্তব্ধ;
চলেছে লক্ষ্মীছাড়াদের জীর্ণ বসতি বেয়ে।
প্রভাতের একটি রবিরশ্মি রুদ্ধদ্বারের নিম্নপ্রান্তে তির্যক্ হয়ে পড়েছে।
সম্মিলিত জনসংঘ আপন নাড়ীতে নাড়ীতে যেন শুনতে পেলে
সৃষ্টির সেই প্রথম পরমবাণী — মাতা, দ্বার খোলো।
দ্বার খুলে গেল।
মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু,
উষার কোলে যেন শুকতারা।
দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষাপরায়ণ সূর্যরশ্মি শিশুর মাথায় এসে পড়ল।
কবি দিলে আপন বীণার তারে ঝংকার, গান উঠল আকাশে
জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।
সকলে জানু পেতে বসল, রাজা এবং ভিক্ষু, সাধু এবং পাপী, জ্ঞানী এবং মূঢ়;
উচ্চস্বরে ঘোষণা করলে — জয় হোক মানুষের,
ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।।
প্রবীর ভট্টাচার্য্য (Prabir Bhattacharya)