করোনার ভয়াবহ তাণ্ডবেও বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা, জবরদখল চলছেই

ভয়ংকর করোনার আঘাতে বাংলাদেশ-সহ গোটা বিশ্ব যখন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ধুকছে, প্রতিদিনই মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তার মধ্যেও বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা, জমি জবরদখল, হিন্দু মেয়েদের জোরপূর্বক অপহরণ ও ধর্মান্তরিত করা, মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুর থেমে নেই। করোনায় লকডাউনে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও বিভিন্নস্থানে হিন্দুরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এই হামলা ও ত্রাণ বিতরণে বৈষম্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে স্মারকলিপিও পেশ করা হয়েছে। ঐক্য পরিষদ বলেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে হরিজন, জেলে, দলিত, রবিদাস, জনজাতি এবং করোনার কারণে। দুঃস্থ ও কর্মহীন সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে বৈষম্য করা হচ্ছে।

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে হিন্দুদের ওপর হামলা, হিন্দু মেয়েদের অপহরণ ও ধর্মান্তরিত করা, মন্দিরে হামলা ও ভাংচুর এবং জায়গাজমি জবরদখলের যেসব ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলো।

ভারতে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি

সাতক্ষীরায় ব্যবসায়ী সুবল চক্রবর্তীকে কলেমা পড়ে মুসলমান না হলে ভারতে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত তালা উপজেলার নগরঘাটায় কালিপদ চক্রবর্তীর ছেলে মুদি দোকানদার সুবল চক্রবর্তীকে গত ১৩ এপ্রিল সোমবার প্রকাশ্যে সবার সামনে মারধর করা হয় এবং কলেমা না পড়লে ভারতে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে দক্ষিণ নগরঘাটা গ্রামের আব্দুর রহিম সরদারের ছেলে দুধর্ষ সন্ত্রাসী মোস্তাক। সে হুমকি দিয়ে বলে, হয় কলেমা পড়ে মুসলমান হও তা না হলে ভারতে চলে যাও। এই ঘটনার পর এলাকার কয়েকশো হিন্দু পরিবারশঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগী সুবল চক্রবর্তী নগরঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান লিপুকে জানালেও তিনি কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার পাটকেলঘাটা থানায় তিনি একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।

বসতবাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হামলা

গত ২৪ এপ্রিল বাগেরহাটে একটি হিন্দু পরিবারকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করতে হামলা চালানো হয়েছে। ওইদিন সকালে মােংলা থানার অন্তর্গত চিলা ইউনিয়নের গোলেরডাঙ্গা গ্রামের অনিলা বালার পরিবারের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায় পার্শ্ববর্তী বাঁশতলা গ্রামের প্রভাবশালী সন্ত্রাসী-ভূমিদস্যু আবদুস ছালামের নেতৃত্বে একদল দুবৃত্ত। এতে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূসুমিতা বালা, অনিল বালা, মায়া বালা, সরলা গোলদার, শিশু পুটু গোলদার ও শংকর গোলদারসহ ৭ জন গুরুতর আহত হন। পরে এলাকাবাসী তাদের উদ্ধার করে স্থানীয়। হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। অন্তঃসত্বা গৃহবধূ সুমিতা বালা ও অনিল বালার অবস্থা গুরুতর বলে জানান কর্তব্যরত চিকিৎসক। এ ঘটনায় থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

শিব মন্দির দখল

জামালপুর জেলার মেলান্দহ থানার অন্তর্গত ঢালুয়াবারি গ্রামে গত ২৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সারাদেশে লকডাউনের সুযোগ নিয়ে মৃত সেকান্দর খাঁ-র পুত্র নুরুল ইসলাম খাঁ-র নেতৃত্বে একদল দুবৃত্ত একটি বহু পুরানো শিব মন্দির ভেঙ্গে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে দখল করে নিয়েছে পুরো দেবোত্তর সম্পত্তি।

মন্দিরে জুয়া খেলতে বাধা দেওয়ায় হামলা । জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর পৌর এলাকার পারঘাটী মন্দিরে জুয়া খেলতে বাধা দেওয়ায় গত ২০ এপ্রিল কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। এসময় দুবৃত্তরা বাড়িঘর ভাঙচুর ও লোকজনদের মারধর করে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে কয়েকজন মুসলমান যুবক ওই মন্দিরে জুয়া খেলছিল। এইসময় মন্দিরের পাশের বাড়ির হিন্দু লোকজন মন্দিরে জুয়া খেলা বন্ধ করতে বললে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও মারধর করে। এ ঘটনার পরপরই পুলিশ রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার কথা বললেও এখনো কেউ গ্রেফতার হয়নি। এ ঘটনায় হিন্দুরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।

শেষ পর্যন্ত অষ্টমীর আত্মহত্যা

রাজশাহীর মোহনপুর থানার অন্তর্গত ঘাসিগ্রামের নিমাই সরকারের মেয়ে নবম। শ্রেণীর ছাত্রী অষ্টমী সরকার শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে। ঘাসিগ্রাম স্কুলের সহকারী শিক্ষক শরিরত আলির সহায়তায় পাশের গ্রামের আফজাল হোসেনের ছেলে গোলাম ও তার সহযোগীরা দীর্ঘদিন ধরে অষ্টমীকে উত্যক্ত করে আসছিল। ফলে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত অতিষ্ট হয়ে গত ১৬ এপ্রিল অষ্টমী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ইতোপূর্বে গত বছর ১১ নভেম্বর প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় গোলাম মোস্তফা ও তার সহযোগীরা অষ্টমীকে অপহরণ করেছিল। খবর পেয়ে ওইদিনই পুলিশ অষ্টমীকে উদ্ধার ও অপহরণকারী গোলাম মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করে হাজতে পাঠায়। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও অষ্টমীকে উত্যক্ত করতে শুরু করে। শেষে আর সহ্য করতে পারেনি অষ্টমী, বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ।

জায়গাজমি দখল করতে হামলা

করোনার কারণে দেশজুড়ে লকডাউনের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের শুক্লদাস পাড়ায় গত ২১ এপ্রিল স্থানীয় প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে এলাকার সন্ত্রাসী মহাম্মদ রাশেদ, মহম্মদ আব্দুল্লাহ, জিয়া উদ্দিন, হাবিবুল্লাহ ও মুসা উদ্দিন-সহ সন্ত্রাসীরা ৩০টি হিন্দু পরিবারের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায় এবং তাদেরকে দেশত্যাগের হুমকি দেয়। হামলায় নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়েছে। গুরুতর অবস্থায় বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করে তাদের জায়গাজমি দখল করাই ছিল এই হামলার উদ্দেশ্য। এ ঘটনায় এলাকাজুড়ে শঙ্কা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।

ইসলাম অবমাননার গুজব রটিয়ে হামলা

ইসলাম নিয়ে ফেসবুকে বিরূপ মন্তব্য ও ধর্ম অবমাননার মিথ্যা গুজব রটিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার কালিগঞ্জ ইউনিয়নের সাতানী হাইল্লা গ্রামের পূর্ণচন্দ্র সরকারের ছেলে অনার্সের ছাত্র পরিতোষ কুমার সরকারের ওপর হামলা চালানো হয়। পরে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় স্থানীয় লোকজন। এ ঘটনায় এলাকায় হিন্দুদের মধ্যে ভয়ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।

দেশত্যাগে বাধ্য করতে হামলা

গত ১৭ এপ্রিল চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার ৯নং ইউনিয়নের নলুয়া গ্রামে শীতল সরকার ও তার ভাই হীরাপদ সরকারকে কয়েক দফা মারধর করে প্রতিবেশী মুন্সী বাড়ির সন্ত্রাসী ছেলে রাকিব হোসেন। শীতল ও হীরাপদ গুরুতর আহত হয়। তাদের চিৎকার শুনে এসে দ্রুত লোকজন ছুটে এসে তাদের স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান। দীর্ঘদিন যাবৎসন্ত্রাসী রাকিবের নেতৃত্বে রিপন, বক্কর, হাসান, মকবুল মাহবুব, মাসুমসহ ১০-১২ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এলাকার হিন্দুদের ওপর হামলা করছে, নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করতেই এভাবে হামলা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এলাকায় তীব্র ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।

গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টা

যশোর জেলার বেনাপোল পৌরসভার ছোটআঁচড়া গ্রামের রবীন সরকারের স্ত্রী রীতা সরকারকে গত ১৬ এপ্রিল রাতে শ্লীলতাহানি করে স্থানীয় আওয়ামি লিগ নেতা বাবু সর্দার। সে মৃত আকবর আলির ছেলে। রীতা প্রকৃতির ডাকে রাত ১২টার দিকে ঘরের বাইরে বাথরুমে গেলে পূর্ব থেকে ওত পেতে থাকা বাবু সর্দার তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এতে রীতা আহত হয়। বাবু সর্দারকে পুলিশ আটক করলেও স্থানীয় আওয়ামি লিগ নেতারা তার জামিনের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে আসামি গ্রামে ফিরে এসে রীতার পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে। আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে রীতার পরিবার।

হামলা চালিয়ে পুকুর দখল

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ৬নং রমজাননগর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ভেটখালী গ্রামের বীরন্দ্র কৃষ্ণ মণ্ডল ও তার স্ত্রী নীলিমা রাণী মণ্ডলকে গত ২৪ এপ্রিল সকালে একই গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সুন্নত আলি গাজি তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্য ইসমাইল হোসেন, রাজ গাজি, আজিম গাজি ব্যাপকভাবে মারধর করে তাদের বাড়ির পুকুর দখল করে নিয়েছে। এ সময় বীরেনবাবু ও তার স্ত্রী বাধা দিলে তাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। ও বাড়িঘর ভাঙচুর করে জেহাদিরা। বর্তমানে বীরেন্দ্র কুফ মণ্ডল শ্যামনগর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

জমি ও বাড়ি দখল

গত ১৩ এপ্রিল দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার নাসিরপুর গ্রামের হিন্দু পল্লীতে হামলা চালিয়ে সুধাংশু দাসের জমি ও বাড়ি জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী ইচ্ছামিয়া ও তার সহযোগীরা। এতে স্থানীয় হিন্দুরা তীব্র ক্ষোভ ও উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে।

হামলার মামলা নেয়নি পুলিশ

গত ১২ এপ্রিল ফরিদপুর সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের মল্লিক পুরের পালপাড়ায় সুরেশ পালের বাড়িতে এলাকার প্রভাবশালী সলেমান ব্যাপারীর নেতৃত্বে মিজান ব্যাপারী, মােঃ রানা ব্যাপারী, মােঃ হৃদয় ব্যাপারী ও মােঃ সুজায়েত-সহ একদল সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছে। এতে সুরেশ পাল, তার স্ত্রী সবিতা পাল, ছেলে সমীর পাল, তার ভাই জগদীশ পাল, তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সুস্মিতা পাল মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদেরকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। সন্ত্রাসী হামলার শিকার হিন্দু পরিবারটি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

জমি ও বাড়ি দখল করতে হামলা

কক্সবাজার পৌরসভা এলাকায় বিডিআর ক্যাম্প অধীন ৬নং ওয়ার্ডে দক্ষিণ সাত্বিতা পল্লী হিন্দু পাড়া সাহা গলি রোডে অবস্থিত গোপাল দাশের বাড়িতে সার্বজনীন শিব মন্দিরের জমি ও বসতবাড়ি দখলের উদ্দেশ্যে হামলা চালায় প্রতিবেশী প্রফেসর হোসেন ও তার ছোট ভাই লিয়াকত-সহ তাদের দলবল। এই সময় তারা মন্দিরের সামনে সীমানা খুঁটি দিয়ে দখল দাবি করে, শুধু তাই নয় গোপালবাবুকে হুমকিও দেওয়া হয়। বর্তমানে হিন্দু পরিবারটি আতঙ্কে দিন কাটচ্ছে।

জমি দখল করে ঘর তৈরি

পটুয়াখালী জেলার মহিপুর থানার অন্তর্গত সদর ইউনিয়নের পুরান মহিপুর গ্রামের নারায়ণ সরকারের ভোগদখলীয় ৩০ শতাংশ জমি গত ৪ এপ্রিল একই গ্রামের ভূমিদস্যু, সন্ত্রাসী রায়হান মীর, ফারুক মৃধা, কালাম চৌকিদার, জাহাঙ্গীর ও খলিল জোরপূর্বক দখল করে সেখানে ঘর তৈরি করেছে। বর্তমানে ভূমিদস্যু চক্রটি ওই পরিবারকে এলাকা ছাড়ার হুমকি দিচ্ছে।

ত্রাণ পেল না ঋষিপাড়ার মানুষ

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরনো সড়কের পাশে ফতুল্লায় নলখালি খালের উত্তর দিকে প্রায় দুই শতাধিক হিন্দু পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে ঋষিপাড়া। করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউনের কবলে পড়ে অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে ওই ঋষিপাড়ার মানুষগুলো। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারি কোনো মহলের লোকজনও তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেনা বলে অভিযোগ করেছে পরিবারগুলো। ওরা স্থানীয় চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান স্বপনসহ আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বাড়িতে ত্রাণের জন্যে গেলেও তারা আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন খালি হাতে।

গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো বাড়ি

গত ০৭ এপ্রিল দুপুরে বি এন পি নেতা মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে তার ভাই জাফর, ফিরোজ-সহ আরও ১০-১৫ জন সন্ত্রাসী ভূমিদস্যু দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলা চালিয়ে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার অন্তর্গত বাজার রাধানগর গ্রামের সুকান্ত চক্রবর্তীর পৈতৃক জমির উপর নির্মাণাধীন স্থাপনা সন্ত্রাসীরা হাতুড়ি, লোহার শাবল দিয়ে। ভাঙচুর করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। এ সময় সুকান্ত চক্রবর্তী-সহ পরিবারের অন্যরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের খুন করার হুমকি দেয় এবং আর কোনোদিন জমির কাছে এলে পরিবার-সহ ভারতে তাড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। সুকান্ত চক্রবর্তীর পৈতৃক শেষ সম্বল ৬০ শতাংশ জমির মধ্যে ১১ শতাংশ জমি ইতোপূর্বে জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছিল মিজানুর রহমান। বর্তমানে তার মালকানাধীন। অবশিষ্ট ৪৯ শতাংশ জমি জবরদখল করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে এই বিএনপি নেতা। মিজানুর রহমান মহম্মদপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের পাঁচ নম্বার ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। এই ঘটনায় হিন্দুদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

হামলা ও লুটপাট

বরিশাল জেলার আগৈলঝড়া থানার অন্তর্গত পশ্চিম সুজনকাঠি (মল্লিক বাড়ি) গ্রামের স্বর্গীয় রমেশ চন্দ্র করের স্ত্রী অঞ্জলি করের বাড়িতে গত ১৬ এপ্রিল এলাকার মােঃ হারুণমল্লিকের দুই ছেলে হাসান মল্লিক ও হাবিব মল্লিকের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী ধারালো অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়। ওরা অঞ্জলি কর, তার পুত্রবধু ঝর্ণা কর, পুত্র অমিয় কর ও প্রভাত করকে এলোপাথারি কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে ও ঘরের মূল্যবান জিনিষপত্র লুট করে। এসময় ঝর্ণা করকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যেতে চাইলে বাড়ির লোকজনের চিৎকারে এলাকার লোকজন এসে তাদের উদ্ধার করে। আহতদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই অবস্থায় ফের তাদের ওপর দুষ্কৃতীরা হামলা করতে পারে এই ভয়ে তারা আতঙ্কে রয়েছেন।

ইসলাম গ্রহণ করতে বলা হচ্ছে

সিলেটে হিন্দুদের ত্রাণ সহায়তা দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেছে ‘বাংলা এইড’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। করোনা ভাইরাস সংক্রামণের প্রেক্ষিতে সঙ্কটে পড়া শ্রীমঙ্গলের সদর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের ১০০ পরিবারের (৮০টি মুসলমান ও ২০টি হিন্দু পরিবার) মধ্যে গত ২২ এপ্রিল ত্রাণ বিতরণ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ত্রাণ বিতরণ করার সময় হিন্দু পরিবারগুলোর উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা বলেন, আমরা হিন্দুদেরও ত্রাণ দিচ্ছি। এখন আপনাদের ইসলাম গ্রহণ করতে বলছি। এ ঘটনা শোনার পর সারা দেশে হিন্দুরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

ধর্মান্তরিত করা হলো প্রতিমাকে

নীলফামারী জেলার ডিমলা থানার ধনেশ্বর। রায়ের কন্যা প্রতিমা রানি রায় গত ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টার দিকে মন্দিরে পূজা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মামুন ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, মাসুদ রানা, রাশেদইসলাম, মশিউর। রহমান জোরপূর্বক তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং পরে তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে। মুসলমানে ধর্মান্তরিত করে বিয়ের কাবিলনামা তৈরি করে। প্রতিমার নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় মোসাম্মত খাদিজা খাতুন।

বাড়ি ও দোকানে লুটপাট অগ্নিসংযোগ

বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার অন্তর্গত গণকপাড়া গ্রামের মৃত শিউলাল রবিদাসের ছেলে সুমল চন্দ্র রবিদাসের বসতবাড়ি ও তার সেলুন দোকান ঘরে গত ২৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যা তরিকুলের নেতৃত্বে ৫০/৬০ জনের সন্ত্রাসী বাহিনী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলা চালায়। ব্যাপক ভাঙচুর, মারধর ও লুটপাটের পর বাড়ি ও দোকানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে, তাদের মধ্যে সুমল রবিদাসের ছোট ভাইয়ের গর্ভবতী স্ত্রী গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। বর্তমানে পরিবারটি মানবেতর জীবন যাপন করছে। এদিকে তরিকুলরা সুমলকে দেশ ত্যাগের হুমকি দিচ্ছে। বলা হচ্ছে নইলে তাদের সবাইকে হত্যা করা হবে। এই ঘটনায় হিন্দুদের মধ্যে। তীব্র ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

দীঘি দখল করতে হামলা

পূর্বপুরুষের দীঘি দখলের উদ্দেশ্যে গত ২৭ এপ্রিল দুপুরে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত জিরাতলী ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের নরেন্দ্র মোক্তারের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে এলাকার সন্ত্রাসী মােঃ বাবুল ও তার দুই পুত্রের নেতৃত্বে ২৫-৩০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল। এই হামলায় প্রতীক পাল, উত্তম পাল ও চন্দন পাল গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন। এ ঘটনায় এলাকার হিন্দুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টিহয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে প্রচণ্ড ক্ষোভ।

প্রতিমা ভাঙচুর

গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপড়াহাটি ইউনিয়নের উত্তর মরুয়া (বকুলতলা) গ্রামে শ্রীশ্রী কালী মন্দিরে গত ২৪ এপ্রিল রাতে দুষ্কৃতীরা মন্দিরের তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে। ২৫ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর জেলার সদর থানারশাঁখারিপাড়ায় রক্ষাকালী মন্দিরেও দুটি প্রতিমা ভাঙা হয়েছে। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দুদের মধ্যে।

বাড়ি ও মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ

গত ১১ এপ্রিল বিকেলে ফরিদপুরে আলফাডাঙ্গা থানার অন্তর্গত টিটুরকান্দি গ্রামে হিন্দুদের ওপর হামলা চালিয়েছে প্রভাবশালী শাহিন শেখের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী। ওরা হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে ভাঙচুর ও লুটপাট কর, পরে অগ্নিসংযোগ করে। হামলায় অসিত কুমার সরকার, অন্তর বিশ্বাস, শ্রীমতি মঞ্জু সরকার, অরূপ বিশ্বাস, মনোজ বিশ্বাস, শম্ভ সরকার, গোপাল সরকার, স্বরূপ সরকার, মহাদেব বিশ্বাস ও বিধান বিশ্বাস গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। আহতরা বর্তমানে আলফাডাঙ্গা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। জানা গেছে, হামলাকারীরা অসিত কুমার সরকারের দোকানের ক্যাশ বাক্সে রক্ষিত একলক্ষ নগদ টাকা ও বিভিন্ন পরিবারের প্রায় দেড়লক্ষ টাকার আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যায়। এর আগে হামলাকারীরা অসিত সরকারের নিকট পাঁচ লক্ষ টাকা চাদা চেয়েছিল, তিনি না দিতে অস্বীকার করায় এই হামলা চালানো হয়। সন্ত্রাসীরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে মারধর করে। এ ঘটনায় গোটা এলাকার হিন্দুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। হামলাকারীদের মধ্যে ছিল মােঃ রাজীব চৌধুরী ওরফে বুলেট শেখ, রেফি শেখ ওরফে বোমরা।

হিন্দুদের দেশছাড়া করতে হামলা

হিন্দুদের দেশছাড়া করে তাদের জায়গাজমি দখলের উদ্দেশ্যে গত ৩০ মার্চ প্রকাশ্যে দিনের বেলায় বরিশাল জোর উজিরপুর উপজেলার মালিকান্দা গ্রামে হিন্দুপাড়ায় হামলা চালানো হয়েছে। ভূমিদস্যু মোহাম্মদ সেরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী পনির মিয়া, আনোয়ার হোসাইন, দেলোয়ার হোসেন, এয়ার হোসাইন, বাবু খান ও রেফাতুল্লা-সহ ৪০-৫০ জনের একটি দল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এই হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সবাইকে লাঠিপেটা করে, দা দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। আহতরা হলেন মৃণাল বিশ্বাস, ননী গোপাল বিশ্বাস, মৃন্ময় বিশ্বাস, পরিমল বিশ্বাস, সুনীল বিশ্বাস, লিপি বিশ্বাস, আরতি বিশ্বাস, অনিল বিশ্বাস ও কবিতা বিশ্বাস। আহতরা বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। বর্তমানে সন্ত্রাসীদের ভয়ে এলাকার বহু লোক গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র মানবেতর জীবনযাপন করছে।

ছাত্রী অপহরণ

গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ি থানার অন্তর্গত হিজলগাড়ি গ্রামের গোপাল চন্দ্র রায়ের মেয়ে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী অন্তরা রানি গত ০৪ এপ্রিল দুপুরে তার মাসির বাড়ি বগুড়ার ধুনট থেকে বাসে বাড়ি ফেরার পথে নুনিয়াগাড়ী নামক স্থানে স্থানীয় মোহাম্মদ আলীর সন্ত্রাসী ছেলে মোহাম্মদ লিখন সরকার তাকে জোরপূর্বক অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তাকে এ ব্যাপারে সহায়তা করে নূরজাহান বেগম, মোহাম্মদ শাহিন মিয়া, রেণু বেগম-সহ আরও কয়েকজন। সন্ত্রাসী লিখন সরকার মেয়েটিকে দীর্ঘদিন যাবৎ উত্ত্যক্ত করে আসছিল। অপহরণের ব্যাপারে স্থানীয় থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হলেও এখনও পর্যন্ত অপহৃত মেয়েটিকে উদ্ধার করা যায়নি। এ ঘটনায় এলাকার হিন্দুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জোরপূর্বক অপহরণ । গত ২২ এপ্রিল ঢাকার ডেমরা থানার বাঁশেরপুল সাধুর মাঠ এলাকার স্বপন চন্দ্র পালের ১৪ বছরের নাবালিকা মেয়ে দীপা রানি পালকে। জোরপূর্বক অপহরণকরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় স্থানীয় জামালের ছেলে শিফাত। অবশ্য প্রচণ্ড প্রতিবাদের মুখে শিফাত পরের দিন রাতে দীপাকে নিজ বাড়িতে ফেরত দিয়ে যায়। এ ঘটনায় এলাকার হিন্দুদের মধ্যে প্রচণ্ড উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।

মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুর

পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলার অন্তর্গত শান্তিপুর ইউনিয়নের জাফরাবাদ গ্রামে হরলাল চক্রবর্তীর বাড়ির শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ মন্দির ও শ্রীশ্রীকালী মন্দিরে গত ৮ এপ্রিল রাতে অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতীরা হামলা চালায়, প্রতিমা ভেঙে দেয়। এ ঘটনায় এলাকার হিন্দুদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

ঢাকা থেকে বিশেষ প্রতিনিধি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.