সাম্প্রতিক বছরগুলোতে,পাকিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব সিন্ধু প্রদেশের হিন্দু মেয়েদের জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা আদালত পর্যন্ত পৌঁচেছে। দেশটির বেশিরভাগ হিন্দুদের বাস দক্ষিণ-পূর্ব সিন্ধু প্রদেশে। ধর্মান্তরনগুলির প্রকৃতি, মামলার ধরনগুলি প্রায় অভিন্ন। ছোট ছোট নাবালক হিন্দু মেয়েদের লক্ষ্য করেই ঘটনাগুলি ঘটছে , প্রথমে জোর করে অপহরণ তারপর বিবাহ ও ধর্মান্তরন। আর তাই সেদেশের প্রায় ২০কোটি নাগরিকের মাত্র ২ শতাংস সংখ্যালঘু জনসংখ্যার গভীরে এক অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পরিসংখ্যানটি থেকে আতঙ্কপূর্ন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজনের ৭০ বছর পর কিছু হিন্দু পাকিস্তানে তাদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করছে।
অথচ,১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তানের মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্কাশ পায় সে সময় দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলী জিন্না বলেছিলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সেখানে থাকার এবং তাদের বিশ্বাস পালন করার স্বাধীনতা থাকতে হবে। কিন্তু আজ পাকিস্তান ইসলামিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত। চরমপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ন শক্তি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমাজে কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। প্রভাবশালী ইসলামী উপাসনালয়,মসজিদ এবং ধর্মীয় দলগুলি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার কাজ করে চলেছে। তাই কিছু হিন্দুরা তাদের গ্রাম ছেড়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে চলে যাচ্ছে কিংবা একেবারে পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসছে।
জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা বেশিরভাগই সিন্ধু প্রদেশ থেকে ঘটছে। যদিও দেশভাগের পর পাকিস্তান মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল আর মুসলমানরাই রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজে তাদের আধিপত্য বাড়িয়েছিল , হিন্দুরা সিন্ধু প্রদেশে কিছুটা সামাজিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল ও যেখানে তারা সফল ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত ছিল। সাম্প্রতিক পাওয়া আদমশুমারি অনুযায়ী, সিন্ধু প্রদেশের জনসংখ্যার ৬ শতাংশের বেশি হিন্দু।
কিন্তু সিন্ধু প্রদেশর নিম্ন-বর্ণ ও নিম্ন আয়ের হিন্দুরা বেশিরভাগই সমৃদ্ধ ভূমি মালিকদের কৃষিজমিগুলিতে কঠোর পরিশ্রম করে কখনো কখনো অর্থনৈতিক দাসত্বের শিকার হতে হয়। তাদের সামাজিক বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয় । একটি প্রতিবেদনে জানা যায় যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, এবং ধর্মীয় সম্মিলিত কারণগুলির জন্য পাকিস্তানের গ্রামীণ এলাকায় একটা সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যার ফলে জোরকরে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা ঘটছে।
হিন্দু সমাজ কর্মীরা এবং নিপিড়ীত পরিবারগুলি অভিযোগ করছে যে, অল্পবয়সী মেয়েদের অপহরণ, ইসলামে ধর্মান্তরিত করার সাথে সাথে মুসলিম পুরুষের সাথে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, , মুসলিম ধর্মীয় কর্মী এবং নেতারা ধর্মান্তরনের পক্ষ সমর্থন করে বলছে,কোনো একজনকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে আশীর্বাদ বা দোয়া অর্জনের উপায়।
এই ধর্মান্তরনগুলিতে প্রায়ই শক্তিশালী উপাসনালয়, মৌলবি, এবং ধর্মগুরুর পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সমর্থন থাকে। মৌলবি, এবং ধর্মগুরুরা দম্পতিদের রক্ষা করে বলে, মেয়েরা স্বেচ্ছায় চলে এসেছে এবং ধর্মান্তরিত হয়ে বিবাহ করেছে। এই বিষয়টি বিবাহ গুলি স্বাধীন ইচ্ছায় না হুমকি এবং হিংসার দ্বারা ঘটানো তা নির্ধারণ করতে আইনজীবী ও সমাজকর্মীদের একটি নুতন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছে।
জোরকরে ধর্মান্তরনের একটি ঘটনা ২০১২ সালে সেদেশের সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল। সেসময় তিন হিন্দু মেয়েকে জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করে মুসলিম পুরুষের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে একজন রিঙ্কল কুমারি নামে একটি মেয়ের ধর্মান্তরনে অনুষ্ঠানে তখনকার পাকিস্তান পিপলস পার্টির একজন আইন প্রণেতাও উপস্থিত ছিল।
অনেক মানুষ তাই মনে মনে ভাবছে তারা ধর্মান্তরিত হয়ে যাবে। হয়তো সরকারি চাকরি মিলবে উপহার হিসেবে। আবার কিছু জন এখনও আছে যারা ধর্মান্তরনের বিরুদ্ধ মুখ খুলছে। যদি তারাই একদিন দেশটা ছেড়ে দেয় তা হলে প্রতিবাদে অক্ষম বাকি সংখ্যালঘু হিন্দু দের কি হবে কেউ জানে না।
২০১২র ঘটনার পর বিভিন্ন স্তরের সমাজকর্মীরা সক্রিয় হতে শুরু করলে ২০১৬ সালে সিন্ধু প্রদেশের আইন পরিষদ ১৮ বছর বয়সের আগে ধর্মান্তরন কিংবা জোরপূর্বক ধর্মান্তরনকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে একটি বিল পাশ হয়। আইনটিকে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির কঠোর তাৎক্ষণিক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। যাদের মধ্যে ছিল জামায়াত-উদ-দাওয়ার মত সংগঠন। এটি ২০০৮ এর মুম্মাই হামলায় যুক্ত লস্কর-ই-তৈয়বা জঙ্গি সংগঠনের জনসংযোগের মুখ। কট্টরপন্থী দলগুলি বিরোধী আন্দোলনের জন্য একত্রিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সিন্ধু প্রদেশের গভর্নর আইন বিলটি বাতিল করে ছিল।
শুধুমাত্র অল্পবয়সী মেয়েদের নয় অনেক হিন্দু পরিবারকে বিশেষ করে নিম্ন-বর্ণের হিন্দু হিসাবে পরিচিতদের ব্যাপক ভাবে ধর্মান্তরনের লক্ষ্যবস্তু হিসাবে পরিনত করা হয়। অনেক মৌলবি এবং ধর্মগুরুরা নতুন মুসলমান ধর্মান্তরিতদের অর্থ এবং আবাসন প্রদান করে তাদের মনে ইসলাম গ্রহণকে একটি উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি হিসাবে এই বিশ্বাস জাগানোর চেষ্টা হচ্ছে।
ধর্মান্তরনে বাধ্যকরার বিষয়টি কখন এবং কেমন করে সংগঠিত আন্দোলন হয়ে উঠল তা স্পষ্ট না হলেও ১৯৭০ এবং ১৯৮০র দশকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনের সময় দেশকে ইসলামীকরণের প্রচেষ্টায় শরিয়া পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আইন হিসাবে প্রণয়নের চেষ্টা করার মাধ্যমে এই ধর্মান্তরনে বীজ বোনা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচিতে,হিন্দুদের ধর্মান্তরন ও অপহরণের গল্প নিয়মিতভাবে শোনা যায়। এখনো সেদেশে অনেক হিন্দু সর্বদা মন ভয় নিয়ে বাস করছে। তাদের পূর্বসূরীরা পাকিস্তানে বাস করতে পছন্দ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন , কিন্তু তখন যদি জানতেন যে উত্তরসূরীদের আজকের এমন পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হবে তা হলে হয়তো তাঁরা বিকল্পটি বাছতেন।